বনগাঁ লোকাল
বনগাঁ লোকাল
বনগাঁ লোকাল
সঞ্চয়িতা রায় চৌধুরী
রমেন আটমাস পর আজকে বাড়ি ফিরছে। শিয়ালদহ থেকে রাতের শেষ বনগাঁ লোকালে উঠে যখন বসেছে তখন ঘড়ির কাটা ১২টার ঘর ছুঁইছুঁই করছে। তার মনের মধ্যে একটা আলাদাই আনন্দ হচ্ছে কারণ অবশেষে সে আটমাস পর বাড়ি ফিরছে।
ট্রেন হুইসেল দিতেই সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
ট্রেনের জানালা দিয়ে রাতের মায়াময় প্রকৃতি উপলব্ধি করার সময় আচমকা তার চোখটা লেগে এলো।
কিছু স্টেশন অতিক্রান্ত হওয়ার পর আচমকা এক দমকা হাওয়ায় ঘুম ভাঙলো তার । চোখ খুলে দেখলো ট্রেনে এখন সেরকম একটা মানুষজন নেই বললেই চলে। তার বসার জায়গা থেকে একটু দূরে বসে আছে এক-দুটো মজদুর সম্প্রদায়ের মানুষ , তার মতোই ঘরে ফিরছে তারাও। তার দিকে কোনো মানুষ নেই যারা ছিল তারা আগের স্টেশনেই নেমে গেছে।
গোবরডাঙ্গা আসতেই ট্রেন থামলো। কুয়াশার জন্য কিছু বুঝে ওঠাই দুষ্কর , রমেন জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো স্টেশনে স্টেশন মাস্টার ছাড়া আর কেউ নেই , জনমানবহীন গোবরডাঙ্গা তখন গভীর ঘুমে ব্যস্ত। স্টেশন মাস্টার সবুজ ফ্ল্যাগ দেখাতেই ট্রেন ছাড়লো।
রমেনের হঠাৎই চোখ গেলো ট্রেনের দরজার দিকে , সে দেখলো এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক দরজার দিকে মুখ করে হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে রয়েছে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। লোকটিকে ভালো করে দেখে রমেন বিড়বিড় করে বলল , " এটা আমাদের পাড়ার মিলন জেঠু না ? ! এতো রাতে এখানে কি করছে ? যদিও শুনেছি গোবরডাঙ্গায় মেয়ের শ্বশুরবাড়ি , তাই হয়তো এসেছিলো এখানে। "
সে হাত নেড়ে ডাকলো ," মিলন জেঠু !"
বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে বলল ," আরে রমেন তুই ? "
কথাটা বলে লোকটা তার পাশে এসে বসলো।
রমেন বলল," আসলে আট মাস বাড়ি ফিরতে পারিনি কাজের জন্য। সেভাবে তো ছুটি পাইনা। তাই অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে চলে এলাম এখানে। তা তুমি এতো রাতে এখানে কি করছো? "
মিলন বলল ,"মেয়ের বাড়ি এসেছিলাম , মেয়েটার শরীরটা ঠিক ভালো নেই। খুব ভুগছে মেয়েটা। "
রমেন বলল ," কি হয়েছে জেঠু ?"
মিলন বলল ," খুব জ্বর অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু কিছুতেই কমছে না। "
রমেন বলল ," একবার কলকাতায় নিয়ে গেলে হয়না ?"
মিলন বলল ," হ্যা জামাই সেটাই বলছিলো। দেখি কি হয় ? ভগবানকে ডাকছি যেন ও ঠিক হয়ে যায়। "
ট্রেন যখন স্টেশনে থামলো তখন বাজে রাত একটা।
ট্রেন থেকে নেমে মিলন বলল," তুই হেঁটে যাবি নাকি ? এখন তো টোটো , ভ্যানরিক্সা কিছুই পাবি না। "
রমেন বলল ," না আমার বন্ধুকে বলেছিলাম সাইকেল রেখে যেতে ; সাইকেল গ্যারেজে রাখা আছে। "
মিলন বলল ," তা কোথায় রেখেছে সাইকেল তোর বন্ধু ?"
রমেন বলল ," ওই তো যদু কাকুর গ্যারেজে।
"
মিলন বলল ," ওহ ! ওই রাস্তাতো ভালো না এতো রাতে যাবি? ওইদিকে একটা মর্গ আছে। আমার ওই পথ ধরতেই হার হিম হয়ে আসে। "
রমেন বলল ," কি করবো বলো ভয় পেলে যে চলে না। "
মিলন বলল ," ঠিক আছে তুই তবে যা আমি ওই পথে যাই। "
সাইকেল নিতে আসার পথে রমেন ভাবলো ," জেঠু একই রয়ে গেলো , বড্ডো ভীতু। মনে আছে পাড়াতে কেউ মারা গেলে সে বাড়ির ছায়াও মারাতো না। "
কথাটা ভাবতেই সে নিজের মনে হেসে উঠলো।
সাইকেল নিয়ে বেড়াতে যাবে এমন সময় মর্গের লোকের কিছু কথা কানে এলো রমেনের ।
-- এই কালকে এই দুটো লাশ বেড়াবে , এদের পোস্টমর্টেম হয়ে গেছে। এই মাসে দেখছি এক্সিডেন্ট কেস আর সুইসাইডাল কেস ভরে ভরে আসছে। আজকে রাতে ফোন করে জানিয়ে দিস লাশদুটোর পরিবারকে ।
নেশাজড়িত গলায় একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করলো, " কিই নাআআমম আছে .... ? "
-- মিলান সর্দার , উর্মিলা সর্দার।
নাম দুটো শুনতেই রমেনের সর্বাঙ্গ যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো , যেন মেরুদণ্ডে ঠান্ডা প্রবাহ খেলে গেলো।
সাইকেলটা যাইহোক করে স্ট্যান্ড করে সে ছুটে গেলো মর্গের ভিতর।
সাদা চাদর জড়ানো লাশ দুটোর দিকে তাকাতেই তার বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠলো।
এ যে তার পাড়ার মিলন জেঠা আর তার স্ত্রী উর্মিলা জেঠি। জেঠির মুখ চেনা দায়, মুখটা প্রায় থেতলে গেছে আর জেঠুর কপালের মাঝখান বরাবর রয়েছে সেলাইয়ের দগদগে কাঁটা দাগ। রমেন নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
রমেন আঁতকে উঠে বলল ," এএএএএগুলো কি ভাবে হলো ?"
পাশের ভদ্রলোকটি বলল ," শুনেছি গত পরশু মেয়ের জ্বর ছিল বলে মেয়েকে দেখতে যাচ্ছিলো মেয়ের শ্বশুড়বাড়ি গোবরডাঙ্গাতে , যাওয়ার পথে ভিড় ট্রেন থেকে পরে যায় এই ভদ্রমহিলা। বউকে বাঁচাতে গিয়ে উনিও ঝাঁপ মারেন। কিন্তু সেই চেষ্টা বৃথা হলো। অকালে দুটো প্রাণ চলে গেলো। "
রমেন বলল ," কোন ট্রেনে উঠেছিল ?"
লোকটি বলল ," খুব সম্ভবত বনগাঁ লোকাল। কেন ? "
রমেন তখন দরদর করে ঘামছে। সে কোন ঘটনাটাকে বিশ্বাস করবে বুঝতে পারছে না। তার মাথায় তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে। গোটা শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আসছে।
কাঁপা কাঁপা গলায় রমেন বলল ,"কি কি কিন্তু আআ আ আ আ আমি একটু আগে ওনার সাথে ... বনগাঁ ... লোকালে এলাম যে । "
ভদ্রলোকটি বলল ," নেশা করেছেন নাকি ? দেখে তো মনে হচ্ছে না। তবে আজকাল বোঝা দায় কে নেশায় আছে আর কে জ্ঞানে। নিতাই আসছি রে। লাশ দুটো আজ এখানেই থাক কালকেই সৎকার তাই আর বেকার তুলে লাভ নেই।
এসব কথার মাঝেও রমেনের কানে একটা কথাই বাজছে "ওই রাস্তাতো ভালো না এতো রাতে যাবি? ওইদিকে একটা মর্গ আছে। আমার ওই পথ ধরতেই হার হিম হয়ে আসে। "
__________