অন্যরকম ভালোবাসা
অন্যরকম ভালোবাসা
অন্যরকম ভালোবাসা
পর্ব-৪৯
আট বছর পর
দেখতে দেখতে কেটে গেছে গোটা আটটা বছর। এর মধ্যে কতকিছু হয়েছে অদৃতের জীবনে । কখনো তার কেরিয়ার বিপদের সম্মুখীন হয়েছে আবার কখনো সাফল্যের। সে এখন নিজেকে সবসময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখে। এখন তার বিজনেসের পরিব্যাপ্তি আগের তুলনায় আরো অনেক বেশি হয়েছে। কতকিছু ঘটে গেছে তার এই আটটা বছরের জীবনে। এতোকিছুর মধ্যেও সে তার আর্যকে আজও ভুলতে পারেনি। আজও সে অপেক্ষা করে আর্যর জন্য।
সে একবার কলকাতায় গিয়েছিল আর্যর খোঁজ করতে , খোঁজ করতে গিয়ে সে জানতে পারে আর্য এখন আর এই দেশে থাকে না , সে বায়রে থাকে। সে অনেক খোঁজ করেছিল আর্যর কিন্তু কোথাও খুঁজে পায়নি তাকে। রাজদীপের কাছেও গিয়েছিল অদৃত কিন্তু সেখানেও সে তা জানতে ব্যর্থ হয়েছে ।
অদৃত তার বিলাসবহুল অফিসের রুমে বসে ভাবলো,'আটটা বছর কেটে গেল আর্য তাও আমি তোমাকে খুঁজে পেলাম না। কোথায় আছো তুমি আর্য? তুমি ভালো আছো?
অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে থাকার কিন্তু কিছুতেই পারিনি। তুমি আমার কাছে গভীর ক্ষতের মতোন হয়ে আছো।এখন তোমার ফোনবন্দী ছবিগুলোই আমাকে সঙ্গ দেয়। জানো আর্য এখন আমার বইয়ের তাকে 'চাঁদের পাহাড়','আম আঁটির ভেপু','মেঘনাদ বধ কাব্য ' বইগুলোর স্থান হয়েছে। কখনো ভাবিনি জানো আমিও বাংলা গল্প পড়ব , বাংলা গল্পের বই কিনবো।
কিন্তু কোথাও যেন এই সমস্ত কিছুর মধ্যেও কিছুর একটা অভাব অনুভব করি আর সেটা তুমি আর্য। আমি কি তোমাকে কোনোদিনও খুঁজে পাবো আর্য?'
হঠাৎ অদৃতের রুমের দরজায় ঠক্ঠক্ আওয়াজ হল।
অদৃত বলল,'কামিং।'
দরজা খুলে বছর তিরিশের একটি ছেলে এলো।
অদৃত বলল,'ও স্বরূপ তুমি!'
স্বরূপ দাস অদৃতের পার্সোনাল অ্যাসিট্যান্ট।
স্বরূপ বলল,'স্যার আমাদের রোমের ফ্লাইট একটা বেজে তিরিশ মিনিটে।'
অদৃত বলল,'ঠিক আছে। সমস্তকিছু নিয়ে নিয়েছো তো?'
স্বরূপ বলল,'হ্যাঁ স্যার । '
অদৃত বলল,'সমস্ত ডকুমেন্টসগুলো?'
স্বরূপ বলল,'হ্যাঁ স্যার নিয়েছি।
কিন্তু স্যার একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল।'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ জিজ্ঞাসা করো।'
স্বরূপ বলল,'আমি না গেলে কি হত না? না মানে সবে সবে বিয়ে করেছি তো বউ আর কি....'
অদৃত মুচকি হেসে বলল,'কি মিস করবে তাইতো?'
