সকল দেশের সেরা
সকল দেশের সেরা


আমার ভারতীয়তা আমার অন্তরের পরিচয়। তাই ভারতের সব কৃতিত্ব আমার কৃতিত্ব মনে হয়। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে আমার চিন্তা ছিল ,জয়ের পর গর্ব অনুভব করি। তারচেয়েও বেশি গর্ব হলো যেদিন আমার সৈন্যেরা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বাংলাদেশকে তুলে দিলো -মনে হলো এই তো আমার দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা। বক্সিং, কুস্তি, বিলিয়ার্ডস, ক্রিকেট, টেনিস, ব্যাডমিন্টনে যখনি ভারত জিতেছে আমার বুকটা গর্বে ফুলে উঠেছে। সত্যজিৎ রায়, মাদার তেরেস, অর্থশাস্ত্রের দুই নোবেল জয়ী থেকে কালাম সাহেবের আণবিক পরীক্ষা কোনটা বাদ নেই আমার গর্বের লিস্টি থেকে। আজ লিখতে বসে মনে হচ্ছে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। তাই মনকে পিছিয়ে নিয়ে চললাম অনেক অতীতে যেখানে আমি শুধু দর্শক নই, এক অপার আনন্দের, গৌরবের অংশীদারও।
কোনো কাগজে ছাপে নি সেই ঘটনা, ভারতের অন্য কোথাও নেই তার প্রভাব। আমার মনে হয় সেই ছোট্ট ঘটনা ভারতের আত্মার পরিচয়, মানুষের জয়গান।
সেই বছর পুরুলিয়াতে ঘোর অনাবৃষ্টি। হাল পর্যন্ত দেওয়া যে নি কোনো জমিতে। যাদের কাছে পুকুর আছে, তারাও আশা ছেড়ে দিয়েছে।
আমি পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করি, সাঁওতালি গ্রাম। ধানের সময়ে মানুষজন ফেরে গ্রামে, ধান কতবার পর সবাই চলে বাইরে কাজের খোঁজে। দরজার সামনে রাখে বাবলা গাছের ডাল যাতে সবাই জানে বাড়িতে কেউ নেই। গ্রামে থেকে যায় বৃদ্ধরা যারা আর চলতে পারে না। সেই গ্রামের কজন মেয়ে বিদ্রোহ করলো। তারা বাইরে কাজের খোঁজে না গিয়ে একটা creche তৈরী করতে চাইলো যাতে মায়েরা বাচ্ছাদের নিয়ে না যায়। পাঁচজন কিশোরী আর ষোলজন বাচ্ছা থেকে গেল - দাদুদের আনন্দের শেষ নেই। এইসময়ে আমিও যোগ দিলাম। ওই মেয়েগুলো পুরুলিয়ার একটা কলেজের ফাংকশনের পরে আমার কাছে হাজির। 'দাদাজি, একটু রোজগার হয় কিছু করা যায় না?' ফেরাতে পারিনি তাদের। ওদের মমতা আমাকে ভাসিয়ে দিলো। পরদিন গেলাম তাদের গ্রামে, দেখলাম তাদের দৈন্য। কিন্তু সবাই হাসিমুখ। অদ্ভুত কাজ করেছিলাম ওদের সঙ্গে। পাকা কুল খড়ের চালে শুখিয়ে বিক্রি করলাম হজমিগুলির কারখানায় একটু আয়ের জন্যে। জঙ্গলের অনেক ওষুধের গাছ- সেগুলোকে বাজারে ভালো দামে বেচলাম। সবাই মিলে খড়ের ছাউনি তৈরী হলো বাচ্ছাদের থাকার ঘর। আমার এক বন্ধু, থাকে কোলকাতাতে, সে অনেক ওষুধ দিলো, মাঝে মাঝে ডাক্তার আনলো।
এরপর ফিরলো সবাই উপার্জনের টাকা হাতে। সে কী আনন্দ। গান, নাচ, সবাই মিলে খাওয়া। সেই সময়ে আসলো খরা। শুখনো পুকুর, লাল মাটির দেশ -আগুনের মতো দেখতে -কোথাও হাল চলেনি, একদিন একটু বৃষ্টি হলো আর তারপর সে কি সূর্যের তেজ!
মেয়েগুলো আসলো আবার,'দাদাজী, কিছু করা যায় না?'
