পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাওয়া
পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাওয়া
রূপান্বিতা সবেমাত্র ব্লগটা লেখা শেষ করে ছবিটা আপলোড করে ফুড ব্লগিং ওয়েবসাইটে সাবমিট করছে, ঠিক সেই সময়েই কানে এলো ঝনঝন-ঝনাৎকার... কাঁচ ভাঙলো মনে হচ্ছে কোথাও। আর মাত্র চোখে পলক পড়ার সময়ের ব্যবধানে ঠিক তক্ষুণিই বাসবের বাজখাঁই চিৎকার, "রূপা, রূপা...", তার শাশুড়ি ঠাকরুনের চিল চেঁচানি, আর তারসাথে বাড়ির কনিষ্ঠতম সদস্য ঋভুর মিহিসুরে ঘ্যানঘেনে কান্না... সবগুলোর একটা বেশ মসৃণ সত্যনারায়নের সিন্নি মার্কা মিশ্রণ, একেবারে সিঁড়ি বেয়ে এসে পৌঁছে গেলো দোতলার ঘরে রূপান্বিতার কানে। সুতরাং, অফলাইন না হয়ে উপায় ছিল না আর। হলোটা কি? দেখতে হচ্ছে তো।
দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে নামতে রূপান্বিতা বুঝলো রান্নাঘরের আশেপাশেই ঐ দক্ষযজ্ঞ জাতীয় গোলমালটা বেধেছে। তার মধ্যেই টিভির গাঁকগাঁকানি... কোভিড নাইনটিনের স্পেশাল বুলেটিন চলছে। রূপান্বিতা এসে টপকে পড়লো অকুস্থলে।পুরো ব্যাপারটা বুঝতে রূপান্বিতার কয়েক সেকেন্ড লাগলো। শাশুড়ি ঠাকরুনের সপুত্র টিভিতে কোভিড নাইনটিনের সারাদিনব্যাপী বুলেটিন শোনার সুযোগে ঋভু একখানা ডাইনিং চেয়ার টেনে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে, চেয়ারটার উপর চড়ে হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠে পড়েছে গ্র্যানাইটের কিচেন স্ল্যাবটার উপর। তারপর পায়ের পাতায় ভর দিয়ে একদম উপরের তাক থেকে হাত বাড়িয়ে গুঁড়োদুধের কৌটোটা নামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে উপর থেকে ফেলে দিয়েছে শাশুড়ি ঠাকরুনের সাধের আমের মোরব্বার কাঁচের বড় বয়ামটা। গোটা রান্নাঘরের মেঝে ছয়লাপ ভাঙা কাঁচের টুকরোতে আর আমের চাকা চাকা টুকরো রসসমেত। একেবারে যাকে বলে ছড়িয়ে ছত্রখান। প্রথম দর্শনেই রূপান্বিতার পেট ঠেলে হাসি বেরিয়ে আসতে চাইলো ভুড়ভুড়িয়ে। তবে সপুত্র শাশুড়ি ঠাকরুনের মুখ চেয়ে রূপান্বিতা অতিকষ্টে সেই হাসি সম্বরণ করলো। ঋভু অবশ্য তখনো রণে ভঙ্গ দেয়নি। বেশ কায়দা করে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ব্যাটা তখনো সেই গুঁড়োদুধের কৌটোর নাগাল পাওয়ার। এদিকে রান্নাঘরের দরজার একপাশে বাসব এবং অন্যপাশে শাশুড়ি ঠাকরুন দাঁড়িয়ে ঋভুকে বেশ উত্তম মধ্যম আক্রমণাত্মক ডায়লগ দিয়ে যাচ্ছে।
