Jagori Sarkar

Horror Crime

3  

Jagori Sarkar

Horror Crime

মনি

মনি

7 mins
308


“মা চা দাও”, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সাবুর প্রতিদিনের প্রথম কথা। সাবু যাকে বলে পাক্কা বাঙালি। সকালে উঠে চা খাওয়া তারপর দাঁত মেজে, চান করে বসে জলখাবার খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়া। উঠে পড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েই দমদম স্টেশন থেকে সকাল নয়টার মেট্রো ধরে অফিস যাওয়া। সারাদিন কাজ তারপর দুপুরে প্রতিদিন মাছের ঝোল ভাত ক্যান্টিনে বসে অন্য কর্মচারীদের সাথে গল্প করা মানে ওই পরও নিন্দা পরও চর্চা করা। শেষ কিছু কাজ সেরে সন্ধ্যে সাতটার মেট্রো ধরে আবার বাড়ি ফেরা।


          গার্লফ্রেন্ড? না এই জীবনে বোধয় কোনো মহিলাকে ভালোবাসা মানে সোজা কথা প্রেম করা হলো না। মা সব সময় সাবুকে বোঝায় , “এবার একটা ভালো দেখে বৌমা আন বাবা। আমরা এরপর চোখ বুজলে তোমার কি হবে? কে দেখবে? আমার বড় চিন্তা হয়”।


“মা, এত ভেবো না। সময় মতন সব হবে।ভালোবাসাটা ভাগ্যের ব্যাপার, কে কার কপালে কেউ জানে না।“

এই সাবু মানে আমাদের সঞ্জীব ব্যানার্জীর জীবনেও প্রেমিকার আগমন হলো। এক ভরা বর্ষাকালের বিকেলে সাবু অফিস থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিল মেট্রো স্টেশনের দিকে। ছাতা বার করে মাথায় দিতে দিতে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো এক সাধারণ সুন্দর নারীকে। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, আলুথালু চুল, পানের মতন মুখ আর হালকা লাল লিপস্টিক দিয়ে রাঙানো ঠোঁট।


             সাবু কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেই দিকে। “সাবু এই সাবু.. দেখে দেখে”, বলে হাত ধরে টান দিল পল্টু। সম্ভিত ফিরতে সাবু চোখ পড়ল সামনের ম্যানহোলের দিকে। ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে এলো সে।

 “কি করছিস বস্!”

“ ওই মানে..”

“কি দেখছিলি এমন করে?সামনে ফাঁকা মেট্রো গেট। তাড়াতাড়ি চল! রাস্তাঘাটের যা অবস্থা কলকাতা ভাসবে!”

সামনের দিকে তাকালো সাবু। সত্যি কোথাও কিছু নেই। সে কোথায় গেল কিছু বোঝার আগেই.. যায় হোক। পল্টুর সাথে স্টেশন এ এসে ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরলো। রাস্তায় পল্টু অনেক কিছু বলছিল কিন্তু কোনো কিছুই যেনো কানে যাচ্ছিল না। বার বার ওই মেয়েটাকে মনে পড়ছিল।

“কি হয়ছে বল তো তোর? কি এত ভাবছিস?”

সাবু কায়দা করে কথা ঘুরিয়ে দেয়। যাই হোক পল্টু কিছু বুঝতে পারে না আর সাবু পল্টুকে কিছু বলে না। বাড়ি এসে সাবু খেয়ে উঠে কিছুক্ষণ ফেসবুক করে।

      ফেসবুক দেখলে ভারী রাগ হয়। সবাই ছবিতে হাসছে আর বাড়িতে শুধু ঝগড়া করে। প্রকৃত সুখ কি কেউ জানেও না। ফোনটা রেখে টিভি খুলে বসে ছিল। খবর শুনছিল, হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। সামনে নম্বরটা অচেনা তবে ট্রু কলার এ দেখালো লেখা আছে মনিহারা দাস। এরকম কাউকে সে চেনে না তাহলে কি ভুল করে?

“হ্যালো! কে?”

কোনো সাড়া নেই শুধু কেউ যেনো জোরে জোরে সাস নিচ্ছে।

“হ্যালো! কি ..”

“আপনার পাস…সের.. বা!!”

সাবু ফোন টা কেটে দিয়ে আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করলো না। ঘর থেকে ছুট্টে গেলো পাশের বাড়ির দিকে। কোন বাড়ি বুঝতে অসুবিধে হলো না কারণ বাইরে বেরোতেই সে দেখতে পেল জানলার সামনে দাড়িয়ে কেউ চেচাচ্ছে।

“ হেল্প! হেল্প!”

এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সে ডোর বেল বাজাল। দরজা খোলাই ছিল। ভিতরে গিয়ে দেখতে পেলো সেই মেয়েটিকে। মাটিতে পড়ে ছোটফট করছে সে।

“আমার ইনহালেরটা.. ওই আলমারিতে..”

সাবু তাড়াতাড়ি আলমারি খুলে ইনহেলারটা ওর মুখের কাছে ধরলো। দুবার মুখে দিয়ে টানতেই সে একটু স্বস্তি পেল।

“ধন্যবাদ.. আপনি আজ না এলে! আমি আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত”।

সাবু সেই কথাগুলো বোধয় শুনতেই পাচ্ছিল না। এক ভাবে শুধু তাকিয়েছিল মেয়েটির দিকে। সত্যি কি ওর প্রথম দেখায় প্রেম হয়ছে? নাকি শুধু একটা ভালোলাগা? স্বপ্ন না সত্যি আজ বিকেলে দেখা সেই নারী ওর সামনে বসে আছে?

“কি হলো?”

“না, মানে কিছু না..আপনি ঠিক আছেন তো?”

মিষ্টি হাঁসিতে ফেটে পরলো মেয়েটি। সাবু যেনো মন্ত্র মুগ্ধের মতন তাকিয়ে ছিল তার দিকে।

“চা খাবেন?”

“হুহ.. না না থাক। আপনি একটু শুয়ে থাকুন। আমি বাড়ি যাই। এত রাতে এভাবে আপনার বাড়িতে লোকে দেখলে কিছু বলতে পারে”।

“ চা খাবেন কি না বলুন না?”

সাবু আর কিছু বলে না। মেয়েটি উঠে গিয়ে রান্নাঘর থেকে চা করে এনে ওর হাতে দেয়। সাবু চা খেতে খেতে ওর দিকে তাকালে মেয়েটি বলতে শুরু করে,

“আমি এই পাড়ায় নতুন এসেছি। আমার নাম মনিহারা দাস”।

“হ্যাঁ জানি… মানে ওই ট্রু কলার এ দেখলাম।“

আবার খিল খিল করে হেসে উঠলো মনি। “আপনি বেশ মজার মানুষ”।

“আচ্ছা একটা কথা… মানে আমার ফোন নাম্বার টা .. আপনি কি করে?”

“পাশের বাড়ির লোকের নম্বর নিয়ে রাখতে হয় মশাই!”

সাবু এবার চা এর কাপ টা রেখে উঠে পড়ল। নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। সত্যি মেয়েটার কিছু একটা ব্যাপার আছে। সাবু মোটামুটি হাবুডুবু খাচ্ছে। পরের দিন দুপুরে ক্যান্টিন এ দেখা হলো পল্টুর সাথে। সব শুনে পল্টু খুব খুশি।

“ বস্!ডুবে ডুবে জল খাচ্ছো দেখছি!চালিয়ে যাও!”

“দুর! এতে ডুবে ডুবে জল .. মানে আমি..” কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ফোন টা বেজে উঠল।

স্ক্রীন এ দেখা যাচ্ছে সেই নম্বর.. মনি। তারপর শুরু হলো রোজকার রুটিন।এক সাথে চা খাওয়া, মেট্রো ধরে কাজে যাওয়া, রাতে মাঝে মাঝে দেখা করা। সাবু শুধু পল্টুকে ছাড়া এই কথাটা কাউকে বলে নি। মা কে এখুনি কিছু বললে শুধু শুধু আশা করবে। তা ছাড়া একটু ভালো করে না জেনে এই ভাবে যদি মনের কথা মনি জানতে পারে হয়তো খারাপ ভাববে।