আমার মনে একটা গোঁ চেপে গেল। আমার অনেক দিন আগের বন্ধু জন, ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় চেন স্টোরের মালিক। লিখলাম তাকে অল্প অর্থ সাহায্যের জন্যে। আমার ওপর অনেক বিশ্বাস -কোনো প্রশ্ন না করে রাজি।
শুরু হলো কাজ। প্রথম কাজ পরিবারদের বোঝানো যে জমি ছেড়ে না যায়। আমার একটাই বক্তব্য : 'এসেছো ধান করতে। ধান উঠবে সেই নভেম্বর -ডিসেম্বরে ,তাহলে ওই অব্দি তো থাকতে পারোই ,এর মধ্যে চেষ্টা করা যাক কিছু করা যায় কিনা। আমার অভ্রান্ত যুক্তি জিতলো ,৭৫টি পরিবার রাজি হলো।
পরিকল্পনাটা এইরকম : একটা পরিবারের বছরের ধান লাগে ১৪০০কিলো। এর দাম দশ হাজার টাকা। ধান না হলেও যদি দশ হাজার টাকা থাকে তাহলে ধানটাতো কিনে ফেলা যাবে। অকাট্য যুক্তি। কিন্তু টাকাটা আসবে কথা থেকে ?
আমার এক কৃষিপন্ডিতের সঙ্গে পরামর্শ করলাম।
পুজো থেকে ক্রিসমাস টমেটোর দাম কখনোই ২০ টাকার কম হয় না। তার মানে কেউ যদি ৫০০কিলো টমেটো বিক্রি করতে পারে তাহলে সে ধানও কিনতে পারে। হাইব্রিড টমেটো প্রতি গাছে ছ -সাত কিলো টমেটো দেয়। কমপক্ষে এক কিলো পেলে ৫০০১গাছ চাই। এক ফুট দূরে দূরে লাগালে জমি চাই মাত্র ৫০০ বর্গফুট। ধানের মতো না হলেও একটুতো জল লাগবেই।
কৃষি পন্ডিত বোঝালো অনাবৃষ্টি মানে জিরো বৃষ্টি নয় ,কম বৃষ্টি। ওই জলটা ব্যবহার করতে হবে। মাঠের পাশে পাঁচ বাই পাঁচ গর্ত করে একটা প্লাষ্টিক দিয়ে চৌবাচ্ছা করা যেতে পারে যাতে যেটুকু জল আসবে সেটাকে ধরে রাখা যায়। তাছাড়া একটুতো হিম পড়বেই। আমরা যদি ১টমেটো গাছগুলোকে সোজ
া না রেখে মাটিতে লতার মতো শুইয়ে দি, তাগলে মাটি ঢাকা পড়বে ,তাহলে মাটিতে ভিজে থাকবে।
পরিবারের রাজি হলো এই উদ্ভট পরিকল্পনাতে। জন সাহেব প্লাষ্টিক আর ভালো বীজের টাকা পাঠিয়ে দিলেন।
পাঁচদিনের মধ্যে ম্যাথ -পুকুর তৈরী ,টমেটোর চারা লাগানো হলো। অবাক কান্ড ,গাছ লোটার মতো তড়তড়িয়ে বাড়তে লাগলো। কে আটকাবে প্রতিগাছে এক কেজি টমেটো ?
