arijit bhattacharya

Horror

4.1  

arijit bhattacharya

Horror

সারমেয়রাজ

সারমেয়রাজ

10 mins
1.3K


#সারমেয়রাজ

#অরিজিৎ_ভট্টাচার্য্য


"এই অঞ্চলের মানুষেরা একটা জিনিসকেই ভয় করে -কুকুর দেবতা বা সারমেয়রাজ। আর দেবতা বললে কি হবে,ইনি কোনো ভয়ঙ্কর অপদেবতার চেয়ে কম যান না। অতি ভয়ঙ্কর,পাহাড়তলির আতঙ্ক। " এক লহমায় এই কথাগুলি বলে থামলেন কৌশিকবাবু। ভাস্কর বলে উঠল,"আপনি অনেকটা মিশরীয়দের কথা মনে করিয়ে দিলেন। মিশরীয়রাও অ্যানুবিস বা শিয়াল দেবতায় বিশ্বাস করে। আর এখানে এসে শুনতে পেলাম এই আদিবাসীরা কুকুর দেবতা বা সারমেয়রাজের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। আশ্চর্য!" কৌশিকবাবু বলে উঠলেন,"আর কি বলব বলুন,এই পাহাড়ের দেবতা বা সারমেয়রাজ পাহাড় আর জঙ্গলের মানুষের কাছে রীতিমতো আতঙ্ক। একবার ভাবুন তো, শাল ,সেগুন আর পলাশের বনে ঢাকা এই অঞ্চল কতোখানি প্রাচীন! কতোখানি অজানা রহস্য আর ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই অঞ্চলের সাথে। তারপর এইরকম এক ভয়ঙ্কর উপকথা।" এবার আমি আর থাকতে পারলাম না। "আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন মানলাম, কিন্তু আপনিও কি বিশ্বাস করেন!না হলে,সূর্য ডোবার আগেই আমাদের কেন গেস্ট হাউসে ফিরে আসার কথা বলবেন!" মৃদু হেসে কৌশিকবাবু বললেন,"সে আর বলতে! দেখুন এই অঞ্চলে পরতে পরতে রহস্য জড়িয়ে আছে। চতুর্দিকে শাল সেগুনে ঘেরা ঘন অরণ্য। আর এই অরণ্য বর্ষাকালে তো আরোও রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে। আদিবাসীরা বলে, যদি অমাবস্যার রাতে এই কুকুর দেবতার কাছে ভেড়া বা পাঁঠা বলি দেওয়া না হয়, তাহলে এই কুকুর দেবতা এতোটাই হিংস্র হয়ে ওঠে যে, আদিবাসী বস্তি থেকে কোনো শিশুকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পিছপা হয় না । আর এই ঘটনা সত্যিই ঘটেছে। কয়েক মাস আগের কথা । কুকুর দেবতার কাছে বলি দেওয়ার জন্য ছাগল বা ভেড়া পাওয়া যায় নি। কিন্তু,সেইরাতে আদিবাসীদের ঝুপড়ি থেকে দুইজন শিশু নিখোঁজ ছিল। " আমি হাসতে হাসতে বললাম,'তাহলে এই ঘটনাই আপনাকে সারমেয়রাজের অস্তিত্ব বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে। হা হা। আর আপনি আমাদের সূর্যাস্তের পর বাইরে থাকতে মানা করছেন। " ভাস্কর হাসতে হাসতে বলল,"দুর,ছাড়তো অরিজিৎ। এই সারমেয়রাজ বা কুকুরদের রাজা নিশ্চয়ই জঙ্গলের সাঁওতাল আর মুণ্ডাদের কোনোও অপদেবতা হবে। আর এই উপকথা আর ভয় এই অঞ্চলের মানুষের রক্তে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। " 

