কল্পণা
কল্পণা
বাজ পড়ার শব্দটা কান কে ছুয়ে গেল। চিঠিটা হাতে নিয়ে জানলার দিকে তাকাল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে যেন এক অজানা অনুভূতিকে আমন্ত্রণ করছে। উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করল শতরূপা। ঘরের ভিতরে থেকেও মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিছু না বলা কথা মনে পড়ে গেল।
সঞ্জয়কে সেদিন প্রথম দেখেছিল হালকা শ্যমলা রঙ,সুপুরুষ চেহারা, সাদা রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট । “মে আই কাম ইন স্যার?”, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল। সঞ্জয় হয়তো ওকে দেখে অতটা মুগ্ধ হয়ে নি। তারপর রোজ এক সাথে কাজ করতে করতে কখন যে কাছে এসে গেছিল বুঝতেই পারে নি।
বেল এর শব্দে সম্বিত ফিরে পেল শতরূপা। সে এসেছে আজও ! ওর জন্যেই এসেছে। এত বৃষ্টি, ঝড় কোনো বাঁধাই যেন ওকে আটকাতে পারবে না । আজ শেষ দিন, কাল শুধু মুক্তি! মুক্তি! কোন দিকে না তাকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে, যেন এক অজানা ডাক তাকে নিজের দিকে টানছে ।
“ রূপা! রূপা! আর আর দেরি করো না! না! না! এসো.. তাড়াতাড়ি এসো! “
দরজাটা যেন শুধু খুলে যাওয়ার অপেক্ষায় বসে ছিল। শতরূপাকে সে নিতে এসেছে। সঞ্জয়কে ভালোবেসে সুখী হয়নি রূপা। সব সময় ঝগড়া, সাংসারিক কলহ শুনে শুনে আর ভাল লাগে না। আজকাল ওর সাথে দেখাও হয় না। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর থেকে সব কেমন বদলে গেল।
“চল ..”,দরজা খুলতে গিয়ে হঠাৎ মাথায় জোরে আঘাত, আর কিছুই দেখতে পেল না রূপা। শুধু রক্তে ভেসে গেল বাড়ির বাইরের মেঝে।
“রূপা! রূপা!”, চোখের জলে ফেটে পড়ল সঞ্জয়। কি ভুল সে করেছে এখন বুঝতে পারছে।
“ আই অ্যাম সরি মিঃ বোস… আপনার স্ত্রীকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না”, ডক্টর সুনীল পাকড়াসি এই কথাটা বলে চলে গেলেন। সঞ্জয় হতবম্ভের মতন শুধু তাকিয়েছিল। কোনদিন বুঝতে পারেনি যে রুপাকে সে এতটাই ভালোবাসত। রূপা আজ আর নেই এটা ভেবে শুধু মনে হচ্ছে রুপাকে সেই খুন করেছে। নিজে হাতে খুন! খুন!
সব কথা মনে পড়ে গেল, রূপার সাথে আলাপ হওয়ার পর থেকে জীবনটা কেমন যেন বদলে গেল। শতরূপা সব রূপ সে দেখেছে, কি সুন্দর দুর্গা প্রতিমার মতন গড়ন, সুশ্রী, সৌম্য নম্র ভদ্র মেয়ে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম কাজে মন বস্ত না । দুজনেই এক সাথে অনেক রহস্য সমাধান করেছে ।
শতরূপা সিকদার একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। অনেকদিন ধরেই পুলিশের সাথে কাজ করেছিল। ওই ভাবেই আলাপ হয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনের পুলিশ সঞ্জয় বসুর সাথে। কত কথা, কত গল্প, প্রায় পাঁচ বছরের সম্পর্কের পর বিয়েতে মত দিয়েছিল সঞ্জয়।
শতরূপা সব সময় এটাই ভাবত যে এক তরফা ভালোবেসেছে। সঞ্জয় বসুর কঠিন মনের ভিতর ঢুকতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল। তবে একটা কথা সে কখনই ভাবেনি। সব সময় তাকে ছোট শিশুর মতন আগলে রেখেছিল সে। রূপা কোন মিশন এ গেলে সব সময় আড়ালে খবর রেখেছে সঞ্জয়। কোনদিন রুপাকে বুঝতে দেয়নি যে ওর কঠিন শরীরটার মধ্যেও একটা মন আছে। গভীরে গেলে সেই মনকেও ছোঁয়া যায়।
