Sanchaita Roy Chowdhury

Abstract Tragedy Others

4.5  

Sanchaita Roy Chowdhury

Abstract Tragedy Others

প্রিয় তুমি কোথায়!

প্রিয় তুমি কোথায়!

5 mins
357



দেবদত্তা আজ অনেক বছর পর কলেজের রিইউনিয়নে এসেছে।কলেজ অনেক বদলেছে।কলেজের রঙ,কলেজের ছাত্র-ছাত্রী,কলেজের অধ্যক্ষ আরো অনেক কিছুই।দেবদত্তার বন্ধু এষা মুখটা গম্ভীর করে বলল,'কলেজটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে'।দেবদত্তা হেসে বলল,'আমরা কি পাল্টাইনি? সব কিছুই পরিবর্তনশীল মানুষ পাল্টে যায় আর কলেজ তো দূরের কথা ।'

কলেজের স্মৃতি কমবেশি সকলের কাছেই খুব দামী, কারণ এখানেই ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের জীবনের স্বাধীনতার বেশির ভাগটা উপভোগ করে।তবে সকলের কলেজের স্মৃতি সমান হয়না। এই যেমন দেবদত্তার।দেবদত্তার কলেজ জীবনে যত না আনন্দের স্মৃতি আছে,তার চেয়ে বেশি আছে দুঃখের স্মৃতি।

দেবদত্তার স্কুলের একমাত্র বন্ধু ছিল সাত্যকি।সাত্যকি খুব গম্ভীর ,স্বল্পভাসি,ঠান্ডা মাথার ছেলে।জীবনে তার যা কিছু ঘটত , তা শুধু সে দেবদত্তাকে বলত।দেবদত্তাকে কেউ কিছু বললে সাত্যকিই সবার আগে রুখে দাঁড়াত।এই কলেজে পড়তে আসাটাও ছিল তার সাত্যকির জন্য।সাত্যকিই চেয়েছিল দেবদত্তা যেন কলেজ জীবনটাও তার সাথে পড়াশোনা করে।

দেবদত্তা সাত্যকিকে সেই স্কুলজীবন থেকে ভালোবাসে,কিন্তু সে কখনো সেই কথা সাত্যকিকে বলে উঠতে পারেনি।দেবদত্তা ভেবেছিল কলেজেই সে তার সমস্ত মনের কথা সাত্যকিকে জানাবে।কিন্তু সব ভালোবাসা যে সত্যি হয়না।

হঠাৎ একদিন কলেজে একটি সুন্দরী মেয়ে তাদের ইংরেজী সাম্মানিক বিভাগে পড়াশোনা করতে আসে।তার নাম ছিল সুমেধা।সুমেধাকে অনেকেই ভালোবাসার প্রস্তাব দিত,কিন্তু সুমেধা তাদের সকলকেই প্রত্যাখ্যান করে দিত।একদিন দেবদত্তা সাত্যকিকে বলে বসল,'দেখ সাত্যকি,সুমেধাকে কতজন ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়,কিন্তু সবাইকে বাতিল করে দেয় মেয়েটা।'

সাত্যকি একটু অদ্ভুত ভাবে বাঁকা হাসি হাসলো।

দেবদত্তা বলল,'কাল আমার জন্মদিন মনে আছে তো ?'

সাত্যকি বলল,'হুম্ ....'

পরের দিন সাত্যকি কেক নিয়ে কলেজে এলো দেবদত্তার জন্মদিন পালন করবে বলে।সাত্যকি বেশি লোকজন পছন্দ করে না,তাই ক্লাস শেষের পর সে দেবদত্তাকে খালি ক্লাসে কেক কাটতে বলল।সবকিছু হয়ে গেলে দেবদত্তা ভাবলো আজই সাত্যকিকে সে সবকিছু জানাবে।কিন্তু তার আগেই সাত্যকি তাকে বলল,'দেবদত্তা আমার তোকে কিছু বলার আছে।আমি অনেকদিন ধরেই বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু বলতে পারিনি।'

দেবদত্তা ভাবলো,'সাত্যকি কি আমাকে বলবে ও আমায় ভালোবাসে?আর যদি বলে আমি কি বলব?'

কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে,কিছুটা লজ্জা পেয়ে দেবদত্তা বলল,'আমার ও তোকে কিছু বলার আছে,কিন্তু তুই-ই আগে বল।'

সাত্যকি বলল,'এক বছর হল আমি একটা সম্পর্কে আছি। আগে তাকে আমি অনেক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।'সাত্যকি একটু লজ্জা পেয়ে বলল,' আসলে আমি একজনকে ভালোবাসি।'

দেবদত্তা ভাবলো,'সাত্যকি যা চাপা স্বভাবের ছেলে তাই হয়তো বলতে পারেনি।তাছাড়াও অনেকদিন থেকেই আমাকে সাত্যকি সেইভাবে পাত্তাও দিচ্ছে না।এত বছরে আজ এই প্রথম আমি সাত্যকিকে এত খুশি হতে দেখলাম।তার মানে সেই সৌভাগ্যবান মেয়েটি আমি হতে চলেছি।'

দেবদত্তা বলল,'কে সেই সৌভাগ্যবান?'

সাত্যকি বলল,'সুমেধা...।'

এক লহমায় দেবদত্তার সমস্ত আনন্দ,উৎসাহ ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।আসলে আনন্দে দেবদত্তা সাত্যকির একবছর সম্পর্কে থাকার কথাটা বুঝতে পারেনি।দেবদত্তা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না।

তাই বলল,'ওহ্!'

সাত্যকি বলল,'তোকে এতদিন বলিনি কারণ সুমেধা মানা করেছিল সবকিছু এত তাড়াতাড়ি প্রকাশ করতে। তুই খুশি তো? আর তুই কি একটা বলবি বলছিলিস?'

দেবদত্তা বলল,' আমি খুব খুশি । আর তাছাড়া আমার খুশি হওয়া না হওয়ায় কি আসে যায় । জীবনটা তোর আমার নয়।' দেবদত্তা আরো বলল,'আর আমি এত খুশি হয়েছি যে যেটা বলব ভেবেছিলাম সেটা ভুলে গেছিরে। অনেক রাত হল বাড়ি ফিরতে হবে।'

সাত্যকি তার গাড়ি করে দেবদত্তাকে বাড়ি পৌছে দিল।

সেদিন সারারাত দেবদত্তা অন্ধকার ঘরে কেঁদেছে,কাউকে বলতে পারেনি তার কষ্টের কথা।

সেই রাতের পর থেকে তার সঙ্গে সাত্যকির সম্পর্ক ক্রমশ বদলাতে শুরু করে।সাত্যকি এখন সুমেধার সঙ্গে এক বেঞ্চে বসে,একসাথে টিফিন খায়,একসাথে সিনেমা দেখতে যায়,একসাথে বাড়ি ফেরে।এসবের মধ্যে দেবদত্তা কোথাও নেই।তার সাথে দেবদত্তার দূরত্ব ক্রমশ বাড়তেই থাকছে।

হঠাৎ একদিন এষা সবাইকে নিয়ে 'ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলতে বসলো।সেখানে দেবদত্তা, সাত্যকি এবং সুমেধাও উপস্থিত ছিল।সুমেধা দেবদত্তাকে হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করল , 'দেবদত্তা তোমার কোন মনের মানুষ আছে?যদি থাকে তো কে?'

দেবদত্তা বলল,'হ্যাঁ,আছে । কিন্তু আমি তার পরিচয় দিতে পারব না ।'

সুমেধা বলল,'কেন?'

দেবদত্তা বলল,'সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না সুমেধা।'এই কথাটা শুনে সাত্যকি দেবদত্তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল।

পরের দিন সুমেধা না আসায় সাত্যকি দেবদত্তার পাশে বসল।ক্লাস শেষে দেবদত্তাকে বলল,'আজ আমার সাথে বাড়ি ফিরবি?'

দেবদত্তা জানতো সাত্যকি তার সাথে কেন বাড়ি ফিরতে চাইছে।বলল,'হ্যাঁ ।'

রাস্তায় যাওয়ার পথে সাত্যকি জিজ্ঞাসা করল,'তো কে সেই মনের মানুষটি যার কথা আমাকে বলা যায়নি?'

দেবদত্তা বলল,'আমার সাথে বাড়ি ফেরার কারণ তবে এটাই ।'

সাত্যকি বলল 'হ্যাঁ ।'

দেবদত্তা বলল,'কি জানতে চাস বল?'

সাত্যকি জিজ্ঞাসা করল,'কতদিন হল?'

দেবদত্তা বলল,'আমি যখন স্কুলে পড়তাম সেও আমার সাথে পড়ত।'

সাত্যকি বলল,'আমি কি তাকে চিনি?'

