নোঙর
নোঙর
আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়লো আরিফ। আজ সারাদিন তার অনেক কাজ। পদ্মানদী হয়ে আজ তার চরখানপুর যেতে হবে। শোনা যায়, চরখানপুরে নাকি নদীভাঙন শুরু হয়েছে। তাই দৈনিক পূর্বআলো পত্রিকার অফিস হতে এই নদীভাঙন নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরীর দায়িত্ব পড়েছে তার উপর। আরিফ আর দেরী না করে দ্রুত তৈরী হতে লাগলো এমন সময় তার ফোনে রিং বেজে উঠে। রিং পেয়ে ফোনটি রিসিভ করতেই শোনা যায় পত্রিকার ফটোগ্রাফার ফারুক আলীর কন্ঠ।
— আসসালামুআলাইকুম আরিফ ভাই। আপনি তৈরী তো?
— ওয়াআলাইকুমুস সালাম। জী ভাই।আমি তৈরী হচ্ছি।
— আচ্ছা,জলদি করুন । আমাদের আবার সদরঘাট গিয়ে নৌকা ধরতে হবে।
— আচ্ছা ভাই, আমি আসছি।
এই বলে আরিফ তার ফোনটি প্যান্টের পকেটে রেখে দিলো এবং দ্রুত তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাসা থেকে থেকে বেরিয়ে যেই মুহূর্তে সে রিকশা খুঁজতে যাবে সেই মুহূর্তে একটা রিকাশাও পাওয়া গেলো না। অন্যদিকে ফারুক আলী তার আসার অপেক্ষায় সদরঘাটে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছু মিনিটপর দূর থেকে একটি রিকশা দেখতে পায় আরিফ। তাই আর দেরী না করে সে রিকশা ডেকে দাঁড় করালো। তারপর সদরঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর আরিফ সেখানে পৌঁছায়। ফারুক আলী কিছু দূর থেকে আরিফ দেখতে পেয়ে তাকে ডাক দিলো “আরিফ ভাই! এই যে, আমি এখানে।’’ আরিফ এটি শুনতেই দৌড়ে ফারুক আলীর সামনে দাঁড়ালো।
— ভাই, এতো দেরি করেছেন কেনো? আরেকটু হলে নৌকা পাওয়া যেত না। চরখানপুর তো কম দূর না। তার উপর আজ পদ্মা উত্তাল।
— আর বলবেন না ভাই, আজ আমার এলাকায় একটি রিকশাও নেই। তাই রিকশা খুঁজতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো। নৌকা পেয়েছেন?
— জি পেয়েছি। ঐ যে ঘাটের সামনের বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে সেই নৌকাটি৷ তবে ভাড়া একটু বেশি নেবে। এদের নাকি সকালবেলা যাত্রি একটু কম থাকে। চরখানপুর থেকে খালি ফেরত আসতে হবে।
— বেলা সাতটা বেজে পনেরো মিনিট। আরেকটু পরে মানুষের ভীড় সামলাতে পারবে না। আর বলছে ফেরত আসতে হবে। আচ্ছা, ভাই, চলুন।
রাজশাহীর সদরঘাটের সকালে নৌকার যাত্রি কম থাকলেও আরিফদের নৌকায় যাত্রীদের কিছুটা ভীড় ছিল। তাই নৌকাটি যখন ইঞ্জিনের মাধ্যমে চলা শুরু করেছে, তখন আরিফ কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। এতো মানুষের ভীড়ে যদি নৌকাটি নদীর মাঝখানে এসে ডুবে যায়! একে তো উত্তাল পদ্মার ঢেউ, তার উপর নৌকাভর্তি যাত্রী। পত্রিকার অফিসের সম্পাদক সাহেব কেন যে এতো ঝুঁকির মধ্যে তাকে পাঠালো। এই নিয়ে যেন সে বেশ চিন্তিত।
— আচ্ছা ফারুক ভাই, এই নৌকাতে এতো মানুষের ভীড়। তার উপর আজ উত্তাল পদ্মার ঢেউ। আমরা ঠিকমতো পৌঁছাতে পারবো তো?
— হা হা হা, কেন ভাই আপনি কি সাঁতার জানেন না?
— হ্যাঁ, তা জানি। তবে পদ্মার কাছে কি আমার সাঁতার গ্রহনযোগ্যতা পাবে?
— হুম..চিন্তার কিছু নেই ভাই। আল্লাহ্ ভরসা। ঐ দেখছেন না মাঝির সামনে বসে একজন খোকা নৌকার বৈঠা ধরে আছে। কি সুন্দর করে আয়ত্ত করছে। তার সাহস দেখেছেন? তাহলে আমরা কি?
