সত্যের বস্তুরূপ
সত্যের বস্তুরূপ


মানুষ চলছেনা উড়ছে, প্রযুক্তি ওড়াচ্ছে। মানুষ মরছেনা, প্রযুক্তি বাঁচাচ্ছে। মানুষ ভাবছে না, প্রযুক্তি ভাবছে।
আমার জীবনটাকে প্রযুক্তি যুক্তি কোরে যুক্ত করেই চলেছে কার সঙ্গে? শুধুই ঝঞ্ঝাটের সঙ্গে।
খাবারের কথাটাই ভাবো। আলু-পোড়া, বেগুন-পোড়া পাবে কোথাও? কাঠের পোড়া গন্ধ -মাখা ঘন দুধ নেই আর এ ভবে, প্রযুক্তি নিয়েছে কেড়ে। কাঠ -ঘুটে-কয়লা ছেড়ে এলো গ্যাস, তারপর মাইক্রো-ওভেন, ইনডাকশন কুকার; জন্ম নিচ্ছে লেজার কুকার।তুমি বলবে পিছিয়ে পড়ার দল পোড়ার স্বাদ খোঁজে। আমার একটা প্রশ্ন আছে - ১০০ বছরের পুরোনো হুইস্কি খেয়ে আল্হাদে গদ গদ হোচ্ছ কেন? কী aroma আহা রে ! ওডিকোলন কিংবা ইভিনিং-ইন -প্যারিস মিলিয়ে সুন্দর গন্ধ ওয়ালা পানীয় খেলেই পারো ? মায়ের গায়ের গন্ধ -মাখা খাবার নেই, আছে প্যাকেট -ভর্তি, প্লাসিক মোড়া ট্রে খোপ ভরা নানা পদ। খাচ্ছো কলকাতায় না কামাসকাটকায় কোনো ভেদ নেই, এক রং, একই স্বাদ। মায়ের স্থানে প্রযুক্তি।
অন্যদিকে বস্ত্র দেখো, নেই প্রযুক্তির আক্রমণ। এখনও সেলাই করতে হচ্ছে। প্যান্টের সাইজটা বদলে বদলে ঘুরে ফিরিছে আপন আলয়ে। শাড়ি গুলো ছোটো থেকে বড় হচ্ছে, আবার ছোট হচ্ছে। ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু যাচ্ছে না। অলংকারগুলো এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে মানুষ নিরালঙ্কার হয় নি। মানুষ চিন্তা করেই যাচ্ছে নতুন আকারের, নতুন রঙের।
বিরহ কবিতা কেউ লেখেনা। হাতের মুঠোয় প্রেয়সীকে এনে দিয়েছে প্রযুক্তি। দূরত্ব গেছে ঘুছে। প্রেমের গান আস্তে আস্তে বাজার ছাড়ছে -সবাই সবাইকে গান শোনাচ্ছে।
কর্মক্লান্ত কপালের ঘাম আর প্রেয়সীর মিষ্টি হাতের পরশে মুছে যাবেনা, প্রযুক্তি দিয়েছে ঘাম -দূরীকরণ মৃদু বাতাস।
যখন আর খাবার -থাকবার -চলবার ভাবনা নেই তখন প্রযুক্তি সামনে আনছে নিত্যনূতন বিভীষিকা। পৃথিবীটা ঢাকা এক ওজন ওয়ালা ঢাকনায়। সেই ঢাকনায় ফুটো হয়েছে প্রযুক্তি খবর দিলো আর দুনিয়া ভর ত্রাহিমাম। হাত -পা মিলিয়ে কুড়িটা আঙুলে কুড়ি রঙের পাথর, প্রযুক্তির ধাক্কায় পাথরের ব্যবসায়ে রমরমা। পৃথিবী মঞ্চে প্রবিশিছে নব কার্তিক -গণেশ - লখ্খী -সরস্বতী, সকলের একই বাণী: Follow Me: আমিই বাঁচাতে পারি তোমাকে। এক এক দেবতার এক এক অস্ত্র -ডলার, সনাতন -তত্ব, পুলিশ, এটম বোমা, যে যেমন চাইবে বাজারে পাবে রেডি মেড মুক্তিদাতা।
প্রযুক্তি আঁকা কোষে মেপেজুপে জানাচ্ছে মেরুপ্রদেশের বরফ গলার ইতিকথা - আর তো কটা বছর মহাপ্লাবনের Repeat performance দেখার। টিকিট কাটছে সবাই হিমালয়ের ওপর ওঠার, মহাপ্রস্থানের উদ্দেশ্যে। ভাত জুটবেনা, মাছ পাবে; শাকাহারীর সংখ্যা ধপাধপ কমছে, মাছের দাম বাড়ছে। নতুন নতুন মৎস্য -মল দিকে দিকে তৈরী হচ্ছে। জলের মধ্যে তেল পাবে কোথা? সূর্যের আলোই ভরসা -প্রযুক্তি রাস্তা দেখাচ্ছে দিনের আলোকে কেমন করে বাঁধলে সে দেবে রাতের লন্ঠন।