দেবদত্তা বলল,'তোর থেকে ভালো আর তাকে কেউ চেনেনা।আমি তাকে অনেকদিন ধরে ভালোবাসার কথা জানানোর চেষ্টা করেছি,সেই নবম শ্রেণী থেকে।কিন্তু যেদিন বলব ঠিক করলাম সেদিন জানতে পারলাম সে অন্য একজনকে ভালোবাসে,তাই আর বলা হয়ে ওঠেনি।কারণ কিছু কথা নিজের মধ্যে রাখাই ভালো ।'

সাত্যকি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,'তাও বল ছেলেটা কে?'

দেবদত্তা বলল,'যদি বলি তুই । আমি তোকে ভালোবাসি।'

সাত্যকি বলল,'কি?'

দেবদত্তা বলল,'হ্যাঁ ।'

সাত্যকি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর গম্ভীর গলায় বলল,' ক্ষমা করিস ।আমি একমাত্র সুমেধাকেই ভালোবেসেছি,আমার পরিবারের সঙ্গে ওর পরিবারের মধ্যে আমাদের বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা চলছে।আমরা বিয়ের পর বিদেশে চলে যাব । আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভুলে যাস দয়া করে । আর আজ থেকে আমার সাথে কোনো রকমের কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করিস না,এটা আমার অনুরোধ।'

দেবদত্তা চোখ ভর্তি জল নিয়ে বলল,'তুই কি এক মূহূর্তের জন্য ও আমাকে ভালোবাসিস নি?আমার প্রতি তোর যত্ন , বন্ধুত্ব এসব কিছুই কি মিথ্যে ছিল?'

সাত্যকি বলল,'আমি তোকে কখনোই ওইভাবে ভালোবাসিনি,আমি তোকে খুব ভালো বন্ধু ভাবতাম।বন্ধুও তো বন্ধুকে যত্ন করে, সাহায্য করে।আমাকে ক্ষমা করিস দেবদত্তা।আর আশা করব আজ থেকে কোন যোগাযোগ তোর আর আমার মধ্যে থাকবে না।' একথা বলে সাত্যকি চলে গেল ।

এই ভয়টাই দেবদত্তা পেয়েছিল। তার সব কথা শুনে সে ভাবছিল যে ,সে ভালোবাসা আর বন্ধুত্বকে হয়তো গুলিয়ে ফেলেছে,কিন্তু তার যে সব থেকে প্রিয় মানুষ আজ তাকে ছেড়ে চলে গেল ।

এরপর থেকে এখন তার কাঁদতেও কষ্ট হয় ।

ক্লাসে গেলেও কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলে না তারা।এভাবেই দেবদত্তার কলেজ জীবন শেষ হল।পরে বন্ধু এষার কাছে শুনেছিল সাত্যকির সুমেধার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে ,সে এখন বিদেশে থাকে ।এসব কিছুই তার আগে থেকেই জানা ছিল ।

আজ অনেক বছর পর কলেজের রিইউনিয়নে এসে এসব কথাই তার মনে পড়ছে।দেবদত্তা জানে সে জীবনে একজনকেই ভালোবেসেছে সে হল সাত্যকি।কলেজের শেষ পরীক্ষার দিন তার সাথে সাত্যকির শেষ দেখা হয়েছিল ,তারপর দেবদত্তা আর কোনোদিন সাত্যকিকে দেখতে পায়নি।সে তার সাত্যকির প্রতি ভালোবাসার কথা সাত্যকি ব্যতীত আর কাউকে কখনো জানায়নি ।

আজও অসংখ্য মানুষের মধ্যে দেবদত্তা তার সাত্যকিকেই খুঁজে বেড়ায় ।শুধুমাত্র সাত্যকি ভালো আছে এটা দেখার জন্য ।

এষা বলল,'তুই এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? চল্,ওদিকে সবাই এসে গেছে ।'

দেবদত্তা হাজারো মানুষের ভিড়ের মধ্যে সাত্যকিকে খুঁজল,কিন্তু এবারও সে তার দেখা পেলনা। দেবদত্তা আশা করেছিল, হয়তো এবার তাকে সে দেখতে পাবে।কিন্তু না,তা হয়নি। দেবদত্তা ভিড়ের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,'প্রিয় তুমি কোথায়!'

                    ________________________



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract