প্রান্তিক প্রেম দ্বাদশ পর্ব
প্রান্তিক প্রেম দ্বাদশ পর্ব
পর্ব ১২
মদনমোহন মুখার্জী চিফ ম্যানেজার ইয়েস ব্যাঙ্ক লাউডন স্ট্রীট ব্রাঞ্চ কলকাতা। সায়ন্তিকা আঢ্য এসিস্টেন্ট ম্যানেজার । দুজনের পরিচিতি কেবল এটুকুই। রোজ দেখা হয়। অবশ্য অফিসের মধ্যেই। অফিসের বাইরে পরিচয় সেই সন্ধ্যেবেলায় । যেদিন সায়ন্তিকা বাসের অপেক্ষায় পায়চারী করছিল বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় । বাকিদের সঙ্গেও পরিচয় ঐদিনই বাগাড়িয়ার আড়তে।
এই কয়দিনে ওরা পাঁচ জন এমন বন্ধুর মত মিশে গিয়েছে; সায়ন্তিকার এই প্রথম মনে হল পৃথিবীটা সত্যিই সুন্দর আর এর বাসিন্দারা আরও আরও সুন্দর। নইলে সামান্য কিছুক্ষণের আলাপে একেবারে এক ভয়ঙ্কর অভিযানে সামিল করে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না।
সায়ন্তিকা মদনমোহনের এই দুরদশায় এত বেশি আপসেট হয়ে গেছে যে তার কেবলই মনে হচ্ছে স্যার যেন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান । তার জন্য যদি ----
ওঝা ??
ঠিক তো ! পবিত্রবাবু তো দারুন বলেছেন। ওঝা ডেকে একবার ঝাড়িয়ে নিলে হোতো !
মনে পড়তেই সায়ন্তিকা পবিত্রবাবুকে জিজ্ঞেস করল - একটা কথা বলি স্যার!
পবিত্রবাবু চমকে উঠলেন। এই তো কিছু সময় আগেই ওকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছিল, হঠাৎ করে এমন বিনয় !
বললেন - বলুন ম্যাডাম !
- স্যার, একটা কথা বলব ?
- নিশ্চয় , বলুন ।
- স্যার মুখার্জীসাহেবকে ওঝা দিয়ে ঝাড়িয়ে নিলে হোতো না ?
পবিত্রবাবু চিন্তান্বিত হলেন । কলকাতা শহরের মানুষজন একথা কেমন ভাবে নেবে কি জানি !
তবু বললেন - মন্দ হয় না। হসপিটালে নিয়ে গেলে তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে যাবে -- কিন্তু অন্যেরা কি রাজী হবেন ?
- সে চিন্তা আমার উপর ছেড়ে দিন স্যার । হাতে তো আর সময়ও নেই । কল বিকেলেই তো রওনা দিতে হবে।
- কিন্তু , আজকের রাতটা ভীষণ ভাইটাল। দেখি কি হয় । সকাল বেলায় না হয় নিয়ে যাব ওঝার কাছে।
- সেই ভালো।
বলে সায়ন্তিকা সুকুমার কমলস্যার এবং মি: বাগাড়িয়ার সঙ্গেও আলোচনা করে নিল ।
এদিকে রাত বাড়ছে। অভিযাত্রী দলেল সদস্যরা এক জায়গায় জড়ো হলেন । পুলিশের গাড়ি যে এভাবে পালিয়ে যাবে কেউই ভাবতে পারেনি। যাই হোক ওরা পাঁচ জন মিলে পাঁচ পাঁচটা পাঁচ সেলের টর্চ হাতে রেললাইনের দিকে চলতে লাগলেন । কিছুটা যেতেই এক অদ্ভুত আলো জ্বলজ্বল করে উঠল। পাঁচটি টর্চ একসাথে জ্বলে উঠল । কয়েকটা শেয়ালের চোখ ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সরে গেল। অদ্ভুত আলো আর দেখা গেল না। সবাই টর্চ নিভিয়ে দিলেন। আলো আবার দেখা গেল। এবার দশ বারো হাত দূরে মনে হল।আবার টর্চ ফেলে দেখলেন কোথাও কিছু নেই। মদনমোহন সায়ন্তিকাকে বললেন - তোমার ভয় করছে না ?
- না তো। একদমই না। আমরা দলবদ্ধ হয়ে আছি। কিছু ঘটলেও মোকাবিলা করে নেব।
মদনমোহন বললেন - আমার যে কি হয়ে গেছল কিছুই বুঝতে পারছি না।
হঠাৎ এক ছায়ামুর্তি বাগাড়িয়াকে ধাক্কা মেরে চলে গেল ।
- এ্যাই কৌন কৌন ! কৌন মুঝে টকরায়া ?
সবাই অবাক হয়ে ' কি ব্যাপার কি ব্যাপার' বলে চেঁচামেচি করছে। কিন্তু যে ধাক্কা দিল তার পাত্তা নেই। হঠাৎ কিছুটা দূরে মদনমোহন এবং সায়ন্তিকাকে একান্ত আলাপচারিতায় দেখে পবিত্রবাবু বললেন - হয়তো ওদের কারও সাথে ধাক্কা লেগে থাকতে পারে।
বাগাড়িয়া চেঁচিয়ে বললেন - হুই নেহি সকতা। ইয়ে টকরাও বড়া জোর কা থা। ম্যায় নে শোচা এক বরফ কা টুকড়া আ পড়া।
- সে কি হরিয়া ? কমলসাধন বললেন - এই রুক্ষ্ম দেশে বরফ এল কোত্থেকে ?
- হাঁ রে । তেমনই মনে হল। কি ঠাণ্ডা ! বাপরে বাপ।হে রামজী ! সবকুছ ঠিক রখ না পরভু !
মদনমোহন সায়ন্তিকার সঙ্গে চলেছেন সেই পাতকুয়োটার দিকে। কাছাকাছি আসতেই মদনমোহন হোঁচট খেয়ে এমন পড়া পড়লেন যে তাঁর ডানহাতের কড়ে আঙ্গুলটা বেঁকে গেল । তীব্র যন্ত্রণায় কাতরে ডেকে উঠলেন। পড়িমরি করে সবাই দৌড়ে চলে এল । পবিত্রবাবু গায়ের জোরে আঙুল টিপে সোজা করলেন ঠিকই কিন্তু যন্ত্রণায় মদনমোহন ছটফট করতে লাগলেন।
আর তো থাকা যায় না। ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। সকলে গাড়িতে উঠে ভুতুড়ে স্টেশনকে নমস্কার জানিয়ে মাঝরাতে বিদায় নিলেন।
কিছুটা পথ আসার পর চাকা পাংচার হল। সবাই নেমে দেখলেন গাড়ির চাকায় হাওয়া নেই। স্টেপনির চাকাই এখন ভরসা। স্টেপনি খুলে চাকা বের করা হল । লাগানোর জন্য যেতেই সবাই দেখল কোন চাকাতেই হাওয়া নেই। অগত্যা রাত্রিযাপন ছাড়া অন্য পথ নেই।
এদিকে মদনমোহনের ব্যথা একটু কমতেই ঘুমিয়ে পড়ল । সীটে হেলান দিয়ে সায়ন্তিকা মদনমোহনের মাথা নিজের কোলে রেখে তন্দ্রা উপভোগ করতে লাগল।