শরীরের অংশগুলো খারাপ হচ্ছে তাতে কী। Spare parts বাজারে এসেছে-একটু দেখে কিনতে হবে নইলে দু নম্বরি মাল পাবে। মালাই চাকি বদলে ফ্যাল-নকল হইতে সাবধান, নইলে পুরো পায়ের রিপ্লেসমেন্ট কিনতে হবে।
টাকা পয়সা বাজার থেকে কমছে, সোনা-হিরে -প্ল্যাটিনাম বাড়ছে। মেশিনে বোতাম টেপো আর পুঁই শাক কিনে ফ্যাল। খবর চাই,আগে তো ঠিক করো কি রঙের খবর চাই তোমার -হাজার sample পাবে একই খবরের। ভোট দিতে বাসনা ? দাবাও বোতাম তোমার পছন্দে। তোমার কাজ শেষ, জানতে চেয়োনা তোমার ভোট তোমার পছন্দ জায়গায় পৌঁছেছে কি না। প্রযুক্তিতে বিশ্বাস নেই ? তবে কেমন নাগরিক? অন্য দেশে কেটে পড়ো।
বুড়ো হচ্ছ। আত্মীয় পরিজনের কাছে থাকতে চাও; প্রযুক্তি তোমাকে সাহায্য করছে -তোমার শেষ শয্যার চারদিকে লাগাও টি ভি পর্দ -নিশ্চিন্তিতে মরো জেক চাই তাকে দেখতে দেখতে।
একবার ভাবো নিজের মনে: ধীরে ধীরে প্রযুক্তির কেনা গোলাম হয়ে যাচ্ছ না তো? অশোকের সাম্রাজ্য, মোগল সাম্রাজ্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আর আখ এসে যাচ্ছে প্রযুক্তি সাম্রাজ্য। আমরা সবাই রাজা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে? খুব আরামে আছো প্রযুক্তির দোলনায় ,ঘুমিয়ে কাটাচ্ছ দিন আর রাত; ঘুমোতে ঘুমোতে ভাবতে ভুলে যাচ্ছ না তো? একটু ভাবো, প্রযুক্তির পেছনে কে আছে, কি আছে,.কেন হচ্ছে আর তোমাকে মুক্তির নাম মানুষ থেকে বনমানুষ বানাচ্ছে কিনা !
মানুষ যাকে সত্য বোলে বিশ্বাস করে সেটাকে বলা হয় জ্ঞান। একসময় মানুষ বিশ্বাস করতো সূয্যিমামা পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে আর তখন সেটাই ছিল তার জ্ঞান। এখনো অনেক জ্ঞান বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে -দেখলে না অযোধ্যা কাণ্ড?
জ্ঞানের অনন্ত ভান্ডার থেকে কিছু অংশকে মানুষ আলাদা করে বুদ্ধির সাহায্যে তার বিশ্বজনীনতা প্রমান করতে পেরেছে, নাম দিয়েছে বিজ্ঞান -বিশিষ্ঠ জ্ঞান। তাই বিজ্ঞান সত্য সন্ধানী মানুষের চেষ্টার ফল। এই বিজ্ঞানের অল্প অংশ মানুষ চেষ্টা করেছে আর চেষ্টা করে চলেছে মানবজীবনের সাহায্যের জন্যে। সেটাই প্রযুক্তি। তাই আমি বলি সত্যের বস্তুরূপ প্রযুক্তি।
আমি জানি সব কিছুর পেছনে লুকিয়ে আছে মানুষের চিন্তা, চেষ্টা, মমতা আর অন্তহীন ভালোবাসা। আমি প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কিছু পেয়েছি, তাই বলে তার দাসত্ব নিতে রাজি নোই। সেই দাসত্ব প্রযুক্তির কাছে নয়, কোনো এক অজানা মানুষের কাছে। বহু বছরের অনেক মানুষের ত্যাগে আমি স্বাধীন -আমার স্বাধীনতা আমার কাছে সবচেয়ে পবিত্র; তাকে ত্যাগ করে অপবিত্র করবো এতটা অমানুষ হতে পারিনি - তাই স্মার্ট রোবোট নই - আনস্মার্ট মানুষ হয়েই বাঁচতে চাই।
মানুষ বহু প্রচেষ্টা আর সাধনা কোরে সত্যকে বস্তুরূপ দিয়েছে - তাই সত্যকে আমি এখনদেখতে পাই, ছুঁতে পারি, খেলার সঙ্গীরূপে পাচ্ছি। প্রযুক্তি আমাকে মানুষের শক্তির ওপর বিশ্বাস আর ভালোবাসার ভিতটা আরও শক্ত করেছে। আমার স্থির বিশ্বাস এই বস্তুরূপ সত্যের সঙ্গে থাকতে থাকতে মানবসমাজ পরম সত্যের সন্ধান পাবে - প্রযুক্তি -বন্ধুর হাত ধরে মানব চলবে অতিমানব হবার লক্ষ্যে।