১৪০০ সাল
১৪০০ সাল
রবীন্দ্রনাথ খুব বড় মাপের কবি ছিলেন। তাই অনেক বড় মাপের কবিতা বড় মাপের মানুষের জন্যে লিখে গ্যাছেন। তবে এটা ঠিক যে আমাদের মতো গবেটদের,শুখনো কাঠেদের একেবারে ভোলেন নি। সেই যে কোন ছোট বেলায় পড়েছিলাম কবিতা ,চোখ বুঝলেই দেখতে পাই লাইনগুলো :
আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে সবে স্মরিছো মোরে খাবার টেবিলে বসি
চায়ের পেয়ালা করে ।
শুনেছি অদ্ভুত ,অসাধারণ ছিল কবির বহুমুখী শক্তি - কুস্তি থেকে কৃষ্টি , উপনিষদ থেকে নিধুবাবুর ঠুংরি সব ছিল তাঁর বাঁয়ে হাতকা খেল। তাই এতো স্বাভাবিক যে গণৎকারী বিদ্যাটাও ভালো মত জানতেন - তা না হলে ১০০ বছর পরে কি হবে তার বিস্তৃত বর্ণনা লিখলেন কি করে ? একেবারে আকাশবাণীর ইডেন গার্ডেন থেকে টেস্ট ম্যাচের ধারাবিবরণ: " আমি রবীন্দ্রনাথ বলছি ,হাজারিবাগ থেকে। "
তাই আমিও অনেক মানী লোকেদের মতো কবিকে গুরুদেব নং ৩ মানি। পাশের মন্দিরের লাল ধুতিপরা পুরোহিত মশাই আমার গুরুদেব নং ১ - মানে এই নয় যে আমি দীক্ষা টিকখা নিয়েছি। মাঝে মাঝেই মন্দিরে জমা গাদা গাদা ফলমূল থেকে পচে-যাবার -আগের কিছু দান করেন আমাকে। আর আমার মতো অনেককে ঠিক পথে চালনা করেন এমন মোটর- সাইকেল বাহন এক মহান ব্যক্তি থাকেন আমারই পাড়াতে -সবাইকার মতো আমিও তাঁকে গুরু বলে ডাকি। তিনিই আমার গুরুদেব নং ২ -তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে চাঁদা দি ,ভোট দি ,মিছিলে যোগ দি ( লুচি আর আলুর দম প্রসাদ পাই দিনের শেষে ), কাউকে মারতে সাহায্য করি ,আবার কাউকে মরণান্তে পুড়োতে নিয়ে যাই।
বর্ণাঢ্যময় আমার জীবনে একবারই এসেছিলো ১৪০০ সালের পয়লা বৈশাখ। কবিগুরু যেমন চেয়েছিলেন ঠিক তেমনি :
আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন চাপড়ায় মাথা কোন দুখীজনে
তোমাদের ঘরে।
আজিকার নিদাঘের সাদর সমবেদন
পাঠায় দিলাম তাঁর করে ,
আজি হতে শতবর্ষ পরে।
হাজারীবাগের সেই দিনটা ছিলো মধুময়। ছেলেটা এসেছে হস্টেল থেকে। হাজারীবাগে বাগ আছে ,বাঘ আছে ,ইস্কুলও আছে ,নাই কোনো কলেজ। তাই সে থাকে মামাবাড়িতে ভালো কলেজে পড়ে। এসেছে মধুর সংবাদ নিয়ে। জলপানি নিয়ে ডাক্তারি পড়বে ,আমার কাছ থেকে একটু হাতখরচ নেবে আর কিছু দরকার নেই। এর চেয়েও আরো মিষ্টি খবর মেয়েকে নিয়ে। সবাই বলে সে নাকি দেখতে খুবই সুন্দর -আমার চোখে পড়েনি - কিন্তু কলকাতার এক ধনী বাবা -মায়ের দৃষ্টি এড়ায়নি। হাজারীবাগ বেড়াতে এসে তাঁদের নবতম আবিষ্কার তাঁদের ছোট পুত্রবধূ। আজই আশীর্বাদ করতে আসবেন সদলবলে।
মনটা খুব ভালো। গৃহিনী আসলেন পুজো দিয়ে এক কাপ চা আর বিস্কুট হাতে। তিনি রোজ ভোর ভোর সূর্য প্রণাম করতে যান। অনেক দিন ধরেই একটা ক্লাবের সদস্যা -তাঁরা সবাই মিলে রোজ সকালে সূর্যদেবকে নমস্কার করেন আর সারাদিন সংসার সামলান।