রূপান্বিতার কানে ঢুকছে সবই, তবে উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা নেই। ওর মাথার মধ্যে তখন অন্যকথা চলছে, "ইস্, কোনো মানে হয়? এখন সব পরিষ্কার করতে হবে আমায়... লকডাউনে তো কাজের লোকেরা ছুটিতে!’ আর কী করে? ন্যাতা ঝাঁটা বালতি নিয়ে কাজে লেগে পড়তেই হলো রূপান্বিতাকে। সবার আগে ঋভুকে বেশ গলা তুলে শাসালো, "একদম নামবি না ওখান থেকে।" ঘড়াং করে টেনে চেয়ারটা সরিয়ে নিলো। ব্যাস্, অমনি ছেলের হাঁ হাঁ করে চিল চিৎকার জুড়ে গেলো বাবা আর ঠাকুমার উত্তেজিত জ্ঞানগর্ভ বাণীর সঙ্গে। বাসব খালি পায়েই রণাঙ্গনে ঢুকে পড়লো রূপান্বিতার হিটলারীয় শাসনের হাত থেকে অবোধ দুধের শিশুকে রক্ষা করতে। তবে পরিকল্পনা মাফিক অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর আগেই কাঁচের একখানা টুকরো বিনা নোটিশেই প্যাঁক করে ফুঁটে গেলো বাসবের পায়ের পাতায়। টপটপ করে ঝরে রক্তধারা মিশলো আমের মোরব্বার রসধারায়। রূপান্বিতা কোনো দিকে না তাকিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করলো। ছেলের কান্নার ভলিউম কমে এখন ফোঁপানি পর্যায়ে।
এবার শব্দের উৎস বসার ঘরে... পিছন থেকে ভেসে আসতে লাগলো বাসবের গলা... "রূপা, ডেটল তুলো ব্যান্ডেড কোথায় আছে?" আবার শুরু হলো, ‘‘রূপা, দেখোতো কাঁচের টুকরোটা এখনো ঢুকে আছে নাকি?" শাশুড়ি ঠাকরুন বললেন, "আমি দেখছি, দাঁড়া।" "তুমি দেখতে পাবে নাকি? থাক, থাক... আমিই দেখছি।" রূপান্বিতা তখন ঝাঁটা আর ন্যাতায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দেয়। বাকি দুনিয়ায় যেখানে যা খুশি হচ্ছে হয়ে যাক... ও ফিরেও তাকাবে না। এমনিতেই ঘর পরিষ্কার করা ভয়ানক অপছন্দের কাজ রূপান্বিতার। তবুও বাধ্য হয়েই প্রায় ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় রান্নাঘরটাকে আবার মোটামুটি একটা জায়গায় দাঁড় করালো। তবে ঘরময় আমের গন্ধে ম ম। ঋভু এখন ওর ঠাম্মার ঘরে ঢুকে পড়েছে মায়ের ভয়ে। পায়ে মোটাসোটা একখানা ব্যান্ডেজ বেঁধে বাসব টিভির দিকে তাকিয়ে... কোভিড নাইনটিনের বুলেটিন শুনছে। নিজের ঘর থেকে শাশুড়ি ঠাকরুন হাঁক পাড়লেন, "কত হলো রে বাবু?" যেন ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটে ইণ্ডিয়া কত রান করেছে! মরণদশা আরকি! অথচ ঐ সপুত্র শাশুড়ি ঠাকরুনের টিভি দেখার সৌজন্যে আরো বড়রকমের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো ঋভুর।
ঋভুকে কোলে নিয়ে শাশুড়ির ঘর থেকে রূপান্বিতা দোতলায় নিজের ঘরে চলেই যাচ্ছিলো। বাসব গুরুগম্ভীরভাবে শুরু করে, "রূপা, তোমার এই মোবাইলের নেশাতেই যত গণ্ডগোল। কোনোদিকে কোনো খেয়ালই রাখো না।" ব্যাস্, আগুনে ঘি পড়লো, ধপ করে ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে ফুঁসে উঠলো রূপান্বিতা, "আচ্ছা, হ্যালো মিস্টার, আমার মোবাইলের নেশায় গণ্ডগোল, নাকি তোমাদের মায়ে-পোয়ের টিভির নেশায় গণ্ডগোল?" রূপান্বিতার কথায় বাসবের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়লো, "মায়ের সারাদিনরাত টিভি দেখার খোঁটা এই সময়ে, এইভাবে?" আরেব্বাবা, ভিসুভিয়াস জেগে উঠেছে। এখন আর সহজে রূপান্বিতা থামবে না, "দু-দুটো কাজের লোকের কাজ তো আমি একা হাতেই সামলাচ্ছি। তা তুমি আর তোমার মা আজ পর্যন্ত সংসারের কোন কোন