স্বরূপ লজ্জা পেয়ে বলল,'আরে স্যার আপনি যে কি বলেন না।'
অদৃত বলল,'এটা বিজনেস ট্যুর বলে নয়তো বলতাম তুমিও তোমার বউকে নিয়ে চলো । কি করবো বলো।'
স্বরূপ লজ্জা পেয়ে বলল,'না স্যার ঠিক আছে।
তবে একটা আনন্দ হচ্ছে আমি ইতালির রাজধানী রোমে যাবো এইটা ভেবে।'
অদৃত হাসলো।
অদৃতের ফোনে তার মা শ্রেয়সীর ফোন বেজে উঠলো।
অদৃত ফোন ধরে বলল,'হ্যালো !'
শ্রেয়সী বলল,'হ্যালো! অদৃত সাবধানে যাস। তোদের ফ্লাইট কটায়?'
অদৃত বলল,'একটা বেজে তিরিশ মিনিটে।'
শ্রেয়সী বলল,'রোমে পৌঁছে আমাদের জানাস।'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ মা জানাবো।'
শ্রেয়সী বলল ,'সব ঠিক করে গুছিয়ে নিয়েছিলিস তো? দেখে নে এখনও সময় আছে।'
অদৃত বলল,'উফ্ মা! সব ঠিক করে নিয়েছি। তুমি অতো চিন্তা কোরোনা তো। আর এমনতো নয় যে আমি প্রথমবার যাচ্ছি । এর আগে তো অনেকবার বায়রে গিয়েছি।'
শ্রেয়সী বলল,' হ্যাঁ জানি। তাও চিন্তা হয়।'
শ্রেয়সী বলল ,'এই দেখ তোর বাবা কি বলছে।'
অদৃত বলল,' হ্যাঁ দাও।'
ইন্দ্রনীল বলল,' সমস্ত কিছু ঠিক করে নিয়েছিস তো?'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ বাবা।'
ইন্দ্রনীল বলল,'ওষুধগুলো?'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ ।'
ইন্দ্রনীল বলল,'অদৃত ওইখানে গিয়ে ঘুমের ওষুধ না খাওয়ার চেষ্টা করিস । বায়রে যাচ্ছিস বিপদ বলে কয়ে আসে না,আর ওইখানে প্রথম যাচ্ছিস ঠিক মতোন তো কিছু চিনিস না।'
অদৃত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,'বাবা তুমি অতো চিন্তা কোরোনা । আর তুমি তো জানোই আমার ওটা ছাড়া ঘুম আসে না ।'
আর্য চলে যাওয়ার পর থেকে তার ঘুমের সঙ্গী এই ঘুমের ওষুধগুলো । দিনের পর দিন সে রাত জেগে কাটিয়েছে, দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি কিছুতেই । সে অবসাদে ভুগেছে । ডাক্তার দেখালে ডাক্তার জানিয়েছিলো ঠিক করে ঘুমাতে। কিন্তু সে কিছুতেই ঘুমাতে পারত না । অবশেষে ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কথা বলে। অদৃতের এমনও অনেক রাত গেছে যখন ঘুমের ওষুধ খেয়েও তার ঘুম আসেনি।
ইন্দ্রনীল বলল,'তোর মা কথা বলবে বলছে। আর তুই সাবধানে যাস।'
শ্রেয়সী ফোন ধরে বলল,'তুই একবার ফোনটা স্বরূপকে দে তো।'
অদৃত বলল,'কেন?'
শ্রেয়সী বলল,'তুই দে না।'
শ্রেয়সীর কথা মতোন সে ফোনটা স্বরূপকে দিলো।
শ্রেয়সী স্বরূপকে বলল,'বাবা তুমি একটু অদৃতকে দেখে রেখো কেমন? ওর একটু খেয়াল রেখো ।'
স্বরূপ বলল,'কিছু চিন্তা করবেন না ম্যাম আমি ঠিক স্যারের খেয়াল রাখবো ।'
শ্রেয়সী বলল,'নিজেরও খেয়াল রেখো স্বরূপ । সাবধানে যেও।'
স্বরূপ বলল,'ঠিক আছে ।'
অদৃত বলল,'মা এবার ফোনটা রাখো আমাদের ফ্লাইটের দেরী হয়ে যাচ্ছে ।'
রোম এয়ারপোর্টে নেমে অদৃত এবং তার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্বরূপ হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হল। তারপর তিনদিন অফিসের কনফারেন্সে কেটে গেল। একদিন ব্রেকফাস্টে টেবিলে খাওয়ার সময় স্বরূপ অদৃতকে বলল,' স্যার আমাদের তো অফিসের কাজ প্রায় মোটামুটি শেষই হয়ে গেছে তাহলে এই দুটো দিন আমরা কি করব ? না মানে বলছিলাম সামনাসামনি ঘুরে এলে হয়না?'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ অবশ্যই হয়। ভালোই হবে তাহলে। আমরা এই শহরটাও দেখে নিতে পারবো শুনেছি এই শহরটা খুবই ইতিহাস বিজড়িত একটি শহর। শহরটির প্রতিটা ইঁটে নাকি ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে।'
স্বরূপ বলল ,'আমার কিন্তু খুব ভালো লাগে ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে। আমার বউ একজন ইতিহাসের অধ্যাপিকা। সময় পেলেই ওর সাথে ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করি বেশ ভালো লাগে ।' অদৃত বলল,' তাই নাকি ।'
স্বরূপ বলল,' হ্যাঁ।
আচ্ছা স্যার আপনার ইতিহাস কেমন লাগে?'
অদৃত বলল,'খুব ভালো লাগে । দেখো আমরা অতীত যদি না ঘাটাঘাটি করি তাহলে তো আমরা ভবিষ্যৎ কি করে গড়তে হয় তা জানবো না, ভুল থেকেও শিক্ষা নিতে পারবো না। তাই ইতিহাস জানাটা খুব প্রয়োজন । আর আমার ইতিহাস পড়তে ভালোই লাগে ।'
ইতিমধ্যেই স্বরূপের ফোনে ফোন বেজে উঠলো। স্বরূপ বলল,' স্যার আমি একটু আসছি। স্ত্রী ফোন করছে।'
অদৃত হেসে বলল, 'হ্যাঁ যাও।'
সন্ধ্যাবেলায় স্বরূপ বলল,'স্যার হোটেলের একজন কর্মী বলল হোটেল থেকে কিছুটা দূর গেলেই নাকি একটা আর্ট মিউজিয়াম আছে , সেখানে আজ এই দেশের একজন নামকরা চিত্রকরের একটা একজিবিশন আছে। শুনেছি ওনার একজিবিশন দেখতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ ভিড় করেন ।'
চিত্রকর শব্দটি শুনতেই তার মনে পড়ল আর্যর কথা।
সে ভাবলো,'আর্য কি করছে কে জানে? ও যদি চিত্রশিল্পী হত তাহলে ওর ও এইভাবে একজিবিশন হত। কি করছো আর্য? কোথায় আছো তুমি? তুমি এখনও আঁকো?'
স্বরূপ ডাকলো,'স্যার! স্যার!'
অদৃত বলল,'হুম্?'
স্বরূপ বলল,'আমরা এবার বেড়াবো তো?'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ ।'
স্বরূপ বলল,'স্যার বলছিলাম আশপাশটাও একবার ঘুরে দেখবো কিন্তু।'
অদৃত বলল,'ঠিক আছে। চলো।'
অবশেষে সন্ধ্যেবেলায় তারা দুজনে বেড়ালো, প্রথমে তারা গেল ট্রেভী ফাউন্টেনে।
স্বরূপ বলল ,'ওয়াও ! স্যার কি সুন্দর এই ঝর্ণাটা। ' অদৃত বলল,' এটার নাম হল ট্রেভী ফাউন্টেন। এটা রোমের একটা বিখ্যাত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বলতে পারো। এটা বিশ্বের বিখ্যাত ফাউন্টেনগুলির মধ্যে একটা।'
স্বরূপ বলল,' বাহ্! খুব সুন্দর। '
অদৃত বলল,' এটির ডিজাইনার হলেন নিকোলা সালভি। এই ঝর্ণাটা তিনটে রাস্তার সংযোগস্থলে অবস্থিত। প্রাচীন রোমের জল সরবরাহকারী জলজ গুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এই ফাউন্টেনের মাঝে যে মূর্তিটা দেখতে পাচ্ছো সেটি হল রোমের সমুদ্র দেবতা নেপচুনের মূর্তি, যিনি একটা রথ চালাচ্ছেন। আর এই ফাউন্টেনের পেছনের অংশটা হল একটা প্যালেস , যার নাম পালাসো পলি।'
রাতের সোনালী উজ্জ্বল আলোয় এই ট্রেভী ফাউন্টেন আরো সুন্দর হয়ে উঠলো।
স্বরূপ বলল ,'স্যার এই হলুদ আলোয় খুব সুন্দর লাগছে কিন্তু। এইখানের সমস্ত আলোই সোনালি রঙের কেন?'
অদৃত বলল ,'হ্যাঁ প্রত্যেকটা স্থাপত্য ভাস্কর্যেই কিন্তু সোনালী আলো ব্যবহার করা হয়।
স্বরূপ জিজ্ঞাসা করল ,'কিন্তু কেন স্যার?'
অদৃত বলল,' যতদূর জানি চোখের সৌন্দর্য্য এবং কিছুটা বলতে পারো এই স্থাপত্য-ভাস্কর্যের একটা জৈব ভারসাম্যপূর্ণতা বজায় রাখে এই আলো এবং নান্দনিক ভাবে আনন্দদায়ক রচনা তৈরি করে এই সোনালি আলো।'
স্বরূপ বলল,' তবে এখানকার স্থাপত্য - ভাস্কর্যগুলো সত্যি খুব সুন্দর ।'
অদৃত বলল ,'এই শহরটা স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের বলতে পারো একটা অন্যতম প্রাণকেন্দ্র।'
স্বরূপ কিছুক্ষণ ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো, অনেক মানুষ ফোয়ারার জলে কয়েন ফেলছেন সে অদৃতকে জিজ্ঞাসা করল,' স্যার আপনি জানেন সবাই ফোয়ারার জলে কেন কয়েন ফেলছে এখানে?'
অদৃত বলল ,'শুনেছি রোমে যদি কারোর আবার আসার ইচ্ছা হয় তবে সে এই ফাউন্টেনের জলে একটা কয়েন ফেলতে পারে । তবে এই কয়েন গুলো পরে একটা চ্যারিটিতে যায়।'
স্বরূপ বলল,'আপনি এতোকিছু জানেন কি করে?'
অদৃত বলল,'বই পড়ে । চলো।'
এরপর তারা রোমের ফুটপাত ধরে এগালো।
স্বরূপ বলল,'এইখানের ফুটপাতগুলো এরকম ওল্ড ফ্যাশনড্ কেন?'
অদৃত বলল,'কোথায় ওল্ড ফ্যাশনড্? আমার তো বেশ লাগছে । তবে হ্যাঁ আমার ভালো লাগছে বলে যে তোমার ভালো লাগবে তা নয়।'
স্বরূপ হেসে বলল,'তবে দেখতে সুন্দর ।'
অদৃত বলল,'তুমি জানো এগুলো কিসের তৈরী?'
