পুতুল বাড়ির গল্প - শারদ সংখ্যা
পুতুল বাড়ির গল্প - শারদ সংখ্যা


উনিশ শতকের গোড়ার দিকের কথা বলছি। তখন আমি এসেছিলাম এই বাড়িতে। কলকাতায় আহিরিটোলার হরচন্দ্র লেনের পুতুল বাড়িতে। হ্যাঁ, লোকে ঐ নামেই ডাকত বাড়িটাকে। কারণ ঐ বাড়িটা একসময় অনেক সুন্দর সুন্দর পুতুল দিয়ে সাজানো ছিল। আমি পুতুল ভালবাসতাম কিনা। তাই আমার মনিব , আমার বাবু আমার জন্য অনেক পুতুল এনে দিয়েছিলেন। সেদিন আমার সৌভাগ্যে জ্বলন হতো অনেকের। মস্ত বড়ো প্রাসাদের মতো তিনতলা পুতুল বাড়িটাতে থাকতাম আমি। বাড়িটা ছিলো রোমান শৈলীতে সাজানো। পাশ দিয়ে বইত গঙ্গা। তখন আমি উনিশ বছরের যুবতি। রূপ লাবণ্যে ঢলঢল আমার মুখখানা আমার বাবুর বড়ো প্রিয় ছিলো। আদর করে কতো দামি গসনেলের সাবান, আতর এইসব এনে দিতেন। আমার নির্দেশে কাজ করতো একগাদা দাসী। সারাদিন তাদের তদারকি করতাম। রাতে বাবু আসত বাড়িতে। তখন তিন তলায় বাবুর ঘরটাতে ডাক পরত আমার। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বাবু আমার নাচ দেখতেন। সঙ্গে মদও খেতেন। আমার পায়ের ঘুঙুর বেজে চলত। একসময় ক্লান্ত হয়ে পরলে , বাবু কাছে টেনে নিতেন আমাকে।
বাবুর নামটা কিন্তু বলবনা। যদি তোমরা তাঁকে খারাপ ভাবো ? সমাজের অনেক নামি মানুষ ছিলেন কিনা ! হ্যাঁ তবে আমার নাম কুসুম। পদবি জানতে চেয়োনা। ওসব হয়না আমাদের। বাপ কে ছিলো তাই জানিনা ! মা ই ছিলো আমার জীবনে সব। লখ্নৌ এর এক বাইজি কোঠিতে মার সাথে থাকতাম। ওখানেই জন্ম আমার। শুনেছি মা কে কেউ বিক্রি করে দিয়েছিল এখানে। বাইজি কোঠিতে ওস্তাদ রেখে মা কে নাচ, গান এসবের তালিম দেওয়া হয়েছিল। মার কাছে ছোটো থেকেই সেসব নাচ, গান শিখতাম। কিন্তু এর মধ্যেই ভালো মুজরার আশায় লখ্নৌ ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলো মা। আমরা থাকতাম চিৎপুরে। ইংরেজ শাসনের যুগে তখন কলকাতায় এক শ্রেণীর বাবুদের খুব দাপট ছিলো। ওঁরা আবার নাচ গানের খুব সমঝদার ছিলেন। মায়ের তখন খুব নাম ডাক। মায়ের এক রাতের রেট ছিলো হাজার টাকা। বাবুরা তখনকার নাম করা বাইজিদের বাঁধা মেয়েমানুষ করে রাখতে চাইত। এনিয়ে বাবুদের মধ্যে প্রতিযোগীতাও চলত। মাকে নিয়েও এই প্রতিযোগীতা চলছিল। অবশেষে মা আমার মনিব বাবুর বাঁধা মেয়েমানুষ হয়ে গেলো। তখন অবশ্য এই বাবুকে চিনতামনা আমি। শুধু দেখলাম চিৎপুর থেকে পুতুল বাড়িতে এসে উঠেছি আমরা। এইসময় বাবু আমার খোঁজ নিতেন। একবার অনেক পুতুল এনে দিয়েছিলেন আমাকে। তারপর কোলে বসিয়ে খুব আদর করেছিলেন আমাকে। তখন মাত্র তের বছর বয়স আমার। সেই প্রথম কোনো পুরুষ মানুষের ছোঁয়ায় শরীরটা