শিক্ষা
শিক্ষা
মিস্টার হাজরা, মেয়ে আপনার পড়াশোনায় খারাপ নয় সে কথাটা সকলেই স্বীকার করবো, কিন্তু তার দুষ্টুমি অনেক ক্ষেত্রেই সহনসীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। ক্লাসটিচার থেকে শুরু করে যে কোনো শিক্ষক শিক্ষিকা যাকে ইচ্ছা আপনি জিজ্ঞাসা করুন, তিনিই বলবেন – হ্যাঁ, আপনার মেয়ে পড়াশোনায় ভালো হলেও অত্যন্ত দুষ্টু এবং অবাধ্য।
বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের স্কুলে শুধু পড়াশোনা নয়, ম্যানার্সটাও দেখা হয়। আর আপনার মেয়ে সেই বিষয়ে কখনোই পাস করার যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমাদের এই স্কুলে তাকে আর রাখা...
দয়া করে ওকে টিসি দেবেন না স্যার, আমি কথা দিচ্ছি, ওকে বাড়িতে গিয়ে ভালো করে বোঝাবো। ও নিশ্চয়ই ওর বিরুদ্ধে আর এমন অভিযোগ করার সুযোগ দেবে না।
বেশ, কিন্তু এটাই ওর লাস্ট ওয়ার্নিং।
রাস্তায় আসার পথে বারবার এটাই ভাবছিলাম, বাড়ি গিয়ে আস্ত একটা বেত পিঠে ভাঙবো সোম-এর। পুঁথিগত বিদ্যায় বিদ্বান হয়ে কি লাভ যদি ম্যানার্সটুকুও না জানে? আজ ওকে...
হ্যা গো, সোম কোথায়?
ওমা, তুমি তো তাকে আনতেই গিয়েছিলে তার স্কুলে, আর আমাকে জিজ্ঞেস করছো সে কোথায়? তুমি ওকে জ্যাকেট কিনতে নিয়ে যাওনি?
ও হো, তাইতো! আমি তো স্কুলে সোমকে আনতেই গিয়েছিলাম। ওকে প্রবীরের দোকানে বসিয়ে গার্জেন কল অ্যাটেণ্ড করতে গিয়ে সব ভুলে গেছি স্যারেদের কমপ্লেনের চোটে। ইস্, মেয়েটাকে দু’বছর পর আজ একটা জ্যাকেট কিনে দেবো বলেছিলাম, আর সেটাই...
তখনই দৌড়ালাম প্রবীরের দোকানে। দেখি – ক্যাশ কাউন্টারের পাশে বসে আবোল তাবোল পড়ে শোনাচ্ছে সে প্রবীর আর ওর কর্মচারী মুকুলকে। তারা শুনতে শুনতে হাসছে আর পড়তে পড়তে সেও খুব হাসছে।
আমি তাকে কিনে দেবো বলে জ্যাকেট দেখাতে বলতেই, সোম আমাকে ঝুঁকিয়ে কানে কানে বলল – বাবা, তোমার কাছে কত টাকা আছে মানে আমাকে কত টাকা দামের জ্যাকেট কিনে দেবে?
আমি তার প্রশ্নের জবাবে কি বলা ঠিক হবে বুঝতে না পেরে বললাম – তোর কত টাকা দামের জ্যাকেট কেনার ইচ্ছে? আমি হাজার তিনেক মতো এনেছি, বেশি লাগলেও অসুবিধা নেই। তুই নে, আমি প্রবীরকে পরে দিয়ে যাবো।
তিন হাজারেই হয়ে যাবে বাবা। কিন্তু আমি জ্যাকেট নেবো না। তার চেয়ে তুমি দু’টো সোয়েটার কিনে দাও।
দু’টো সোয়েটার কি হবে? তাছাড়া তুই তো জ্যাকেট নিবি বলেছিলি!
জ্যাকেট তো মণি আর তুয়াকে পরতে দেখে কিনতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু, জানো বাবা, আমাদের কেজির স্কুলে রিকশা করে নিয়ে যেতো যে আঙ্কেল, করোনায় মারা গেছে। ওনার মেয়ে ঝুমা তো আমাদেরই কেভি তে পড়ে। ওদের আর ঝুপড়িতেও ঢুকতে দেয়নি তারপর, জানো? ঝুমার একটাও শীতের জামা নেই! সেদিন দেখি এই শীতে ফুটপাথের ধারে বসে কাঁপছে আর কাঁদছে। স্কুলেও তো আসে না এখন। এই দু’টোর একটা সোয়েটার ওকে দিয়ে দেবো। তুমি ওকে বলো না বাবা আবার স্কুলে আসতে?
বলবো, ঝুমা আবার নিশ্চয়ই স্কুলে যাবে। তুই আগে সোয়েটার দু’টো পছন্দ কর।
সোমকে আর মারধর করা বা বকাবকি করা হলো না আমার। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে যে মানবিকতা দেখালো সে তারপর আর তাকে ম্যানার্স শেখাতে ইচ্ছে করলো না আমার। বাড়িতে এসে তাকে বললাম – মা, সব থেকে খুশি বাবা মায়ের কখন হয় জানিস? যখন সন্তানের পরিচয়ে লোকে তাদের চেনে, আর চিনতে পারার জন্য তারা গর্ব করে সেই সন্তানের নাম নেয়।
আমার অনেক আনন্দ হবে জেনে যে তুই একজন বিদূষী হয়েছিস। কিন্তু তার থেকেও আনন্দ হবে দেখে যে একজন মানুষ হিসেবে লোকে গর্ব করে তোর নাম নিচ্ছে।