তারপর একদিন দুজন প্রথমবার ঘনিষ্ট হয়েছিল এক দুর্যোগের রাতে। জীবন যেন পাল্টে গেছিল। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লেগেছিল।সঞ্জয় ভয় পেত সম্পর্কের বন্ধনকে। একজন পুলিশ অফিসার এর জীবনটা সুন্দর করে সাজাতে গেলেও ভয়। সত্রুর অভাব নেই। নিজের মা বাবাকে পাঁচ বছর আগে চোখের সামনে মরতে দেখেছে।
বিয়ের পর পর সব ভালো হতে লাগল। আরো অনেক কেস এক সাথেই সলভ করেছে ওরা দুজন। তবে আবার সমস্যা হল রূপা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর।
জন্ম দিয়ে হাত ধরে
চলতে শেখাও পথে
বাবা তুমি যে বুকে আগ্লাও
কাঁটা বিধিয়ে পিঠে
মা হয়ে রূপার এক অদ্ভুত সমস্যা দেখা দিতে লাগল। সব সময় ভয়, কিসের ভয় বলত না। এক অজানা আতঙ্ক যেন তারা করে বেড়াত। সঞ্জয় যে পুলিশ সেটা বোধয় আর রূপা বুঝতে পারত না। প্রত্যেক দিন কাজে বেড়িয়ে সঞ্জয়কে অনেক বার ফোন কল, ফোন না তুললে রাতে বাড়ি ফিরে তুমুল ঝগড়া।
সঞ্জয় ওকে আবার কাজে নেমে পড়তেও বলেছে, কোনো লাভ হয়ে নি। শেলীকে নিজের থেকে আলাদা করতেই চাইত না। সব সময় এক কথা, “ পুলিশের চাকরিটা ছেড়ে দাও। অনেক শত্রু আছে, শেলির যদি কিছু.. আর তোমারও .. না! না! আমি কি নিয়ে বাঁচব। ও আমাকে নিয়ে যাবে, ও! ও! এখানেই আছে। আমি যাবো না! না! ..”।
“ কি যাতা তা বলছ বলত! শেলীকে কেউ ছুঁতে পারবে না। আমি কথা দিচ্ছি , আর আমি চাকরি ছাড়লে সংসার কি করে চলবে। তুমিও তো আজকাল কিছুই করো না। সব সময় মেয়ে আর মেয়ে। শেলীকে আমিও ভালোবাসি রূপা তা বলে তো আর বাড়িতে বন্দি করে রাখা যায় না। আর কে আসবে তোমায় নিতে! কি বলছ কিছুই বুঝলাম না!”
এরপর কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় করত। রোজ এই কষ্ট সহ্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। যত দিন যাচ্ছিল তত ওর পাগলামিটা যেনো বেড়েই যাচ্ছিল। তারপর একদিন শেলী একটা কার অ্যাক্সিডেন্টে.. আবার সব শেষ।
দূরত্বটা এতটাই বেড়ে গেছিল যে মুখ দেখা দেখি প্রায় বন্ধ ছিল। সঞ্জয় অনেক রাতে বাড়ি ফিরত আর ভোর বেলা বেরিয়ে যেত। এর মধ্যে দু একদিন একটা দুটো মিসড কল দেখেও ফোন করেনি রুপাকে।
মনের চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছিল সেই সময় ফোনটা বেজে উঠল। “ স্যার! ম্যাডামকে খুন করা হয়েছে। মাথার উপর কিছু একটা শক্ত জিনিস এর আঘাতেই.. স্যার আর একটা কথা ছিল.. কল্পণা কে স্যার? ম্যাডাম এর মুখের ভিতর থেকে একটা চিঠি পাওয়া গেছে”।
“ আমি আসছি”, বলে ফোন কেটে দিল সঞ্জয়। মনের ভিতরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। তাড়াতাড়ি করে ডিপার্টমেন্ট এ ঢুকে দেখল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।
“ চিঠিটা দাও”।
সাবিনস্পেক্টর সুবিনয় ঘোষ এগিয়ে দিলেন সেই চিঠি।
“প্রিয় রূপা,
তোমার সাথে বন্ধত্ব হওয়ার পর থেকে জীবনের এক অন্য মানে খুঁজে পেয়েছিলাম। এত স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে আমায় আগলে রাখতে তুমি। সব সময় এক সাথে চলেছি আমরা। তোমার শুধু মন না শরীরের ও অঙ্গ ছিলাম তাই কোনদিন তোমার থেকে আলাদা হবো ভাবতেই পারি নি। আমরা যে যমজ, জন্ম থেকে দুটি জোড়া শরীর এবং দুটি মাথা। সব সময় তোমার সব কাজ আমিই করতাম।
কতবার তোমায় বাঁচাতে গিয়ে বিপদকেও হারিয়েছিলাম। মা বাবা সবাই তোমাকে বুদ্ধিমতী ভাবত। আমি ছিলাম তোমার সব থেকে বড় বন্ধু আর তুমি কি না আমকেই!
