দিনের আলোয় ঢাকা তারা
দিনের আলোয় ঢাকা তারা
পরিবারের ছবির এলবামে দুটো ছবি আমাকে বারবার টানে। একটা বড় ছবি প্রায় একশো জনের। অন্যটা ছোট সাইজের জনা বারো নিয়ে। প্রথমটা ১৯৩৩সালের ,আমার মা -বাবা ছবিতে আছে ,ওরাই সালটা ঠিক করে দিয়েছে। অন্যটা ১৯০৫সালের আমার নিজের অঙ্ক করে বার করা। প্রথম ছবিতে মধ্যমনি একজন কালো গলাবন্ধ কোট আর ধুতি পরা, কাছারির কেরানীর মতো । পাশে নিশ্চই তাঁর সহধর্মিনী - শাড়ি পরা ,ডান কাঁধটা খোলা ,মাথায় ঘোমটা ,মুখটা আর ছোখ দুটো ভাবুক ভাবুক।অন্যেরা ছয় ভাই আর তিন বোন ,সঙ্গে এক নাতি। দ্বিতীয় ছবিটাতে মধ্যমনির লম্বা দাড়ি ,সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতো.পেছনে ঝুলছে একটা বাঁধানো ছবি। শাড়ি পরা ,ডান কাঁধ খোলা। চোখ আর মুখ বাবুল ভাবুক। বয়সটা বেশি হলেও কোনো সন্দেহ নেই ইনই প্রথম ছবির সহধর্মিনী। সুতরাং মধ্যমনি যে আগের ছবির সরকারি কর্মচারী তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। আমার গল্প এই দুজনের।
কলকাতার কাছেই মদনপুর। গ্রাম ঠিক নয় ,সেমি শহর বললে মাদানপুরকে ঠিক বোঝা যাবে। এখানকার প্রধান দুই পরিবার। ঘোষেদের বংশ গোঁড়া সনাতনী ;কালী মন্দির,দূর্গা মন্দির ,রাধা -কৃষ্ণ মন্দির এই বংশের কীর্তি। দেব পরিবার কট্টর ব্রাহ্ম ,পুতুল পুজোর ঘর বিরোধী। মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে লম্বা দাড়িওয়ালা কয়েক জন আসেন ,প্রার্থনা সভা হয় ,ব্রহ্ম সংগীত শোনা যায় ,তাতে মেয়েরাও যোগ দেয়। দু পরিবার দেখা হলে সৌজন্য বিনিময় করে না।
কি করে রজতেন্দ্র ঘোষ আর সৌদামিনী দের পরিচয় হলো জানিনা। স্কুলে যাবার পথে হতে পারে। ঘোষ বাড়ির ছেলে পড়াশুনাতে সুনাম ,জলপানি পেয়ে কলকাতা গেল প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে। যাবার আগে নিশ্চই ভাষাহীন ভাব বিনিময় হয়েছিল তা না হলে তার এমন পরিবর্তন হলো কি করে ? ব্রাহ্ম সমাজে নাম লিখলো ,পত্র -পুস্তিকাতে রচনা ছাপালো হিন্দু গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। বি এ পাশ করবার আগেই ব্রাহ্ম সমাজের একজন নামকরা হয়ে উঠলো। সৌদামিনী ম্যাট্রিক ক্লাসে উঠলো। তারপরেই শুরু হলো দক্ষ যজ্ঞ। শ্রীমান রজতেন্দ্র বাড়িতে জানালো তার মনের বাসনা ,সৌদামিনীকে বিয়ে করতে চায়। মা -বাবা কেউ সম্মতি দিলো না, তখন শ্রীমান হাজির হলো ব্রাহ্ম সমাজের অফিসে তার আর্জি নিয়ে। দে পরিবারের জেষ্ঠরা আসলেন তাদের আপত্তি ধোপে টিকলো না যখন স্বয়ং সৌদামিনী লজ্জা ছেড়ে রণভূমিতে প্রবেশ করলো। শ্রীমান -শ্রীমতীর যৌথ উদ্যোগে সমাজপতিদের হার মানতে হলোই।
পাত্রপক্ষের অসহযোগ অমান্য করে ব্রাহ্ম মতে বিয়েটা হলো আর এক সরকারি কাজ পেয়ে নবদম্পতি সুখে সংসার পাতলো। প্রমাণ প্রথম ছবি।
বছর কাটলো ,কলকাতায় নতুন বাড়ি হলো। পাড়ার লোকেরা এক বজ্র গোঁড়া অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দাপটে মাথা নামিয়ে থাকলো। বাড়ির মধ্যে কড়া শাসন ,চা চলবে না ,সিনেমা -থিয়েটার চলবে না , প্রা
র্থনা করতে হবে ইত্যাদি।
জেষ্ঠ্য পুত্র বাপের পদাঙ্ক অনুশরন করে ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে নাম করে ফেললো। বিপদ আসলো মেজো ছেলেকে নিয়ে। তার বড় ইচ্ছে কাপালিক হবার। গোঁড়া ব্রাহ্ম পরিবারের মা বোঝাবার চেষ্টা করলেন ,তারপরে সুপার -গোঁড়া ব্রাহ্ম বাবা গর্জন করলেন করলেন। কিন্তু ছেলে অবিচল। উপায় না দেখে এক উদারপন্থী পরিবারে সুন্দরী কন্যার সঙ্গে প্রায় জোর করে বিয়ে দিলেন। সব কিছু under control এ এলো। বছর ঘুরলো। মেজো পুত্রের দুটি পুত্র সন্তান হলো। বাবা -মা নিশ্চিন্ত ,কাপালিক হবার ভূতটা ঘাড় থেকে নামলো। এর পর বিনা -মেঘে বজ্রপাত -একদিন সকালে দেখা গেল সুন্দরী বৌকে ফেলে একটা চিঠি লিখে মেজোছেলে উধাও হিমালয়ের উদ্দেশে। কাপালিক সে হবেই।
একান্নবর্তী পরিবার ,খাবারের অসুবিধে নেই, কিন্তু অল্প বয়সী বৌমা সঙ্গে দুটো ছেলে -সারাদিন হাসিভুলে ঘুরে বেড়ায়। সকলের মনটা কাঁদে ,কিন্তু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তার স্থানে অচল। ছেলেকে ত্যাজ্য করলেন ,স্ত্রীর কথায় কান না দিয়ে। দুঃখী বৌমাকে সমাজের কাজে ঢোকাবার চেষ্টা করলেন। বৌমার মুখে হাসি ফিরলো না।
সৌদামিনী কদিন অস্থির হয়ে থাকলেন ,তারপর একদিন স্বামীকে বললেন তিনি নিজে বৌমার জন্যে কিছু করতে চান। স্বামী সহজেই রাজি।
সৌদামিনী নতুন বৌমাকে নিয়ে কাউকে কিছু না বলে সোজা গেলেন রামকৃষ্ণদেবের স্ত্রী সারদা মায়ের কাছে। সব খুলে বললেন আর প্রার্থনা করলেন মা যদি তার বৌমার মনে একটু শান্তি ফেরাতে পারেন।
সারদা দেবী অনেকক্ষন ভাবলেন ;একটা সুন্দর হাসি ফুটে উঠলো তাঁর মুখে। বৌমাকে কাছে ডেকে ঘর সংসারের কথাই বললেন। শেষে বললেন ,"তোমার ছেলেদের নিয়ে আমার কাছে এসো একদিন, আমি রান্না করে খাওয়াবো। আর হাসিটা ভুলে যেও না -তোমার স্বামী ঠাকুরের ইচ্ছেতে ফিরে আসবে।তখন ওকে নিয়ে এসো ,আমি তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে দীক্ষা দোবো। " সৌদামানির অজান্তেই তার চোখ ভেসে গেল। শাশুড়িকে দেখে বৌমা অবাক ,গোঁড়া পরিবারের শাশুড়ি তাঁর হলো কি ? বাড়ী ফিরে সব শুনে সবাই অবাক। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দুদিন কথা বন্ধ করে দিলেন।
জন্ম -ব্রাহ্ম সৌদামিনী ,নব্য -ব্রাহ্ম স্বামীকে বোঝালেন ,"নিজের বিশ্বাস নিজের জন্যে। আর মায়ের ভালোবাসা সন্তানের জন্যে। এদুটো মিলে সুন্দর ,এদুটো মিলে অন্ধকার থেকে অলোর পথ -সেটাই ব্রাহ্মদের প্রাণের কথা। "
রাগী গোঁড়া রজতেন্দ্র চুপ করে শুনলেন সেই অনন্ত বাণী ,শিখলেন তাঁর সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে।
অনেক অনেক সৌদামিনী তাদের অনেক ভালোবাসা দিয়ে ,অনেক সাহস দিয়ে ,অনেক বিবেচনা দিয়ে আমাদের আজকের সুন্দর দিনটাকে এনেছেন ।তাঁরা কেউ রানী রাসমণি ,রানী ভবানী নন। সূর্যের আলোতে তাঁদের স্নিগ্ধ আলো ঢাকা পরে আছে।