এবার ৭৫জন মহিলাকে শেখানো হলো কি ভাবে টমেটো পাড়তে হবে, রাখতে হবে,কি করে বেচতে হবে। তিনটে টিম তৈরী হলো পুরুলিয়া বাজারে জায়গা ঠিক হোলো , টিমের প্রতিজন যতটুকু ফসল হোক না কোনো একজায়গায় জড়ো করবে।প্রতিদিন দুজন সদস্যা বাসে কোরে নিয়ে পুরুলিয়া বাজারে যাবে ।সেখানে বিক্রি করে টাকা ভাগ হবে যে যেমন দিয়েছে সেই হিসেবে, যারা যাবে তাদের খরচ বাদ দিয়ে। প্রত্যেক টিমকে বার পাঁচেক ট্রায়াল দিয়ে পোক্ত করা হলো। আমার কাজ শেষ। আমি অন্য কাজে গেলাম দেশের বাইরে। ফিরলামঃ ডিসেম্বরের প্রথম দিকে।
জন খবর দিলো কজন বন্ধু মাইল ভারত দর্শনে আসছে ,অনেকের সঙ্গে তাদের স্ত্রীরাও থাকবে। ওরা একদিনের জন্যে পুরুলিয়ার সাঁওতালি গ্রামে যেতে চায় ,আর জনের ইচ্ছে টমেটো গ্রামে যেতে। আমি খুশি। গ্রামে খবর দিলাম।একটি ছেলেকে পাঠালাম ৭৫টি পরিবার কত আয় করেছে তার হিসেবে তৈরী রাখতে।
আমার অতিথিরা আসলো রাঁচিতে। পরদিন ভোরে গাড়িতে করে গেলাম গ্রামে। সে কী অভ্যর্থনা ! গ্রামের সবাই প্রসেশন করে নিয়ে গেল। কিছু কিছু টমেটো গাছ দেখালো ,প্লাস্টিকের চৌবাচ্ছা দেখালো। আমার ছেলেটি প্রতি পরিবারে আয়ের বিবরণ দিলো। আমি অবাক ,একজনও ছ হাজারের বেশি রোজগার করে নি।
আমার মুখ দেখেই মেয়েরা বুঝলো আমি হেরে গেছি। সবাইকার হয়ে একজন আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝালো কোনো আয়টা কম। মেয়েটি আমাকে বললো আর ভগ্নহৃদয় আমি সাহেব মেমদের জানালাম মেয়েটির ব্যাখ্যা :
\দাদাজীর কথামতো চললে আমরা সবাই বারোহাজার মতো আয় করতে পারতাম। কিন্তু আমরা দেখলাম যে লোকটিকে আমরা ধান বেচি তার কোনো রোজগার নেই। এই ফটিকদা বছরের পর বছর আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম এ বছর আমরা ফটিকদার পাশে দাঁড়াবো। তাই ফটিকদাকে ডেকে বিক্রির ভারটা নিতে বললাম।ফটিকদা আমাদের কাজ কমিয়ে দিলো। এমন রোজগার আমাদের কেউ কোনোদিন করেনি।'
আমাকে সান্তনা দিলো চিন্তা না করতে। প্রায় বছরেই বারো মাসের ধান হয় না ,তাই আমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। বিদেশীরা একটু অবাক হয়ে সবচেয়ে গরিব মেয়েদের কথা শুনলো। ফটিকদাকে ডেকে জানলো এবছর অন্য বছরের তুলনায় বেশি উপার্জন করেছে,প্রায় সাড়ে সাত লাখ ।
মনটা ভালো নেই। রাঁচি ফিরে বিদেশীদের হোটেলে ছেড়ে বাড়ি ফিরলাম। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো , কথা রাখতে পারলাম না জনের কাছে ,যে আমাকে বিশ্বাস করেছে।
পরদিন দুপুরে ফেরার প্লেন। সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে জমা হলাম। হটাৎ মনে হলো আমার দিকে কেমন সম্মানের সঙ্গে তাকাচ্ছে। বুঝলাম আমি পৌঁছনোর আগেই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা করেছে।
দলের একজন মহিলা আমার পাশে বসলেন। আমার একটা হাত দুহাতে ধরে বললেন ,
" ভারতের অন্য জায়গায় কি দেখবো জানিনা। কিন্তু তুমি যা দেখালে সেটা বোধহয় কোথাও পাবনা। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।"
আমার মুখ দিয়ে কথা বেড়োলো না।
জন বোঝালো ,' আমরা সবাই বুঝেছি তোমার দেশের শক্তি কোথায়। য়ুরোপে আমরা পাউনড ডলার দিয়ে জীবন চালাই ,আর তোমরা চালাও মানবিকতা দিয়ে। আমরা ভাবতে পারিনা যে একজন নয় দুজন নয় ,এতজন সবাই এত দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও হাসিমুখে সবকিছু আর একজনকে দিতে পারে। আমরা দেখলাম ওই ফটিক লোকটি যাকে আমরা রক্তচোষা বাদুড় ছাড়া ভাবতে পারিনা ,সেই লোকটাও অনায়াসে যেমন ঠকাচ্ছে তেমনি সহজ ভাবে তার দায়ীত্ব মেনে নিচ্ছে। তা না হলে বলতেই পারতো না কত লাভ করেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে একটা আত্মিকতা কথা আছে সেটা আমরা ভুলে গেছি। তোমার গ্রামের মেয়েরা আমাদের শেখালো মানুষ কাকে বলে, কেমন করে মানুষের মতো বাঁচতে হয়। '
ভারতীয় বলে একটা অদ্ভুত গর্ব আমার দুচোখ দিয়ে জল হয়ে বেড়োতে থাকলো।