পূর্ণিমারাতের আতঙ্ক

পূর্ণিমারাতের আতঙ্ক

9 mins
515


#পূর্ণিমারাতের_আতঙ্ক

#অরিজিৎ_ভট্টাচার্য্য


নিজের গ্রাম বিশালগড়ে ফিরছে অর্চনা। অর্চনা রাও।রায়পুর কলেজের বি.কম থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। সেমিস্টার শেষে ফিরছে নিজের দেশের বাড়িতে।রাস্তার দুইপাশে ঘন শাল- সেগুন- পলাশের জঙ্গল। শন শন করে বইছে ঠান্ডা হাওয়া। দূরে জঙ্গলের গভীরে ডাকছে নিশাচর কোনো পাখি।থমথমে চারিদিক ,অদ্ভূত এক নীরবতা বিরাজ করছে।উপরে আকাশে গোল পূর্ণিমার চাঁদ,সমগ্র বিশ্বচরাচর ভাসছে রূপালী জ্যোৎস্নায়।সারা পৃথিবী যেন রূপোর চাদরে মোড়া! না, ট্রেনটা আজ ভালোই লেট করেছে, অনুভব করল অর্চনা। পৌঁছানোর কথা ছিল রাত সাড়ে ন'টায় , আর সে গড় পঞ্চকোট স্টেশনে পৌঁছেছে রাত সাড়ে এগারোটায়। যখন সে গড় পঞ্চকোট স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলো ,তখন সারা প্ল্যাটফর্ম নির্জন, সুনসান। স্টেশনমাস্টারের ঘরে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। আকাশে পূর্ণিমার গোল চাঁদ যেন মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। গেস্টরুমে শুধু চারজন দেহাতী যাত্রী রাতের রায়পুর-সুরগুজা প্যাসেঞ্জার ধরার জন্য অপেক্ষা করছে। অর্চনার মনে হল আজ রাতটা গেস্টরুমে ঐ যাত্রীদের সাথেই কাটিয়ে দেয়। তারপরেই মনে পড়ল,সে মা- বাবাকে জানিয়ে রেখেছে যে আজি সে বাড়ি ফিরছে। আর এখন যে সে জানাবে যে, সে আর আসতে পারছে না- তারও কোনো উপায় নেই। ট্রেনে আসতে আসতে কখন যে তার ফোনটা সুইচ্ড অফ্ হয়ে গেছে -তা সে খেয়ালই করে নি। গড় পঞ্চকোট এমন কিছু বড়ো স্টেশনও নয়। একজোড়া চার্জিং পয়েন্টার আছে, কিন্তু সেগুলি কাজ করে না।অর্চনা ভাবল, আজকে যদি সে বাড়ি না যায়,তাহলে বৃদ্ধ বাবা-মা তার জন্য রাত জেগে থাকবে। না, এ সে কোনো মতেই হতে দিতে পারে না। আরেকটা কারণও ছিল ,সর্বক্ষণ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ভয়। এই ভয় তাকে গত দু'বছর বাইরের কোথাও খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে দেয় নি, বিশেষ করে পূর্ণিমার রাত তো একেবারেই নয়। 

যাই হোক, সারা পৃথিবী চাঁদের আলোয় ভাসছে। দিগন্তে ধূসর পাহাড়শ্রেণী। অর্চনার মনে হল, চাঁদের আলোয় একা একা বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হবে না কোনো । এখান থেকে তাদের গ্রাম বিশালগড় মোটামুটি ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে। এখন হাঁটতে শুরু করলে সে মোটামুটি রাত দুটোর মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবে। কিন্তু সে কি জানে, তার ভয় তার পিছু ধাওয়া করছে! ভয় তাকে তার অনিবার্য পরিণতির দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। 

অবস্থাসম্পন্ন জমিদার বাড়ির মেয়ে অর্চনা । তার পিসেমশাই প্রদীপ সোলাঙ্কি বিশালগড় থেকে মোটামুটি দেড়শো কিলোমিটার দূরত্বে ছোটোনাগপুরের পাহাড়-জঙ্গলের পটভূমিতে অবস্থিত প্রতাপগড়ের জমিদার। তিনি ও তাঁর ভাই অজিত সোলাঙ্কির দাপটে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায় । কিন্তু চিরদিন কারোর সমান যায় না। সোলাঙ্কি বংশের আকাশেও একদিন ঘনিয়ে এল কালো মেঘ।

একদিন গভীর জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে প্রেমে পেলেন অজিত সোলাঙ্কি।বিস্তারিতভাবে ঘটনাটি বলা যাক। একদা প্রতাপগড়ের জঙ্গলে সেগুন কাঠ আর শালপাতা সংগ্রহে যাওয়া কাঠুরেদের কাছে মূর্তিমান ত্রাস হয়ে উঠেছিল এক হিংস্র বাইসন । ঐ বাইসনটির সামনে পড়লেই অবধারিত ছিল মৃত্যু , যেন সে সাক্ষাৎ যমদূত। কাঠুরে আর গ্রামবাসীদের কাছে আতঙ্ক হয়ে ওঠা ওই বাইসনটিকে নিধন করতেই বাছা কয়েকজনকে নিয়ে শীতের সকালে রোদের আমেজ গায়ে মেখে জঙ্গলে আগমন অজিত সোলাঙ্কির। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত ঘন জঙ্গলের কুহেলিকাময় মায়াবী পরিবেশে পথ হারান তিনি। তাও মনোবল অটুট ছিল তার। অজিতের মনে হয়েছিল, কাছাকাছি যেখানে কোনো পাহাড়ী ঝর্ণা বা জলাশয় আছে ,তার আশেপাশেই আস্তানা গেড়েছে বাইসনটি। কিছুদূর যেতেই তার কানে প্রবেশ করল পাহাড়ী ঝর্ণার কুল কুল শব্দ । সাথে রাখা দেশী গাদা বন্দুকটিতে বারুদ ভরে কিছুদূর গিয়েই অজিত দেখতে পেলেন অপরূপ এক দৃশ্য, যা তার মন ছুঁয়ে গেল।

ছোট্ট পাহাড়ী নদী সৃষ্টি করেছে পাহাড়ী এক ঝরণা, কবির ভাষায়,"তরলিত চন্দ্রিকা চন্দনবর্ণা"। আর সেখানে স্নানরতা উদ্ভিন্নযৌবনা এক অপরূপা সুন্দরী। তার দিকে চোখ পড়তেই তার শরীরে নিবদ্ধ হয়ে গেল দৃষ্টি, মাথা আর মন থেকে উবেই গেল হিংস্র বাইসন টির কথা। সুস্তনী মোহময়ী সুন্দরী যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো এক অপ্সরা, নতুবা সে কোনোও এক জলপরী।যেমনভাবে মুগ্ধ হয়ে ঐ অপ্সরীর দিকে চেয়েছিলেন অজিত, তেমনই এক সময় ঐ সুন্দরী তাকালো অজিতের দিকে।চোখে চোখে হয়ে গেল কতোও কথা!

সুন্দরীর রূপে মগ্ন হয়ে গেছিলেন অজিত। হয়তো বা মগ্ন হয়ে গেছিল সুন্দরীও।এই সময় কোথা থেকে মূর্তিমান ত্রাসের মতো উপস্থিত হলো বাইসনটি।কাছাকাছি ঝোপ-জঙ্গলে কোথাও লুকিয়েছিল হয়তো। চমকে উঠলেন অজিত। ভয় পেয়ে বিহ্বল হয়ে গেল মেয়েটি। ভয় পেরেছিলেন অজিতও, কিন্তু ক্ষণিকের চমক কাটিয়ে তিনি হাতে তুলে নিলেন গাদা বন্দুক। আর মুহূর্তের মধ্যে গুলির ছররায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল অজিতের দিকে প্রচণ্ড গতিতে ধাবমান বাইসনটি। মুহুর্মুহু চলতে লাগল গুলিবর্ষণ । একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল বাইসনটির প্রাণহীন রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেন।