কৃতি ছেলে ,সুন্দরী মেয়ে ,গৃহকর্মে নিপুণা স্ত্রী পরিবৃত আমি চা সহযোগে বিস্কুট খাচ্ছি টেবিলে বসে ; মনে হচ্ছে আমি গৌরহরি কবিরাজ। কোনো জানি রামকৃষ্ণদেবের কথা মনে আসলো -অদৃষ্টের পরিহাস। পয়লা জানুয়ারী বরানগরের বাগান বাড়িতে কল্পতরু হয়ে গেলেন -সবাইকার ইচ্ছে পূরণের আশ্বাস দিলেন। আমি ভাবলাম আমিই বা কিসে কম ? সাবধানী স্বভাব আমার পুরো রিস্কটা নিতে পারলাম না। তাই পয়েন্ট ওয়ান রামকৃষ্ণদেব হয়ে মনের ইচ্ছেটা প্রকাশ করেই ফেললাম,
" আজকের দিনটা খুব আনন্দের। তোমরা সবাই আমাকে ঝুড়ি ভর্তি খুশি দিচ্ছ ,তোমরা সবাই এত ভালো। আমারও ইচ্ছে করছে তোমাদের কিছু দিতে। বলো কী চাই ,আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে আমি কথা দিচ্ছি দেবো। "
সবাই থমকে গেল আমার কল্পতরু রূপ দেখে। গৃহিনী রাজনীতি বোঝে ,বিবেচনা করে কথা বলে ;আমার কোথায় ভোটের আগের গন্ধ পেলেন। 'একটু ভেবে পরে চাইবো' বলে গেলেন রান্না ঘরের দিকে। ছেলে আর মেয়ে মায়ের দিকদর্শন শিরোধার্য করে গেল মায়ের পেছন পেছন। আমার মনে একটু ভয় ভয় করলো , ত্রি- মস্তক কি চেয়ে বসে আমাকে না ঝুলিয়ে দেয়। তবু আমি স্থির থাকলাম ,মরোদ্কা বাত বোলে কথা।
সবাই মিলে পুরি -সবজি খাওয়া হলো অনেক হাসি তামাশা মিশিয়ে। তারপর পুত্র মুখপাত্রের রোল নিলো, " বাবা ,আজ সকালে যা বললে ভেবে বলেছিলে তো ,না কি কথার কথা ?"
আমার পুরুষত্ত্বে আঘাত : আবার বললাম আমার বাণী - আমার সাধ্যে থাকলে আমি দেবোই।
পুত্র জানালো তিনজনের একটাই যৌথ ইচ্ছে যা নাকি আমিই দিতে পারি ,জগতের আর কেউ নয়।
একলা আমিই দিতে পারি শুনে অবাক হলাম ,কী আছে আমার ?
খুব একটা আনন্দে মনটা ভরে গেলো। দ্বিধাহীন ভাষায় দিলাম অঙ্গীকার।
" আমাদের তিন জনের একটাই চাওয়া তোমার কাছে - আজ থেকে আর কখনো তুমি বিড়ি সিগারেট খাবেনা। "
ক্লাস থ্রী থেকে আমার সঙ্গী বিড়ি। মাঝে মাঝে কেউ দিলে সিগারেট খাই ভদ্রতার খাতিরে - আমার বিড়ি -অনুরাগ নিৰ্ভেজাল ,তার স্থানে কাউকে বসাতে পারিনি। তাকে ত্যাগ করবো ? আমি নিজের মাঝে অনুভব করলাম শ্রীরামচন্দ্রের সীতামাকে জঙ্গলে পাঠানোর ব্যথা। এর আগে গৃহিণীকে কতবার দেখিয়েছি যে আমি বিড়িকে খাই ,বিড়ি আমাকে খায় না। সাতদিন বিড়িহীন অবস্থায় থেকে আমার প্রভুত্ব প্রমাণ করে আবার ধরেছি বিড়ি খাওয়া। একবার ইঁদুরের কলে একটা ইঁদুরের চোখ দেখেছিলাম ; সেটা দেখে একটু দূরে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম ইঁদুরটাকে। আমার সামনে আয়না নেই ,কলে আটক -পরা ইঁদুরের চোখ তুলে চাইলাম আমার প্রিয়জনের দিকে ,ভাবলাম আমার চোখের শব্দহীন ভাষা বুঝে তারা আমাকে ছেড়ে দেবে।
দিলো না।
হটাৎ নজর করলাম তিনজনের শব্দহীন চোখের ভাষা। একটুও নির্দয় নয় , শুধু বিশ্বাসভরা প্রার্থনা।
বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাইটা ছেলের হাতে দিয়ে বললাম দূরে ফেলে আসতে।
আর বিড়ি খাইনি। এখন ১৪২৬ সাল।