সিনিয়র ভূত
সিনিয়র ভূত


এসি কলেজের বয়েজ হোস্টেল,আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।পুজোর ছুটির আগের ঘটনা ,তেমন পড়ার চাপ নেই তাই সবাই বাড়ি চলে গেছিল ।টিউশন ছুটি দেয়নি তখনও তাই আমি আর গণিত বিভাগের হরিদা তখনও হোস্টেলে।বেশি ছাত্র নেই তাই হোস্টেলের মিল ও চলছে না।সকালে উঠে দুজনে মিলে রান্না করে খাই,সকালের রান্নায় রাত অব্দি চলে যায়।
সেদিন হরিদার সন্ধ্যেবেলা টিউশন ছিল।অন্ধকার নামতে নামতে কেমন জানি লাগতে লাগল।আমি থাকতাম পনের নং রুমে আর হরিদা চোদ্দ নং রুমে।কেউ না থাকায় হোস্টেলটা ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছিল।দেওয়ালের ছোটো ছোটো ফাটলগুলোকে আরো বড় বড় মনে হচ্ছিল।পিন পয়েন্ট নীরবতা গোটা হোস্টেল জুড়ে ,বাথরুমের জল পড়ার শব্দও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তবু বাথরুমে গিয়ে বন্ধ করার সাহস হচ্ছিল না।ভাবছিলাম জোরে সাউন্ড দিয়ে টিভি চালালে অনেকটা ভালো লাগবে।টিভি দেখার রুমটা আমার রুম থেকে দুই রুম এগিয়ে গিয়ে সোজা উত্তরে।
আমাদের হোস্টেলটা কলেজ থেকে পঞ্চাশ ষাট মিটার ভিতরে হোস্টেলের একদিকে কয়েকটা কোয়ার্টার আর একদিকে বোটানিকাল গার্ডেনের জঙ্গল ছোটোবড়ো অনেক গাছ দিয়ে ভর্তি।
সেই উত্তর দিকে টিভি দেখার রুমে যাওয়ার করিডর থেকে পুবদিকে তাকালে একটা বুড়ো বটগাছকে দেখা যায়।তার পিছনে একশো মিটার দূরে মহাশশ্মান।রাত্রিবেলা মহাশশ্মানের তীব্র হলুদ লাল আলো বুড়ো বটগাছটার ঝুড়ির ফাঁক দিয়ে আসার ফলে আরো ভয়ংকর দেখায়।
মনে হয় যেন একটা প্রচন্ড বড় মুখ রেগেমেগে তাকিয়ে আছে,লাল আলোগুলোকে রক্তাভ চোখের মত লাগে,তাকাতেই ভয় হয়।তাছাড়া শুনেছি হোস্টেল এর আশেপাশের জায়গায় নাকি আগে মরা মানুষ এনে ফেলা হত আর কুকুর শেয়ালে সেগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত।এখনও কালীপুজোর রাত্রে নাকি তাদের আবির্ভাব হয়।
তাই কালীপুজোর রাত্রে কোয়ার্টারের লোকেরাও এখানে থাকে না।আশেপাশে নাকি সেদিন অস্ফুষ্ট গোঙানি আর চিৎকার শোনা যায়।কয়েকমাস আগেও একটা বাচ্চাকে বটগাছটার পাশে কবর দেওয়া হয়েছিল।আমি ওসব আজগুবি গল্প শুনতাম না,কিন্ত আজকে কেন জানি সেইসব গল্পগুলো বারবার মনে পড়ছে।
অস্বস্তি হচ্ছে মনে।অস্বস্তি কাটাতে দৌড়ে টিভির রুমে গেলাম পুবদিকে না তাকিয়ে।তারপর ফুল সাউন্ড দিয়ে আইপিএল এর হাইলাইটস দেখতে শুরু করলাম।এমন করে কতক্ষণ কেটেছে ঠিক জানি না ।মোবাইলে তাকিয়ে দেখলাম এগারোটা বাজে ।হরিদা কল করল
-ভাই একটা বন্ধুর এখানে আছি ,আজকে না গেলে কোনো সমস্যা হবে তোর সমস্যা হলে এখানে চলে আয়।
আমি বললাম না কিছু অসুবিধে হবে না।কলটা রেখে দিয়ে ভাবলাম কোনো ভুল করলাম নাতো। একা একা তো সময় কাটবে না।তার উপর রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজ পাচ্ছিলাম চারিদিকে। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিল অনেকেই ঘরের মধ্যে আসতে চাইছে ,জানালার কাছে তাকিয়ে দেখছে হয়ত। পিছনে তাকাতেও ভয় পাচ্ছিলাম।
আর এখানে থাকা যাবে না সাহস করে মুখ ঘোরাতেই দেখলাম শব্দগুলো সব বন্ধ হয়ে গেল।আর তেরো নং রুমে আলো জ্বলছিল , সেসময় কারো আসার কথা ছিল না ,তবে কে ? .তবে খুশি হলাম যে রাতটা গল্প করার জন্য কাউকে পাওয়া গেল।
রুমে গিয়ে দেখলাম একটা লম্বা মতো ছেলে মাথায় টুপি পড়া বিছানা সাজাচ্ছে ।তেরো নং রুমের লাইটটা খারাপ হয়ে গেছে তাই একটা কম পাওয়ারের লাইট লাগানো হয়েছিল,সেই আলোয় সব আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছিল।
আমাকে একবার দেখে ছেলেটা বলল কিরে ভাই -তোর নাম কি হিমাংশু?
