রাতের অতিথি
রাতের অতিথি
পর্ব এক
মিতা হঠাৎ ফোনটা পেয়ে চমকে উঠল । শতদ্রুদা, এত রাতে ? মোবাইলের সুইচ টিপতেই ওপার থেকে ভেসে এলো চেনা সর।
“মিতা! মিতা! হ্যালো ! হ্যালো!”
“হাঁ! বল.. কি হল সব ঠিক আছে তো?”
“মিতা! মিতা! আমাদের খুব বিপদ .. তাড়াতাড়ি আমাদের বাড়ি চলে আয়! এক্ষুনি! চলে আয়”।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তবে তার আগেই কলটা কেটে গেল। শতদ্রু সান্যাল এর সাথে মিতার আলাপ হয়েছিল প্রায় পনেরো বছর আগে। অফিস সহকারী হিসেবে বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল দাদার সাথে। সব সময় সব কাজে অনেক সাহায্য করেছে, ওর বিয়ে এক রকম দাড়িয়ে থেকে দিয়েছিল।
তারপর মিতাও চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিল। অনেকদিন কথা হয় নি। এই বছর ওরা জলপাইগুড়িতে বেড়াতে এসেছিল এবং দাদার সাথে দেখা। অনেকদিন পর সবার সাথে কথা হল। বৌদি আর চন্দনা মানে দাদার মেয়ে খুব ভালো আছে।
“এখন কি হল? হঠাৎ এভাবে ডাকল কেন? এত রাতে তুমি কি করে যাবে?”
“আমার একবার যাওয়া উচিত। আমি গাড়ি নিয়ে চলে যাব। তুমি চিন্তা করো না।“
গাড়ি আর মোবাইল ফোনে নিয়ে মিতা বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে ছেলেকে একবার দেখে নিল, ঘুম থেকে না উঠিয়ে, একবার কপালে হাত বুলিয়ে দিল। সমরকে ফোন করে সব জানাবে বলে দিল।
গাড়ি দ্রুত গতিতে রাস্তা দিয়ে ছুটছে আর মিতার মনটা কেমন যেন করতে লাগল। কি এমন বিপদ হল যে এত রাতে তাকে ডেকে পাঠালেন? রেডিওটা চালাতেই মিতার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, “ সতর্কবার্তা, আজ সারা রাত বজ্র বৃষ্টি ও ঝড়ের সম্ভবনা আছে। ঘর থেকে রাতে বেরোবেন না। রাতের অতিথি নামের কাউকে দরজার ভিতরে ঢুকতে দেবেন না।“
এসি গাড়িতে বসে দর্ দর্ করে ঘামছিল। এক অজানা আতঙ্ক যেন গ্রাস করছিল। এই রাতের অতিথির কথা এখানে এসেই শুনেছে মিতা। লোকের বাড়িতে রাতের বেলা টোকা দেয় দরজায় এবং যে দরজা খুলে দেয় তাকে অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ির দরজার কাছে পাওয়া যায়, জ্ঞান ফিরলেও সেই মানুষ আর বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারে না। তিন দিনের মাথায় মৃত্যু অবধারিত, কেউ বাঁচে নি। এইভাবে গত এক বছরে চল্লিশজন মারা গেছে।
শতদ্রুদার বাড়িটা শহর থেকে একটু দূরে, গাড়িটা বাড়ির সামনের রাস্তায় রেখে মিতা হাঁটতে শুরু করল। বাড়ির সামনে বেশ বড় একটা বাগান। বৌদির খুব বাগান করার শখ তাই দাদা এত সুন্দর একটা বাগান করতে দিয়েছে। বেশ হালকা হওয়া চলছিল। বৃষ্টিটা একটু থেমেছে তবে ভিজে মাটির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। চারিদিক সাংঘাতিক নিস্তব্ধ, গা ছম ছম করতে লাগল।
কলিং বেল বাজিয়ে দু মিনিট দাড়াতে হল তারপর দরজা খুলল বৌদি। মিতাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে ওদের সোফাতে বসতে বলল। শতদ্রুদাদের বাড়িটা একটু অদ্ভুতভাবে সাজানো দেখে মিতার বেশ ভালো লেগেছিল। উনি ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে খুব ভালোবাসতেন। ওনার বাড়ি এই ভালোবাসার প্রমাণ। বহু পুরনো দিনের আদলে তৈরি সোফা, টেবিল, চেয়ার, আয়না, সাজের সরঞ্জাম, ফুলদানি ইত্যাদি দিয়ে ঘর পরিপাটি করে সাজানো।
“মিতা! তুই এসেছিস!... ভীষণ বিপদ!”
সতদ্রুদাকে দেখে মিতা একটু ভয় পেয়েগেল, উস্কোখুস্কো চুল, চোখ লাল, কাপড় ঘামে ভিজে, খুব জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছিল যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। মিতা ওনাকে বসিয়ে একটু শান্ত হতে বলল।
“দাদা কি হয়ছে? একটু শান্ত হয়ে প্রথম থেকে বল।“
“তুই চলে যাওয়ার পর বেশ কিছু বছর আমি ওই চাকরিটা করেছিলাম। তুই তো জানিস আমার অনেক দিনের শখ ছিল একটা আন্টিক স্টোর একেবারে নিজের মতন করে খুলে চালানোর। আমি সেই সপ্ন পূরণ করেছিলাম। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিস্তর বাবস্যা করেছিলাম। কত মানুষ যে ঐতিহাসিক মূল্য থাকা জিনিস কিনতে সখ রাখে এটা বোধ হয় এই মানুষ গুলোর সাথে পরিচয় হওয়ার পর জেনেছি।
সব ভালো ছিল তবে কাল হল মুসৌরি ঘুরতে যাওয়া। আজ থেকে দুই বছর আগে আমরা ঠিক করি ঘুরতে যাব। অনেক ভেবে ঠিক হল মুসৌরি, ওখানে লেকের কাছে হোটেল মাউন্টেন ভিউতে উঠলাম। কি সুন্দর জায়গা, আমাদের সবার মন ভরে গেল। সেদিন বিকেলে হঠাৎ হোটেলের ফোনে থেকে একটা কল এল।
“স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে চায়, বলছেন কিছু অন্টিক জিনিস নিয়ে আলোচনা করবেন। আমি ওনাকে বলেছি আপনি কারুর সাথে এখন দেখা করতে চান না কিন্ত উনি বলছেন খুব দরকার”।
আমি ঘুরতে এসে ব্যাবসা নিয়ে কথা বলা খুব একটা পছন্দ করি না । সেদিন যে কি মনে হল লোকটার সাথে কথা বলতে রাজি হয়ে গেলাম। দরজা খুলে দেখলাম একজন ফর্সা, রোগা, লম্বা ভদ্রলোক , মনে হয় পঞ্চাশ এর কাছাকাছি বয়স, নাম বললেন সন্দীপ বর্ধন ।
প্রথমে আমাকে নিজের পরিচয় দিলেন। ভদ্রলোক একজন ভূতত্ত্ববিদ এবং উনি সরকার এর হয়ে অনেক সাইট এ গিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক জায়গা থেকে জিনিষ সংগ্রহ করেছিলেন। উনি আমাকে বললেন একবার ওনার সাথে ওনার বাড়ি যেতে কারণ ওনার কালেকশন থেকে কিছু জিনিষ উনি আমায় দিতে চান “এস এ গিফট”।
আমি বেশ অবাক হলাম এবং বললাম যে আমি অন্টিক কিনে বেচি। এটা শুধু আমার ব্যাবসা নয়, এক রকম শখ বলা যেতে পারে সুতরাং আমি উপহার নিতে পারবো না। এটা ছাড়াও আমি সর্ত দিয়েছিলাম যে যেটা উনি দেবেন আমার পছন্দ না হলে আমি নেব না। উনি আমায় বললেন যে ওনার শেষ ইচ্ছা হচ্ছে এই জিনিসটা আমাকে দিয়ে যাওয়া। উনি নাকি জানেন যে উনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না।
পরের দিন বিকেলে ওনার বাড়িতে গেলাম। এরকম লেকের ধারে এত সুন্দর বাড়ি আগে কখনও দেখিনি । ওনার বাড়ি পরিপাটি করে সাজানো অথচ উনি একাই থাকেন বললেন। কিছু ছবিতে দেখলাম ওনার স্ত্রী আর মেয়েকে, কিন্তু উনি বললেন কিছু বছর আগে বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে দুজনের একই দিনে মৃত্যু হয়। “ It was an accident”, আমি সেদিন বাড়িতে ছিলাম না।
ভীষণ খারাপ লাগছিল মানুষটার জন্যে, আর তাই বোধহয় মায়ার বসেই এক রকম ওনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
“ কি বলেছিলেন? একজন অজানা লোক এভাবে তোমাকে ডেকে একটা জিনিষ দিল কেন? তোমাকেই কেন?”