ফারুক আলীর মুখে এই কথাটি শুনতেই আরিফের চোখ পড়লো মাঝির সামনে বসা সেই পিচ্চি ছেলের উপর। উশকো খুশকো চুল, তামাটে রংয়ের দেহ আর শুকনো একটি ছেলে। তবে তার চোখ দুটি বেশ সুন্দর। একদম মায়াবী। আরিফ সেই ছেলেটিকে দেখে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো—
— এই যে খোকা! তোমার নাম কি?
— আবদুর রহমান
— তুমি স্কুলে যাওনা?
— জী স্যার, যাই।
— তাহলে এখানে কি করছো? স্কুলে যাবে না?
আরিফের কথা শুনে ছেলেটি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চুপ করে গেলো। কিছুক্ষণপর নৌকার মাঝি আরিফের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো:
— তার আইজকা স্কুল নাই স্যার। তাই আমার লগে নিয়া আইছি।
— ওহ্, আচ্ছা। ভালো। তবে আমাদের পৌঁছাতে আর কত সময় লাগতে পারে?
— আশা করতাছি চল্লিশ মিনিটের মইধ্যে আমরা পৌঁছাইবার পারুম।
মাঝি এই কথাটি শেষ না করতেই যেন, ভয়ানক এক দূর্ঘটনার ঘটার আশংকা করছিল আরিফ। সে দেখতে পেলো পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ে নৌকার বেশ ভালোভাবেই দুলছে।আর একপাশ যেন ডুবে যাবার মতো অবস্থা। বলতে না বলতেই নৌকার একপাশে বসা অর্ধেক মানুষ নদীতে পড়ে ভেসে যেতে লাগলো। সকলের চোখে মুখে তখন যেন ভয় এবং কান্না। আরিফদের পাশে বসা সত্তর বছর বয়সী এক মুরব্বির কান্নাভরা কন্ঠে তখন সূরা ইউনূস শোনা যাচ্ছে।
—ফারুক ভাই, আপনি চাচাকে ধরুণ। চাচা আপনি ঘাবড়াবেন না।
—জি ভাই, আমি চাচাকে ধরেছি।
অন্যদিকে, নৌকার মাঝি এবং তার ছেলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল কীভাবে নৌকাটিকে কোনো এক তীরে পৌঁছানো যায়। তবে মাঝি ও তার ছেলেকে দেখে আঁচ করা যাচ্ছিলো না তারা ভয়ে আছে। নদীর সাথে যুদ্ধ যেন তাদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা৷ নদীর মাঝখানে নৌকা থাকায়,তারা কোনো গতি করতে পারছিলো না কীভাবে তীরে পৌঁছানো যায়। নৌকায় পনেরো জন যাত্রীর মধ্যে পাঁচজন নদীর স্রোতে ভেসে কোথায় যে মিলিয়ে গেলো। কি যে করুন দৃশ্য, আরিফদের চোখ যেন রাজসাক্ষী। তবুও তাদের যদি খোঁজ পাওয়া যেত! নৌকায় থাকা আরিফদের এই কয়জন কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। ঐদিকে মাঝি যখন নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করছিলো,তখন মাঝির ছেলে চিৎকার করে বলে উঠলো “আব্বা! ঐ যে মাইঝ কিনারে একখান গাছ দেহা যাইতাছে!’’ ছেলের কন্ঠে আনন্দ চিৎকার শুনে মাঝি ও আরিফেরা যেন কিছুটা স্বস্তির পথ খুঁজে ফেলো। মাঝি তখন বৈঠা দিয়ে ধীরে ধীরে নৌকাটিকে সেই বটগাছটির কিনারে নিয়ে যেতে লাগলো।
একটা সময় পর তারা সেই গাছটির কিনারে এসে পৌঁছালে মাঝি তার ছেলেকে গাছের সাথে নোঙর বাঁধতে বলে। আরিফদের চোখে মুখে তখন স্বস্তির হাসি।
— ফারুক ভাই, আজ ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছি। আমার ফোনটাও নদীতে পরে গিয়েছে। নয়তো মাকে ফোন দিয়ে দোয়া চাইতে পারতাম।
— জি ভাই, আজকে এই গাছ এবং নোঙর না থাকলে জীবন এখানে থেমে যেত। নদীর আমাদের স্রোতে অনেক কিছুই ভেসে গেল।তবে জীবন ভেসে যায় নি।
নৌকায় থাকা নোঙর যেমন শত বিপদের সময় ও আটকে থাকে তেমনি আমাদের জীবনে বিপদ নেমে আসলেও নোঙরের সদৃশ বুকভরা সাহস আটকে থাকে।
