শুচিস্মিতা
শুচিস্মিতা
আমার দিকে নির্নিমেষ চক্ষে তাকিয়ে থাকল শুচিস্মিতা .বাইরে কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা তুমুল বৃষ্টি হয়ে গেছে,বৃষ্টিস্নাত পাইন -ফারের বনভূমিকে অপরূপ লাগছে. শনশন করে শরীরে শিহরণ জাগিয়ে বইছে মিস্ট্রাল . ওক পাতায় মর্মরধ্বনি গোটা পরিবেশকে রহস্যময় করে তুলেছে. আকাশের মেঘ কিছুটা সরে গেছে এবং তা দিয়ে উঁকি মারছে রুপোলী চন্দ্র. দূরে তুষারাবৃত পাহাড়শ্রেণীকে রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে .যেন কতো যুগ আগেকার রহস্য সঞ্চিত ভয়ে আছে সেখানে.
শুচিস্মিতা আমার প্রেম, আমার বুকের প্রতিটি হৃদস্পন্দন. ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়. এক দিন শীতের কুয়াশামাখা সকালে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ওর সাথে আমার আলাপ. আমি অবসর সময়ে নিশ্চিন্তে টিউলিপের শোভা উপভোগ করছিলাম আর ও পড়ছিলো 'wuthering heights ' বইটি .যাই হোক, নিজের ভালোবাসাকে প্রকাশ করতে আমি আর বিলম্ব করিনি. বসন্তের এক সোনালী বিকেলে চেরিগাছের ছায়াতলে বসে প্রপোজ করেছিলাম ওকে. ভালোবাসার উপহার হিসাবে ওকে দিয়েছিলাম একগুচ্ছ লাল টিউলিপ .
এভাবেই শুরু হলো আমাদের প্রেমকাহিনী. শুচিস্মিতার গায়ের রং ছিল আপেলের মতো টকটকে ফর্সা. রক্তিম চেরীফলের মতো রসালো দুই ঠোঁট ,অলকাপুরীর কোনো অপ্সরীর মতো কোমর অবধি লম্বা ঢেউ খেলানো চুল, হরিণীর ন্যায় দুচোখ কিছুটা কটা. চাঁদের মতো মুখমণ্ডলে শুভ্রধবল দুই পাটি দাঁত ,তাদের মধ্যে আবার একজোড়া গজদন্তও বিদ্যমান. শুচিস্মিতা যখন হাঁসে, তখন তার মুখমণ্ডলে চাঁদের চাঁদনী সৃষ্টি হয়. কতোবার যে আমি ওর রূপে মুগ্ধ হয়ে ঘরে আলতো চুম্বন করেছি, আর ও শিউরে উঠেছে. কতোবার যে ও লাজুক প্রজাপতির মতো আমার নাগাল থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছে, কিন্তু অবশেষে আমি লাভ করেছি ওকে. পূর্ণ হয়েছে আমার অভিলাষা .কতবার একসাথে পাহাড়ি নদীতে বোটিং করতে গিয়ে ওর ওষ্ঠ আমার অধরকে চুম্বন করেছে. ইউনিভার্সিটি পরার সময়ই আমাদের শারীরিক সম্পর্ক হয়.
যাই হোক, আমরা এখন ঘন অরণ্যের মধ্যে বসে আছি. এখানে না কাজ করে জিপিএস ,না আসে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক. দূরে বহুদূরে আল্পসের শ্রুভ্রধবল শৃঙ্গেরা যুগ যুগান্তরের রহস্যময়তার সাক্ষ্য বহন করছে. হু হু করে জানালা দিয়ে ঢুকছে হিমশীতল হাওয়া ,তাই শুচিস্মিতাকে বললাম জানালাটা বন্ধ করে দিতে. এখন এই ঝড়জলের রাতে ফায়ারপ্লেসের আগুনই আমাদের সম্বল .এটাই যোগাবে আমাদের আলো, এর আঁচ শরীরকে দেবে উষ্ণতা, শীতের হিমশীতল নড়াতে যোগাবে আরাম, দেবে মনপ্রাণকে স্বস্তি.
আমার মাথায় যে কি উদ্ভট খেয়াল চাপলো, ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই শুচিস্মিতাকে নিয়ে সুন্দরী ইংল্যান্ডকে ছেড়ে এই ইউরোপের এই নামগোত্রহীন পাহাড় জঙ্গলে ঘুরতে এলাম, আর এসেই দুর্যোগের মুখে পড়লাম. দূর বহুদূরে পাহাড়ের দিক থেকে একপাল নেকড়ে ডেকে উঠলো. আবার ডেকে উঠল নেকড়ের পাল, কিন্তু এবার একটু কাছে. জানি আজ রাত পূর্ণিমা, আজ রাত প্রেমের রাত, আজ রাত শরীরী কামনার রাত, আর এই রাত নেকড়ে মানুষের রাত, যাদের werewolf বলা হয়. ফ্রান্সের এই অঞ্চলে ওয়ারউল্ফ নিয়ে অনেক লোককথা প্রচলিত আছে, হয়তো তাদের কিছু সত্য. যা রটে তা কিছুটা ঘটে. আজকের রাতে চাঁদের মায়াবী আলোয় হয়তো ঘটবে কোনো অপূর্ব সুন্দর যুবক বা উদ্ভিন্নযৌবনা সুন্দরীর রূপের পরিবর্তন, ভদ্র কেটদষ্ট কোনো মানুষ রূপান্তরিত হবে হিংস্র নেকড়েতে এবং সেই পিশাচের হাতে নির্মম মৃত্যু ঘটবে নিরীহ কিছু গ্রামবাসীর. এভাবেই আজ নিজের ক্ষুদা মেটাবে নরপিশাচ!
কিন্তু, আমাদেরও তো কিছু খেতে হবে. সকালে জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে শটগান দুটো ফাউল মেরেছি. ফায়ারপ্লেসের আগুনে পুড়িয়ে খেতে বেশ লাগবে. তারপর রাতে হালকা বিয়ার আর তারপর একসাথে শুয়ে সুচিস্মিতার সাথে শরীরী চাহিদায় মেতে ওঠা তো আছেই. না, বাইরে ওয়ারউল্ফ তার শিকার খুঁজুক ,আমরা নিশ্চিন্তে আরামে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবো.দারুন কাটবে শীতের রাত, শুচিস্মিতা আর বিয়ারে ককটেল ভালোই জমবে একসাথে.
কিন্তু কিছুদিন থেকে শুচিস্মিতার আচরণ একটু অন্যরকম লাগছে, হতে পারে আমার মনের ভুল. হ্যাঁ, এখানে আসার পরেই এইরকম হয়েছে. কোনো অজানা কারণে এই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল আমার প্রেমাস্পদাকে স্নিগ্ধশান্ত তরুণী থেকে রাগি আর খিটখিটে করে তুলেছে. একটু জংলীও হয়ে গেছে, রক্ত আর কাঁচা মাংসের প্রতি অদ্ভুত একটা টান দেখছি ওর মধ্যে. যেবার আমার বারণ করা সত্ত্বেও ও জঙ্গলের মধ্যে এক ঘুরতে গিয়েছিলো, হ্যাঁ ঠিকসেবার থেকেই এরকমটা হচ্ছে.
কিন্তু ও যতোই জংলি হচ্ছে ,ওর মধ্যে যৌবনের চঞ্চলতা আর প্রাণশক্তি যেন দিন দিন বাড়ছে। দিন দিন আরোও বেশি মোহময়ী হয়ে উঠছে। ওর চোখের দৃষ্টির একঝলক যেকোনো পুরুষের হৃদয়কে বিদ্ধ করে তাকে সিডিউসড করার জন্য যথেষ্ট। ওর প্রতিটি চালচলন আর অঙ্গভঙ্গি এখন আমাকে আকর্ষিত করে।
ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে জানালা দিয়ে। বাইরে শুরু হয়েছে তুষারপাত।
যাই হোক,সিলভার বুলেট ভরা একটা বন্দুক জোগাড় করেছি। ওয়্যারউল্ফ যদি আজ ঝড়জলের নিশুতি রাতে হানা দেয় ,তাহলে ওটা দিয়েই পিশাচটাকে নিকেশ করব।
কিন্তু, শুচিস্মিতা দিন দিন সন্দেহজনক আচরণ করছে।ইদানীং দেখছি ওর মানুষের রক্তের প্রতি প্রবল আসক্তি। কেমন যেন বোঁটকা গন্ধ সারা শরীরে। আমারই হয়তো মনের ভুল।
রাতের মাংস আর তারপরের পরপর তিন পেগ বিয়ার আজ আমায় মাতাল করে তুলেছে।শুচিস্মিতাকে নীল হাউসকোটে ডানাকাটা পরী বলে মনে হচ্ছে. আজ ও এইরকম করছে কেন! দরদর করে ঘামছে, তীব্র কামনায় দুই চোখ জ্বলছে।হাউসকোট টা খুলে ফেললো শুচিস্মিতা. না, নিচে কিছুই পরে নি। আমার চোখের সামনে ওর তীব্র মন মাতাল করা সুডৌল শরীরের সৌন্দর্য।না, আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না আমি .।ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম শুচিকে গভীর আলিঙ্গনে।নিভিয়ে দিলাম ফায়ারপ্লেসের আগুন।কিন্তু না, শুচি নয়. অনুভব করলাম আমার নিরাবরণ শরীরকে খামচে ধরেছে এক পশু তার ধারালো নখর দিয়ে. অনুভব করলাম এক দুর্গন্ধ আর সেই পশুর উষ্ণ শ্বাস।অনুভব করলাম আমার মৃত্যুকে!