"কিন্তু,এই সারমেয়রাজের আতঙ্ক তো শুধু অমাবস্যাতেই হয়। বাকি রাতে কি ভয় থাকতে পারে!"আমি শুধালাম ভাস্করকে। "আরে ধুর সারমেয়রাজ! শুনলি তো সারমেয়রাজের মন্দির বা থান জঙ্গলের কতো গভীরে। সেখানে ছাগল বা ভেড়া রাখলে এমনিতেই জঙ্গলের শিয়াল আর হুড়াল সেগুলিকে নিজের আহার বানায়। আর নাম হয় সারমেয়রাজের! অরিজিৎ আমি ড্যাম শিওর যে, ঐ বাচ্ছাদেরও বস্তি থেকে রাতের অন্ধকারে শিয়াল বা নেকড়েই তুলে নিয়ে গেছিল।"


এতক্ষণে তো আসল কথাই বলা হয় নি। আমি অরিজিৎ আর আমার প্রাণের বন্ধু ভাস্কর বেড়াতে এসেছি ঝাড়খণ্ডের ফুলডুংরির জঙ্গলে। আমরা ভীষণভাবে নাস্তিক আর যুক্তিবাদী। ভূত কেন,ভগবানকেও বিশ্বাস করি না। উঠেছি ফরেস্ট গেস্ট হাউসে আর এখানকার বাঙালী ম্যানেজার কৌশিক মিত্রের সাথে আলাপ। দিলদার,প্রাণখোলা,মিশুকে মানুষ। আর এই কৌশিকদার মুখেই শুনেছিলাম এই অঞ্চলের আতঙ্ক সারমেয়রাজ বা সারমেয়দেবতার ভয়ঙ্কর কাহিনী।


বলতে গেলে ছোটনাগপুরের শাল সেগুন আর পলাশের জঙ্গল আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। আর এটাও জানি যে,বর্ষাকালে এই জঙ্গল কতো মোহময় ,কতো অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে ওঠে। বইছে মন মাতাল করা বাদলা হাওয়া। আকাশে ঘন কালো জলধর। চমকে উঠছে ক্ষণপ্রভা। বৃষ্টি হচ্ছে,কখনো ঝিরিঝিরি,কখনো বা ঝমঝম মুষলধারে। সুবর্ণরেখা সম্পূর্ণশরীরা,জলে টইটম্বুর। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। প্রকৃতি পূর্ণযৌবনা,সদ্যস্নাতা। দিগন্তরেখায় ধূসর অভ্রভেদী নগের হাতছানি। যেন সবকিছু এক সুদক্ষ চিত্রকরের সুদক্ষ হস্তে অঙ্কিত ক্যানভাস।


তাই তো,ভাস্কর যখন বলেছিল আগস্ট মাসে সিংভূমের ফুলডুংরিতে যাবার কথা তখনই লুফে নিয়েছিলাম ওর প্রস্তাব। আর এখানে এসে তো সুন্দরী প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গেলাম। মুণ্ডাদের সাজানো ছবির মতো গ্রাম, আর তার চারপাশে মাইলের পর মাইল জুড়ে দিগন্তবিস্তৃত ছোটনাগপুরের গহন পর্ণমোচী অরণ্য। যত সেই অরণ্যের গভীরে যাওয়া যাবে,প্রকৃতি পলকে পলকে খুলবে নিজের অন্তর্বাস। তবে,সুন্দর সুন্দর জায়গাতেও অনেক সময় কুৎসিত,কদর্য আর ভয়াল ভয়ঙ্কর ঘটনাবলি ঘটে থাকে। এই সুন্দরের স্বর্গের মধ্যেও কোথাও একরাশ অনন্ত বিভীষিকা নিয়ে আস্তানা গেড়ে বসে আছে সেই ভয়াল ভয়ঙ্কর সারমেয়রাজ!


যাই হোক,আবার গল্পে ফিরে আসি। কৌশিকদা বললেন,"যেদিন শিশুদুটি নিখোঁজ হয়,সেদিন মধ্যরাত্রে উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়তলি থেকে ভেসে এসেছিল এক হাড়হিমকরা গর্জন। আর বলা বাহুল্য,সেই গর্জন কোনো কুকুর বা নেকড়ের হতে পারে না। এমনিই নেকড়ে গর্জন করলে একপাল নেকড়ে একসঙ্গে গর্জন করে। আর একটা নেকড়ের গর্জন এতজোরেও হয় না। এত হিংস্র,এত ভয়ঙ্কর- এ নিশ্চয়ই অপার্থিব কোনো জীবের-কোনো নারকীয় বিভীষিকার। এ নিশ্চয়ই সেই ভয়ঙ্কর সারমেয়রাজ,যার সাথে আমি মিল খুঁজে পাই The Evil Hound এর। " আমরা দুজনেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। তাহলে কি এই গহন বনানীর মধ্যে সত্যিই এইরকম ভয়াল ভয়ঙ্কর কিছু আছে! দুপুরে খাওয়া দাওয়া ভালোই হল। ফ্রায়েড রাইস আর তার সাথে দেশী মুরগীর কষা মাংস। খাওয়া দাওয়ার পরে গেস্ট হাউসের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। উত্তর-পশ্চিমের ধূসর পর্বতশ্রেণীকে ধোঁয়াটে লাগছিল। সেই দিকে তাকাতেই বুক দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল।


ভাস্কর এসে বলল,"জানিস অরিজিৎ,আজ শনিবার,তায় আবার অমাবস্যা। আমাদের কুকুর দেবতার জন্য সত্যিই একটা স্পেশাল দিন। যাই হোক,আমি থাকছি না দুপুরে,সন্ধ্যার দিকে ফিরব।"


অবাক হয়ে গেলাম আমি ওর ভয়ডরহীন মুখের দিকে তাকিয়ে। " সত্যি তুই এতটুকু ভয় পাসনি!" "ভয় মানে!"ভাস্কর ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,"সারমেয়রাজের কথা কি শুধু কৌশিকদার মুখ থেকে শুনলাম নাকি! এখানে আসার আগে থেকেই শুনেছি এই অঞ্চলের আতঙ্ক কুকুর ভূত,হ্যাঁ এই নামটাই মানায় ওকে। আমরা এখানে এসেছি বুধবার,আর বৃহস্পতিবারই আমি গিয়েছিলাম কুকুর ভূতের ইন্টারভিউ দিতে উত্তর পশ্চিমের পাহাড়তলিতে। আর অতি অবশ্যই ,সেটা তোকে না জানিয়ে!" চমকে উঠলাম আমি। ভাস্কর তারপর যা বলল শিউরে উঠলাম আমি।"আরে,প্রকৃতির সৌন্দর্য কিছু নয়,এই সারমেয়রাজের আকর্ষণেই তো এখানে এসেছি আমি। তুই ভয় পেয়ে যাবি বলে তোকে আগে বলিনি। যাই হোক,এই সারমেয় অপদেবতা এই অঞ্চলের সরল মুণ্ডাদের মনে এক বিশাল আতঙ্ক গেড়ে বসে আছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। আর সম্প্রতি এই পাহাড়ি অঞ্চলে বেশ কয়েকটা হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আর তাতে ভয় আরোও বেড়ে গিয়েছে।"

উত্তেজিতভাবে বললাম আমি,"বলিস্ কি রে!" ভাস্কর তার উত্তরে যা বলল তার সারমর্ম হল এই যে,ছোটনাগপুরের এই পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলটা সভ্য জগতের অনেক বাইরে। কাছের শহর ঘাটশিলা। তাও আবার চল্লিশ মাইল। তো হয় কি ,এই অঞ্চলের মানুষেরা নানা কুসংস্কারের অন্ধকারে আচ্ছন্ন, সভ্য জগতের জ্ঞানের আলোক সেই অন্ধকারকে পুরোপুরি ভেদ করতে পারে নি এখনোও। আমরা কুসংস্কার বিরোধী যুক্তিবাদী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। আর খুব তাড়াতাড়ি আমরা এই অঞ্চলের মানুষকে দেখিয়ে দেব,এই সারমেয়রাজ বা কুকুর দেবতার কথা অজ্ঞ আদিবাসীদের অর্থহীন কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। স্রেফ ভাঁওতা। দেখবি লোকে ঘৃণা করবে এই কুকুর দেবতাকে।

আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,"আচ্ছা,তুই এই কুকুর দেবতাকে দেখেছিস নিজের চোখে?" 