কেঁপে উঠেছিল আমার। খুব ভালো লেগেছিল ঐ বাবুকে। তারপর থেকে দূরে থেকেই হা করে দেখতাম বাবুকে। মা যে বাবুর কাছে যেতে দিতনা। কেন- সেটা বুঝিনি তখন। বাবু ছিলেন খুব শৌখিন। প্রতি রাতে ঘোড়ার গাড়ি চেপে পুতুল বাড়িতে আসতেন। গায়ে গিলে করা পাঞ্জাবি, আর চুনট করা ধুতি। গলায় সোনার চেন, পায়ের জুতোর ডগায় ছিলো হিরে বসান। কব্জিতে বেল ফুলের মালা জড়ান থাকত। গা থেকে আতরের গন্ধ আসত। তখন থেকেই মনে মনে ভালোবেসে ছিলাম বাবুকে। যদিও বাবু আমার থেকে প্রায় পঁচিশ বছরের বড়ো ছিলেন। মাকে বলতেন " গোলাপির জন্য ভাবিসনা , ওর সব দায়িত্ব আমার।" বাবু আমার নাম দিয়েছিলেন গোলাপি। মা কিন্তু কথাটাতে খুশী হতনা - সেটা বুঝতে পারতাম। মা আমাকে আলাদা বলত " নাচ আর গানটা শেখ ভালো করে। তাহলে স্বাধীন মতো মুজরা করবি। কারুর বাঁধা মেয়েমানুষ হয়ে থাকতে হবেনা আমার মতো।" তবে কি মা সুখী ছিলনা , বুঝতে চেষ্টা করতাম।
কলকাতার রাস্তায় বেরবার জো ছিলনা মায়ের। খুব নাম ডাক ছিলতো, তাই রাস্তায় বেরলে লোকে বাইজি দেখবে বলে ভীড় জমাতো। তাই মা বাবুর পাল্কিতে মাঝে মাঝে গঙ্গা স্নানে যেতো। আমিও সঙ্গী হতাম মায়ের। তখন পাল্কিতে বসে দুচোখ ভরে কলকাতা শহরটাকে দেখতাম। কি সুন্দর রাস্তা , বড়ো বড়ো বিল্ডিং, রাস্তায় গোরা সৈন্যরা দাঁড়িয়ে থাকত। বনেদি বাড়ির বৌরাও এইসময় পালকি করে গঙ্গার ঘাটে আসতেন। আমাদের নৌকা চাপিয়ে বেড়াতে নিয়ে যেতেন বাবু - মহেশের রথে , খড়দহের মেলায়। তখন নৌকায় কতো যে রঙ্গ তামাসা হতো ! বাবুর মনটা ছিলো উদার , খরচ করতেন হাত খুলে। শুনেছি সব বাবুরাই নাকি দেদার টাকা খরচা করতেন। শুনেছি জমিদার নিমাই চাঁদ মল্লিকের নাতি রামরতন মল্লিকের বিয়েতে চিৎপুরের দুমাইল রাস্তা নাকি ভেজানো হয়েছিলো খাঁটি গোলাপ জলে। শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেব দুর্গা পূজায় বাইজি নাচাতেন। আমার মাকে ডাকা হয়েছিলো কয়েকবার। সেখানে ইংরেজরাও নিমন্ত্রিত হতেন। মা তখন বাবুদের নিয়ে প্রচলিত একটা ছড়া প্রায়ই বলত - " গোবিন্দরামের ছড়ি।/ উমিচাঁদের দাড়ি।/ নকুধরের কড়ি।/ মথুর সেনের বাড়ি।"
হঠাৎ দুদিনের জ্বরে মারা গেলো মা। তখন থেকে বাবুই আমার সব। বাবু ছাড়া আর কিছু জানতামনা। মায়ের পর থেকে রাতে আমি থাকতাম বাবুর কাছে। বাবু কিন্তু মায়ের শেখানো নাচ, গান শুনতে চাইতেননা। বাবুকে খুশী করতে আমি কিছু চটুল গান শিখেছিলাম ঐ সময় -
" মদন আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ , কি গুণ কল্ল ঐ বিদেশী, ইচ্ছা করে উহার করে। প্রাণ সঁপে সই হইগো দাসী।"
এই গান শুনে খুশী হয়ে আমার কোমর দুলিয়ে দিতেন বাবু। বাবুর ছিলো মশলার ব্যবসা। গঙ্গার ঘাটে সেইসব মাল আসত ছোটো জাহাজে। আর স্টক করে রাখা হত এবাড়ির এক তলায়।সেটা গুদামের জন্যই ব্যবহার হতো। তাই অনেকে একে গুদাম বাড়িও বলত। তারপর বাবু একসময় বেঁচে দিলেন এবাড়ি, এক নট্ট কোম্পানির কাছে। তারাও থাকেনা এখন এবাড়িতে, কোথায় চলে গেছে। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। ইংরেজ শাসন শেষ হোলো। বাবুদের যুগ শেষ হোলো। আমার বাবু চোখ বুজলেন। শুধু আমি রয়ে গেছি এখানে।
শেষের দিকে পাল্টে গেছিলেন বাবু। রাতে মাঝে মাঝে অন্য অনেক বাবুদের নিয়ে আসতেন এই বাড়িতে। কখনো ইংরেজদেরও নিমন্ত্রণ করে আনতেন। মদ , মাংস ছাড়া ইংরেজদের জন্য চুরুট , আইসক্রিম , কমলালেবুর রস এসবের ব্যবস্থা থাকত। ওঁদের মনোরঞ্জন করতে হতো আমাকে। আমার শরীর , মন বিদ্রোহ করতো। যাঁকে মন দিয়েছি , সেই পাঠাচ্ছে অন্য পুরুষের কাছে ! বাবুর এক কথা " মেয়েমানুষের শরীর পুরুষের ফুর্তির জন্যই। তোর এতো সুন্দর শরীর কেন একা আমি ভোগ করবো? ওঁদের একটু খুশী কর , তাহলে আমার অনেক সুবিধা হবে। বল , সেটা তুই চাসনা ? " তাই বাঁধা মেয়েমানুষ থেকে তখন হলাম ' উটকো মেয়েমানুষ' , যাকে কিনা সবাই ভোগ করতে পারে।
তাও মেনে নিয়েছিলাম বাবুর অনুরোধে। কিন্তু বেঁকে বসলাম , যেদিন দেখলাম প্রায় নাতনির বয়সি একটা মেয়েকে বাবু তাঁর বাঁধা মেয়েমানুষ করে এই বাড়িতে এনে তুললেন। যে আমি কোনোদিন বাবুর মুখের উপর কথা বলিনি , সেই রোজ বাবুর সাথে বাক বিতণ্ডা করতাম। তখন থেকে আর বাঁচতে ইচ্ছা করতনা। মার কথা খুব মনে পড়ত। নিজের জীবনটার উপর খুব ঘৃণা হতো। একদিন তর্কাতর্কির সময় রেগে বাবু আমার গলা টিপে ধরে। তাতেই অক্কা গেছিলাম। বাবু আমার শরীরটা এই বাড়ির পিছনে বাগানে পুঁতে দেয়। সেই থেকে রয়ে গেছি এখানে। অপঘাতে মরেছিলামতো , তাই মুক্তি হয়নি। বাড়িটাতে এখন কিছু ভাড়াটে থাকে। রক্ষণাবেক্ষন হয়না বলে বাড়িটার অনেক অংশ ভেঙে পড়ছে , দেওয়াল থেকে মাথা তুলেছে বটের চারা। ভগ্ন , পোড়ো এই বাড়িটা দেখতে ভীড় করে অনেকে। বলে এখানে নাকি ভূত থাকে। ভাড়াটেরা বিরক্ত হয়ে নোটিশ দিয়েছে - ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু কে শোনে কার কথা ! লোক জোর করে ভিতরে ঢুকে পড়ছে , আর কি শুনে ভয় পেয়ে ছুটে পালাচ্ছে। এখানে আমার সাথে আমার মতই কিছু হতভাগিনি থাকে। তাদের কান্না হয়তো শোন তোমরা। কিন্তু বিশ্বাস করো - আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করবনা। শুধু দীর্ঘদিনের বুক চাপা কষ্টে মাঝে মাঝে হাহাকার করে উঠি !