স্বরূপ মাথা চুলকে বলল,'উহু জানি না ।'
অদৃত বলল,'কোবেল স্টোনের অর্থাৎ যাকে বলা হয় মুচি পাথর। গোটা ইতালির সমস্ত রাস্তাই এরকম। তবে রোমের এই কোবেল স্টোনের নাম হল স্যাম্পিট্রিনী ,যার অর্থ হল সামান্য ।'
এরপর তারা গেল রোমের বিখ্যাত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু কলোসিয়ামে ।
স্বরূপ তার ফোনে কলোসিয়ামের ছবি বন্দি করতে করতে বলল ,'স্যার এটা তো আরো সুন্দর ।'
অদৃত বলল,'রোমের এই কলসিয়াম হলো পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটি । এটি হলো একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার *। এটি এখনও পর্যন্ত রোমে নির্মিত বৃহত্তম প্রাচীন অ্যাম্ফিথিয়েটার। বিশ্বে আরো অনেকগুলি অ্যাম্ফিথিয়েটার থাকা সত্ত্বেও এটি এখনো পর্যন্ত সর্বাধিক বিখ্যাত একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার। কলোসিয়ামটির রোমান সম্রাট ভেসপাসিয়ান -এর আমলে নির্মাণকার্য শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তার উত্তরাধিকারী টাইটাসের অধীনে এটির নির্মাণ কার্য সম
্পন্ন হয়েছিল। এটি ট্র্যাভারটাইন চুনাপাথর , আগ্নেয় শিলা এবং ইট-মুখী কংক্রিট দিয়ে নির্মিত।এখানে প্রাচীন যুগের মানুষ মূলত গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই* দেখতে আসতো আর এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করত সেকালের সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারগুলো। কিন্তু এই কলোসিয়াম প্রাচীন রোমের অনেক নিষ্ঠুর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটের সময় খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু যারা সম্রাটের আদেশ অমান্য করে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করত আর সেই ধর্মের অনুরাগী হত তাদেরকে এখানে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হতো। কেউ সম্রাটের বিরুদ্ধাচারণ করলেও তাকে এখানে ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে ছেড়ে দেওয়া হতো আর বাকিরা দর্শক আসনে বসে আনন্দ নিতো।
কলোসিয়াম বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভূমিকম্প এবং পাথুরে ডাকাতদের দ্বারা । রোমের অন্যান্য বিল্ডিং ,দুর্গ ও চার্চ তৈরি করার সময় এর থেকে পাথর খুলে নেওয়া হয়েছিল। অনেকবার রিকনস্ট্রাকশনের পর আজকে এসে এই অবস্থায় দাঁড়িয়েছে ।'
এরপর তারা একটি ইতালিয়ান রেস্তরাঁতে খেতে যাবে বলে ঠিক করল। রেস্তোরাঁয় যাবে বলে যখন তারা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল তখন একজন মাঝ বয়স্ক লোক গিটার বাজিয়ে রাস্তার ধারে খুব সুন্দর ইটালিয়ান ভাষায় গান করছিলেন, তারা দু'জন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গান শুনলো । তারপর হাঁটতে হাঁটতে আবার রেস্তোরাঁর উদ্দেশ্যে রওনা হল। রেস্তরাঁয় পৌঁছে দু'কাপ কফির সাথে সামান্য কিছু খাবার অর্ডার করল। রেস্তরাঁর পাশেই কিছু তরুণ যুবক-যুবতী গানের পশরা বসিয়েছে। এইসব দেখে বেশ ভালো লাগলো অদৃত এবং স্বরূপের।
স্বরূপ বলল,' স্যার এবার আমাদের একজিবিশন এর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।'
অদৃত বলল,' হ্যাঁ চলো।'
তাদের খাওয়া শেষ করে তারা রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে একজিবিশন দেখতে গেল। তারা একজিবিশনে গিয়ে দেখলো একজিবিশনের আয়োজন যেখানে করা হয়েছে সেটি বেশ বড় একটি মিউজিয়াম । ভেতরটা বেশ জমকালো প্রকৃতির। সেখানে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ধরনের চিত্রশিল্প প্রত্যেকটি চিত্রশৈলীতে বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে চিত্রকরের ভাবনা। এইসব দেখে স্বরূপ এবং অদৃতের বেশ ভালো লাগলো ।
স্বরূপ বলল ,'স্যার আগে ভ্যাটিকান সিটিটা ভাগ্যিস দেখে নিয়েছিলাম, নয়তো পরে আর সময়ই হত না ।
বাহ্ ! কি সুন্দর । সত্যিই রোম শান্তির দেশ।'
অদৃত স্বল্প হাসলো ।
তারা সামনে তাকিয়ে দেখলো বেশ একটা বড়ো জমায়েত তৈরি হয়েছে , সেখানে একটি স্টেজ এর মতন অংশ রয়েছে, যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বছর তিরিশের ছেলে । ছেলেটির পরনে রয়েছে ধূসর রঙের স্যুট এবং একটি কালো রঙের শার্ট। ছেলেটির মুখটি অদৃতের অত্যন্ত পরিচিত , এমনকি ছেলেটির গায়ের রং , হাঁটাচলা , কথা বলার ভঙ্গিমা ইত্যাদি সমস্তকিছুই অদৃতের অত্যন্ত পরিচিত । ছেলেটি স্টেজে দাঁড়িয়ে তার চিত্রশৈলী সম্পর্কে ইতালিয়ান ভাষায় কিছু বক্তব্য পেশ করছিলেন। স্বরূপ বলল ,'জানেন স্যার ছেলেটির নাম হল আঁন্তোনীয়। এই যে এতক্ষন যে ছবিগুলো দেখছিলেন সব ওর আঁকা ছবি। শুনেছি খুব নাম আছে এনার । ছেলেটিকে দেখতেও খুব সুন্দর।'
অদৃত বিস্মিত চোখে একদৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলো, চারপাশটা যেন ঝাপসা হয়ে উঠলো তার কাছে শুধুমাত্র আঁন্তোনীয়র মুখ ছাড়া।
অদৃত স্বরূপকে বলল,'কোনোভাবে আলাদাভাবে কথা বলা যাবে স্বরূপ আঁন্তোনীয়র সাথে?'
স্বরূপ বলল,' কি বলছেন স্যার? উনি ভীষণ ব্যস্ত একজন মানুষ।আর তাছাড়া উনিতো ইতালীয়ান ভাষায় কথা বলছেন আপনি তো কিছু বুঝতেই পারবেন না। তবে?'
অদৃত করুণ সুরে বলল ,'প্লিজ স্বরূপ আমার এই অনুরোধটুকু রাখো।
একবার বলে দ্যাখোই না।'
স্বরূপ কাঁচুমাচু মুখ করে বলল ,'ঠিক আছে । চেষ্টা করছি কিন্তু জানিনা হবে কিনা।'
স্বরূপ আঁন্তোনীয়র ম্যানেজারকে গিয়ে বলল, যে তার সাথে কোনোভাবে দেখা করা যাবে কিনা।
তার ম্যানেজার সাফভাবে জানিয়ে দিলেন যে,সে এখন কোনোভাবেই দেখা করতে পারবেন না।
স্বরূপ তার ম্যানেজারের কথাগুলো এসে অদৃতকে জানালো ।
অদৃত মিউজিয়ামের একটি কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলো এবং অপেক্ষা করল। আঁন্তোনীয় স্টেজ থেকে নেমে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এমন সময় একটা ফাঁকা জায়গায় অদৃত ডেকে উঠলো,' আর্য!'
ছেলেটি এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অদৃত পুনরায় ডাকলো,'আর্য! আমি জানি তুমি আর্য, আঁন্তোনীয় নয়।'
আর্য গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলো, এটা তো তার অত্যন্ত পরিচিত একটা কন্ঠস্বর।
সে ভাবলো ,'আমি ঠিক শুনছি? এটা তো অদৃতের গলার স্বর । অদৃত কি করে আসবে এখানে ? হয়তো আমি ভুল শুনছি। কিন্তু আমার নাম জানলো কি করে? না না আমি ভুল শুনছি। '
দ্বিতীয়বার আবার সেই চেনা গলার কন্ঠস্বর পেয়ে ভাবলো,'না আমার ভুল নয় এটা অদৃতের কন্ঠস্বর ।আমি নিশ্চিত । আর এই ডাক যে আমি উপেক্ষা করতে পারবো না ।'
সে ঘুরে দেখলো বছর ছত্তিরিশের একটি ছেলে। চোখে তার সেই পরিচিত কালো সরু ফ্রেমের চশমা পরনে তার হালকা সবুজ রঙের শার্ট এবং জিন্স। মুখে একটা শান্তভাব বিরাজমান ।
আর্য হেসে বলল,'অদৃত তুমি এখানে?'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ। আমি অফিসের বিজনেস ট্রিপে এসেছি।'
আর্য বলল,'ও।'
তারপর দু'জনে কি বলবে বুঝতে পারল না। তারা দু'জনেই খানিকক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
অদৃত বলল,'কিন্তু তুমি এখানে কি করে?'
আর্য বলল,'আমি এখানে একটা একজিবিশনে....'
ইতিমধ্যে স্বরূপ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল,'আরে স্যার আপনি কোথায় চলে গেছিলেন আমি কতক্ষণ ধরে আপনাকে খুঁজছি আপনি জানেন? উফ্!
একি ইনি...ইনি....ইনি তো আঁন্তোনীয়। স্যার আপনি..'
অদৃত বলল ,'আলাপ করিয়ে দিই ও হল স্বরূপ আমার পার্সোনাল অ্যাসিট্যান্ট।'
স্বরূপ বলল,'আরে স্যার আপনি ওনার সাথে বাংলায় কথা বলছেন কেন? উনি বাংলা বোঝেন না কি মুশকিল ।'
অদৃত বলল,'আর ও হল আর্য সেন।'
স্বরূপ চোখ বড় বড় করে বলল,'আপনার কি হল স্যার উনিতো আঁন্তোনীয় ।'
আর্য বলল,'নমস্কার!'
স্বরূপ অবাক হয়ে বলল,'ন...ম...স্কা...র!'
আর্য বলল,'কোথাও গিয়ে কিছু খাওয়া যাক?'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ ।'
স্বরূপ বলল,'স্যার আমি হোটেলে যেতে পারি? আসলে বউ বারবার ফোন করছে আর তাছাড়া আমার সেইভাবে একটা ক্ষিদেও পাচ্ছে না । তাইজন্য আর কি।'
অদৃত বলল,'ঠিক আছে ।'
স্বরূপ হোটেলে ফিরে গেল ।
অদৃত এবং আর্য একটি রেস্তরাঁয় গিয়ে বসলো। দু'জনে রেস্তোরাঁর টেবিলে মুখোমুখি বসলো আর্য দেখলো অদৃতের চেহারায় সামান্য বদল এসেছে, চোখের চশমার পাওয়ারটা আগের তুলনায় একটু বেড়েছে আর অদৃতের মুখের মধ্যে আগের সেই শান্ত ভাবটা আরো প্রকট হয়েছে।গায়ের সেই সুন্দর চেনা গন্ধটা এখনও একইরকম রয়েছে।
অদৃত আর্যকে ভালো করে দেখে ভাবলো তাকে দেখতে আগের তুলনায় আরো সুন্দর হয়েছে। তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি এবং সময় তাকে অনেকটা বেশি ম্যাচিওর করে তুলেছে। তার মুখের মধ্যে একটা চাপা শান্তভাবের ছাপ লেগে রয়েছে ।
তারা কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না।
তারপর অদৃত বলল,' কিছু খাওয়ার অর্ডার করা যাক ।'
আর্য স্বল্প হেসে বলল,' হ্যাঁ যাক ।'
তারা দু'জন খাওয়ার অর্ডার করল তারপর আবার তাদের দু'জনের মধ্যেখানে একটা অদ্ভূত নিস্তব্ধতা নেমে এলো ।
আর্য অদৃতের দিকে তাকিয়ে ভাবলো,' কোনদিনও ভাবিনি আবার তোমার সাথে দেখা হবে। হয়তো তুমি এখন জীবনে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছো , ভরা সংসার। মা- বাবা ,পত্রলেখা হয়তো এতদিনে একজন বাবাও হয়ে উঠেছো তুমি। খুব জানতে ইচ্ছা করছে তুমি কি এখনো আমাকে মিস করো? না হয়তো করো না। আমি তোমাকে খুব মিস করি জানো এখনো চোখ বন্ধ করলেই সেই আগের অদৃত রায়ের মুখটাই ভেসে ওঠে।'
অদৃত ভাবলো ,'কি বলি? কেমন একটা অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছে। এত বছর পর তোমার সাথে দেখা হল। কত খুঁজেছি তোমায় কখনো ভাবিনি শেষমেশ এখানে এসে তোমার সাথে দেখা হবে। হয়তো এতদিনে তুমি কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো,তোমার জীবনে নতুন কেউ এসেছে। জানিনা। না জেনে কল্পনা করাটা ঠিক নয়।
তবে হতেই পারে একদিকে এত বড় একজন চিত্রকর আর অন্যদিকে বড়ো মনের একজন মানুষ ।তোমার মতন মানুষ পাওয়ার জন্য তো সবাই অপেক্ষা করে আমিই একমাত্র যে পেয়েও হারিয়েছি। আচ্ছা তোমার হৃদয়ে আজ আমার জন্য কোনো জায়গা আছে?'
তাদের দুজনের এই সাক্ষাতের মধ্যে কোথাও অভিমান নেই ,কোথাও রাগ নেই আছে এক অদ্ভূত গভীর নিস্তব্ধতা , আর সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে রয়েছে অনেক না বলা কথার ভিড়।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শেষমেষ আর্য বলে বসলো,'অদৃত তুমি কেমন আছো?'
অদৃত ভাবলো সেই চেনা গলার স্বর। সেই চেনা গলার ডাক।
অদৃত ভাবলো,'কেমন আছি? সত্যি বলতে ভালো নেই। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমি ভুলে গিয়েছি কিভাবে ভালো থাকতে হয়,কিভাবে বাঁচতে হয়।'
অদৃত বলল,' ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?' আর্য মনে মনে ভাবলো,'তুমি মুখেতো বলছো ভালো আছি কিন্তু তোমার মুখ দেখে কেন মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই। না না আমার মনের ভুল হয়তো সত্যি ভালো আছে। কিন্তু .....'
আর্য বলল ,'ভালো আছি ।'
অদৃত বলল,' এখানে একজিবিশনে এসেছিলে ?'
আর্য কিছু বলতে যাবে এরকম সময় টেবিলে খাবার চলে এলো ।
আর্য বলল ,'এইখানে কবে এসেছো?'
অদৃত বলল,'তিন দিন আগে ।'
আর্য বলল,' আচ্ছা।'
তারপর আর্য জিজ্ঞাসা করল,' আন্টি- আঙ্কেল ভালো আছেন ?'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ ভালো আছে।'
কথাটা বলে অদৃত রেস্তোরাঁর কাঁচের বাইরের দিকে তাকিয়ে খেতে থাকলো।
আর্য ভাবলো ,'তোমাকে এতটা অন্যমনস্ক লাগছে কেন? দেখে মনে হচ্ছে তুমি যেন একটা খুব ক্লান্তি কাটিয়ে উঠেছো। কি হয়েছে তোমার?'
তারপর আর্য জিজ্ঞাসা করল,' পত্রলেখা কেমন আছে?'
অদৃত একবার আর্যর দিকে তাকালো, তারপর বলল,' ভালো।'
আর্য ভাবলো,' অদৃতকে পত্রলেখার সাথে দেখলাম না তো ? হোটেলে পত্রলেখা আছে হয়তো । হয়তো তাদের সন্তানকে সঙ্গ দিচ্ছে অথবা সে কোনো কাজে ব্যস্ত।'
তাই সে সামান্য কৌতুহল নিয়ে অদৃতকে জিজ্ঞাসা করল,' পত্রলেখা আসেনি তোমার সাথে?'
To be continued ...................
অ্যাম্ফিথিয়েটার:-বিশেষত গ্রীক এবং রোমান স্থাপত্যশৈলী। নাটক বা ক্রীড়া ইভেন্টের উপস্থাপনার জন্য দর্শকদের জন্য আসনের স্তর দ্বারা বেষ্টিত কেন্দ্রীয় স্থানসহ একটি খোলা বৃত্তাকার বা ডিম্বাকৃতি ভবন।
গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই:- রোমান সাম্রাজ্যে ক্রীতদাসদের রোমান সম্রাটরা নিজেদের আনন্দের জন্য ক্ষুধার্ত সিংহের সাথে লড়াই করাতো। এই খেলায় বেশিরভাগ ক্রীতদাসের মৃত্যু হত। এই খেলাই 'গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই ' নামে পরিচিত ।