ভাস্কর হা হা করে হেসে উঠল,"বললাম তো গিয়েছিলাম ওদিকে। এইসব মুণ্ডা অধিবাসীরা যতো ভয়াল ভয়ঙ্কর দেব দেবীর পূজা করে,কুকুর দেবতা তাদের মধ্যে অন্যতম। কালো পাথর কুঁদে তৈরি বিরাট মূর্তি,ধারালো দাঁতের সারি আর তা থেকে ঝরছে লালা। চোখদুটি পাথরের হলে কি হবে যেন জীবন্ত, আর তা দিয়ে সারা জগতের আদিম হিংস্রতা প্রতিফলিত। আর সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার কি বলতো অরিজিৎ, চোয়ালে লেগে রয়েছে কোনো পশু বা পাখির টাটকা রক্ত। দেবতা যেন সদ্য রক্তপান করেছে। বিকালের পড়ন্ত আলোয় ফুলডুংরির জঙ্গলে সেই ভয়াল দৃশ্য দেখে ভয়ই করছিল বলতে গেলে। " ভাস্করের মুখে একথা শুনে বলা বাহুল্য আমার শরীরটাও শিউরে উঠল।


দুপুরে কোনো পাত্তা মিলল না ভাস্করের। বিকালে ভাস্কর ফিরে এল। এসেই বলল,"শোন অরিজিৎ,তুই তো খেতে খুব ভালোবাসিস। তো কাল সকালে আমরা মাটন খাচ্ছি। সে যে সে মাটন নয়,সাক্ষাৎ সারমেয়রাজের প্রসাদ। অবশ্যই মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া প্রসাদ। আর যে মুখ থেকে এই প্রসাদ কেড়ে নিয়েছে,সেই শ্রীমান ভাস্কর স্বয়ং তোর সামনেই উপস্থিত। " আমি বললাম,"ভাই ,এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল!" অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল ভাস্কর,"কিসের বাড়াবাড়ি রে! এতদিন কুকুর দেবতা বাড়াবাড়ি করেছে। আর এখন আমরা করলেই দোষ! " আমি বললাম,"দেখ ভাস্কর এইভাবে বলিস না! কৌশিকদার কাছে শুনলি তো যে,সারমেয়রাজ যদি কারোর ওপর ক্ষিপ্ত হন,তাহলে................................................."

আমার মুখের কথা আর শেষ করতে দিল না ভাস্কর। "তা হলে তিনি তাকে মৃত্যুর মুখে পাঠিয়ে দেন তো! হা হা। তুই আমার কথা শোন্ অরিজিৎ। আজ যদি সাকসেসফুল হই আমরা,কালই ওর ঘন্টা বাজিয়ে দেব। হ্যাঁ,এখন ওরই ভয়ে কাঁপার সময়। " 

ভাস্কর আমায় নিয়ে গেল গেস্টহাউসের পেছন দিকে। ওখানে বাঁধা আছে একটা মাঝারি সাইজের খাসি,ব্যা ব্যা করছে। ভাস্কর বলল,"দেখলি তো,কুকুর দেবতার থান থেকে একেবারে সোজা পিক আপ করে নিয়ে এসেছি। আর রাতে একে নিয়েই আমরা ঐ অপদেবতার সাথে ডিল করব।"

"মানে এটা কি আমাদের সাথেই থাকবে না কি!" চমকে গিয়ে বললাম আমি।

"হ্যাঁ,মাই বয়,শুধু তাই নয়। আমাদের ঘরেই বেঁধে রাখব। দেখি রাত হলে ঐ অলৌকিক কুকুরের শক্তি কতো বাড়ে! ওর আস্তানা থেকে আমি ওকে এনেছি। এখন দম থাকলে আমাদের ঘাঁটি থেকে নিয়ে যাক। " 