সবশেষ , অবশেষে খতম হল প্রতাপগড়ের ত্রাস। কিন্তু, সুন্দরী কোথায় গেল! তাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এই সময় সিক্ত বসনে ধীরে ধীরে জল থেকে উঠে এল সেই সুন্দরী।মোহিত হয়ে গেলেন অজিত, যেন কামদেবের শর তার হৃদয় বিদ্ধ করল। অজিত জিজ্ঞাসা করলেন তার নাম। মৃদুস্বরে সুন্দরী উত্তর দিল- ' মল্লিকা'। উদ্বেল হয়ে গেল অজিতের হৃদয়, তিনি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন মল্লিকাকে। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিলেন তার সারা শরীর। তারপর তাকে নিয়ে ফিরে এলেন জমিদার বাড়িতে।

বিজয়ী হয়ে প্রতাপগড়ে ফিরে এলেন অজিত। এর আগেই অজিতের দলছুট হয়ে নিখোঁজ হবার সংবাদ বাড়ির সবার কানে পৌঁছেছিল। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছিল সকলে। এইসময় যখন মল্লিকাকে সাথে নিয়ে বাড়িতে এলেন অজিত, আর সকলে জানতে পারল অজিত সফল হয়েছেন বাইসনটিকে নিধন করতে সারা গ্রাম ভেসে গেল আনন্দের জোয়ারে। মল্লিকা কে,কি তার পরিচয় বৃত্তান্ত কেউ জিজ্ঞাসা করল না, এর কিছুদিন পর কুলদেবতাকে সাক্ষী মেনে ধূমধাম করে মল্লিকাকে বিয়ে করলেন অজিত।

কিন্তু , অজিতের বিয়ের পর সারা গ্রামের বুকে নেমে এল আতঙ্কের কালো ছায়া।

প্রত্যেক পূর্ণিমার রাতে গ্রামের সম্পন্ন বাড়ি থেকে গরু- ছাগল- ভেড়া- বাছুর সব নিখোঁজ হতে লাগল। পরের দিন সকালে দূরের কোনো ভাগাড়ে বা শ্মশানের কাছে পাওয়া যেত সেগুলির রক্তশূন্য প্রাণহীন দেহ। চিন্তিত হয়ে পড়ল গ্রামবাসী। যথারীতি খবর এল অজিত সোলাঙ্কির কানে।অজিত প্রস্তুত হলেন পদক্ষেপ নেবার জন্য।

তিনি কিছু বাছাই করা শাকরেদ নিয়ে সারা রাত দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন সারা গ্রাম ও কাছের পাহাড় জঙ্গল।কিন্তু খুঁজে পেলেন না কোনো কিছুই। আততায়ী কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায়,কেউ জানে না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, তাকে কেউ দেখেই নি।বারবারে বিভ্রান্ত হতে লাগলেন অজিত। কিন্তু আততায়ীর দাপট বাড়তে লাগলো। আর সে গরু-ছাগলের রক্ত পান করে সন্তুষ্ট হয় না। তার লক্ষ্য হল মানুষ, গভীর জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাওয়া নিরীহ কাঠুরেরা। গহন জঙ্গলে প্রতি পূর্ণিমার রাতের পরের দিন সকালে পাওয়া যেত তাদের রক্তশূন্য প্রাণহীন নিস্তেজ দেহ।কাঠুরে দের পরে শিকার হতে লাগল সরল গ্রামবাসীরা, অসহায় বোধ করতে লাগলেন অজিত। সারা গ্রাম কাঁপতে লাগল পূর্ণিমারাতের আতঙ্কে।

গভীর রাতে বিলাশবহুল পালঙ্কে ঘুমিয়ে ছিলেন অজিত। হঠাৎই ভেঙে গেল তার রাতের ঘুম। জানলা দিয়ে এসে পড়েছে চাঁদের রূপালী আলো, আজ পূর্ণিমা । সারা বিশ্বচরাচর জোৎস্নায় ভাসছে। কিন্তু অজিত চমকিত হয়ে দেখলেন তার সুন্দরী স্ত্রী মল্লিকা তার পাশে নেই। মহলের কোথাও মল্লিকাকে খুঁজে পেলেন না অজিত, কিন্তু ঘাবড়ালেন না। এরকম কিছু একটা তিনি আগেই আন্দাজ করেছিলেন। রাইফেল আর গুলির কার্তুজ নিয়ে তিনি চেপে বসলেন তার ঘোড়ায়, গন্তব্য রামগড়ের জঙ্গল। এই জঙ্গলে মানুষ রাতে কেন, দিনে যেতেও ভয় পায়। সবাই বলে এখানে কিছু একটা আছে ,যেটাকে ঠিক যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।যেটা চরম অশুভ,চরম অমঙ্গলকারী।

জঙ্গলের ভেতর আছে এক শ্মশানকালীর মন্দির।সবাই বলে এখানকার দেবী জাগ্রত। অশুভ শক্তির উপাসকেরা তাদের অশুভ কাজ করার আগে দেবীর উপাসনা করে তাঁর কাছে শক্তি প্রার্থনা করে। ওখানে আসে পিশাচিনী- শাঁকচুন্নীরা, ওখানে আসে ডাকিনী- যোগিনীরা।এই স্থান অতি ভয়ঙ্কর ,অতি বিপজ্জনক। আজকের রাতে এটাই অজিতের গন্তব্যস্থল।

শ্মশানকালীর মন্দিরের সামনে এসে পূর্ণ হল অজিতের অভিলাশা, অজিত জানতেন যে, আততায়ীর মূল লক্ষ্য অবিবাহিত যুবকেরা, সেই থেকে অজিত আন্দাজ করেছিলেন আততায়ী একজন পিশাচিনী, যে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিরীহ মানুষের হত্যা করে বেড়ায়। সেই থেকে কিছুটা হলেও সন্দেহ করেছিলেন মল্লিকাকে, কিন্তু তার দুঃস্বপ্ন যে এইভাবে সত্যে পরিণত হবে তা তিনি কোনোওদিন কল্পনাও করেন নি।প্রথম থেকেই মল্লিকার আচরণ ছিল সন্দেহজনক।বাসররাতেই অজিত দেখেছিলেন মল্লিকার রক্তের প্রতি অদ্ভূত এক আসক্তি।

টিঘরীর মন্দিরের মহাদেবের মন্ত্রপূত ত্রিশূল আর গুলিভরা রাইফেল নিয়ে শ্মশানকালীর মন্দিরে পৌঁছালেন অজিত। সেখানে মল্লিকাকে তার প্রকৃত রূপে দেখে চমকে উঠলেন। ভয়াল ভয়ঙ্কর সাক্ষাৎ এক পিশাচিনী, নগ্ন মানবী থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে তার আসল রূপে। অনেকটা বনবিড়ালের মতো, লোমশ শরীর, মুখের দুকশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, লোমশ শরীর, মুখের দুকশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, লোমশ দুই হাত আর আঙ্গুলের ডগায় ধারালো লম্বা নখর, দুই চোখ দিয়ে যেন আদিম হিংস্রতা প্রতিফলিত হচ্ছে! ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হলো অজিতের কাছে, মল্লিকা তার যৌবন দিয়ে প্রলুব্ধ করত গ্রামের সাধারণ যুবকদের। তারপর তাদের রামগড়ের জঙ্গলে এনে তাদের ভবলীলা সাঙ্গ করত। এখনোও তার সামনে পড়ে আছে এক উনিশ-কুড়ি বছরের যুবকের দেহ।পতঙ্গ যেমনি প্রদীপশিখার দিকে ধেয়ে এসে পুড়ে মরে, তেমনি এই যুবকও মল্লিকার যৌবনের আগুনে পুড়ে মরেছে।না, আর দেরি করা চলবে না।

পিশাচিনীকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করলেন অজিত,অজিত যেহেতু পিশাচিনীর পেছনে ছিলেন, তাই পিশাচিনী লক্ষ্য করেনি তাকে। অতর্কিত গুলিবর্ষণে চমকে উঠল পিশাচিনী, কিন্তু ততক্ষণ সে মারাত্মকভাবে আহত। শেষমেষ তীব্র হিংস্র গর্জন করে অজিতের দিকে তেড়ে এল মল্লিকা। তার গর্জনে কাঁপতে লাগল রামগড়ের পাহাড়- জঙ্গল কিন্তু ভয় পেলেন না অজিত, তিনি পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বার করলেন মহাকালের মন্ত্রপূত রুদ্রাক্ষ, আর সেটা ছুড়ে মারলেন পিশাচিনীর দিকে।

ঈশ্বরের অপার মহিমা, সেটা গিয়ে পড়ল দানবীর গলার উপর! কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ল পিশাচিনী।এরপর অজিত পিশাচিনীর বুকে বসিয়ে দিলেন মহাদেবের ত্রিশূল। শেষ হল পূর্ণিমারাতের আতঙ্ক।

প্রসঙ্গত বলে রাখি , অজিত আর মল্লিকার একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল। মল্লিকার মৃত্যুর সময় ছেলেটির বয়স ছিল দেড় বছর; কিন্তু ছেলেটি যতো বড়ো হতে লাগল, ততই তাকে নিয়ে অজিতের চিন্তা বাড়তে লাগল। ছেলের বয়স যখন মোটামুটি চারের কোঠায় পড়ল, তখন অজিত একদিন তাকে স্নান করাতে গিয়ে তার পিঠের ওপর আর কানের লতিতে অদ্ভূত কিছু লোম গজাতে দেখলেন।এরপর ,একদিন আরও অবাক হয়ে গেলেন, যখন তিনি ছেলেটিকে এক কাঠবেড়ালিকে নিজের হাতে মেরে তার কাঁচা মাংস খেতে দেখলেন।এতো হিংস্র, এতো নৃশংস কি কোনো মানবশিশু হতে পারে! হতবাক হয়ে গেলেন অজিত। তারপর তিনি দেখলেন যে, বাচ্চাটির বয়স মাত্র ছয় বছর।কিন্তু, তার তেজী অ্যালসেসিয়ান কুকুরটিও বাচ্চাটি সামনে এলে কেমন যেন কাঁচুমাচু হয়ে যায়,ভয়ে কাঁপতে থাকে। তখনই অজিতের প্রথম উপলব্ধি হল, তাঁর সন্তানের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই অলৌকিক কিছু আছে! প্রথমকথা, দানবী আর মানবের মিলনের ফলে এই শিশুর জন্ম,দ্বিতীয়ত এ মাত্রাতিরিক্ত রাগী আর হিংস্র।

তখনই সোলাঙ্কিদের জমিদার বাড়িতে আগমন তাদের কুলগুরু তারানাথ তান্ত্রিকের, যিনি তন্ত্রমন্ত্রে সিদ্ধহস্ত। তারানাথের কাছে একটি বিশেষ দর্পণ ছিল,যার সাহায্যে তিনি তন্ত্রমন্ত্রের মাধ্যমে কোনো মানুষের নাম করলেই,তার ভবিষ্যৎ ঐ দর্পণে ফুটে উঠত।

যাই হোক, যেহেতু অজিত তাঁর পুত্রকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন,তাই তিনি তারানাথের কাছে নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ জানতে চাইলেন।কিন্তু, তাঁর সামনে তারানাথ তান্ত্রিকের মায়াবী দর্পণে ফুটে উঠেছিল পূর্ণিমার রাতের পটভূমিতে এক নেকড়ে মানুষের প্রতিচ্ছবি।অজিত বুঝতে পারলেন ,তিনি যতোই চেষ্টা করুন না কেন,অদৃষ্টের হাত থেকে নিস্তার নেই।কিন্তু,নিজের সন্তানকে তো আর মেরে ফেলা যায় না।তাই, অজিত এক সিদ্ধান্ত নিলেন।স্থানীয় এক সম্পন্ন গ্রামবাসীকে দত্তক দিলেন তাঁর সন্তান মোটামুটি তেরো-চৌদ্দ বছর আগের কথা। এসব কথা অর্চনা তার পিসির কাছে শুনেছে!


কিন্তু, দুই-তিন বছর আগে প্রতাপগড়ের আকাশে ফের ধেয়ে এসেছে কালো মেঘ। মায়াবী পূর্ণিমার রাতে ফের শুরু হয়েছে হত্যালীলা। হিংস্র কোনো নরপশুর হাতে খুন হচ্ছে সাধারণ মানুষ। কেউ বলছে ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী, কেউ বলছে বা মহাপিশাচ।ডাকিনী মল্লিকাও হয়তো এতোটা আতঙ্কবিস্তার করে নি, মানুষের মনে আর মস্তিষ্কে আতঙ্ক বিস্তার করে নি।

কেউ আবার বলছে 'নেকড়ে-মানুষ' বা werewolf। গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত আবার বলছেন অদ্ভূত এক কথা।তাঁর মতে, এ যেন সাক্ষাৎ ভগবান বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার। সোলাঙ্কিরা নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর অনেক জুলুম করেছেন। তাই আবার ধরার বুক থেকে পাপীদের বিনাশের জন্য নৃসিংহ অবতারের প্রত্যাবর্তন। যারা মারা যাচ্ছেন তারা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সময়ে কিছু না কিছু অন্যায় করেছেন।

আক্রমণ হতে লাগল সোলাঙ্কি পরিবারের ওপর। প্রথমে গভীর গহন জঙ্গলে পূর্ণিমার সন্ধ্যায় মৃগয়া করতে গিয়ে নরপশুর অতর্কিত আক্রমণে মারা গেলেন প্রদীপ সোলাঙ্কি- অর্চনার পিশেমশাই। তারপরের পূর্ণিমার রাতে রামগড়ের বনে ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেল অজিত সোলাঙ্কির।তারপর ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হতে লাগল সোলাঙ্কি বংশ। মারা গেলেন বংশের শেষ প্রদীপ প্রিয়ব্রত সোলাঙ্কি। এরপরেও থামল না হত্যাকাণ্ড, ক্রমশঃ একে একে মারা যেতে লাগলেন সোলাঙ্কিদের আত্মীয়রাও। অর্চনাও সোলাঙ্কিদের আত্মীয়, তাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন প্রদীপ সোলাঙ্কি। ঘটনাক্রমে নিঃসন্তান প্রদীপ তাঁর সমস্ত সম্পত্তি অর্চনাকেই উইল করে দিয়েছেন। কিন্তু ঐ হিংস্র নরপশু যে সোলাঙ্কি বংশ কেই উত্তরাধিকারীশূন্য করার কাজে নেমেছে। এখন কি তার লক্ষ্য অর্চনা! ঐ জানোয়ারটা তো এরকম পূর্ণিমার রাতেই নিজের শিকার খুঁজে বেড়ায়!

সেগুনের গহন বনানীর মধ্যে দিয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরছিল অর্চনা। শুনশান পথে হঠাৎ দেখা সুরজ সিং- এর সাথে। সুরজ তার ছোটবেলার বন্ধু। সুরজের সাথে তার দেখা হয়েছিল প্রতাপগড়ে ।ওখানের পন্ডিতজির ছেলে সুরজ। হয়তো তাদের একে অপরকে ভালোও লেগেছিল। কিন্তু,সুরজ এতদূর বিশালগড়ে কেমন করে এল! যাই হোক, একজন সাথী তো পাওয়া গেছে , আর ভয় নেই. কে জানে,জানোয়ারটা তার পিছু নিয়েছে কিনা!

পৃথিবী ভেসে যাচ্ছিল রোম্যান্টিক জ্যোৎস্নায়। রূপোলী চন্দ্রালোকে হতবাক হয়ে অর্চনা দেখতে লাগল সুরজের চেহারার পরিবর্তন। সারা শরীর আয়তনে বাড়ছে, হাত গুলো কেমন যেন লোমশ হয়ে যাচ্ছে, মাথার চুল কেমন যেন লম্বাটে হয়ে যাচ্ছে, চোয়াল কেমন যেন লম্বাটে হয়ে কুকুরের মতো অনেকটা হয়ে যাচ্ছে,চোয়ালের গোড়ায় ঝকঝক করছে শ্বেত শ্বদন্ত। মুখ দিয়ে কথার বদলে বেরোচ্ছে গোঙানি।

যখন হুঁশ ফিরল,তখন অর্চনা অনুভব করল তীক্ষ্ণ নখর তার সারা শরীর ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। আর্তনাদ করে উঠল অর্চনা, আর তার সাথে ভেসে এল গভীর রাতে কোনোও ক্ষুদার্ত জানোয়ারের তীব্র গর্জন।


চলবে


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror