স্বপ্ন
স্বপ্ন
ইশ! দশটা বেজে গেছে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুকটা ধড়াস করে ওঠে রিয়ার। এগারোটা থেকে পরীক্ষা। স্কুলে পৌঁছতে পৌঁছতে যাহোক দশটা কুড়ি, ততক্ষনে তো সবাই হলে ঢুকে গেছে, আর আধঘন্টা আগেই ব্যাগপত্র সব বাইরে বের করে দিতে হবে, তাহলে আরও একবার সিলেবাসটা রিভাইজ করবে কি করে রিয়া? গলার কাছে সদ্য আলুভাতে মেখে খাওয়া ফ্যানা ভাতটা আটকে যায়, বুক ঢিপঢিপ করে ওঠে ভয়ে।
কোনোক্রমে ব্যাগ কাঁধে ফেলে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায়, কিছুটা ছোটার পর মনে হয়, যাহ! মাকে বাবাকে তো প্রণাম করে আসা হলো না!
কব্জি ঘুরিয়ে সময় দেখে রিয়া, দশটা দশ, আবার ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
মনেমনে বাবা মার মুখটা মনে করে দৌঁড় লাগায় রিয়া আবার।
আশ্চর্য্য! স্কুল এত চুপচাপ কেন? পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল নাকি! ঘড়িতে তো এখন দশটা পঁচিশ!
ভয়ার্ত রিয়া ক্লাসরুমে যায়, নাহ! শুরু হয়নি।
খাতা দেওয়া শুরু করেছেন প্রমথ বাবু। রিয়ার তাহলে আরও একবার রিভাইজ করে নেওয়া হলো না!
যাকগে!
একি! একটা প্রশ্নও তো কমন নয়, আরে, আজ কি ভূগোল পরীক্ষা? রিয়া তো ইতিহাস পড়ে এসেছে! কি হবে এবার? কান্না পাচ্ছে রিয়ার! কি করে পরীক্ষা দেবে সে? কোনো উত্তরই তো মনে আসছে না....
ঘুম ভেঙে যায় রিয়ার। ঘেমে নেয়ে একশা! আজকাল প্রায় রোজ দিন এই একই স্বপ্ন আসে। কেন যে আসে?
স্কুলের পরীক্ষায় বারবার হেরে যাচ্ছে রিয়া। কিন্তু স্কুলে তো কোনোদিন সে দ্বিতীয় ছেড়ে তৃতীয় হয়নি!
মাধ্যমিকেও যথেষ্ট ভালো নম্বর ছিল, উচ্চমাধ্যমিকেও, এমনকি, স্নাতকেও সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। তবু এই কম্পিটিটিভ এক্সামের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে কেন বারবার এমন বিফলতার স্বপ্ন দেখে সে?
বিফল কথাটা মনে আসলেই রিয়ার শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। বিফলতা একটা মানুষকে কিভাবে শেষ করে দিতে পারে সেটা রিয়ার বাবাকে দেখলেই বোঝা যায়।
শিক্ষকতা করার স্বপ্ন দেখতেন নিখিল। কমিটি থেকে নেওয়া ইন্টারভিউয়ে সিলেক্ট হয়ে যাওয়ার পরও কেবল মাত্র কয়েক হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে নিখিলের পদটা পাশের পাড়ার সৌম্য ছিনিয়ে নিলো। লজ্জায়, ঘেন্নায় নুইয়ে পড়েছিলেন নিখিল। এ রাজ্যে যোগ্যতা দেখা হয়না, দেখা হয় ক্ষমতা, অর্থের ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা। আর কোনোদিন কোনো পরীক্ষায় বসেননি নিখিল। বাবার নুইয়ে পড়া ব্যবসার হাল ধরেছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আর মেয়ের মধ্যে বুনে দিয়েছেন জেদের বীজ।
বিছানা থেকে উঠে এসে পড়ার টেবিলে আলো জ্বালায় রিয়া। সত্যিই কি তবে তার সাধনায় ফাঁকি থেকে যাচ্ছে? মোটা বইটা খুলে বারবার চোখ বোলায় ছোট ছোট প্রশ্নোত্তর গুলোয়। না না ,এভাবে না, থরো রিডিং চাই। রিয়া বইআলমারি খুলে নিচু ক্লাসের বইগুলো বের করে, ইতিহাস, ভুগোল, জীবনবিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, ইংরেজি, গণিত।
চাকরির পরীক্ষার এখনো পর্যন্ত কোনো খবর নেই, নাই থাক, কিন্তু রিয়াকে যে তৈরি থাকতেই হবে, কোনো ক্রমেই যে সে হেরে যাবে না। দশ হাজার শুন্যপদের মধ্যে একটিও কি যোগ্যর জন্য তোলা থাকবে না?
এতো রাতেও মেয়ের ঘরে আলো জ্বলছে দেখে পাশের ঘর থেকে মা উঠে আসে, দরজা ঠেলে রিয়াকে বলে,"কিরে, এখনো পড়ছিস? ঘুমাবি না?"
রিয়া মায়ের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয়, "তুমিই তো বলতে ছোট বেলায়, যে ঘুমিয়ে থাকে, তার ভাগ্যও ঘুমিয়ে থাকে!"
মা জানে, এখন রিয়াকে কোনো কিছু বলেও কোনো লাভ হবে না। মেয়েটা বরাবর জেদী, সেই ছোট্ট থেকে।যেটা একবার মনে মনে সংকল্প করে নেবে, সেটার শেষ দেখেই ছাড়বে।
ছোটবেলায় কতদিন হয়েছে ,মাঝরাতে উঠে রিয়াকে ঠিক এভাবেই বলতে হয়েছে ঘুমোনোর কথা, আর রিয়াও ঠিক একই রকম নির্লিপ্ত ভাবে বলেছে,"মাত্র পাঁচটা নম্বরের জন্য শ্রেয়া বারবার ফার্স্ট হয়ে যায় মা, প্লিজ তুমি এখন আমায় শুতে বলো না!"
*******************************************
তিন বছর আগের দেওয়া ডব্লিউ বি সি এসের মেইন পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে। প্রথম চারজনের মধ্যে রিয়া একজন। এবার বাকি ইন্টারভিউ। এখানেই প্রমাণ হয়ে যায়, কিসের ওজন বেশি, যোগ্যতার না ক্ষমতার। এবার নিজের ব্যক্তিত্ব তৈরি করার সময়, রিয়াকে তো পারতেই হবে।
টেবিলের সামনের দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছে এ পি যে আব্দুল কালামের উদ্ধৃতি... "ড্রিমস ইজ নট হোয়াট ইউ সি ইন স্লিপ, ইজ দ্য থিং হুইচ ডাজ নট লেট ইউ স্লিপ!"