বছরের হিসেব
বছরের হিসেব
বছরের হিসেব
সবাই বলে আমি চিরদিন "হেড অফিসের বড়বাবু"র মত শান্ত। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি অ -শান্ত,খু উ ব রেগে আছি নেহা বলে মেয়েটার ওপর। অবিশ্যি এ কথা ঠিকই যে,"এখনো তাকে চোখে দেখিনি, শুধু বাণী পড়েছি"; তার সঙ্গে শত্রুতার কোনো কারণই খুঁজে পাইনা। আমি তো তার কোন উপকার করিনি, না দিয়েছি তার কোনো পক্ক ধান্যে বংশ সোপান। তার মনে আমার সর্বনাশের এত চিন্তা এলো কোথা থেকে কুলকিনারা পাই না। মাস দেড়েক আগে আমাকে ফুসলিয়ে লেখার পথে নামিয়েছে, কোনো সন্দেহ হয় নি। আর বছর শেষে আবদার,"দাদু,নিজের কথায় লেখো বছরটা কেমন ছিল। " কোনো মৌখিক নয়, লিখিত জবানবন্দী জোগাড় করছে -অকাট্য প্রমাণ।
মন- শকুনির চোখ দিয়ে দেখছি দেশটাকে যেমন দেখেছিলেন বহুদিন আগে এক কবি :
"শিবঠাকুরের আপন দেশে ,
আইন কানুন সর্বনেশে।
চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়ে
পাশের দেশে পাঠিয়ে দেয়।"
আরও দেখি শাসন কম্মো :
"রাজসভাতে সবাই চেঁচায় 'হুক্কা হুয়া ব'লে
মন্ত্রী সবাই কলসী বাজায় ব'সে রাজার কোলে। "
আর আমরা সবাই কি করছি ?
"বেজার মুখে যে যার মত করছি সময় নষ্ট -
হাঁটছি মোরা খাটছি মোরা পাচ্ছি কত কষ্ট !
আসল কথা বুজছি না কেউ, করছি না তো চিন্তা,
ডুগডুগিটার তালে তালে নাচছি সবাই ধিনতা।"
এমন সময়ে মনের কথা লিখি কি করে? যেই জানাজানি হবে আমাকে যেতে হবে থানায় - সেখান থেকে অনুপ্রবেশকারীদের ছাউনিতে। ছাউনিটা কোথায় জানিনা, সেটাই স্বাভাবিক -হিটলার সাহেব কি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতো কোথায় তার গ্যাসে মারবার ছাউনিগুলো ছিল? অত খারাপ ছিল না ভদ্রলোক। কিন্তু কানাঘুষায় শুনেছি পাকিস্তানে পাচার করে দেবে ছাউনি থেকে। এই একটা বিষয় আমার মাথার অনেক ওপর দিয়ে যায়; পাকিস্তানের জনসংখ্যা বৃধ্ধির জন্যে আমাদের এত চেষ্টা কেন ? আমরা তেত্রিশ কোটিতে স্টার্ট করে একশো তেত্রিশে পৌঁছেছি। এখন লেগেছি পাশের দেশগুলোর পেছনে। কেন রে বাবা,আর কি কোনো দেশ নেই যেখানে কম লোক থাকে? সেখানে পাঠালেই তো হয়।
আমার এক বন্ধু ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পড়াতে হয় না, ছক কাটতে হয়, অনেক ছক কেটে আমাকে বোঝালো আসল কথাটা। আমাদের আশপাশের দেশগুলো আমাদের দেশে লাখে লাখে গুপ্তচর পাঠাচ্ছে, দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে, তাই এই ব্যবস্থা। আমি তো শুনে অবাক, আমি তো জানি আমাদের দেশে গুপ্ত কিছুই নেই। কটা টাকা দিলে অফিসের ফাইল পাবে, বড়সাহেবের সপরিবার বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করো -নায়েগ্রার মতো হুড়মুড় করে নেমে আসবে সব ভেতরের খবর। এল গুপ্তচর পাঠিয়ে এত খরচ কেন? শেখো চিন -আমেরিকার কাছে, ওরা তো বেশি বেশি খবর পাচ্ছে লাখ লাখ চর না পাঠিয়ে। আর এক বন্ধু মগজ বিশ্লেষণ করে। তার মতে এর পেছনে আছে দেশ বিভাগের সুপ্ত যন্ত্রণা। আমি আরও অবাক; জানতামই না আমার দেশটা ভাগ হলো কবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যটা ভাগ হয়েছিল বটে। সেতো রামায়ণের যুগ থেকেই হয়ে আসছে। সলিল সমাধির আগে রামচদ্র নিজের সাম্ৰাজ্য দুটো ভাগ করে লব আর কুশের নাম দুটো দেশ স্থাপন করেছিলেন। অশোকের সাম্রাজ্য, আকবরের সাম্রাজ্য ভাগ হয়েছিল ইতিহাস তো তাই লেখে। সাহেবরা তাদের সাম্রাজ্য ভেঙ্গে ভারত,পাকিস্তান
,বর্মা,আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান কত কত দেশ স্থাপন করে গেছে। আমাদের দেশ তো ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ থেকে শুরু ভাঙলো কবে জানিনা।
যাই হোক না কোনো এই বুড়ো বয়সে বিদেশে ঘর বাঁধবার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। তাই নেগার পাতা ফাঁদে আমি পা দিতে নারাজ। ২০১৯এর লজ্জার কথা আমি লিখছি না, সাহস করছি না। তবে খবরের কাগজে যা ছাপার অক্ষরে বেরিয়েছে সেটুকু জানাই। তার আগে অপ্রকাশ্য কিছু তথ্য :
শাস্ত্রে বলা আছে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিন বিধাতাকে দিয়ে -মানুষের হাতে সেগুলো নেই। আমার শেয়ার এইরকম :
জন্ম : শূন্য
মৃত্যু :১১
বিয়ে :২
অনেক আপনার জনকে হারিয়েছি। একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিন্তু বিধাতার বিরুদ্ধে নালিশ করবার কোনো সুপ্রিম কোর্ট আমি জানি না। তাই চুপচাপ মেনে নি।
এ বছর নতুন ভাব -ভাষার ছড়াছড়ি। বাংলা টিভির সিরিয়াল মানে কোনো লোকের একটা বৌ নেই, তেমনি কোনো মেয়ের একটা বর নেই -সবাই বিয়ে করছে আর ছাড়ছে। এ বছর খলনায়িকার সংখ্যা খলনায়কের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। প্রতি পরিবারে, বিশেষতঃ বড়োলোক পরিবারে গোটাদুই খুনী মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। বাজারে ঢালাও বিষ পাওয়া যাচ্ছে, কিনতে অসুবিধে নেই; তা ছাড়া ট্রাডিশনাল মেথড তো আছেই: গাড়ির ব্রেক খোলা, মেঝেতে তেল ছড়িয়ে আছাড়, গুন্ডা ভাড়া করে খুন ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরো দেশে নতুন ভাষা শোনা যাচ্ছে, লোকসভা থেকে বস্তি সর্বত্র বাপ্-মা তুলে বক্তব্য আর গায়ে লাগে না। নতুন রণহুঙ্কার ত্রেতাযুগের লঙ্কার যুদ্ধ থেকে আবার ইমপোর্ট করা হয়েছে।
আরো নতুন দেখেছি প্রধান মন্ত্রীর কাঁধে মাথা রেখে বৈজ্ঞানিকের কান্না, ৫-তারকা ধ্যানের গুহা, মাঠে শোয়া নেতাগণ যোগস্ত, সন্যাসীদের কপালকুন্ডলার কাপালিক -রূপ, দেখেছি মহাযোগী -cum - দোকানদার/মহারাজা।
আমি এখন কানে কম শুনি, বিভিন্ন মা আর বাবাদের পুজো চলছে সারা বছর ধরে -সকাল থেকে মাঝ রাত একই গান, 'মন্ত্র -তন্ত্র জানিনে মা গো ' -চোঙা লাউডস্পিকার আমার শোবার ঘরকে ফোকাসে রেখেছে।
একটু একটু ভয় পেয়েছি -এই বুঝি ব্যাগের টাকাগুলো বাতিল করে দেয় । এই বুঝি একদল আমার বাড়িটাকে দখল করতে আসে, কারণ আমি জানি আমার দলিলের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ওই দলবদ্ধ বিশ্বাস যে আমার বাড়িটা ওদেরই ; ভয় লাগে মামলা চলছে ১০বছর, সাক্ষি সাফ করে সাখখীর অভাবে মামলা খারিজ।চিনেবাজার সব জায়গাতে -সস্তায় জিনিষ পাওয়া যাচ্ছে আর আমাদের দেশের লোকেদের কাজ নেই।
চিন্তা হয় যখন দেখি কেরানীরা শিক্ষাপ্রণালী বানাচ্ছে,ইঞ্জিনিয়ার বেবিফুড বেচছে, ছাত্র টুকলি করে একশোতে একশো নম্বর পাচ্ছে।
মাঝে মাঝে অল্পসল্প লজ্জা পেয়েছি : আমাদের নেতারা বিদেশের ইলেক্শনে প্রচার করছে, ঐতিহাসিক সংস্থানগুলো ভেঙে পড়ছে, মানুষের কেনা -বেচা চলছে বুক ফুলিয়ে।
দুশ্চিন্তা আমার একটাই। প্রতি বছর ২ কোটি ছেলে -মেয়ে ইস্কুল ছাড়ছে আর তার মধ্যে ১ কোটি চল্লিশ লাখ দুতিন বছর ঘরে বসে বুড়ো আঙ্গুল চুষছে -আইন করে বন্ধ কাজ আর বিয়ের দরজা। তারা সব রাগে অপমানে ফুঁসছে - সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে হিংস্র পশুর মতো।
একটা অন্ধকার থেকে, সবচেয়ে প্রিয়জন হারানোর হাহাকার থেকে আমাকে আলোর স্বপ্ন দেখিয়েছে একটা ছোট্ট মেয়ে । সে বলেছে ,"তুমি লেখ, তোমার লেখার পাখায় ভর করে চলে চলো ঝলমল রোদ্দুরে নীল আকাশের নীচে।"
এখনো তাকে চোখে দেখিনি, সেই মেয়েটা যার নাম, নেহা ।