STORYMIRROR

arijit bhattacharya

Horror

3.9  

arijit bhattacharya

Horror

পঞ্চম মাত্রা

পঞ্চম মাত্রা

5 mins
902


#পঞ্চম_মাত্রা

#অরিজিৎ_ভট্টাচার্য্য


"জানিস তো,আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে যাদের ভূত,অপদেবতা বা প্রেতাত্মা বলা হয়,তাদের অনেকেই আজগুবি গালগল্প বলে মনে করে । কিন্তু তারা সত্যিই আছে এবং তারা আছে ফিফথ ডায়মেনশানে। সেজন্যই আমরা তাদের সচক্ষে দেখতে পারি না।" এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে থামলো সঞ্জীবদা। অবাক চোখে সঞ্জীবদার কথাগুলি শুনছিলাম আমরা। সঞ্জীবদা বলে চলেছে,"জানিস তো,চতুর্থ ডায়মেনশান বা মাত্রা হল সময়,আইনস্টাইনের থিয়োরি অব রিলেটিভিটি অনুসারে। আর এই চতুর্থ ডায়মেনশান অনেকটা একটা টানেলের মতো। এই টানেলের পুরোপুরি পথ অতিক্রম করতে গেলে শূন্য মাধ্যমে আলোর যা গতিবেগ তার থেকে বেশি গতিবেগে যেতে হবে।" বিক্রম এবার বলল,"কিন্তু দাদা এটা তো কোনো দিনই সম্ভব নয়। শূন্য মাধ্যমে ফোটন কণার গতিবেগের চাইতে বেশি গতিবেগ আছে এরকম বস্তু এখনোও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে,সেটা বিজ্ঞানীদের পক্ষে আবিষ্কার করা এখনোও সম্ভব হয় নি। তাবড় তাবড় বৈজ্ঞানিকগণ এই নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।যেদিন সত্যিই ফোটনকণার থেকে গতিশীল কোনো বস্তু বা শক্তি আবিষ্কার করা সম্ভব হবে,সেদিন এক যুগান্তকারী দিন হবে।"

সঞ্জীবদার মুখে হাসি,"হ্যাঁ সেটাই তো। সেজন্যই তো টাইম মেশিন আর টাইম ট্র্যাভেল এখনোও আমাদের কল্পনাতেই রয়ে গেছে। যেদিন সত্যিই শূন্য মাধ্যমে ফোটনের থেকে গতিশীল কোনো বস্তু আবিষ্কার হবে,সেদিনই আমরা অতীত বা ভবিষ্যৎ এ যেতে পারব। আপাতত এই টাইম ট্র্যাভেল এখন কল্পবিজ্ঞানের এক উপাদান।"

কৃষাণু বলে উঠল," তাহলে তুমি বললে কেমন করে আত্মা বা ভূতের অস্তিত্ব ফিফথ ডায়মেনশানে রয়েছে!"

সঞ্জীবদা হেসে বলল,"এখানেই তো আমাদের মনের গতিশীলতা। মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মা তার নশ্বর শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আমাদের পুরাণ কি বলছে দেখ,আত্মা অবিনশ্বর,আত্মা অজেয়,আর আত্মা গতিশীল। তখন সেই দেহহীন আত্মা আলোর থেকেও বেশি বেগে ফোর্থ ডায়মেনশানের টানেলকে পার করে। আর প্রবেশ করে ফিফথ ডায়মেনশানে। এ এক অন্য জগৎ।যাই হোক,এই ব্রহ্মাণ্ডে মাত্রা বা ডায়মেনশান আছে  মোট বারোটা। আর প্রেতাত্মা,ভূত বা আত্মা যাই বলি না কেন,এরা অবস্থান করছে ফিফথ ডায়মেনশানে।"


গল্প হচ্ছিল সঞ্জীবদার বাড়ির দোতলায়। খোলামেলা চারিদিক। এগারোটা বাজে,এখনো হু হু করে বইছে উত্তুরে হাওয়া।সঞ্জীবদা ( পুরো নাম সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়) আমাদের ফিজিক্সের প্রাইভেট টিউটর। পড়া শেষ হয়ে গেছে। আজ রবিবারের সকাল। এখন চলছে গল্প। প্রতি রবিবারের সকালে পড়া শেষে এরকম আধ ঘন্টা গল্প হবেই। এটা সঞ্জীবদার নিজের প্ল্যান। দাদার মতে,শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যে ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক অবশ্যই প্রয়োজন। তাই ক্লাসে সঞ্জীবদা যতোই কড়া হোক না কেন,এই গল্পের সময় ওর মতো দিলদার মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। মাঝে মাঝে মনে হয়,সঞ্জীবদা ফিজিক্সের স্যার না হয়ে লেখক হল না কেন!