ভাস্করের কন্ঠস্বরে কঠিন শীতলতা।

"কুকুর চুলোয় যাক,রাত্রিবেলা যদি চেঁচামেচি করে ,তাহলে কি হবে বল তো,ঘুমের দফারফা হয়ে যাবে। "

"আরে ডার্লিং,কিছু পেতে হলে তো কিছু জিনিসের বলিদান দিতেই হয়। আজ রাতে নয় আমি আর তুই ঘুমটাকে বিসর্জন দিলাম। আর তার বদলে কি পাব ভাব তো,খ্যাতি,সম্মান আর রহস্যভেদের সাফল্য। কৌশিকদা আমাদের সাহসের ধন্য ধন্য করবে। কোলকাতার খবরের কাগজগুলিতে আমাদের কথা বড়ো বড়ো অক্ষরে ছাপা হবে। আমরা এই ছোটনাগপুরকে মহামারীর মতো ছড়িয়ে থাকা এক কুসংস্কারের ভয়ের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছি। আর সেগুলির যদি কোনোটাই না হয়,নিজের স্যাটিশফিকেশন তো আছেই। আর এইসবের কাছে অরিজিৎ তুই তো জানিস,একরাতের ঘুম কতো তুচ্ছ!" 

"কিন্তু কৌশিকদা যদি অ্যালাউ না করে!"

"আরে কৌশিকদাকে বোঝানো হবে,যে ব্যাপারটা কেন করা হচ্ছে! আমরা জিদ ধরব।আর যদি আমরা ফেমাস হই,উনিও কম ফেমাস হবেন না। শুধু দরকার ঠিকভাবে ওনাকে ব্যাপারটা বোঝানোর। উনি খুব জেদী নন,না করবেন না।" দৃঢ় গলায় বলল ভাস্কর।


আমি খাসিটার দিকে তাকালাম। কপালে সিঁদুর মাখানো। তার মানে উৎসর্গ করে দেওয়া হয়েছে। দেবতার মুখের খাবারকে একেবারে কেড়ে এনেছে ভাস্কর। দেবতার রুষ্ট হবারই কথা!


রাত তখন মোটামুটি দেড়টা হবে। হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল। সারা গেস্টহাউস ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনে হয় লোডশেডিং হয়েছে। শুনতে পেলাম কুকুরের কান্না। আওয়াজটা খুব সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসছে। একটা কুকুর খুব করুণ স্বরে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। হঠাৎই থেমে গেল কান্না। কিছুক্ষণের জন্য নিঝুম নীরবতা। আমি কোনোওরকমে বললাম,"ভাস্কর!" পাশ থেকে উত্তর এল,"হ্যাঁ,জেগে আছি। ভয় পাস্ না।" ছাগলটাও দেখলাম আশ্চর্যজনকভাবে চুপ করে গেছে। যেন খুব ভয় পেয়েছে!

এরপরেই পরপর তিনবার কুকুরের বুক কাঁপানো গর্জন। এতো তীব্র আর প্রচণ্ড গর্জন যার,তার দেহের আকার কিরকম হবে তা আন্দাজ করেই ভয় পেলাম। বুকের রক্ত জল হয়ে গেল। হঠাৎই থেমে গেল সেই প্রলয়ঙ্কর গর্জন। ফিসফিস করে ভাস্কর বলল,"দেখলি তো,আমাদের কুকুর দেবতা ভয়ঙ্কর রুষ্ট হয়ে আছেন। তিনি এখন এইদিকেই আসছেন।" আর থাকতে পারলাম না আমি। ভাস্করকে বললাম,"চুপ কর তো। তুইই যতো নষ্টের মূল।"

"জানি না।কি হবে।" স্বগতোক্তির স্বরে হাসল ভাস্কর। আমিও অনুভব করেছি,ওর মধ্যে ভয়ের উপস্থিতি। তাহলে কি ও আন্দাজ করতে পেরেছে যে,ভয়ঙ্কর কোনো কিছু ঘটতে চলেছে! হঠাৎই দেখলাম ঘরের তাপমাত্রা আশ্চর্যজনকভাবে কমে এসেছে। ঘরটা যেন কোনো এক অজানা কারণে হঠাৎই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বিছানার নিচে থেকে এক অপার্থিব শব্দ এল,"ফোঁস!"

আমি জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম,"কৌশিকদা!" কোনো সাড়াশব্দ নেই। গেস্ট হাউসে সবাই যেন কালঘুম ঘুমাচ্ছে। ভাস্কর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,"অরিজিৎ,কোনো লাভ নেই। আমাদের স্বর আর এই ঘরের বাইরে যাবে না। আমরা নিশ্চয়ই কোনো অদৃশ্য মন্ত্রবলে বাঁধা পড়েছি।" মনে হল ভাস্করও ভয় পেয়েছে যথেষ্ট। রক্ত জল হয়ে গেল আমার। ব্যা ব্যা করে পাগলের মতো চিৎকার আর ছটফট করতে শুরু করেছে খাসিটা। সারা ঘর ভরে গেছে এক অজানা কটু গন্ধে।


কিছুক্ষণের প্রতীক্ষা শুধু। আর বিছানার তলা থেকে বিরাট আকারের চারপেয়ে কোনোকিছু লাফিয়ে পড়ল খাসিটার ওপর। আর খাসিটার আওয়াজের সাথে ভেসে এল কুকুরের ভয়াল হুহুঙ্কার। কিছুক্ষণের মধ্যে চিৎকার আর ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পড়ল খাসিটা। মনে হল,ভবলীলা সাঙ্গ করেছে। কিন্তু,অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছিল,জীবটাকে দেখতে পারছিলাম আবছা আবছা। অতোবড়ো কুকুর,মনে হল নেকড়ে আর কুকুরের সংকর,জীবনে দেখিনি। জীবটা আমাদের ঘরে ঢুকলোই বা কখন, আর এতক্ষণ ওটা যে বিছানার তলাতেই লুকিয়ে ছিল,কেউ খেয়ালই করিনি। তখনোও কুকুরটা সমানে খাসির গলা চিরে রক্তপান করছিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম আমি। ভাস্করকে ডাকতে গিয়ে দেখলাম ওর হাত পা কাঁপছে। বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে একপলকে জীবটার দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,"সারমেয়রাজ। পরম করুণাময় ঈশ্বর ব্যতীত এখন কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারেন না এই সারমেয়রাজের কবল থেকে।"

আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।তাহলে কি আজকের এই অমাবস্যা রাতেই আমাদের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে! আজ রাতই কি আমাদের জীবনের শেষ রাত! দেখলাম একজোড়া জ্বলন্ত চোখ ইহজগতের সমস্ত ভয়াবহতা নিয়ে আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

এই সময় যখন আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠছি আর আকাশ পাতাল ভেবে চলেছি,তখন বিদ্যুতের মতো এক চিন্তা খেলে গেল আমার মনে। এই কথা এতক্ষণ আমার মনে পড়ে নি কেন! আদিবাসীদের ভয়াল ভয়ঙ্কর অপদেবতা যতই শক্তিশালী হোক না কেন,পরম করুণাময় ঈশ্বরের শক্তির কাছে তার শক্তি কিছুই নয়।


আর এই ভূত আর অপদেবতার বিরুদ্ধে যিনি নিরন্তর লড়েন,তিনি শ্রীরামচন্দ্রের পরম ভক্ত হনুমানজী। যতোই নাস্তিক হই,সেইসময় মনে পড়ে গেল আমার হাতেই তো মা জোর করে পরিয়ে দিয়েছেন হনুমানজীর কবচ। পরম ভক্তিভরে ডাকতে থাকলাম পবনপুত্রকে,জোরে গাইতে থাকলাম ভজন। জন্তুটা লাফ দিতে গিয়েও থেমে গেল। মনে হল যেন ভয় পেয়েছে। 

