রক্তচোষা
রক্তচোষা
লন্ডনের উপকন্ঠেই ছোট্ট সুন্দর সাজানো শহর ল্যাভেনহ্যাম। দুপাশে দিগন্তপ্রসারী সবুজ মাঠ,তার মাঝখান থেকে চলে গেছে রাস্তা। ধরণীর ওপর কেউ যেন একখণ্ড সবুজ গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে দিগন্তবিস্তৃত চোখ জোড়ানো গম,ওট আর বার্লি ক্ষেতও আছে। কোনো কোনো জায়গায় পাহাড়ের গায়ে ভেড়া বা শুয়োরের পাল চরছে। কাঁটাগাছের ঝোপের দিকটা থেকে বড়ো রাস্তায় উঠে এল রবার্ট। আজ আকাশ মেঘলা,ঝোড়ো হাওয়া বইছে,ঝিরঝির করে আবার বৃষ্টিও পড়ছে।না,সন্ধ্যা হয়ে গেলে বিপদ হতে পারে,আবহাওয়ার পরিস্থিতি ভালো না,মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এরকম নির্জন জায়গা খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা,এদিকে নাকি তেনারা থাকেন। কাছেই পরিত্যক্ত কবরস্থান। না,আজ রাতের মধ্যেই ল্যাভেনহ্যাম পৌঁছাতেই হবে। সেখানে আজ সে তার প্রেম জেনিফারের বাড়ির অতিথি।
ঐ তো একটা মোটর গাড়ি আসছে,ল্যাভেনহ্যামের দিকেই যাচ্ছে। যাকগে,বাঁচা গেল। ঈশ্বর পরম করুণাময়,ঠিক সময়ে রাস্তা দেখান। হাত দেখাল রবার্ট,থামল মোটরগাড়ি,রবার্টকে নিয়ে মোটর ছুটল ল্যাভেনহ্যামের দিকে।
সামনের সিটে বসেছিল দুই ভাই,হান্স আর হেনরি। রবার্ট গাড়িতে উঠতেই কেমন যেন এক পচা গন্ধ পেতে থাকল তারা,দুজনে দুজনের মুখের দিকে চাইল। গাড়িতেও এমন কোনো জিনিষ নেই,যেটা পচছে। লন্ডন থেকে ল্যাভেনহ্যামগামী রাস্তার ওপর এই জায়গাটা সুবিধার নয়,কাছাকাছিই কোথাও আছে এক শতাব্দীপ্রাচীন পরিত্যক্ত কবরস্থান।এখানে নাকি তারাই ঘুরে বেড়ায়,যারা দিনের বেলা মাটির তলায় ঘুমোয়। রাতের বেলা যখন আঁধারে ছেয়ে যায় বিশ্বচরাচর,তখন ঘুম থেকে জেগে কফিন থেকে বেরিয়ে মাটির ওপর বিচরণ করে। এরা অন্ধকারের জীব,এরা অ-মৃত। মৃত্যুর পরও এদের অভিশপ্ত আত্মা শরীর ছেড়ে বেরোয় নি। এরাই পিশাচ বা ভ্যাম্পায়ার।
ভ্যাম্পায়াররা দুটো জিনিসকে ভয় পায়,একটা পেঁয়াজ বা রসুন ,আরেকটা যীশুর পবিত্র ক্রুশ। আর এইমুহূর্তে কোনোটাই তাদের কাছে নেই!
এই লোকটা যতক্ষণ থেকে উঠেছে,ততক্ষণ থেকেই পচা গন্ধটা আসছে।বারবার লোকটার দিকে আড়চোখে তাকায় দুই ভাই। লোকটা মাথা নিচু করে বসে কেমন যেন উশখুশ করছে!এদিকে বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। জনশূন্য রাস্তা দিয়ে তীব্র বেগে ছুটছে গাড়ি। দুভাইয়ের মনে ধীরে ধীরে সন্দেহের মেঘ জমে ওঠে।
রবার্টের অস্বস্তি হয়। গাড়িতে ওঠার পর থেকে রবার্টও একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছে,একটা নেশা ধরানো গন্ধ যেটা স্নায়ুর মধ্যে পলকে জাগিয়ে তোলে শিহরণ।কেমন যেন অপার্থিব অনুভূতি হয় তার।আচ্ছা,ওরা দুইজন তার দিকে এভাবে কেন তাকাচ্ছে। না,চাহনিটা ভালো লাগছে না। মনের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করছে।জায়গাটা ভালো নয় মোটেই।এখানেই গাড়ি থেকে নেমে গেলে কেমন হয়! আজকে কার কপালে কি আছে কে জানে।
সূর্য অস্ত গেছে। বাইরে গোধূলির মৃদু আলো। কড়কড় শব্দে ঘননীল মেঘের বুক চিরে চমকে ওঠে বিদ্যুল্লেখা। মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের সবকিছুকে আলোকিত করে। গায়ে কাঁটা দেওয়া ঝোড়ো হিমেল হাওয়া বইছে।
হঠাৎই ভিউয়িং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে হেনরি। পিছনের সিটে মানুষ কোথায়,সিট তো ফাঁকা। এদিকে পেছন ফিরে দেখে,ঐ তো দিব্যি বসে আছে লোকটা, বেশ নিশ্চিন্তেই বাইরে বর্ষাস্নাতা প্রকৃতির শ্যামল অঙ্গের শোভা অনুভব করছে।এই দৃশ্য দাদা হান্সকে ইশারা করে দেখায় হেনরি। আতঙ্কে কাঁপতে থাকে দুজনে। দুজনেরই হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে আসছে। কতক্ষণে লোকটা নামবে গাড়ি থেকে কে জানে! যতক্ষণ লোকটা না নামছে তাদের গাড়ি থেকে,রক্ত জল করা এই আতঙ্কের হাত থেকে মুক্তি নেই কারোও।
ওদিকে রবার্ট ছটফট করে ওঠে। গন্ধটা বাড়ছে ক্রমশ,শরীর মনে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। আর স্থির থাকতে পারে না রবার্ট। গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই,একঘন্টা তো পেরিয়ে গেল,ল্যাভেনহ্যাম আসার নাম নেই। আর থাকতে পারে না রবার্ট। বুক ফেটে যাচ্ছে, উফ্,
পিপাসা,প্রচণ্ড পিপাসা। এই পিপাসার অন্ত নেই,বিরাম নেই।অনেক ধৈর্য্য ধরেছে,আর নয়।
পরের দিন সকালে লন্ডন থেকে ল্যাভেনহ্যামগামী রাস্তায় পাওয়া গেল দুই ভাই হান্স আর হেনরির রক্তশূন্য মৃতদেহ।অজানা আতঙ্কে দুজনেরই চোখের তারা বিস্ফারিত।পুলিশ বলছে অজানা আততায়ীর রহস্যময় খুনের কথা,কিন্তু স্থানীয় মানুষ বলছে অন্য কথা।
রক্তচোষা বা ভ্যাম্পায়ার। লন্ডন থেকে ল্যাভেনহ্যামগামী রাস্তার ওপর কাঁটাগাছের জঙ্গলে ঘেরা পরিত্যক্ত কবরস্থানের আঁধারের মিথ ছিল এরা। আজ হান্স আর হেনরির রক্তশূন্য দেহ আর গলার কাছে সূঁচের আঘাতে যেমন হয়,সেরকম ছোট্ট দুই ক্ষতচিহ্ন এই মিথটাকেই আজ সত্যি প্রমাণ করল।