সেদিন ক্লাসের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল মাত্রা বা ডায়মেনশন।পড়ানোর পর গল্প শুরু হল টাইম মেশিন নিয়ে। একে চারদিকে ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ারের আমেজ। বাইরে সোনালী রোদ। সঞ্জীবদা বলছিল ,টাইম ট্র্যাভেল করা সম্ভব হলে মানুষ নিজের অতীত বা ভবিষ্যৎকে দেখতে পারবে শুধু তাই নয়,তাদের সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎও করতে পারবে।আর তখনই তৌসিফ টানল ভূত আর প্রেতাত্মার কথা। আর সেই প্রসঙ্গেই সঞ্জীবদার মুখ থেকে আমরা শুনতে পেলাম ফিফথ ডায়মেনশানের থিয়োরি। সঞ্জীবদা বলছিল,মানুষের আত্মা যেমন প্রবল গতিশীলতার জন্য ফোর্থ ডায়মেনশানের সময়ের টানেলকে অতিক্রম করে ফিফথ ডায়মেনশানে প্রবেশ করে,তেমনই তার কিছু ইচ্ছা বা কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গেলে,কারোর ওপর প্রতিশোধস্পৃহা থাকলে,কোনো অসমাপ্ত অভিলাষা থাকলে,বা কারোর প্রতি মোহ থাকলে সে আবার একই ভাবে ফোর্থ ডায়মেনশানের টানেলকে অতিক্রম করে ফিরে আসতে পারে। তখন আমরা তাকে দেখতে পারি,অনুভব করতে পারি। সেই কারণে পৃথিবীতে এখনো হন্টেড প্লেস আছে,এখনো সুপারন্যাচ

ারাল বা স্ক্যারি কিছু ঘটনা ঘটে থাকে। ভারতেই তো আছে কতো হন্টেড প্লেস। আর,যা রটে কিছু তো তার ঘটে।

বাড়িতে এসে খাসির মাংস আর ফ্রায়েড রাইস খেয়ে শুয়ে শুয়ে সঞ্জীবদার কথাগুলি ভাবছিলাম আমি। তাহলে কি আমাদের উপনিষদ আর পুরাণ সত্যি কথাই বলেছে! মন বা আত্মা কি সত্যিই আলোর থেকে বেশি গতিশীল। সেদিন শুনেছিলাম টেলিপ্যাথি আর ট্র্যাভেলিং ক্লেয়ারভয়েন্সের কথা। ট্র্যাভেলিং ক্লেয়ারভয়েন্স মানে যেখানে মুমূর্ষু ব্যক্তির আত্মা কিছু সময়ের জন্য তার শরীর ত্যাগ করে প্রিয়জন বা প্রিয় বস্তু বা স্থানকে সাক্ষাৎ করে আবার পুনরায় নিজের শরীরে ফিরে আসে। আর আজ শুনলাম ফিফথ ডায়মেনশান! এও কি সম্ভব। তাহলে কি সত্যিই আছে দেহহীন আত্মার অস্তিত্ব।

কেউ বলেছিল,দেহহীন আত্মা নাকি ইথার দিয়ে তৈরি এবং তা বিশ্বচরাচরের ওপর বিরাজমান এই ইথারেই ভাসমান। তাই তাকে আলাদা ভাবে সনাক্ত করা যায় না। বলা বাহুল্য,অ্যারিস্টটল থেকে প্রাচীনকালের বিজ্ঞানীরা অনেকেই বিশ্বাস করতেন এই ভরহীন অতিস্বচ্ছ ইথারের অস্তিত্বে।আর এই ইথারের অস্তিত্বের কথা আইনস্টাইনও উড়িয়ে দেননি। তিনি বলেছিলেন,ইথার থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে।