সেদিন রাতে তুমি আমায় বললে, “ এটা ঠিক হচ্ছে না। তুই সব কাজ করবি আর আমি রং নেব। আমি নিজেই পারি নিজেকে দেখতে। তোকে আমার লাগবে না। এবার হয় তুই মরে যা নয় আমিও মরে যাব”।
সেদিন আমি নিজেই তোর জন্য বিষ খেলাম। মরে গিয়ে তোর শরীর থেকে আমি বাদ পড়লাম। তোর জন্যে নিজের জীবন দিয়েছিলাম কিন্তু তুই তাতেও শান্তি পেলি না।
রহস্য সন্ধানী হওয়ার ইচ্ছা আমার বরাবর ছিল এটা তুই জান্তিস তাই আমাকে আবার ডাকলি। রোজ আমায় আসতে বলতিস। আমি তোর কাছে না এসে পারতাম না রে। প্রতিদিন তোকে অনেক সাহায্য করেছিলাম। তুই তো ভালোবাসতেই শিখিসনি। সঞ্জয়কে আমি ভালবাসতাম। ও শুধু আমার ছিল কারণ আমি যখন তোর কেস সলভ করতে যেতাম সঞ্জয় আমায় রক্ষ্যা করত। ও শুধু আমার! কিন্তু বিশ্বাসঘাতক! তুই এটা কি করে পারলি! তুই সঞ্জয়কে ভোগ করলি। আমি সেদিন এত কষ্ট পেয়েছিলাম যে বোঝাতে পারবো না। তান্ত্রিক বাবার দেওয়া মাদুলি পড়ে ভেবেছিলি আমায় তাড়িয়ে দিয়ে সুখে সংসার পাতবি। তোর খ্যাতি জস্ সব আমার দেওয়া।
তুই পাপিষ্টা! আমি সেইদিন থেকেই প্রতিশোধ নেব ঠিক করি। তুই ভুলে গেছিলি যে আমি কোনো সাধারণ প্রেত নই! তোর বোন রে! তোর যমজ জোড়া বোন!
তোকে বোকা বানাবো বলে তোর জীবনে আসি কল্পনার রূপ ধরে। কল্পনাকে আমি ক্ষতি করতে চাই নি তাই ওকে না জানিয়েই ওর শরীরে আমি ঢুকে যাই। তারপর তোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে আসতে আসতে তোর মনে বিষ ঢালতে থাকি। এতটাই বিষ যে তুইও বেঁচে থেকে মরার মতন জীবন কাটাবি।
তারপর একদিন তোকে বাধ্য করলাম মাদুলি খুলে ফেলতে। আর কল্পণা কেও প্রয়োজন ছিল না। তাই একদিন ওই তুই যখন গাড়িটা এতো জোরে চালাচ্ছিলি! হা! হা! হা! হা! তুই কিছু বোঝার আগেই তোর প্রাণাধিক প্রিয় মেয়ে আর কল্পণা ওর আয়া চোখের নিমেষে শেষ!
শুধু ভাবলাম তোকে আর একটু বেশি কষ্ট পেতে দেখতে চাই তাই এতটা আঘাত করি নি। আজ আমি খুব খুশি! তুই এবার আমার সাথে চলে আয় । সব শেষ হয়ে গেছে রে .. সঞ্জয় আর তোকে চায় না। আমি আসছি তোকে নিয়ে যেতে ।
ইতি,
রূপকথা সিকদার”
“স্যার এরা কারা! আমি তো কিছুই? মানে ভুত?”
