Manasi Ganguli

Abstract

5.0  

Manasi Ganguli

Abstract

পৃথিবীর সর্বোচ্চ সীমায়

পৃথিবীর সর্বোচ্চ সীমায়

10 mins
1.0K


"কি গো সুমিতাদি খুব তো ঘুরে এলে? ভালোই আছো তোমরা, সুযোগ পেলেই বেশ বেরিয়ে পড়ছ। তোমাদের আর চিন্তা কি,ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে,আমাদের দুটো যে কবে বড় হবে,হিংসা হয় তোমাদের দেখে",ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে ফেলল সিক্তা। সুমিতা হাসে, "আরে,আমাদেরও তো অমন দিন ছিল,ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতে কতটুকই বা ঘুরেছি বল? তোরাও ঘুরবি,অত ভাবছিস কেন?" "খুব ভাল লাগে গো,দাদাকে আর তোমাকে দেখে,খুব ভাল কর তোমরা এটা,আর দাদার যা কাজের চাপ,মাঝে মাঝে একটু ব্রেক ও তো দরকার। আজ আমি সব সেরে একদম ফ্রি হয়ে এসেছি তোমার দুবাইয়ে ঘোরার গল্প শুনব বলে,ছেলেমেয়েরা স্কুলে,ফিরতে এখনও অনেক দেরী", বলল সিক্তা। "খুব ভাল করেছিস,দুপুরে আমার সঙ্গেই দুটো খেয়ে নিস,তাহলে অনেক্ক্ষণ গল্প করা যাবে", সুমিতার কথায় দুজনেই হেসে ওঠে। 

     সুমিতা শুরু করে,"মধ্যপ্রাচ্যের একটি বিশ্বব্যাপী শহর এবং ব্যবসা কেন্দ্র হল এই দুবাই। তেল রাজস্ব শহরটির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছিল কিন্তু দুবাইয়ের তেলের পরিমাণ সীমিত এবং উৎপাদন মাত্রা কম,রাজস্বের ৫% র ও কম আয় তেল থেকে আসে। দুবাইয়ের অর্থনীতি আজ বাণিজ্য,পর্যটন,বিমানচালনা,রিয়েল এস্টেট ও আর্থিক পরিষেবাগুলির উপর নির্ভর করে,অথচ জানিস অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে দুবাই একটি মাছ ধরার গ্রাম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। দুবাই বিশ্বব্যাপী লম্বা নির্মাণ প্রকল্প আর ক্রীড়া ইভেন্টের মাধ্যমে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে,বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ভবন বুর্জ খলিফা। পর্যটনকে ওরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে জানিস,কি পরিমাণ বিদেশি টাকা ঢুকছে এই পর্যটনের মাধ্যমে,সত্যি শেখার বিষয়। ওখানে গিয়ে ভাবছিলাম,আমাদের দেশের নেতা,মন্ত্রীরাও তো যায় ওদেশে,দেখে শিখতে ইচ্ছে করে না? আমি যদি মন্ত্রী হতাম না ঠিক আমাদের দেশের পর্যটনকেও শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতাম"। " এটা তুমি দারুণ বললে সুমিতাদি,দাদাকে বলতে হবে তোমায় ভোটে দাঁড় করাবার ব্যবস্থা করতে",সিক্তার কথায় দুজনে হো হো করে হেসে ওঠে। 

    সুমিতা আবার শুরু করল,"দুবাইয়ের মূল বাণিজ্যিক শহর 'ডাউনটাউন দুবাই'এর শেখ জায়েদ রোডে রয়েছে বর্তমানে পৃথিবীর আকাশচুম্বী অট্টালিকা বা উচ্চতম ভবন বুর্জ খলিফা। এটি দেখার এবং এর উচ্চতম অংশ ১২৪ তলা থেকে পাখির চোখে রাতের লাল-হলুদ-সবুজ আলোয় ঝলমলে দুবাইকে দেখার সৌভাগ্য হয় আমার গত ১০ই অক্টোবর। দুবাই শহরে পা রেখেছিলাম ৮ই অক্টোবর। ৭ই অক্টোবর রাত থেকে শুরু হয়েছিল দুর্যোগ,কি করে যাব তাই ছিল অনিশ্চিত। সে কি অবস্থা,রাতভর বৃষ্টি। দুবাই যাবার ও বুর্জ খলিফা দেখার উত্তেজনা ছিলই,সাথে এই দুর্যোগে যুক্ত হল অনিশ্চয়তা,সব মিলিয়ে সে রাতের ঘুম তো দফারফা। রাত ৩.৩০টেয় বিছানা ছেড়ে ৪.৪৫র মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম দুবাই যাবার জন্য,যদিও বৃষ্টি চলেছে সমান বেগে,টাপুরটুপুর ছন্দে নয়,একেবারে ঝমঝমাঝম ছন্দে। ওই বৃষ্টির মধ্যে এয়ারপোর্টে যাবার পথে জ্যামে পড়লাম,কি করে যে পৌঁছাব সে এক ভীষণ আশঙ্কায় মনের মাঝেও কালো মেঘের ঘনঘটা। অবশেষে সব দুর্যোগ কাটিয়ে সময়মতোই পৌঁছাতে পারলাম এয়ারপোর্ট,তারপর চেপে বসলাম এমিরেটসের বিমানে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে। জানলার কাচে বৃষ্টির জল,কিছুটা ওপরে উঠলে বৃষ্টি উধাও,জানলা দিয়ে মেঘেদের ওড়াউড়ি দেখলাম খানিক,তুই তো জানিস আমি প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে খুব ভালবাসি। খানিক পরে বিমানবালারা খাবার আর পানীয় সার্ভ করলে তার সদ্ব্যবহার করে কিছু সময় চোখ বুজে নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি কাটাবার চেষ্টা চালাতেই কোথা দিয়ে ৫টা ঘন্টা পার,বেলা একটায় দুবাই পৌঁছালাম। এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আর পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম,ব্যস্ততম বিমানবন্দর। এটি খুব সুন্দর,পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন,বেশ কয়েকঘন্টা অনায়াসে এখানে কাটানো যায়। ভিতরে শপিং কমপ্লেক্স,ফুড কোর্ট,ডিউটি ফ্রি শপ সবই রয়েছে সময় কাটাবার জন্য। আমার তো ওখানেই অনেকটা সময় কাটাতে ইচ্ছে করছিল"। সিক্তা হাসতে হাসতে বলে,"তারপর?"

     "ভেতরে রয়েছে ব্যাটারিচালিত ড্রাইভারবিহীন ট্রেন,একটা টার্মিনাল থেকে আরেকটায় যাবার জন্য,রয়েছে ঘরের মত বড় সাইজের লিফট,যাতে করে ৩০ কিংবা তারও বেশি মানুষ একসাথে ওঠানামা করতে পারে। লাগেজ নিয়ে হোটেল পৌঁছালাম ঝকঝকে ইনোভা ট্যাক্সিতে করে। সেদিনের মতন লাঞ্চ করে নিয়ে গেলাম গোল্ড স্যুক দেখতে। সেখানে চারিদিক সোনার আলোয় ঝলমলে,চোখ যেন ঝলসে যেতে লাগলো কনকদ্যুতিতে। এত সোনা একসাথে দেখিনি কখনও আগে। সোনার জুতো,সোনার নাইটি ম্যানিকুইনকে পরানো জানিস তো। সেখান থেকে বেরতে কি আর ইচ্ছে করে? কিন্তু রাতের জন্য আবার বুক করা ছিল ক্রুজ,সেও এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা,অসাধারণ মেনু,কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই,সঙ্গে দারুণ সব প্রোগ্রাম,নাচগানের আয়োজন। সুন্দর সাজানো-গোছানো আলো দিয়ে সাজানো লঞ্চে চেপে রাতের খাবার খেতে খেতে ক্রিকের বুকের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া দারুণ উপভোগ্য। পাস দিয়ে ভেসে যাচ্ছে অন্যান্য বেশ কয়েকটি লঞ্চ,সবকটাই আলো দিয়ে সুসজ্জিত। জানিস,এত সৌন্দর্য একা একা উপভোগ করতে মন চায় না,মনে হয় প্রিয়মানুষদের সঙ্গে দেখি।" "তা ঠিক", সিক্তা বলে। 

" তারপর?"

     "পরদিন ভোরবেলায় অর্থাৎ ৯তারিখে ছিল হেলিকপ্টার রাইড,অনলাইন টিকিট কাটাই ছিল আগে। জীবনে কখনও হেলিকপ্টার চাপিনি,ছিল তাই দারুণ উত্তেজনা। ভোরবেলা পৌঁছে গেলাম হেলিপ্যাডে কিন্তু সেদিন আকাশ পরিষ্কার না থাকায় প্রথম হেলিকপ্টার ছাড়তে অনেক দেরি হয়ে গেল। আমাদের টার্ণ আসতে আসতে আরো বেলা হয়ে গেল। খিদে পেয়ে গেছে তখন সকলের। তারপর মাথায় হেলমেট চাপিয়ে হেলিকপ্টারে উঠে বসলাম। সামনে থেকে দেখলাম তো,কি বিরাট বিরাট পাখাগুলো। উড়লাম আমরা,সমুদ্রের উপর দিয়ে যখন যাচ্ছিল দারুণ রোমাঞ্চকর অনুভূতি,তলায় সমুদ্র উপর দিয়ে আমরা যাচ্ছি। নিচে পাম আইল্যান্ড,জুমেরা বিচ,হোটেল আটলান্টিসের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার পাক খেতে লাগলো,অসম্ভব জোরে আওয়াজ কিছু শোনা যাচ্ছে না,আমাদের সঙ্গের সাথীটি চোখ বুজে বসে ছিল ভয়ে। ১৫কি ২০মিনিটের রাইড ছিল বেশ ভাল লাগল,কিছুক্ষণের জন্য বেশ নিজেকে ইন্দিরা গান্ধী মনে হচ্ছিল,বুঝলি"। "খুব বুঝলাম" বলে সিক্তা হো হো করে হেসে ওঠে। "এরপর হোটেলে ফিরলাম,খানিক রেস্ট নিয়ে সেদিন দুপুরে ছিল আমাদের মরুভূমি যাওয়া সেখানে মরুভূমির মধ্যে যে চালক আমাদের নিয়ে গেল সে স্যান্ড ডিউনসের মধ্যে দিয়ে উঁচুনিচুতে গর্তের মধ্যে দিয়ে অসম্ভব দক্ষতায় গাড়ি চালাচ্ছিল। এদিকে যেমন মৃত্যুকূপের ভিতর কূপের গা দিয়ে গাড়ি চালানো দেখায় বিভিন্ন মেলায়,এ যেন সেইরকম,বালি দিয়ে যখন গর্তের ভেতর নেমে গা দিয়ে লাফালাফি করছিল আমার ভীষণ ভয় করছিল। সঙ্গের সবাই খুব এঞ্জয় করছিল,কয়েকজন বিদেশিও ছিল গাড়িতে,কিন্তু আমার একদম ভাল লাগছিল না,আমি সুস্থ ভাবে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। এই অসুবিধার কথাটা আমি বলার আগেই দুজন বিদেশি ছিল যারা নিজেরাও অসুবিধা বোধ করছিল,তারা জানালে গাড়ি থামাল,আমরা নামলাম মরুভূমির ঊষর মাটিতে। যেদিকে দুচোখ যায় ধূ ধূ বালি,দূরে তাকালে রোদের আলোয় সোনার মত চিকমিক করছে। বিদেশি দুজন ড্রোন ক্যামেরায় ছবি তুলল,আমরাও ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে দেখলাম,এরপর ড্রাইভার স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চালিয়ে ৪৫ মিনিটের জায়গায় ২০ মিনিট ঘুরিয়ে আমাদের বাইরে বার করে নিয়ে এল। তোর দাদার অবশ্য ভালই লাগছিল, বেচারা আমার জন্য এঞ্জয় করতে পারল না। তবে আরেকটু থাকলে মরুভূমিতেই সূর্যাস্ত দেখতে পেতাম,বেরিয়ে আসায় রাস্তা দিয়ে ফেরার পথে মরুভূমির প্রান্তে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ফিরলাম আমরা হোটেলে"। "সারাদিনই প্রোগ্রাম,তাই না? হেকটিক হয়ে যাচ্ছিল না?" সিক্তার জিজ্ঞাসা সুমিতাকে। "তা তো একটু হচ্ছিলই,কিন্তু ঐ ধর সাড়ে পাঁচ দিন মত ছিলাম ওখানে,বারবার তো আর যাবো না,তাই একটু কষ্ট করেই ঘুরেছি।তবে হ্যাঁ,পায়ে যন্ত্রণাও হয়েছে,একটা করে ক্রোসিন রোজই খেতে হয়েছে"।

    "পরদিন সকালে ১০ তারিখে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে গিয়েছিলাম জুমেরা বিচে,আরবসাগরের সবুজ মাখা নীল জলে যেন স্নিগ্ধতা মাখানো,চোখ জুড়িয়ে গেল,কিছু ছবি তুলে সেখান থেকে হোটেল আটলান্টিস,ভিতরে যাইনি,সময় কম,এরপর দুবাই আউটলেট মলে,কিছু কেনাকাটা না করলে কি হয়,তা কিছু-টা একটু বেশি কিছু হয়ে গেল। ঘুরলাম কিছুক্ষণ,ওখানেই লাঞ্চ সারলাম,গেলাম মিরাকেল গার্ডেন,দেখা হল না,নভেম্বরে খুলবে। এত শুনেছি এটার কথা,খুব আপশোষ হল। আর দেখলাম রাস্তা দিয়ে হেঁটে পার হওয়ার সময় গাড়ি এসে পড়ায় যেহেতু আমি পার হচ্ছি গাড়ি থেমে গেল। খুব ভাল লাগল জিনিসটা,আর দেখলাম টোলে ট্যাক্স দেবার জন্য কোনো জায়গায় দাঁড়াতে হয় না,অটোমেটিক্যালি ট্যাক্স কাটা হয়ে যায়"। " বাঃ,দারুণ সিস্টেম তো" সিক্তা খানিক অবাকই হল। "আর রাস্তাঘাট কি পরিষ্কার,সোঁ সোঁ করে গাড়ি ছুটছে,দুপাশে উঁচু উঁচু ইমারতেরা গর্বের সঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাঝখান দিয়ে চলেছি,রাস্তার ঠিক দু'পাশে ছোট ছোট খেজুর গাছ চারিদিকে রয়েছে। এই খেজুরও কিন্তু ওদেশে ভাল ব্যবসা দেয়। রয়েছে মেট্রো রেল স্টেশন মাঝে মাঝে,ওপর দিয়ে মেট্রো রেল যাচ্ছে। আমাদের হোটেলের পাশ দিয়ে মেট্রোরেল লাইন রয়েছে,ঘর থেকেই দেখা যায় রঙচঙে এই মেট্রোরেল ঘুরতে"।

     "রাস্তা দিয়ে যেতে খুব ভালো লাগছিল,পথে জনমানব দেখা গেল না কোথাও,মানুষজন যা দেখলাম হোটেলে অথবা মলে,বাইরের তাপমাত্রায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আমাদের দেশের মত সম্ভব নয়। এরপর সন্ধ্যায় প্রোগ্রাম ছিল বুর্জ খলিফা,বিশাল লাইন দিয়ে এগোতে লাগলাম একটু একটু করে। বুর্জ খলিফা যাবার দুদিন আগে থেকেই দুবাইয়ের যেখানে যখন গেছি দেখেছি ওই গগনচুম্বী অট্টালিকাকে যার উপরিভাগ পৌঁছে গেছে মেঘেদের রাজ্যে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে ৬০ মাইল দূর থেকেও এই ভবনটি দৃশ্যমান হয়,এটি দুবাই টাওয়ার নামেও পরিচিত"।

    "২০০৪ সালে এটি নির্মাণ শুরু হয় ও ২০০৯ সালে শেষ হয়। ৪ঠা জানুয়ারি ২০১০ তারিখে এটির উদ্বোধন হয়। নির্মাণকালে এর বহুল পরিচিত নাম বুর্জ দুবাই থাকলেও উদ্বোধনকালে নাম পরিবর্তন করে বুর্জ খলিফা রাখা হয় আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সম্মানে। দুবাইয়ের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য দুবাই সরকার তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে ও দেশের অর্থনীতিতে ভ্রমণের প্রভাব বাড়াতে এই টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা করে। রকেটের মত দেখতে এই টাওয়ারটি দুবাইয়ের অহংকার ও অলংকার। কিন্তু ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বুর্জ খলিফা নির্মাণকালে অর্থনৈতিক সংকটে ছিল দেশটি। ২০০০ সালে অর্থনীতি বহুমুখীকরণ শুরু করার পর দুবাই ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের কাছে। প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান আর্থিক সহায়তা করে এই সংকটমুক্ত করেন"। সিক্তা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যাচ্ছে। 

    "বর্তমানে বুর্জ খলিফা পৃথিবীর সর্বোচ্চতম ভবন এবং সারা বিশ্বের কাছে এটি দর্শনীয় ও আকর্ষণীয়। বুর্জ কথার অর্থ টাওয়ার তাই বুর্জ খলিফা হল খলিফার টাওয়ার। এতে ৫৭টা লিফট ও ৮টা এস্কেলেটর আছে। এই ভবনটিতে রয়েছে ৩০হাজার বাড়ি,৯টাহোটেদুবাই মল। একেকটি লিফটে ১২-১৪ জনের ক্যাপাসিটি। নিচ থেকে ১৬০ তলা অবধি ২৯০৯টি সিঁড়ি আছে। এটি তৈরিতে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছে। এখানে ১০৪৪টি অ্যাপার্টমেন্ট আছে,৪৩ তম তলা ও ৭৬ তম তলায় আছে দুটি সুইমিং পুল। আছে ১৬০ কক্ষ বিশিষ্ট একটি হোটেল। ১২৪তম তলায় দর্শকদের জন্য প্রকৃতি দর্শনের ব্যবস্থা আছে। এখানকার কোন কোন লিফটের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ মাইল। মাত্র ৫৪ সেকেন্ডে উঠে গেলাম ১২৩ তলা,সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম একটা তলা। জীবনে প্রথম এত উচ্চতায় উঠে এক অসাধারণ অনুভূতি হচ্ছিল,আরও যারা ছিলেন সেখানে তাদের অভিব্যক্তিও বলে দিচ্ছিল আমার মত অনুভুতি তাদেরও হচ্ছিল। পাগলের মত ছুটে ছুটে এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দেখছিলাম দুবাই শহরকে। তলা দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট গাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন পিঁপড়েরা সারি দিয়ে যাচ্ছে। বেশ অনেকটা সময় ওখানে কাটালাম শিশুর মতন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে। উপর থেকে আলো ঝলমলে দুবাই দেখলাম তবে এই বুর্জ খলিফা শুরু হওয়ার আগে নাকি এখানটা ছিল ধূ ধূ প্রান্তর। উপর থেকে দিনের বেলা পরিষ্কার বোঝা যায় একদিকে ধূধূ মরুভূমি,অন্যদিকে ফেনিল সাগর"। "বাপ রে,কত কি জানো গো তুমি সুমিতাদি"। "আরও জানি,আর এখন জানার কত সুবিধা,হাতের মুঠোয় পৃথিবী,মুঠো খোলো,জেনে নাও। আমি যখনই কোথাও যাই,জায়গাটা সম্বন্ধে ভাল করে পড়ে নিই,তাহলে কবে কোথায় যাবো যেমন প্ল্যানিং করা যায়,তেমনি কিছু মিস হয়ে যাবার সম্ভাবনা কম। দেখ একজায়গায় তো আর বারবার যাবো না,তাই যতটা কভার করা যায়। আমরা সাড়ে পাঁচ দিন ছিলাম ওখানে,জানা ছিল বলে অনেকটাই কভার করেছি,ঐ কদিনে সব তো আর খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয় না। তবে ওখানে গিয়েও অনেক কিছু জানলাম। বিভিন্ন প্রোগ্রামে যখন গেছি,সেসবের টিকিটের পিছনে হয়তো কিছু লেখা ছিল বা কোথাও সাইনবোর্ড, সেগুলোর ছবি তুলে নিতাম,পরে দেখতাম। আর জেনেছি হোটেলের কর্মচারীদের কাছে। জানিস প্রচুর বাংলাভাষীদের দেখলাম ওদেশে কাজ করতে,আমাদের হোটেলেই তো মনে হত যেন কলকাতায় আছি। ওদের কাছেও জেনেছি অনেক কিছু। তবে এইসব বাঙালীদের বেশিরভাগটাই বাংলাদেশের"। "উফফ,ভাগ্যি আজ তোমার কাছে এলাম গল্প শুনতে,তাই কত কি জানলাম। সিক্তার এই কথায় সুমিতা বলে," আরও কিছু জেনে নে তাহলে",দুজনে খুব খানিক হাসল।

    "এটি নির্মাণের সময় প্রতি তিনদিন পর পর এক একটি ছাদ তৈরি করা হয়েছে। রোজ ১২০০০ শ্রমিক কাজ করেছে সেই সময়। বর্তমানে এর প্রতি বর্গফুট জায়গার দাম ৪০০০ ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে,অথচ এরকম বিশাল ব্যয়বহুল এক কাজে দুবাই সরকার অর্থ ব্যয়ে কৃপণতা করেছে শ্রমিকদের সাথে। যে ৭৫০০ শ্রমিক ৬ বৎসর যাবৎ কাজ করেছেন তারা দৈনিক মাত্র ২.৮৪ ডলার পারিশ্রমিক পেয়েছেন। তাছাড়া কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি ঘটেছে আরো অনেক শ্রমিকের। দুবাই সরকার এই শ্রমিকদের প্রতি মানবিক আচরণ টুকুও করে নি। শ্রমিকদের বাসস্থান ও খাবারের ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের,এছাড়া বেশি সময় কাজ করিয়ে অল্প পয়সা দেওয়া হত এদের। এদের একটা বড় অংশ দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে রঙিন স্বপ্ন দেখতে পাড়ি জমিয়েছিল দুবাই,অথচ সরকারের তাতে ভ্রুক্ষেপও ছিল না। তাই ২০০৬ সালে প্রায় ২৫০০ শ্রমিক মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।"

    "বুর্জ খলিফা এত উঁচু একটি ভবন যে নিচতলা ও সর্বোচ্চ তলার মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে উঠতে একসময় মেঘেদের দেশে হাত বাড়ায় পৃথিবীর উচ্চতম স্থাপনা,ভুবনখ্যাত,আকাশচুম্বী অট্টালিকা বুর্জ খলিফা। সূর্যাস্তের পরেও আরো ২মিনিট ধরে সূর্যকে দেখতে পায় ভবনের উপর তলার লোকেরা,ফলে রমজান মাসে দুবাইয়ের মাটিতে মুসলিমরা যখন ইফতার শুরু করেন বুর্জ খলিফার ৮০ তলার উপরে বসবাসরত মুসলিমরা ইফতার করেন তার ২মিনিট পর"।

     "এই টাওয়ারটি ডিজাইন করে SOM যারা শিকাগোর Will Tower ও নিউ ইয়র্কের One World Trade Centre এর ডিজাইন করেছে। প্রথমে স্থির হয়েছিল বুর্জ খলিফা সম্পূর্ণ আবাসন হবে। ৪০০০রেরও বেশি টন স্টিল ব্যবহার হয়েছে এই ভবনটি নির্মাণে। ১০০০ পিস বাছাইকৃত,বিখ্যাত আর্ট ওয়ার্ক দিয়ে বুর্জ খলিফার অন্দর সুসজ্জিত। ১০৮ তলা পর্যন্ত ৯০০টি ব্যক্তিগত বসবাসযোগ্য অ্যাপার্টমেন্ট আছে যেগুলি মার্কেটে আসার আধঘণ্টার মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। শোনা যায় শাহরুখ খানের নাকি একটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে এখানে। প্রখর সূর্যের তাপ যাতে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় তাই মিরার গ্লাস দিয়ে তৈরি এর দেওয়াল এখানে ব্যবহৃত স্টিল গুলি ও মিরর এফেক্ট দেওয়া। এ যেন এক আর্কিটেকচারাল জায়ান্ট।

    এই ভবনটি অনেকগুলি বিশ্ব রেকর্ড করেছে 

বিশ্বের সর্বাধিক তলা বিশিষ্ট-১৬০ তলা

সর্বোচ্চতম আবাসন -১০৮ তলা পর্যন্ত

সর্বোচ্চ ভবন -৮২৮ মিটার 

বিশ্বের দীর্ঘতম এলিভেটর-৫০৪ মিটার 

বিশ্বের উচ্চতম মসজিদ -১৫৮তলায় 

বিশ্বের উচ্চতম নাইট ক্লাব

বিশ্বের দ্রুততম এলিভেটর -ঘন্টায় ৬৪কিলোমিটার 

বিশ্বের উচ্চতম সুইমিংপুল -৪৩ তলায়

   দুবাই মল দিয়ে বুর্জ খলিফা ভবনে ঢোকার পথ। 

এই মূল প্রবেশপথের পাশেই একটি কৃত্রিম ঝর্ণা আছে যা দুবাই ফাউন্টেন নামে পরিচিত। আমেরিকার ওয়েট এন্টারপ্রাইজ ২১৭ মিলিয়ন ডলার খরচ করে এই ঝর্ণাটি তৈরি করে। রাতের বেলা এই ঝর্ণাকে আলোকিত করে ৬৬০৪টি রঙিন বৈদ্যুতিক বাতি। এটি ৪৯০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত জল ছুঁড়তে পারে,আর পুরো ভবনকে ঘিরে রয়েছে বিস্তৃত মনোরম বুর্জ খলিফা পার্ক। এই পার্কে চারিদিকে রয়েছে ছোটখাটো অনেক ঝর্ণা এবং প্রতিটি গাছে আলো দিয়ে সাজানো,এ যেন কোন উৎসব মনে হয় এখানে এলে। ২০১০ সালে উদ্বোধনের পর থেকেই বুর্জ খলিফা হয়ে ওঠে পৃথিবীর অন্যতম ট্যুরিস্ট আকর্ষণ। শুধু উচ্চতায় নয় বুর্জ খলিফার আভিজাত্য ও নির্মাণশৈলী এক কথায় চোখ ধাঁধানো"।

    "অসাধারণ সুমিতাদি,অসাধারণ। দুবাইয়ের কি সুন্দর একটা ছবি তুলে ধরলে তুমি,চোখের সামনে যেন ভাসছে। কি স্মরণশক্তি গো তোমার। শুধু তাই নয়,এত সুন্দর বর্ণনা,তুমি ভ্রমণকাহিনী লেখো দিদি,মার্কেটে পড়তে পাবে না। আমি কিন্তু একটুও ইয়ার্কি মারছি না,সিরিয়াসলি"। " আর বকিস না তো,ঘড়িটা দেখ,বকতে বকতে বেলা দুটো,চল খেয়ে নিই"। সিক্তা হইহই করে উঠল, "চল,চল,স্কুল ছুটির আগে বাড়ি যেতে হবে আবার"।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract