স্বপ্নাদেশ
স্বপ্নাদেশ
ঘুমোতে যাওয়া একটা বিভীষিকা। সেই এক স্বপ্ন ,সেই এক কান্না ,সেই এক হতাশা। তারপর দুঃসহ পেটের যন্ত্রনা নিয়ে ঘুম ভাঙ্গা। সারাটা দিন আচ্ছন্ন ভাব -ঘুমের অভাব ,চিন্তা -মনটাও কেমন খিটখিটে। মনে হতো আমি আর আমার হাসি -মজা -আনন্দ পৃথিবীর দুই প্রান্তে।
অথচ স্বপ্নটা খুবই সাধারণ -কোনো ভূতপ্রেত নেই ,অন্য জগতের শিংওলা মানুষ নেই। বাঘ ভাল্লুক তাড়াও করছে না। অন্ধকারে সাপের গর্তেও পড়িনি।
দেখছি একটা দেয়াল ,ইঁটের নয় ,ছাদ থেকে মেঝে মোটা মোটা শিক দেওয়া। শিকগুলো সোজা নয় -কেমন জানি লম্বা লম্বা চওমিনের মতো ,গুটিয়ে গুটিয়ে এদিক সেদিক। গরাদগুলো মরা নয় -তাদের প্রতিটার একটা নাচের ছন্দ আছে।
গরাদের একদিকে আমি আর অন্যদিকে দুটো ছোটো মেয়ে। একেবারে অল্প বয়েস -বেশ ফর্সা ,পরনে ফিনফিনে চাদর একটু হলদে একটু গোলাপি রঙের।
আমার বুক ফেটে যাচ্ছে ওই দুটো মেয়ের চোখের চাউনিতে। ওদের হাত দুটো গরাদের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে ছড়ানো। ভাষা নেই -কিন্তু আমি ওদের চোখে দেখছি এক আকুতি : আমাদের এই অন্ধকুপ থেকে বাঁচাও।
আমার কোনো শক্তি নেই ,বলতেও পারছিনা। একটা অব্যক্ত ব্যাথা নাভীর নীচ থেকে গলা অব্দি উঠে আসছে।
মাস তিন আগে থেকে এই স্বপ্ন আর ব্যাথা শুরু। দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
আজ সকালে প্রথম দেখলাম আমার বিছানার পাশে মা আর বাবা ;উৎকন্ঠায় ভরা চোখ -মুখ। আমার সমস্ত শরীর ঘামে ভেজা।
'স্বপ্ন দেখেছিস ? এমন করে গোঙানি ? কী হয়েছে খোকা। বল আমাদের। '
মায়ের হাতটা কত ঠান্ডা ;কষ্টটা অনেক কমলো।
কিন্তু কি বলবো ? দুটো ছোট্ট মেয়ে দেখে ভয় পেয়েছি ? না কি ওদের ভাষাহীন চোখের আর্তনাদে কষ্ট পেয়েছি ? আমার কোনো উত্তর নেই।
ডাক্তারকাকা আসলেন দুপুর নাগাদ চেম্বারের কাজ শেষে। আমি তখন অমিতে ফিরে এসেছি। খেয়েছি,পড়েছি ,খেলা করেছি।
ডাক্তারকাকা শুয়ে পড়তে বললেন। চোখ -নাক -কান পরীক্ষা করলেন টর্চের আলোতে। তারপর স্টেথো দিয়ে বুক -পিঠ দেখলেন ,জোরে জোরে নিঃশাস নিতে বললেন। তারপর এক তেল পেটের ওপর রেখে অন্য হাত দিয়ে চাপড় মারলেন। সব পেট চেপে চেপে দেখলেন। মুখটা গম্ভীর ,একটু চিন্তিত স্বরে বললেন ,'সে রকম তো কিছু দেখছি না। ভয়ের কিছু নেই। '
পাশের ঘরে গিয়ে বাবা -মা -ডাক্তারকাকা পরামর্শ করলেন।সন্ধ্যেবেলা মা দুটো কালো ট্যাবলেট অনেকখানি জালের সঙ্গে খাওয়ালো। মুখটা থমথমে। মায়ের মুখ দেখে আমার একটু ভয় লাগছিলো ,লক্ষ্মীছেলের মতো ওষুধটা খেয়ে ফেললাম।জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না এটা কিসের ওষুধ। তারপর রাত্রে খাবার পরে মা আবার ওষুধ দিলো।একটা কাপে অনেক চামচ ,কি অসম্ভব মিষ্টি ! রসগোল্লার রস জ্বাল দেয়া ঘন একটা সিরাপ।
বহুদিন বাদে স্বপ্ন দেখে ভয় না পেয়ে ঘুমোলাম ওষুধের গুণে। তবু স্বপ্নটা ছিল ,গরাদ দেয়া দেয়াল দেখলাম ,কিন্তু মেয়ে দুটো হাত বাড়িয়ে নেই ,মনে হচ্ছিলো গরাদের পেছনে ওরা দুজনে লুকোচুরি খেলছে।
ওষুধের গুনেই বোধহয় সকাল হতে না হতেই বাথরুম দৌড়োতে হোলো। পেট ভালো করে পরিষ্কার হলো। তারপর দেখি এ কী ? একটা সাদা -হলুদ -লালচে সাপ বেড়োচ্ছে। টেনে বার করলাম ,প্রায় ফুটখানেক লম্বা একটা কেঁচো।
আমার ভয়ের চিৎকারে মা ছুটে এলো ,দেখালাম কেঁচোটাকে। মায়ের চিন্তিত মুখখানা জ্বলজ্বল করে উঠলো। কি উৎসাহ ! বাবাকে ডাকলো।ডাকাডাকিতে বাসন মাঝা ছেড়ে দৌড়ে এলো চপলাপিসি। চপলাপিসি বহুদিন আমাদের বাড়ীতে কাজ করে। চার পুত্র -কন্যা -অকর্মন্য স্বামী নিয়ে সংসার চালায় একলা। বাহুগুণসম্পন্না ,দশভুজা। বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে রায় দিলো : 'আরও একটা আছে ,এরা সব সময়ে জোড়ায় থাকে। '
হট্টগোলের মধ্যে একটা নাম বার বার সবাই বলছিলো -ফিতে কৃমি ।
সেদিন রাতে আর পরদিন সকালে Same Input ,Same Output .
খারাপ স্বপ্ন আর কখনও দেখিনি।