“আমি একটু একা থাকতে চাই”, বলে উঠে গেলেন সঞ্জয়।
মাথার মধ্যে অনেকগুলো চিন্তা ঘুরছিল। ফোন টা হাতে নিয়ে কল করলেন, “হ্যালো… আমার আপনার সাথে কথা ছিল”।
ডাক্তার অনিল ঘোষের ক্লিনিক এ ঢুকে কান্নায় ফেটে পড়ল সঞ্জয়। “ পারলাম না ডাক্তার .. শেষ রক্ষা হলো না”।
একটু জল খেয়ে শুরু করল সঞ্জয়, “ প্রথম প্রথম ব্যাপারটা ধরতে পারি নি কিন্তু যখন ও পুলিশের সাথে কাজ করত সম্পূর্ণ আলাদা একটা মানুষ আবার একা যখুন আমার সাথে থাকত তখন সম্পূর্ণ অন্যরকম। মনে মনে ভাবতাম কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস।
বিয়ের পর মাঝে মাঝেই নিজের সাথে কথা বলত। অনেক সময় জিজ্ঞেস করেছি বলত কল্পনার সাথে কথা বলছে। “কে কল্পণা?”, বলত, “ কল্পনাকে চেনো না? এতদিন ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে”।
অথচ কেউ কোথাও নেই। একদিন হঠাৎ কাজ থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে দেখি শেলী কে কোলে নিচ্ছে আবার নামিয়ে অন্য গলা করে একটা অন্য ভাষায়, তামিল হবে, কথা বলছে। কি অদ্ভুতভাবে একটা মানুষ নিজেকে এক মুহূর্তে একজন আর অন্য মুহূর্তে অন্য কেউ। সেদিন প্রথম ঠিক করলাম আপনার কাছে আসব”।
“ রূপা ওয়াজ সাফারিং ফ্রম স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার। এটি একটি মনের রোগ যাতে মানুষ নিজেকে অন্য কেউ ভাবতে শুরু করে। রূপার মধ্যে তিনটি মানুষ এর ট্রেট দেখা দিয়েছিল। কল্পণা, রূপা আর ওর বোন রূপকথা। ছোটবেলায় ওর জোড়া যমজ বোন বিষ খেয়ে মারা যায়। সেই থেকেই এই রোগের সূচনা। রুপাকে ওর মা বাবাও মাঝে মধ্যে অদ্ভুত আচরণ করতে দেখত ঠিক ওর বোনের মতন। আমি তখন থেকেই ওর চিকিৎসা করি শুধু তোমাকে কোনদিন ব্যাপারটা বলি নি। সব সময় তোমাদের বাড়িতে আসতাম আস এ ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। তাই সেদিন তুমি আমায় ব্যাপারটা জানিয়েছিলে।
তোমাকে ভালোবাসার পর থেকে ওর মধ্যে রূপকথা আর আসত না। ওকে মিথ্যা তান্ত্রিক সেজে মাদুলিটা আমি দিয়েছিলাম তা না হলে ওর মন থেকে রূপকথা কে ভোলানো যেত না। তবে তোমাদের মেয়ে জন্মানোর পর ও খুব ডিপ্রেসড থাকত। ওর মনে হতো যে তুমি ওর মেয়েকে মানে সিউলিকে ( শেলী) ভালোবাসোনা। তাই ওর মনে কল্পণা জন্ম নেয়। কল্পনার সাথে সব সময় থাকতে থাকতে ও অন্যরকম হয়ে যায়। হয়তো কখনো নিজেকেই বোঝাই যে মাদুলির আর প্রয়োজন নেই।
মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত! ও এবার ভাবতে শুরু করে রূপকথা ফিরে এসেছে। ওকে ডাকছে তাই সেদিন গাড়ির ব্র্যাক, ও, রূপকথা হয়ে ভেঙ্গে দেয়। যেহেতু গাড়ি চালাচ্ছিল শেলী তাই অ্যাক্সিডেন্টে ওই শেষ হয়ে যায়। তারপর আরো মর্মান্তিক জীবন কাটাতে শুরু করে। তোমাকে না পেয়ে ও রোজ রূপকথার অত্যাচার সহ্য করতে থাকে”।
“ কিন্তু ওই চিঠি?”, জিজ্ঞেস করল সঞ্জয়।
“ ওটা তো নিজেই লিখেছিল .. রূপকথা হয়ে”।
সঞ্জয় বাকিটা বলল, “দরজার পাল্লার সাথে শিলটা বেঁধে রেখেছিল। তারপর দরজা খুলতেই.. জোরে মাথায় আঘাত লেগে সব শেষ”।