মা
মা
মানুষের জীবনের কিছু ঘটনা এমন থাকে যার কোন সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। আমার ছোট বেলার একটা ব্যাপার ভাবলে আজ ও শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।
মা তুমি জন্ম দিয়েছ আমায়
ভালোবেসেছ প্রাণ ভরে
কখনো যদি হয় প্রাণ সংশয়
জীবন দিয়ে বাঁচাবে আমায়
আসবে ফিরে তুমি বারে বারে
শত্রু করতে বিনাশ
আমি যে তোমার সন্তান
মা গো
তোমায় করি বিশ্বাস
কলকাতার এক নাম না জানা হাসপাতালে জন্ম হয়েছিল আমার, আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে।মা বাবা ভালোবেসে নাম রেখেছিল আদৃতা। পুরো নাম আদৃতা সাহা। আমার যখন তিন বছর বয়স সেই সময় জন্ম নিয়েছিল আমাদেরই পরিবারের আর একজন সদস্য।
বেড়াল মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু কাল। এরা সুমিষ্ট মিউ ডাক দিয়ে মন জয় করে নেয় প্রায় সবার।আমরা বাঙালিরা পোষ্য বেড়াল টিকে সবাই খুব আদর করে থাকি।এই অত্যন্ত নিরীহ দেখতে প্রাণীটি কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং এর উদাহরণ আমরা বিভিন্ন সময় পেয়ে থাকি। আজকাল সোসিয়াল মিডিয়াতেও এদের কেরামতি প্রায়ই দেখা যায়। তা ছাড়া রূপকথার গল্পে যেমন পুস ইন বুটস থেকে শুরু করে গারফিল্ড কার্টুন হিসাবে বা সত্যজিৎ রায় এর প্রফেসর সঙ্কুর নিউটনকে আমরা সকলেই চিনি। কালো বিড়ালকে কেও কেও আবার শয়তান এর প্রতীক অথবা ডাইনির পোষ্য হিসাবেও মনে করে।
আমাদের পরিবারের যে সদস্য টির কথা বলবো সে আমার ছোট বেলার বন্ধু একটি বিড়াল, নাম মিনি। আমরা একসাথে মানুষ হয়েছি। মা যখন আমায় খাওয়াতো তখন মিনিকেও খেতে দিতেন। সকালে উঠে প্রথমে উঠোনে গিয়ে মুখ ধুতাম তখন মিনি আসতো গুটি গুটি। অনেক সময় ওকে বলতাম “ ছ্যা! দাঁত মজিস না কেনো ?”। মিনি কিছু বলতো না শুধু মাঝে মাঝে একটু করে মাথা নেড়ে চোখ টিপতো। তারপর স্কুল এ যাওয়া আর ফিরে এসে একসাথে খাওয়া।
সেদিন ছিল কনকনে শীতের রাত। খাওয়ার সময় শোনা গেলো সেই ডাক। মা শুনেই বুঝেছে মিনি এসেছে। দরজা খুলে দেখে সে প্রসব যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। মা ওকে ঘরের মধ্যে একটা জায়গায় কম্বল পেতে শুইয়ে দিল। সারা রাত জাগিয়ে সে প্রথম বার মা হলো।
ছোট ছোট ছানা গুলো কেমন যেনো নোংরা মতন। মা খুব আদর করছিল মিনি কে, ভীষণ মিষ্টি দেখতে হয়েছে নাকি ছানা গুলো। আদিখ্যেতা দেখে আমার মোটেই ভালো লাগলো না। খুব রাগ হয়েছিলো, মিনি বিয়েতে ডাকলো না, খাওয়ালো না। যাই হোক ক্ষমা করে দিতেই হলো। তিন মাসের হলো, তখন ছানা গুলো বেশ ভালো লাগতো আমার। মিউ মিউ করে বাড়ি মাথায় করতো। সাদা, কালো, হলুদ নামই ডাক হলো তাদের। সব ভালো ছিল, কাল হল, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে সনাতন দাস, নতুন ভাড়াটে আসার ব্যাপারটা।
সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা রাস্তায় বাস করা প্রাণনিদের ভালো চোখে দেখেন না। মিনিকে আমরা খেতে দিতাম তবে ও গৃহপালিত ঠিক ছিল না। বাড়ির উঠানে থাকতো এবং এক রকুম পাড়ার ই বেড়াল ছিল। কিছু মানুষ বাড়ির পোষ্যটিকে মাথায় করে রাখে কিন্তু অন্য কোনো প্রাণী রুগ্ন অথবা রাস্তায় থাকলে তাকে ঘেন্না করতে শুরু করে দেয়।সনাতন বাবুর কিছু অজানা কারনে বেড়ালের প্রতি অত্যধিক অনীহা এবং রাগ ছিল।
মাঝারি বয়সের রোগা গড়ন, লম্বা এবং চোখগুলো খুব তীক্ষ্ণ ও উজ্জল। বেশি ঘর থেকে বেরোতেনই না এবং বেড়াল দেখলেই কেমন যেনো ক্ষেপে গিয়ে তাড়া করতেন। টমি, এই ব্যাপারে ওনাকে খুব সাহায্য করতেন। এবার টমির কথাই আসি। গৃহপালিত পশু এবং ম্যানস বেস্ট ফ্রেন্ড কুকুর প্রাণীটি কিন্তু বেড়াল খুব একটা পছন্দ করে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে প্রাণীরা সাধারণত অহেতুক অন্য প্রাণীকে অসুবিধা করে না। তবে এই জার্মান স্যেপের্ড কুকুরটি এই নিয়ম মান্তই না। সম্ভবত মালিক এর প্রতি ভক্তি দেখাতেই হয়তো বেড়াল দের প্রতি একেবারেই সহানুভূতিশীল ছিল না।
মিনির সাথে প্রায়ই ঝগড়া লাগতো টমির। একদিন আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন সনাতন বাবু বললেন, “নমস্কার, আমার নাম সনাতন। আমি পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকি। আপনারা খুব বেড়াল ভালোবাসেন দেখছি। হে হে! আমার আসলে বেড়াল ঠিক পছন্দ নয়। আমার বাড়িতে টমি একদম বেড়ালদের দেখতে পারে না। আপনারা যদি খেতে না দেন তাহলে আর বেড়ালগুলো আসতো না। খুব উপকার হতো তা হলে। আসলে আমার টমি আগের বার একটা বেড়ালকে খুব বাজে ভাবে মেরে ফেলেছিল। রাস্তার নোংরা জির্ণ প্রাণী দেখলে টমি যেনো কেমন ক্ষেপে যায়। এর জন্যেই তো আগের পাড়া ছেড়ে এখানে এলাম। কতবার যে .. হে হে ! বুঝতেই পারছেন”।
বাঙালির ধর্মই হলো পাশের বাড়ির লোককে একটু সমঝে চলা। যদি কিছু মনে করেন, তা ছাড়া ভয় লাগে শুধু শুধু ঝামেলা করা উচিত নয়। মাকে অনেক বার বারন করার পরেও মা আর মিনিকে খেতে দিত না। উনি খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন যদি লোকটা বা কুকুরটা মিনি আর ওর ছানাদের ক্ষতি করে। মিনি অবলা জিব, সে বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা, তাই, আর আসতো না।
কিছু দিন পর একটা খুব মর্মান্তিক ব্যাপার ঘটলো। বাড়ির ঠিক বাইরে ময়লা ফেলার জায়গার এর সামনে গলা কাটা অবস্থায় মরে পড়ে ছিল মিনির তিন ছানার দেহাবশেষ। কেউ যেনো কেটে ছিঁড়ে দিয়েছে ছোট্ট শরীরগুলো। আমি খুব কেঁদেছিলাম এমন কি রাতেও কিছু খাই নি। কিছুদিনের জন্যে শিমলা বেড়াতে চলে গেছিলাম। মিনিকে রাস্তায় শেষ বার দেখেছিলাম, মন মরা হয় শুয়ে ছিল ।
যেদিন ফিরলাম প্রথম বার দেখেছিলাম টমিকে। বীভত্স কালো বিশাল বড় চেহারার কুকুরটির দৃষ্টিতেই কেমন যেনো নৃশংসতা দেখা দিল। খুব ভয় লেগেছিল ওকে দেখে, মাও ওকে ঠিক পছন্দ করতো না। মিনি তারপর থেকে অনেক দিন ধরে নিখোঁজ ছিল। শুনেছিলাম পাড়ার আরো অনেক বেড়ালই নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছিল তাই মিউনিসিপালিটির লোকদের ও জানানো হয়েছিল । টমি কে নিয়ে প্রচুর লোক থানায় পর্যন্ত রিপোর্ট করেছিল। লোকটার খুব জানা চেনা ছিল তাই প্রত্যেক বার বেচেঁ গেছে ।
এই ঘটনার ঠিক এক বছর পর এলো সেই দিন। আমি পুরো ব্যাপারটা মার কাছে পরে শুনেছিলাম। আমার স্কুলে নাচের প্রতিযোগিতা ছিল তাই বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। আমরা বাস স্টপে নামই রাত দশটার সময়।
“মা ভয় করছে”,আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
“কিছু হবে না বাবু, এই তো দশ মিনিটে বাড়ি পৌঁছে যাবো”।
“মা , টমি কিছু করবে না তো”।
“ না সোনা আমি আছি তো, এসো আমার সঙ্গে । কিছু হবে না।“
বর্ষাকালের এক ঝিরঝিরে হালকা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে।আমি আর মা রাস্তায় একা হাঁটছি । কেউ কোথাও নেই।চারিদিক এতটাই নিস্তব্ধ যে একটা পিন পড়লেও শব্দও হতো। কিছুদিন আগে থেকে আমাদের পাড়ায় অদ্ভুত ঘটনা ঘটছিল। প্রতিদিন রাতে মনে হতো কোনো বেড়াল কাঁদছে। আমরা অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোথাও কেউ ছিল না। ওই লোকটাও কদিন ধরে কুকুরটাকে নিয়ে খুঁজতো তবে কেউ কিছু পায় নি। বাবা একদিন দেখেছিল লোকটা ঘরে বসে ফোনে কথা বলছিল। “আমি কিছু বুঝছি না। কদিন ধরে টমির সারিরটাও ভালো নেই। ওই বেড়ালটা..”, দেখতে পেয়ে থেমে গেছিলেন উনি।
বাবা বাড়ি এসে মা কে বলেছিলেন যে কিছু একটা গন্ডগোল লাগছে। ওনার ঘর থেকে রাতে মাঝে মাঝেই ভয় পেয়ে চিৎকার করার শব্দ শোনা যায়। আমাদের পাড়ার লোকেরাও একই কথা বলেছে। তাই সেই রাতে আমারও খুব ভয় করছিল।
একটা বিশ্রী পচা গন্ধ ভেসে এলো। মা আর আমি দুজনেই নাকে চাপা দিয়ে সামনে তাকাতেই আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। জুলাই মাসের বৃষ্টি ভেজা দিনেও যেনো হঠাৎ ঘাম দিতে লাগলো।
আমাদের সামনে দাড়িয়ে ছিল টমি। চোখ দুটো টকটকে লাল, দাঁত মুখ খেছিয়ে একবার ডেকে উঠলো। ঘাড়ের কাছে একটা দগদগে ঘা, সারা শরীর থেকে কে যেন রক্ত সুষে নিয়েছিল। শুধু হারের উপর চামড়াটা বসানো। খুব রাগ এবং খিদেই চোটফট করছে প্রাণীটি। আমি মার কাছে সিটিয়ে গেলাম। এই বোধয় আমাদের দুজনকে খেয়ে ফেলবে, অনেক দিনের খিদে মেটাবে।
মা তাও একটু সাহস দেখিয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে কুকুরটাকে “ হ্যাট্ হ্যাট্!”,করেছিল। তাতে যেনো সে আরো ক্ষেপে গেল এবং আমাদের দিকে এগোতে লাগলো। আমি আর মা দুজনেই মাটিতে বসে পড়লাম। নিজের চোখে সামনে আসন্ন মৃত্যুকে দেখতে পেয়ে দুজনই কাঁদছিলাম। মাথা কাজ করছিল না। কাউকে যে চেঁচিয়ে ডাকবো, যেনো মাথায় আসে নি।
টমির হাথ থেকে সেদিন নিস্তার পেতাম কিনা জানি না তবে দেখলাম প্রাণীটি আমাদের পেরিয়ে চলে গেলো কিছু একটা জিনিষ লক্ষ্য করে। তখুন দুজনই ফিরে তাকালাম এবং হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমাদের ঠিক পেছনে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে আছে মিনি, সারা শরীর যেন হিংস্র একটা ভাবে ফেটে পড়ছে। শান্ত, জ্বলজ্বলে হলুদ চোখ গুলোতে আর ভালোবাসা নেই। খুব রাগে একবার ডাকলো, “ ম্যাউউউউউউউ ম্যাউউউউ…. গররররররর…”। টমি ওর কাছাকাছি পৌছতেই ঘটে গেল সেই ঘটনা। মিনি আর টমি জোরে গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল, যেন একে অপরকে ছিড়ে দেবে। প্রায় পাঁচ মিনট পরে অনেক জোরে চিৎকার করে টমি লুটিয়ে পড়লো মাটিতে, রক্তেরাক্তক্ত চতুর্দিক।
মা বলেছিল, “মিনি ছিল এক সন্তান হারা মা। জন্তুদের সাধারণত প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা বা সন্তান এর প্রতি স্নেহ বেশি হয় না। তবে যদি তার চোখের সামনে অন্যায় ভাবে কেউ তার সন্তান কে কেড়ে নেয় তখন তার চেয়ে ভয়ংকর প্রতিশোধ আর বোধহয় কিছু হয় না। মিনির ছানাদের আমরা তাড়িয়ে দিলাম তখন ওরা আশ্রয় নয় বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে আস্তাকুড়ের সামনে। এই কুকুরটি প্রায়ই সেখানে গিয়ে মিনির সাথে ঝগড়া করতো। একদিন মিনি যখন খেয়ে ফিরছিল সে দেখে তার চোখের সামনে সেই শিশুদের মাংশোচিরছিল এই টমি। তখনই মিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে কুকুরটির উপর কিন্তু ঠিক সুবিধা করতে পারে না। সনাতন বাবু বেরিয়ে এসে তাকে তাড়িয়ে দিয়ে টমি কে বাঁচিয়ে নেন।
এরপর একদিন টমির উপর হামলা করে মিনি। সনাতন বাবু ব্যাপারটা দেখে খুব রেগে যান এবং তখুনি চুরি চালিয়েদেন মিনির মাথা ভেদ করে। আমরা সেই সময় বেড়াতে শিমলা গেছিলাম তাই এটা জানতাম না আর পরে জানতে পেরেও তোকে বলি নি।
মিনি বোধয় ফিরে এসেছিল এবং রোজ রাতে কাঁদত তার প্রতি হওয়া অন্যায় এর কথা ভেবে। টমি কে নিয়ে সনাতন বাবু খুব মুশকিল পড়েছিলেন। কিছু খেত না, রাত হলেই কাঁদত, মাঝ রাতে প্রায়ই কামড়াতে আসতো। সারাদিন ওকে ঘরে বন্দী করে রাখতেন। উনি নাকি ঘরে মধ্যে বেড়াল দেখতে পেতেন। সেই দিন টমি কিছু ভাবে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে সনাতন বাবুকে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে। পুলিশ ওনার মৃতদেহটা ওনার ঘর থেকে উদ্ধা করেছিল”।
“সেদিন মিনি কেন এসেছিল মা?”
“মা হয়ে আর এক মায়ের কোল ফাঁকা হতে দিতে পারতো না, তাই"।