অচেনা মানুষ
অচেনা মানুষ
আমার লেখার অনুপ্রেরণা আমার মা | মা ছিলেন একজন সাহিত্যিক | কিছু লিখলে আমাদের ই প্রথম শোনাত মা | আমাদের মতামতের অনেক মূল্য ছিল মায়ের কাছে | মা আজ নেই | বড়ো কষ্টে কেটেছে মায়ের শেষ সময়টা | ঠিক সেভাবে পাশে থাকতে পারিনি, যেভাবে মা চেয়েছিল | সেই আক্ষেপ এজীবনে যাবেনা | মনে হলে রুদ্ধ ঘরে আজও চোখের জল বাধা মানেনা | আমার প্রথম লেখা মাকে নিয়েই | সেটাই এখানে দিলাম | তবে গল্পের প্রয়োজনে অনেক চরিত্র বা ঘটনা দেওয়া হয়েছে, যার সাথে বাস্তবের মিল নেই |
আয়নার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে করুনা | যেন নিজেকে ই চিনতে পারেনা | কোথায় গেল তার সেই সুন্দর মুখ? এতো অকালে জরা জীর্ণ বিকৃত এক মুখ | চোখ সরিয়ে নেয় করুনা | এসে বসে ফ্ল্যাটের ছোট্টো ব্যালকনি তে | বর্ষার জল পেয়ে সামনের কদম গাছটা ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে | নাক টেনে চেষ্টা করেও কদম ফুলের গন্ধ পায়না করুনা | kচোখের দৃষ্টি, ঘ্রান শক্তি সবই যেন বড়ো ঝাঁপসা আর ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে | আজ বেলুড় মঠে গেছিল করুনা | অপারেশন এর পর অনেক দিন বাড়ি থেকে বের হয়নি | কিন্তু কতদিন আর নিজেকে লুকিয়ে রাখবে? তাছাড়া মঠে যাওয়ার অভ্যেস করুনার বহুদিনের | মঠের গেটে দেখা হয়েছিল সেই পাগলিটার সঙ্গে | বরাবরের মতো পয়সা দিতে গেছিল করুনা | পাগলিটা বলে উঠল " পয়সা লাগবেনা মা, আহা কি অবস্থা হয়েছে তোমার !" করুনা অবাক হয়ে ভাবলো পাগলিটা ও তাকে করুনা করছে | মন্দিরে যেতেই শুনলো চাপা গুঞ্জন " একা বেরিয়েছে কেন? মেয়েরা কেউ তো সঙ্গে আসতে পারতো " সবার এতো করুনা যে সে চায়নি |
"ও দিদি, আজ কি রান্না হবে? " বলে ব্যালকনি তে এসে দাঁড়ায় ঝর্ণা|ওর কথায় চমকে ওঠে করুনা | আজকের রান্না টা বলা হয়নি যে | করুনার জন্য অবশ্য রোজই মাছ আর তরকারি দিয়ে একটা ঝোল বানিয়ে দেয় ঝর্ণা | ঝাল, মসলা ছাড়া, প্রেসার কুকারে গলিয়ে | অপারেশন এর পর থেকে এরকমই খায় করুনা | আসলে ঝর্ণা জানতে চাইছে ওর স্বামী অমল কি খাবে | এই মানুষ টার খাবার নিয়ে বড্ডো বায়না | বিয়ের পর থেকে স্বামীর অনেক আবদার রেখেছে করুনা, এখন আর এসব ভালো লাগেনা | তার অসুখ নিয়ে স্বামী - সন্তানেরা যেন বড়ো বেশি উদাসীন | নাকি অমল করুনার এই অসুখে দারুন আঘাত পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে | বুঝতে পারেনা করুনা | নিজের সন্তান দের ই বুঝতে পারেনা | ওরা যেন নিজের সংসার নিয়েই ব্যস্ত, মাকে দেখার সময় কোথায়
! বাংলা দেশে একসময় মুসলমান আক্রমণের ভয়ে একের পর এক হিন্দু পরিবার পালাতে শুরু করে | করুনার বয়স তখন চোদ্দ | ওকে আর ওখানে রাখতে ভরসা পেলোনা করুনার বাবা | বাংলা দেশ থেকে করুনা এলো তাহেরপুর, বড়দির শশুরবাড়ি | সেখানে বড়দির একগাদা বাচ্চা সামলাতে হতো করুনা কে | বাচ্চা দের সাথে সময় কাটাতে ভালোই লাগতো করুনার | কিন্তু মায়ের জন্য খুব মন কেমন করতো | কত রাত মার জন্য কেঁদে বালিশ ভিজে যেত করুনার | তারপর ভর্তি হয়েছিল তাহেরপুর স্কুলে | পড়াশোনার আনন্দে বাড়ির দুঃখ ভুলে গেছিল করুনা | কিন্তু সেই আনন্দ বেশিদিন থাকলোনা | বড়দি ওর দেওরের সাথে করুনার বিয়ে দেবার জন্য খেপে উঠল | করুনা প্রবল আপত্তি করেছিল " তোমার ওই গোমড়া মুখো, নাক ডাকা দেওর কে আমি বিয়ে করবোনা " স্কুলের দিদিমনি রাও বলেছিলো " এখনই বোনের বিয়ে দিচ্ছেন কেন? ও এ
