সেকালের কথা
সেকালের কথা
আধুনিক সমাজে প্রায়শই যে দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়, তার বিপরীতে একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকার গুরুত্ব তুলে ধরা জন্য একটা বই
পড়ছিলো আমার এক কলিগ। "দ্যা আর্ট অফ ন্যেবারিং" বইটি জে পাঠক এবং ডেভ রুনিয়ন-এর লেখা। এটি প্রতিবেশীদের সাথে প্রকৃত এবং শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার উপর আলোকপাত করেছেন তিনি। বইটিতে গসপেলের শিক্ষার আলোকে প্রতিবেশীদের ভালোবাসা এবং তাদের সাথে একটি প্রকৃত সংযোগ স্থাপনের পদ্ধতি শিখিয়েছেন।
আমার তখন ছোটবেলার কথা মনে পড়লো। যেমন রিনা দি। প্রতিদিন সকালে উঠে একটা বাটি হাতে বেড়িয়ে একদিন আমাদের বাড়ি, একদিন আপুদের বাড়ি, একদিন মামদের বাড়ি, মানে পালা করে সব বাড়িতে হাজির হতো। কোন দিন তেল, কোন দিন চিনি , কোনদিন দুধ চাইতো রোজ কিছু না কিছু ফুরিয়ে যেতো ওর। জিনিসটা নিয়ে ক্ষান্ত হতো না হাড়ি খবর নিতো। আবার অন্যের বাড়ির হাড়ির খবর রপ্তানিও করতো।
রিনা দিদির মতো প্রতিবেশি সকলের ছিলো সেকালে। আজ সময় বদলেছে। ফ্যাট হাইরাইজ সংস্কৃতিতে, আমাদের প্রতিবেশিদের নাম হয়তো জানি না। বিদেশী লেখক জে পাঠক তাঁর লেখায় কিছু প্রশ্ন রেখেছেন।আপনি প্রতিবেশীদের কথা ভাবলে আপনার মনে কী আসে?
হয়তো আপনি তাদের খুব একটা ভালো করে জানো না, অথবা, যদি আপনি সত্যি কথা বলতে পরেন, হয়তো আপনার রাস্তার ওপারের ব্যালকনিতে দাড়ানো মহিলাটিকে একটু অদ্ভুত মনে করেন। আমাদের অনেকের কাছেই, আমাদের দূরত্ব বজায় রাখার কারণ আমরা আমাদের নিজেদের কাজে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু ঈশ্বর কি সত্যিই আমাদের এভাবেই বাঁচতে চান?
বইটায় লেখা হচ্ছে "যীশুর অনুসারী হিসেবে, আমাদের ঈশ্বর এবং আমাদের প্রতিবেশী উভয়কেই ভালোবাসার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। বলা যতটা সহজ, করা ততটা সহজ নয় কারণ আমরা ভয়, সময়ের বাধা এবং অহংকার আমাদের অন্যদের সাথে বাধা । তাহলে আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষের সাথে গভীর সংযোগ গড়ে তুলতে পারি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, ঈশ্বরকে খুশি করতে পারি।"
আমাদের জীবন প্রতিবেশীদের গুরুত্ব অনেক ছিলো। যেমন আমরা খুব গরীব ছিলাম। দত্ত বাড়িরা ছিলো বড়ো লোক ওদের বাড়িটা পাঁচিল দিয়ে ঘরা ছিলো। ও বাড়িতে আমার সমবয়সী ছেলে ছিলো আপু। ওর জীবনে কত আনন্দ ছিলো। ওর জন্মদিন হতো। ওর অনেক বন্ধু আসতো। আমি যেতে পারতাম না।
আশু দাদু আমার কষ্ট বুঝতো। সে বলতো পৃথিবীতে পাঁচিল না থাকলে সবাই সুখী থাকবে। গরীব লোক বড় লোক থাকবে না। আমি স্বপ্ন দেখতাম দিন বদলের। আমি চাইতাম কেউ আমার প্রতিবেশী হবে না। সবাই হবে ঘরের লোক আপনজন।
না প্রতিবেশী দের মধ্যে আমি অনেক আপন জন পেয়েছি। প্রিয় মানুষ পেয়েছিলাম। কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি সেই ভালোবাসার আশ্রয়কে ছোট বেলা থেকে বন্ধু ছিলো আমাদের। খেলনা বাটি খেলা থেকে শুরু করে পিয়াড়া চুরি, সব সময় সাথী ছিলো আমার রিমি। হঠাৎ করে বড়ো হয়ে গেলো ও। প্রেম শুরু করলো ও পাড়ার বাপির সাথে।
আজ কানে এলো ওর ডিভোর্স হবে।
আমি গেছিলাম ওর বাড়ি। ও আমাকে ফিরিয়ে দিলো। ওর কাছে একটা জোর করে হাগ চাইলাম। হয়তো আপনি খারাপ ভাবছেন । আমাকে নানা আমি ওর খারাপ অবস্থার সুযোগ নিতে চাইনি।
আমি জানি ভাইফোঁটা পর থেকে ও খুব মানসিক অশান্তিতে আছে। আমি চেয়েছিলাম ও বোঝুক আমি এখনো শুধু ওকে ৎভালোবাসি।আমাকে কোথাও একটু অন্তত দশ মিনিট সময় দিক আমাকে । একটু আলোচনা করতে চাই। ওর মা অসুস্থ ওর সম্পর্কটা ভেঙে যাচ্ছে দেখে। আমি ওকে শুধু ভোগ করে পালিয়ে যাও মানুষ নয়। আমি ওর পাশে থাকতে চাই।
আপনি জানেন দুবাই জায়গাটা কেমন। আমি কাজ করি।ওখানে আমি ইচ্ছা করলে আমার সব চাহিদা পূরণ করতে পারি। কিন্তু আমি সত্যিই ওর পাশে থাকতে চাই। কারণ আমি জানি ওর মা ছাড়া কেউ ওর পাশে নেই। আমি জানি ও হয়তো ওর বংশের সম্মানের কথা ভেবে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। তাতে অসুবিধা নেই। আমি ওর থাকবো চিরকাল। কারণ মন সব সময় বলে আমি ওর এই অবস্থার জন্য দায়ী।
বাপির সাথে ওর প্রথম ব্রেক আপ হলো। সেইদিন ও আমার সাথে আবার অনেক দিন পর প্রান খুলে কথা বলেছিলো। প্রথম আমার সাথে সেক্স করেছিলো, সেই ওর চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়েছিলো আমার বুক। মানে ও হয়তো আমাকে আকড়ে ধরে নতুন একটা জীবন শুরু করতে চেয়েছিলে। আমি ওকে এড়িয়ে গেছিলাম সাত পাঁচ ভেবে।
বাপি ওকে বদনাম করে দিয়েছিলো। ওর দাদা হঠাৎ ওর বিয়ে ঠিক করে। ওর দাদা আমার বন্ধু ছিলো। আমি তখন আর ওদের সিদ্ধান্ত বিরোধীতা করতে সাহস পাই নি। কারণ আমার চাকরি ছিলো ছিলো না ওদের মতো বংশ মর্যাদা।তাই আজ কিছু ভাবতে চাই না, কোন বদনামকে ভয় করি না। আমি ওর পাশে থাকতে চাই। ওকে আশ্রয় করে নতুন করে বাঁচাতে চাই।
সেইদিন হয়তো আমরা চাই দিলিপ জ্যাঠুর সাহায্য পেতাম। ছোটবেলা থেকেই উনি বলতেন আমাদের পাশাপাশি নাকি খুব মানায়। লোকটাকে সব মানুষ খুব সন্মান করতো। একটু গম্ভীর মানুষ ছিলেন । বাংলাদেশের জমিদার ছিলো ওরা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল, বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর গণহত্যা হয়েছিল আপনারা জানেন।বিশেষ করে খুলনার চুকনগরে ২০ মে, ১৯৭১ তারিখে সংঘটিত চুকনগর গণহত্যা ছিল পৃথিবীর বর্বর গণহত্যাগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা অনেক বাঙালি হিন্দুকে হত্যা করে।
সেই সময় উনি ওনার পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসছিলেন। পথে সেনাদের হাতে ধরা পড়ে ওনারা। ওনার স্ত্রী ওদের নিরাপদে ভারতের আসতে দেওয়ার বদলে সেনা অফিসার সাথে রাত কাটাতে রাজী হন। ঐ রাস ভারী লোকটাকে রাতে বারান্দায় বসে কতদিন বাচ্চাদের মতো কাঁদতে দেখেছি। কিন্তু কাছে গিয়ে সান্তনা দিতে পারি নি। কারণ আমরা শুধু মাত্র প্রতিবেশী আপনজন না।