তারপর শুরু হল এক অদ্ভুত কাণ্ড। শোঁ শোঁ শব্দে বাইরে যেন ঝড় শুরু হল। এক অপার্থিব কিন্তু স্বর্গীয় জ্যোতিতে ভরে উঠল ঘরটা। সেই আলোতে দেখলাম জন্তুটা মাটিতে পড়ে গোঁ গোঁ করে ছটফট করছে। তারপর ধীরে ধীরে শূন্যে মিলিয়ে গেল। যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফিরে যেতে হল অপদেবতাকে।

চলে এল কারেন্ট। আমি উঠে লাইটটা জ্বালালাম। আর দেখলাম এক রক্ত জল করা দৃশ্য। পড়ে রয়েছে খাসিটার মুণ্ডহীন রক্তশূন্য ধড়। আর কিছু দূরেই গড়াগড়ি খাচ্ছে মুণ্ড। অথচ সমস্ত জায়গাটাতেই রক্তের কোনো চিহ্নই নেই।

--------‌---------------------------------------------------


পরের দিন সকাল হতেই ভাস্করের সাথে গেলাম কুকুর দেবতার থানে। মূর্তিটাকে দেখে ভাস্করও চমকে উঠল। সারা গায়ে অজস্র ফাটল। মূর্তিটার এরকম দুরবস্থা এক রাতেই কীভাবে সম্ভব! মনে হল আগের রাতে ভয়াল ভয়ঙ্কর অপদেবতা কোনো মহাশক্তিধরের সাথে ঝাপটা ঝাপটি করেছে। চোখদুটি পাথরের হলেও জীবন্ত,ইহজগতের সমস্ত নৃশংসতা আর বর্বরতা যেন ঐ চোখের মণিতে কেন্দ্রীভূত রয়েছে। বাঁকানো ধারালো দাঁত। একটা কুকুর যেন সামনের দু পা গেড়ে বসে আছে। এই কুকুর আমাদের খুব চেনা। একে কাল রাতে দেখেছে,গেস্টহাউসে খাসির রক্তপান করছিল। ভয় লাগানো এক অনুভূতি খেলে গেল আমার সারা শরীরে। মূর্তিটা মোটামুটি বসে থাকলেও সাত ফুট হবে,কুকুরটার আকার আয়তন আন্দাজ করেই শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। কুকুরটাকে দেখে মনে হয় এক্ষুণি লাফ দেবে। মূর্তিটাকে দেখলে দিনের বেলাতেও ভয় লাগে। ভাস্করকে দেখলাম হাত জোড় করে নত হতে। হয়তো সে তার আগের দিনের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে সারমেয়রাজের কাছে।

হঠাৎই আমার চোখে পড়ল সেই ভয়াল ভয়ঙ্কর হাড় হিম করা দৃশ্য। কুকুর দেবতার চোয়ালে দেখলাম মাখানো তাজা রক্ত। এই রক্ত যে সেই হতভাগ্য খাসির,তা বুঝতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা থাকল না মনে। আগের আঁধার রাতে এই সারমেয়রাজের ক্রূর হিংস্রতা থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য আগের দিন রাতে আবির্ভূত হয়েছিলেন অঞ্জনীনন্দন পবনপুত্র হনুমান।ধন্যবাদ জানালাম পরম প্রতাপশালী পবনপুত্রকে। নত হলাম সারমেয়রাজের কাছেও। ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমা চাইলাম।

হঠাৎই দেখলাম সারমেয়রাজের চোখের সেই আদিম ক্রোধ সম্পূর্ণ অদৃশ্য। রক্ত পান করে তৃপ্ত হয়েছেন পাহাড়ের কুকুর দেবতা।


সমাপ্ত

কলমে অরিজিৎ


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror