সবচেয়ে বড়ো ভয়
সবচেয়ে বড়ো ভয়


বিষয়টা বড় জটিল। জন্মগত ভাবে আমি ভীরু প্রকৃতির মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তান। গোদা ভাষায় যাকে বলে ছাপোষা মানুষ। আমিতো সবেতেই ভয় পাই। ভয়ের আবার চতুর্বর্ণ আছে জানতামই না।
এই ভয়ের চোটেই তো semi -নন্দলাল হয়ে কাটিয়ে দিলাম জীবনটাকে। জীবনের প্রতিটি বয়সে কোনো না কোনো ভয় আমাকে এগোতে দেয় নি। বয়েসের সাথে সাথে অন্য্ একটা ভয় প্রথম জায়গাটাকে দখল করেছে। এদের মধ্যে কোনো Maxima /Minima নেই। এ বলে আমায় দেখ ,ও বলে আমায় দেখ।
আমি ভাবছি বয়েস -আধারিত আমার ভয়ের তালিকার একটা লিস্টি বানাতে। এই লিস্টি দেখে যে কেউ পছন্দ -মতো ফার্স্ট -সেকেন্ড rank দিতে পারবে।
জন্মের সময়ের ভয়টা আমার মায়ের মুখে শোনা : মায়ের পেট থেকে বাইরের আলো দেখে আমি এতো ভয় পেয়েছিলাম যে কথা বন্ধ হয়ে গেছিলো। মহিলা ডাক্তার আমার পাদুটোকে ধরে মাথা ঝুলিয়ে দিলেন কয়েক ঘা চাপড় ,আর আমি ব্যাথার চোটে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলাম ,তাতেই সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
খুব ছোট বেলাতে আমার ভয় ছিল পাশের বাড়ীর ছোড়দি। সব সময়ে ভয় করতো না ,আমাদের খুব আদরের ছিল। যা বলতো শুনতাম। কিন্তু অবাধ্য হলেই বিপদ : মাথায় গামছা বাঁধা , দুটো চোখের পাতা উল্টোনো ,হাতে লাঠি আর নাঁকি সুরে ভাষণ ,' আমি কিন্তু আমি নোই।' আমরা কচিকাচারা ভয়ের চোটে কেঁদেই ফেলতাম আর আমাদের অনুনয় , 'ও ছোড়দি ,তুমি আবার ছোড়দি হয়ে যাও।'
ইস্কুলে পড়ার সময়ে ভয় ,ইস্কুল শেষে কোথায় যাবো ? তাই বছর বছর ফেল করে ইস্কুলেই থাকতাম। আমার দুটাকা ফী এর জন্যে ইস্কুল নামটা কেটে দিতো না। তারপর একদিন একটা নতুন ছাত্র জিজ্ঞেস করলো ,'কাকু,ক্লাস নাইনটা কোন দিকে ?' ঠাকুর বলে গেছেন ,লজ্জা -ঘৃণা-,ভয় তিন থাকতে নয়। আমার কিন্তু ভয়টা কমেছিল লজ্জা পেয়ে। তাড়াতাড়ি উচ্চ -মাধ্যমিকটাও পাশ করে ফেললাম।
চাকরিতে কী হবে ভয়ে দরখাস্ত করতাম না। আমার এক মেসো জোর করে তার এক বন্ধুর অফিসে ঢুকিয়ে দিলো। সেখানেই আছি ,একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার আমার চাকরি জীবনের চিরসখা।
বিয়ের কথা ভাবলেই হাত পা কেমন ঠাণ্ডাঠাণ্ডা লাগতো ,আমি ওই risk নিতে রাজি ছিলাম না একেবারেই। কিন্তু কথায় বলে ,জন্ম -মৃত্যু -বিয়ে বিধাতাকে দিয়ে। আমারও বিয়ে হলো এক অঘটনে। পিসির সইএর মেয়ে বুঁচকি -তার বিয়েতে গেছি পিসির body guard হয়ে। সন্ধে বেলা বর আসলো ,একটু বাদে এলো পুলিশ -বরের নাকি বিয়ে করাটা একটা hobby ; সে তো গেল জেলে। পুলিশের বড়বাবু আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে এক বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করলেন আমি বুঁচকি উদ্ধারে রাজি কিনা। ভয়ে আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। মৌনম সম্মতি লক্ষণম বুঝে সবাই আমাকে সাজিয়ে গুজিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসালো।সারা জীবনের জন্যে আমি বুঁচকির্ বোঁচকা হয়ে গেলাম।
ভালোই আছি। কাজে কম ফাঁকি দি বলে একটা সুনাম আছে ;কেউ জানেনা কাজ চলে যাবার ভয়েই আমি কাজে ফাঁকি দি না। ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে ,কলকাতার কাছেই একটা একতলা ছোট বাড়ীও করেছি। এখন আমার ভয় শুধু পাড়ার কেষ্টোর দলকে। ওরা কাজ করে না ,পুজো করে আর পুজোর সময় নানারকম অনুষ্ঠান করে। বারো মাস পুজো চলে ,আমাদের রাস্তায় গাড়ি চলে না ; পুজোর জন্যে বাঁশের প্যান্ডেল permanently রাস্তা দখল কোরে বসা। ওঁদের চাহিদা মতো চাঁদা দিতে হয় আর সেটা দেশের মুদ্রা স্ফীতির সঙ্গে এক ছন্দে চলে। এইতো গত পুজোতে বৌয়ের শাড়িটা বাদ গেল চাঁদার ভারে। মনে একটা শান্তি পাই ,মরে গেলে পোড়ানোর লোকের অভাব হবে না।
একটা খবরে ভয় পেয়ে আছি। আইন হয়েছে, আমিই যে আমি সেটা কাগজ পত্রে প্রমাণ দিতে হবে ; ভেবে ভেবে আমার পান -জর্দা খাওয়াটা কমে গ্যাছে। ছোড়দির কথা প্রায় মনে পড়ে ,আমি কিন্তু আমি নোই। প্রমাণ না দিলে আমাকে হয় জেলে ভরবে আর না হলে একটা ছোট নৌকোতে বসিয়ে মাঝ দরিয়ায় ছেড়ে দিয়ে আসবে।
সত্যি কথা বলছি : আমার এখনের সচেয়ে বেশি ভয় একটা দুঃ স্বপ্নের। প্রায় রোজ scene by scene দুঃ স্বপ্ন টা হানা দেয়।
দেখি, আমার বাড়ীতে এসেছে কেষ্টোর দল। কেষ্টোর এক পিসেমশায়ের ভায়রাভাই ছিলেন। তাঁর বাবার ঠাকুরদা আমার জমিতে তিনবার কালীপুজো করেছিলেন। সেই স্মৃতিতে এখানে কালী মন্দির করতে হবে,তাই জমিটা দিতে হবে।
দেখি, কেষ্টোর দল একদিন লুকিয়ে আমার বৌয়ের পুজোর পিঁড়িতে একটা কালী ঠাকুর বসিয়ে গেল আর তারপর একদল গুন্ডা গুন্ডা দেখতে লোক বাড়ীটাকে ঘিরে ফেললো। নানা রকমের শ্লোগান , জমি চাই ,বাড়ী চাই ,নইলে তোর গর্দান চাই। আমরা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি -ছাদে উঠে একদল হাতুড়ি মারছে ,ছাদটায় ফাটল ধরছে। আমরা খাটে বসে দেখছি আর শুনছি। কিছু করবার ক্ষমতা নেই।
আবার দেখি, কেষ্টোর দল ,সঙ্গে পুলিশ। আমাদের বারান্দায় বসিয়ে দরজায় তালা দিলো ,বলে গেল বিচার হবে। একটু শান্তি এলো মোনে।
দেখি, বিচার শেষের scene : বিচারকেরা বিশ্লেষণ করেছেন কেষ্টোর দল দেশের সব আইন ভেঙেছে। সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন ভীতু বাঙালীর এই আইন ভাঙ্গার সাহসিকতার জন্যে তাঁদের বঙ্গবীর উপাধি দেওয়া হোক। রায় দিয়েছেন: কেষ্টোর দলের ভক্তির শক্তি ,যা তাঁদের আইন ভাঙতে সাহস জুগিয়েছে ,সেই শক্তির সম্মানে আমার বাড়ী জমি তাঁদেরকে দেওয়া হোক।
দেখি, আমি বুঁচকি বোঁচকা নিয়ে বসে আছি গাছের তলায়। জন্মের সময়ের মতো একটা ভয় আমাকে ঘিরে ফেলেছে।আমি কথা বলতে পারছি না। একজন আমাকে গাছের ডালে লটকে দিলো। আমার পিঠে দম দম করে মারছে।
আমার মুখ থেকে অস্ফুট একটা আওয়াজ : হুপ ,হুপ।