তো মেধাবী ছাত্রী, আরও পড়ুক না " কিন্তু বড়দি কারো কথা শোনেনি | করুনা মেনে নিয়েছিল, ওরতো কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলনা | তাছাড়া বাড়ির সবাই এতে খুশি হয়েছিল | করুনার বিয়ের দায় আর ওদের নিতে হলোনা | বিয়ে টা হয়ে গেছিল | করুনার থেকে ষোলো বছরের বড়ো অমল করুনা কে ভালোবাসতো | কিন্তু করুনার কষ্টটা বুঝতে পারতোনা | বিয়ের পর করুনার দুটো সন্তান দুধ না পেয়ে মারা যায়, অথচ অমল তার সরকারি চাকরির পুরো মাইনে তুলে দিতো তার বৌদির হাতে | এরপর করুনার ভাসুর ভালো চাকরি পেয়ে দিল্লী চলে যায় পরিবার নিয়ে | ভাইয়ের কাছে রেখে যায় বৃদ্ধ বাবাকে, অবিবাহিত বোনকে, নিজের বড়ো ছেলে সন্তু কে | এরপর অমল পোস্টিং পেয়ে কলকাতায় চলে আসে | কোয়ার্টার ও পায় | সন্তু থাকতো করুনার কাছে | বড়দি বলেছিলো " তোর ছেলে নেই, তাই সন্তু কে দিলাম " সন্তু কলেজ পাশের পর চাকরি পেয়ে মুম্বাই গেলো, ওখানেই সেটল করেছে | করুনার যখন ওরাল ক্যান্সার ধরা পড়লো, তখন সন্তু র ভরসায় মুম্বাই ছুটে গেছিল টাটা মেমোরিয়াল এই অপারেশন এর জন্য | তখন বুঝতে পেরেছিল সন্তুর উপর ভরসা করাটা কতো বড়ো ভুল ছিল | পরের ছেলে যে কোনোদিন নিজের হয়না এটা বুঝতে কতবছর লেগে গেলো করুনার |
দুটো সন্তান মারা যাবার পর যখন অদিতি এলো করুনার কোলে, তখন করুনা ওকে চোখে হারাতো | বড়ো আদরের, বড়ো গর্বের ধন ছিল অদিতি | অদিতির প্রেমের বিয়েটা ওর শশুরবাড়ি মেনে নিতে পারেনি | তাই ইচ্ছা থাকলেও করুনা অনুষ্ঠান করে অদিতির বিয়ে দিতে পারেনি | পরে অবশ্য গয়না, আসবাব, বিছানা, বাসন সবই কিনে দিয়েছিলো মেয়েকে | কিন্তু অদিতি করুনা কে আজও কথা শোনায় - তাকে নাকি করুনা ঠকিয়েছে, কিছুই দেয়নি | ছোটো মেয়ে অনিন্দিতার বিয়ে দিয়েছিলো ডাক্তারের সঙ্গে | সেতো বিয়ের আগেই করুনা কে জানিয়ে দিয়েছিলো শশুরবাড়ির কোনো দায়িত্ব নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না | বিয়ের পর অনিন্দিতার বাপের বাড়ি আসা নিয়েও জামাই আপত্তি করতো | অনেক কান্না কাটি করে কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ি আসতো অনিন্দিতা | করুনা বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিতো | নাহলে জামাই অশান্তি করবে | করুনা ভাবতো - ওরা সুখে থাক , তাকে নাই দেখলো | অথচ একটা ছেলের থেকে কি তফাৎ করে মানুষ করেছে সে মেয়েদের | জামাই তো তার বাবা মার প্রতি সব কর্তব্য ই করছে | কিন্তু করুনা তার মেয়ের প্রতি কোনো দাবি করতে পারবেনা |সে যে সমাজে মেয়ের মা !
শরীরটা আজকাল খুব দুর্বল লাগে করুনার | শুধু দুধ আর ফলের রস ছাড়া অন্য কিছু খেতে পারছেনা এখন | মুখের ভেতরের ঘা এখন বেরিয়ে এসেছে বাইরে | ভয়ঙ্কর দেখায় করুনা কে |বাইরে যেতে পারেনা | কথাও বন্ধ হয়ে গেছে চিরকালের মতো | ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে করুনা | আর কিছুi হবে খেয়ে? এখন তো শুধু মৃত্যুর দিন গোনা | প্রতিদিন ঠাকুরের ফটোর সামনে মাথা ঠুকে করুনা বলে " তুলে নাও, আর পারছিনা " আলমারি খুলে হাত বোলায় সাজিয়ে রাখা পাণ্ডুলিপি গুলোতে | একদিন বড়ো সাহিত্যিক হবার স্বপ্ন দেখেছিলো | অসহ্য কষ্টে লিখতে চায় কাগজে | কিন্তু কাপা হাত শুধু আঁকিবুকি কাটে | আয়া টা আজ করুনার গায়ে গরম জল ঢেলে দিয়েছে, জানে করুনা কথা বলতে পারেনা | সুযোগ বুঝে ঝর্ণা ও করুনার ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে গেল | করুনা সবই দেখে, বোঝে - ব্রেন টাতো খারাপ হয়ে যাইনি | সংসারের স্বরূপ বুঝেছে করুনা - এখানে সব সম্পর্ক প্রয়োজনে হয়, প্রয়োজন ফুরালে কেউ ফিরেও চায়না
আজ সকাল থেকে খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে করুনার | এখন ঘরেই স্যালাইন চলছে | করুনা চোখ খুলে দেখে অনেক গুলো মুখ ওর দিকে তাকিয়ে | ওর জন্য হয়তো এরা কষ্ট করেছে এতদিন, তাই সবাই ক্লান্ত - করুনা ভাবে | ওরা নিঃশব্দে ওর মৃত্যুর অপেক্ষা করছে | এরা তার আপন জন ! কিন্তু করুনার মনে হোলো সে এদের চেনেনা, আর চিনতেও চায়না | ও চোখ বোজে | নিজের অজানা যাত্রা পথটা ভাবতে চেষ্টা করে | দেখে সামনে আলোর রেখা, করুনা পা বাড়ায় |