“সেইটাই তো আগে বুঝিনি রে! তাহলে .. কখনোই ওনার কথা মেনে নিতাম না। হায় ভগবান! কি ভুল করলাম”।
“কেঁদো না… খুলে বলো সব কিছু”।
“লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে অনেক কিছু দেখছিলাম যেমন মুঘল আমলের হাত পাখা, হরপ্পার মেয়েদের চুল বাঁধার জিনিষ, কিছু রাজাদের কাপড় ও শাড়ি। এই বার উনি আমায় ওনার বেডরুমের ঘরের আলমারি থেকে একটা বাকসো বের করে খুলতে বললেন। আমি দেখলাম ওটা হাতির দাঁত ( আইভরি) থেকে তৈরি করা, বাকসোর গায়ে খুব সুন্দর কারুকার্য করা ছিল, আস্তে করে খুলতেই ভিতরে দেখলাম একটা সাদা আর লাল রঙের পাথর দিয়ে তৈরি করা মেয়েদের গলার হার। উনি বললেন, “ এটা আমাকে স্যার রবার্ট ব্রাউন দিয়েছিলেন আস এ প্রেজেন্ট ফর মাই ওয়েডিং। এই হারটা রুবি আর হিরে দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এবং এটির অধিকারিনী ছিলেন ওনার মা মানে মিসেস মারিয়া ব্রাউন। ওনার শেষ ইচ্ছা ছিল ওনার মৃত্যুর পর এই হার ওনার ভাগ্নি মানে আমার স্ত্রী পাবে। প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারি নি। আমার স্ত্রী এই হারটা দেখে খুব চমকেছিলেন এবং এটা সব সময় আলমারিতে তুলে রাখতেন। তবে আমার মেয়ে একদিন এটা নিজে থেকে নিয়ে পড়ে ফেলে আর তারপরই আমার সব শেষ হয় যায়”।
“মানে? এই হার পড়লে কি হয়?”
“এই হার … অভিসপ্ত! দেখুন মিস্টার শতদ্রু আমি এটা আর আমার কাছে রাখতে চাই না। আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি এটা কাউকে দিয়ে দিন এবং এটা আপনার ফ্যামিলির কাউকে দেখবেনই না। আপনি এটা একটা ঠিকানায় পৌঁছে দেবেন আর এই চিঠিটা ওখানে গিয়েই পড়বেন এবং যেমন বলা আছে করবেন।“
“ কিন্তু একটা কথা আমি বুঝলাম না যে আপনি কি অভিশাপের কথা বলছেন?”
“আমি যেটা জানি সেটা বলছি তোমায়। মিসেস মারিয়া ব্রাউন খুব গয়না পড়তে ভালোবাসতেন। ওনার স্বামী ওনার জন্যে বেছে বেছে বিভিন্ন রকমের অলঙ্কার কিনে এনে দিতেন। সেটা ছাড়াও অন্য কারুর কাছে কোনো ভালো অলঙ্কার দেখলে মারিয়া ম্যাডাম সেটা নিতে চাইতেন। একবার ওনারই প্রতিবেশীর একটা হার ওনার ভালো লেগে গেছিল। উনি অনেক টাকা অফার করলেও ওই মহিলা হারটা ওনাকে দিতে চান নি। এরপর লোকের মত অনুযায়ী এর কিছুদিনের মধ্যেই ওই মহিলা এক অজানা জ্বরে হঠাৎ মারা যান তারপর ওই হার কি করে মারিয়া ম্যাডাম এর কাছে এলো কেউ জানত না। তবে লোকে বলে উনি শয়তান এর সাধনা করতেন। ওনার ঘর থেকে কিছু মন্ত্রপূত পুতুল পাওয়া যায় তার থেকেই প্রমাণ হয় উনি কিছু একটা জাদু বিদ্যা জানতেন।
এই হার পাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় বিপত্তি। প্রতি পূর্ণিমার রাতে এই হার পড়ে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। উনি কোথায় যেতেন কেউ জানত না কিন্তু যেদিন উনি বেরিয়ে যেতেন তার পরের দিন অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ির বাগানে পাওয়া যেতেন। এই ঘটনার তিন দিন পরে কেউ না কেউ অবশ্যই মারা যেত।“
“ওনার কথা শুনে একটু ভয় লেগেছিল কিন্তু ভাবলাম যদি ওনার কথা মতন জায়গায় পৌঁছে দিতে পারি তাহলে ওনার একটু সাহায্যও হয়ে যাবে। তা ছাড়া আমার কৌতুহল হচ্ছিল এটা জানতে যে ওই চিঠিতে কি লেখা ছিল। এছাড়াও উনি আমায় আরো কিছু জিনিষ দিয়েছিলেন যে গুলোর ভাল দাম পেতাম। আমি ওই হার ঘরে নিয়ে এলাম। বউ আর মেয়েকে বেশি কিছু বলিনি।
পর্ব দুই … আসছে