যাই হোক,ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমের অতলে তলিয়ে পড়েছিলাম ,নিজেও বুঝতে পারি নি। বিকালে একরাশ খুশি নিয়ে বাড়িতে আসলেন মলয়দাদু। তিনি উত্তর কোলকাতার কাশীপুরে থাকেন,রিটায়ার্ড মানুষ,দাদুর সাথে একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন।মলয়দাদু আসা মানেই দেশ বিদেশের গল্প,একসাথে খাওয়া দাওয়া,হইহুল্লোড় । এবার সাথে একটা দারুণ কেক নিয়ে এসেছেন। এমনিতে উনি শনিবার বিকালেই আসেন,কিন্তু এবার ওনার আসতে দেরি হওয়ায় আমরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যাই হোক উনি এসেছেন। দ্যাটস ইট!

মলয়দাদু হেসে দাদুকে বললেন,"আরে শনিবার বিকালে নিতাই হঠাৎ করে চলে এল। আমাকে নিয়ে গেল বরাহনগর রামকৃষ্ণ মিশনে। জানোই তো,একে বড়দিনের সিজন। তাই ভাবলাম আজকেই সারপ্রাইজ দিই দাদুভাইদের।"

সোমবার সকালে আমাদের টাটা করে কাশীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন মলয়দাদু। এই বয়সেও মানুষটার জীবনীশক্তি দেখে অবাক লাগে,যেমন রীতিমতো উপনিষদ অধ্যয়ন করেন,তেমন অফুরন্ত প্রাণশক্তি। গায়ত্রী ও মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র গড়গড় করে বলতে পারেন। আবার আমাদের সাথে ঠাট্টা ইয়ার্কিও করতে পারেন রীতিমতো।


স্কুল যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি ,আর তখনই ফোনে এল সেই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। কাশীপুর থেকে মলয়দাদুর দাদা ফোন করেছিলেন,রবিবার সকালেই হার্টঅ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে মলয়দাদুর। যে মানুষটা সবসময়ই প্রাণবন্ত থাকতেন,অসুখের কোনো লেশমাত্র ছিল না তারই এইরকম এক আকস্মিক মৃত্যু।সত্যিই কাল যে কিভাবে কার কাছে আসে,কেউ বলতে পারে না। মলয়দাদুর দাদার কাছে আমাদের ফোন নাম্বার ছিল না। একে এইরকম শোকজনক ঘটনা,তারপর বাড়িতে আত্মীয়দের ভিড়।সেজন্যই খবর দিতে পারেন নি তিনি। কাশীপুর শ্মশানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর আজ সকালে কোনোমতে। মঞ্জুমাসির কাছ থেকে আমাদের বাড়ির ফোন নম্বর নিয়ে ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছেন। মলয়দাদুর দাদা জানতেন এই পরিবারের সাথে তাঁর সখ্যতা।

এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। রিসিভার ছিটকে পড়ল মায়ের হাত থেকে মেঝেতে।দাদু ভেঙে পড়লেন কান্নায়। মলয়দাদু সহকর্মী হলেও ছিলেন তাঁর দাদার মতো।

আমি ভাবতে লাগলাম,তাহলে আমাদের বাড়িতে বিকেলবেলা মলয়দাদু কিভাবে আসলেন! বিদ্যুৎঝলকের মতো মনে পড়ে গেল সঞ্জীবদার কথা। মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা সময়ের টানেল অতিক্রম করে পৌঁছে যায় ফিফথ ডায়মেনশনে,কিন্তু অপূর্ণ অভিলাষা বা মোহমায়া থেকে থাকলে সে আবার একইভাবে ফিরে আসে ইহজগতে। তাহলে কি মৃত্যুর পরেও আমাদের প্রতি মোহ থেকে গিয়েছিল মলয়দাদুর মনে!সেইকারণে মৃত্যুর পরেও ফিরে এসেছিলেন তিনি!

এই প্রশ্নের উত্তর তো একমাত্র মলয়দাদুর আত্মাই দিতে পারেন,যিনি জ্যোতির্ময় ও চরম গতিশীল। সময় সারণী অতিক্রম করে এখন অবস্থান করছেন সেই ফিফথ ডায়মেনশানে।


কলমে অরিজিৎ


Rate this content
Log in