কাজটা যেন করে দিয়েছো, খেয়াল করে করে... বলবে?" "রূপা, আমি এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি। অফিসে যাচ্ছি না। বাড়িতে বসেই কিন্তু অফিসের কাজই করছি।" "ওও, আচ্ছা, তাহলে সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে শোয়ার সময় পর্যন্ত একই খবর নানা চ্যানেলে দেখাটাও আজকাল তোমার অফিসের কাজেই জুড়ে গেছে জানতাম না তো!" মুখঝামটা দিয়ে ওঠে রূপান্বিতা।
এবার শাশুড়ি ঠাকরুন আসরে নেমে পড়েন, "সারা পৃথিবী জুড়ে এতোবড় একটা সংকট... কে বাঁচবে কে মরবে, তার নেই ঠিক, আর এখন খবর না দেখে সিনেমা দেখতে বসবো নাকি?" রূপান্বিতাও গলায় আর জিভে শুকনো লঙ্কার ঝাঁঝ মিশিয়ে উত্তর দেয়, "না না, তুমি কেন সিনেমা দেখবে? তুমি তো সাতসকালে উঠে বাংলা সিরিয়ালের রিপিট টেলিকাস্ট দেখবে।" অসহ্য শ্লেষ মেশানো কথার তীর ছুঁড়ে দেয় রূপান্বিতা। মা আর বৌ যখন লড়ছে সেরকম সময়ে বাসব সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে নিরাপদ দূরত্বে বিচরণ করে। আজও যথারীতি তাইই ঘটলো। ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়ে বাসব কেটে পড়েছে। ঝগড়ার চাপানউতোর যখন মোটামুটি তুঙ্গে, দুপক্ষেরই হারজিতের ফিফটি ফিফটি চান্স, তখন রূপান্বিতার খেয়াল পড়লো, "ঋভু কোথায়? সিঁড়ির সামনেই তো দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম! গেলো কোথায়?" এবার দুই পক্ষের সন্ধি অবশ্যম্ভাবী। ঠাকুমার আদরের নাতি ঋভু, আর মায়ের কলিজার টুকরো ঋভু। অতএব, যুগপৎ চিৎকার সমস্বরে, একটি বেয়াড়া সরগমকে হারমোনিয়ামে ডুয়েটে তোলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা শাশুড়ি ঠাকরুন আর বৌমার, "ঋভু, ঋভুউউউ..."!
একটা উঁ উঁ আওয়াজ শুনে আবার শাশুড়ি ঠাকরুন আর বৌমা ছুটলো রান্নাঘরের দিকে। যখন রান্নাঘরের দরজায় রূপান্বিতা আর রূপান্বিতার শাশুড়ি ঠাকরুন পৌঁছলো, ততক্ষণে "মিশন গুঁড়োদুধ সাকসেসফুল!" এবারে অবশ্য আর্মিতে ঋভু একা নয়... ঋভুর বাবা বাসবও অ্যাকটিভলি আছে। খোলা ক্যাবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাসব, আর বাসবের কাঁধের ওপর দুদিকে দুপা ঝুলিয়ে বসে মূর্তিমান ঋভু। ওদিকে ঋভুর বগলদাবা গুঁড়োদুধের কৌটো। নিশ্চিন্তমনে হাত ঢুকিয়ে গুঁড়োদুধ বার করে নিজেও খাচ্ছে, আর যত্ন করে বাবাকেও খাওয়াচ্ছে। অভূতপূর্ব দৃশ্য! রূপান্বিতা আর শাশুড়ি ঠাকরুন দুজনেই চোখে চারশো চল্লিশ ভোল্টের অগ্নিশিখা জ্বেলে মুখোমুখি। দুজনের মনের ভেতরে একটাই কথা ঘূর্ণিঝড় তুলেছে, "তোমার বিশ্ববখাটে ছেলেটার পাল্লায় পড়ে আমার শান্তশিষ্ট ছেলেটা একেবারে গোল্লায় গেলো গো! হাড়বজ্জাতটাকে পিটিয়ে হাতের সুখ করে নিতে হয় একেবারে!" হায়, হায়... লকডাউন আর কি কি দেখাবে গো? শাশুড়ি ঠাকরুন ও বৌমার যুগপৎ কপাল চাপড়ানিতেও দিব্য সাকসেসফুলি জারি রইলো "মিশন গুঁড়োদুধ"!