-আমি বললাম হ্যাঁ তুমি চেনো আমাকে?
-না , এই রুমে যে ভাইটা থাকে ও বলছিল হোস্টেলে বোধহয় হিমাংশুদা আছে।
-আমি বললাম আচ্ছা।তোমার বাড়ি কোথায়? নাম কি তোমার?
আমার নাম সুরেশ দাশ বাড়ি ছিল ইসলামপুরে ,এখন অনেক দূরে থাকি।
তারপর জিজ্ঞেস করল
-হ্যাঁরে এখন গার্লস আর বয়েজ হোস্টেলের মধ্যে সম্পর্ক কেমন?
-আমি বললাম ঠিকঠাক দু তিনটে দাদা গার্লস হোস্টেলের মেয়ের সাথে প্রেম করে।
-তোদের ফ্রেশার্স এ মেয়েরা আসে?
-না , কি একটা ঘটনা হয়েছিল শুনেছিলাম গার্লস হোস্টেলে কে যেন ফাঁসি দিয়েছিল তারপর থেকে নাকি এদিকে আসতে দেয় না।
-ও আচ্ছা তারপর থেকেই।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুরেশদা তারপর বলল কেমন লাগে হোস্টেল?
আমি বললাম ভালো লাগে।একা ছিলাম ভয় ভয় লাগছিল এখন তুমি এসেছ সব ভয় কেটে গেছে ।ভাগ্যিস তুমি এসেছিলে না হলে রাতটা যে কিভাবে কাটাতাম।
-আচ্ছা অনেক রাত হল তুমি ঘুমোও তাহলে আমি আমার রুমে ঘুমাই।এই বলে যেই দরজাটা খুলেছি মনে হচ্ছিল একটা দমকা হাওয়ার সাথে একটা বড় কঙ্কালসার হাত যেন আমাকে বাইরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।চারিদিকে অট্টহাসি আর চাপা গোঙানির শব্দ।
হঠাৎ পিছন থেকে সুরেশদা একহাত দিয়ে টেনে আনল আমাকে। চোখগুলো যেন আগুনের গোলার মত ঘুরছে।আমি ভয় পেয়ে গেলাম ।তারপর সুরেশদা শান্ত হয়ে বলল
-আজকে আমার রুমেই থাক ,দুজনে গল্প করা যাবে।আমারও না করার সাহস হল না আর বাইরে বেরুনোর।তারপর কি কি গল্প করে রাত কাটিয়েছি মনে নেই।
সকাল হলে দেখলাম তেরো নং রুমের দরজা হা করে খোলা ।আর হরিদা বলছে হিমাংশু হিমাংশু ওঠ ভাই।
আমি চোখ কচাতে কচলাতে বললাম
-আচ্ছা এত সকালে চলে এলে যে বন্ধুর বাড়ি থেকে।
-তুই ঠিকঠাক আছিস তো ভাই?
-আমি বললাম হ্যা ঠিকঠাক এ তো আছি।এমন করছ কেন?
-কালকে রাতে কোনো কিছু দেখেছিস নাকি আত্মা টাত্মা?
- কই তেমন কিছু দেখি নি তো সুরেশদার সাথে গল্প করতে করতেই রাতটা কেটে গেল ।
-কোন সুরেশদা?
-ইসলামপুরের সুরেশদা একসময় থাকতো এখানে ,ইতিহাস নিয়ে পড়তো হয়ত।
-হরিদা চোখ বড় বড় করে বলল সুরেশদা কে জানিস?
-না
-গার্লস হোস্টেলে একটা মেয়ে ফাঁসি দেওয়ার পর এই তেরো নং রুমে একটা দাদা গলায় দড়ি দিয়েছিল,ওই দাদাটার নাম সুরেশদা।
-তারপর আমি হরিদাকে সুরেশদার সম্পর্কে যা যা জিজ্ঞেস করলাম তা ঠিকঠাক মিলে গেল আশ্চর্যভাবে।
হরিদা বলল আমি কালকে রাতে বন্ধুটার কাছে শুনলাম যে কালকের রাতটায় নাকি এখানে প্রেতাত্মার আবির্ভাব হয়।গোঙানি আর চিৎকার শোনা যায় একটা কালো কঙ্কালসার হাত নাকি টেনে নিতে আসে।তারপর অনেকের খোঁজ পাওয়া যায় না।
তাই ওই কালকের রাতে কেউ এখানে থাকে না।
আমি ভাবলাম হরিদাকে আর ভয় না দেখানোই ভালো ,না হলে কেউ হোস্টেলে থাকবে না।তারপরে সুরেশদাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম আমাকে বাঁচানোর জন্য।
দেওয়াল ঘড়িটার কাঁটায় সকাল সাতটার ঘন্টা বাজল ,দেখলাম নীল দেওয়ালটায় দাগ কাটা সুরেশ দাশ (২০০৩-২০০৬), ইতিহাস বিভাগ।