এই কদিন ধরে মনি কে অনেক ভালো করে চিনতে শুরু করেছে সাবু। মনিহারার পৈতৃক বাড়ি গাইঘটাতে, সেখানে তার মা, বাবা আর পিসি থাকে। তারা সাধারণ গ্রামের মানুষ ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল তাই ও বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসে। মহাত্মা গান্ধী রোড এ একটা মোবাইল রিপেয়ার সেন্টার এ চাকরি করছে। এখানে ভাড়া নিয়ে একাই থাকে। মোটামুটি যা রোজকার হয় তাতে ওর খরচ চলে যায়।

“তুমি কত দিন চাকরি করছো?”

“প্রায় এক বছর হবে। এর আগে আমি শ্যামবাজার a থাকতাম”।

“ তাহলে এখানে এলে ?”

“ মেট্রো স্টেশন টা এখন থেকে কাছে তাই সুবিধা হয়"।

এই ভাবে প্রায় এক বছর কেটে গেল। দুজনের ভালই মনের মিল ছিল। তবে কিছু অদ্ভুত জিনিষ একটু সাবু কে ভাবাচ্ছিল। প্রথমত যে বাড়িতে মনির ফ্ল্যাটটা ছিল সেই বাড়িতে খুব কম লোকজন থাকতো। আসে পাশে ফ্ল্যাট এর লোকজন খুব একটা এই দোতালায় আসতো না। নতুন করে বাড়িটা তৈরি হয়েছিল সেটা একটা কারণ হতে পারে।

 

মনির কোনো ফোন কল আসতো না। কেউ কি ওর খোঁজ রাখে না। এমন কি ওর অফিস থেকেও না। তবে সেটারও কারণ হতে পারে যা অন্য সময় হয়তো  যখন ও থাকে না তখন কথা বলে। বাড়ির লোক রেগে আছে তবে বাড়িওলা কেও তো কখনো দেখে নি। সব চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো রাস্তাতে যখন ওর বন্ধুরা থাকে মনিকে ডাকলেও মনি আসতে চায় না।

কিছু বললে বলে,"না না.. আমি কারোর সঙ্গে দেখা করতে চাই না। আমার মা বাবা আমায় খোঁজে লোক লাগিয়েছে। কেউ বলে দিলে আমায় আর এখানে থাকতে দেবে না। আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। আমি অচেনা কারোর সামনে যাবো না”।

সাবু ওকে আজ কাল বলাই ছেড়ে দিয়েছে। তবে এবার একটা কথা ও মনে মনে ভেবে নিয়েছে। মনিকে ও বিয়ের জন্যে বলবে। মনি না বললেও ও ওকে বোঝাবে যে বিয়ের পরেও ও কাজ করতে পারবে। ভাড়া থাকতে হবে না এমন কি ওর মা বাবা কেও মানিয়েই নেবে সাবু।

সেদিন বিকেলে সাবু মনির সাথে ওর বাড়ি গেলো। চা খেতে খেতে বলে দিল মনের কথা।

“দেখো মনি অনেকদিন তো হলো এবার বাড়িতে জিজ্ঞেস করছে। রোজ রোজ দেরিতে ফিরি .. তাই। বিয়ের ব্যাপারে তুমি ভেবো না , সব দায় আমার। তোমার পরিবার এর সবাই কেও আমি ঠিক মনিয়েই নেবো”।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মনি সাবুর দিকে তারপর বললো,” বিয়ে? সাবু.. আমি মানে দেখো এই তো বেশ ভালো আছি। বিয়ে হবে না হয়.. এক্ষুনি এই কথাটা থাক!”

“ না না .. তুমি চাপ নিও না। ভালো করে ভেবে.. আসলে বাড়িতে বার বার জিজ্ঞেস করছে? কি বলবো?”

এরপর আর কথা বাড়ালো না। সাবু চলে গেলো কিন্তু মনে একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। এই ভাবে আরো অনেক দিন পেরোলো কিন্তু কোনো মতেই মনি বিয়েতে মত দিচ্ছিল না। সাবু নিরুপায় হয়ে একদিন মা কে সব খুলে বললো।

মা শুনে চমকালো। “দেখ বাবা একটা কথা অনেকদিন থেকে বলবো ভাবছিলাম। দেখ.. পাড়ার লোকে বলছে তুই যে বড়তে যাস সেটা ভালো না”।

“কেনো মা?”

“সে ঠিক জানি না বাবা। ওই বাড়িতে যারা ফ্ল্যাটে থাকছে তারা সুধা মানে রান্নার মাসীকে বলেছে যে দোতলার ফ্ল্যাটটা সারাদিন এমন কি রাতেও তালা দেওয়া থাকে। তোকে ওখানে যেতে দেখে অনেকে ডেকেছে। তুই নাকি কারুর কথা শুনতেই পাস না। ওরা এটাও বলেছে যে একটি মেয়েকে মাঝে মাঝেই দেখা যায় ওখানে। হঠাৎ যেনো হওয়ায় মিলিয়ে যায়। তুই যাস না ওখানে !”

“ মানে? তুমি কি বলতে চাইছো? আমি এই সব মানি না । আমি মনি কে ভালোবাসি। মনি আমায়.. না না!”

এরপরের দিন সাবু সারাদিন মনির ফোন তোলে নি। সে সব কিছু পল্টু কে খুলে বলল।

“হ্যা কিছু গন্ডগোল নিশ্চই আছে! তুই ওর অফিস এ গিয়ে খোঁজ নে”।

“ যদি কিছু মনে করে .. মানে জানতে পারলে?”

“ তুই চল তো!”

এবার দুজন মিলে গেলো মনির অফিসে। তারপর যা শুনলো হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার যোগাড়। সেটা বলার আগে এর পরের ঘটনাগুলো বলে নি। পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে ঢুকলো দোতালায় মনির ফ্ল্যাটে। ওখান থেকে অনেক খোঁজার  পর দেওয়াল ভেঙ্গে উদ্ধার করা হলো এক কঙ্কাল। সম্ভবত কোনো মহিলার। মনির বাড়িতেও খবর দেওয়া হলো এবং গ্রেফতার হলো বাড়িওলার ছেলে মহেশ সাহা।

“ আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে মনি পালিয়ে এসেছিল কলকাতায় কাজ এর সন্ধানে। চাকরি সূত্রে তার পরিচয় হয় মহেশ এর সাথে। মহেশকে খুব ভালোবাসত মনি এবং ওদের বিয়েও ঠিক হয় যায়। একদিন দুজনের মধ্যে অফিসের কোন অন্য কর্মচারিকে নিয়ে খুব ঝগড়া লাগে। রাগ এর মাথায় একটা ফুলদানি ছুঁড়ে মারে মহেশ। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই সব শেষ। ভয় পেয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে লাশ দেওলের পেছনে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল”।

“ সাবুদা তোমায় মহেশের সম্পর্কের কথা তো অফিস এর কর্মচারীরা জানিয়েছিলেন। খুনটা সে করেছিল?”

“পুলিশ লাশ পোস্টমর্টেম করে একটা জামার টুকরো পেয়েছিল মেয়েটির হাতে। সেটা মহেশ বাবুর বাড়িতে খুঁজে পাওয়া গেছিলো। মহেশ বাবুও নিজের দোষ স্বীকার করতে বাধ্য ছিল। যে দিন আমরা পুলিশ এর সাথে ওখানে যাই মহেশ বাবু কে দেখে মনে হলো অনেক দিন শান্তিতে ঘুমান নি। পুলিশ ওনাকে মানুষিক ভাবে অসুস্থ বলে অ্যাসাইলাম এ রেখেছে।

“মনি কে আর কখনো দেখেছো দাদা?”

“ মন কে মাতিয়ে গেলো সে

  জীবন ছুয়ে গেলো সে

  আসেনা কভু আর

 ভালোবাসি যারে আমি

    সকল দুঃখ ভুলি

  চলে গেছে পারা পার

আমার চোখের মনি সে

আছে মনে মনে

মনিহারা নাম হলেও হারায় নি

সামনে …সপনে”

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror