STORYMIRROR

গুলাল আবু বকর ‹›

Comedy Tragedy

3  

গুলাল আবু বকর ‹›

Comedy Tragedy

নাচো ভাই, নাচো—

নাচো ভাই, নাচো—

4 mins
210

রাস্তায় সেদিন এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। আমার মা হাইপারটেনশনে ভোগেন। নিয়মিত দু'রকম ওষুধ খান। ডাক্তারবাবু বলেছেন, ‘হার্ট বেশ দুর্বল।’ যে কোনো সময় অ্যাটাক হতে পারে। তাই মাঝেমধ্যে চেক-আপের জন্য তাকে ডাক্তারবাবুর চেম্বারে নিয়ে যেতে হয়। সেখানে যেতে হলে এক্সপ্রেস বাসে এক ঘন্টা চড়তে হয়। সেদিন একটা বাসে করে রওনা দিয়েছি, উদ্দেশ্য মাকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে যাব। সেবার তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। বাসের ড্রাইভার ভালোভাবেই গাড়িটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তায় ড্রাইভিং করা আজকাল এক কঠিন কর্ম। গাড়িঘোড়া, মানুষ আর খানাখন্দ বাঁচিয়ে গাড়ি চালানো এখন ভালো শিল্পী ছাড়া অন্যদের কম্ম নয়। রাস্তার ধারে পার্কিং করা থাকে হরেক কিসিমের যানবাহন...মোটরবাইক, অটো, টোটো, মেশিন ভ্যান আর নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা চারচাকা, ছ'চাকা ইত্যাদি। এদের ডিঙিয়ে গাড়ি ছোটানো শিল্পী ছাড়া কে পারবে? তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যায়। রাস্তাগুলো আর বাড়িয়ে তৈরি করার অবস্থায় নেই। তাই মানুষরা এই সুযোগে বুক ফুলিয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটে। অনেকক্ষেত্রে বোধহয় হেঁটে গাড়ির আগে গন্তব্যে পৌঁছায়। বাসযাত্রার এই অভিজ্ঞতা কমবেশি সবারই আছে। আমাদের এই বাস ভ্রমনের মাঝে ঘটল আরেক কাণ্ড। সেটাই এখন বলব।


      প্রায় আধঘণ্টার রাস্তা পার করে এসেছি। জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। দেখি গাড়ির গতি কমে আসছে। সামনে নজর করে দেখি পরপর নানারকম যানবাহন আটকা পড়ছে। একটু এগিয়ে বোঝা গেল রাস্তা জ্যাম হয়েছে। সামনে থেকে ভেসে আসছে ডিজে বক্সের বুম বুম শব্দ। হাজার টায়ার ফাটানো আওয়াজ। বোঝা যাচ্ছে কোনো এক মিছিল রাস্তার ওপর। এদিকে আসছে। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চল গাড়িতে আটকে রইলাম। কাছাকাছি আসতে বোঝা গেল ব্যাপারটা। স্থানীয় কোনো এক ক্লাবের বয়স সুবর্ণজয়ন্তী ছুঁয়েছে। বয়সটা খারাপ নয়। আর সেই উপলক্ষে শুভ জন্মদিন উদযাপন হচ্ছে। তাই ডিজে সহকারে নৃত্যের এই কিঞ্চিৎ আয়োজন। মিছিলে বাচ্চা এবং বুড়ো আর ছোঁড়া ও ছুঁড়ি (এছাড়া উপযুক্ত শব্দ পাওয়া গেল না) সকল শ্রেণীর অংশগ্রহণে জমজমাট। অবশ্য নাচের কসরৎ করছে শুধু ছোঁড়ার দল। এদের একটা বড় অংশ নিজেদের মতো করে অঙ্গভঙ্গি করছে। একের সঙ্গে অন্যের তালে কোনো মিল নেই। বোঝা যায় তরল কিছু পেটে পড়ে মস্তিষ্কের অনুভূতিকে পাল্টে দিয়েছে। না হলে খালি পেটে এই জিমন্যাস্টিকস সহজে আসে না। এইভাবে আমাদের ঠায় দাঁড় করিয়ে ধীর গতিতে তারা মজা উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলেছে।


       হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বুম বুম শব্দে মায়ের শ্বাসের কিছু কষ্ট শুরু হয়েছে। সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে পড়লাম। এগিয়ে গেলাম ঐ খিচুড়ি নৃত্যশিল্পীদের দিকে। চেঁচিয়ে বললাম, 

— ভাই, গাড়িতে অসুস্থ রোগী আছে। বক্সের আওয়াজ যদি একটু আস্তে করে দেন। ওনার বেশ কষ্ট হচ্ছে। 

অনুরোধ করে বললাম। আমার ঐ চিৎকার ওদের কানে কিছু পৌঁছে দিল কিনা সন্দেহ।


       ওদের ডিজে বক্সের জোরালো শব্দে আমি আমার নিজের কথাগুলো শুনতে পেলাম না। আমার বুকে কেউ যেন খুব জোরে লাব-ডুপ, লাব-ডুপ করে ধাক্কা দিচ্ছে। কানের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্কের কেন্দ্রস্থলে আঘাত করছে। এবার আমি দুই হাত উঁচু করে বোঝাতে চাইলাম, ‘থামো!’ ওদের মধ্য হতে একজন ষণ্ডামার্কা ছেলে, কি বুঝলো জানিনা। একটু বেশি বোধহয় বুঝলো। আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। হয়তো ইচ্ছা করে জোরে টান দেয়নি, হয়ে গেছে। সবার পা ভালোরকম টলছে। জোরেশোরে হ্যাঁচকা দেওয়ায় আমি গিয়ে পড়লাম তাদের মাঝখানে। আমার ডাইনে, বাঁয়ে, পিছনে, সামনে উৎকট নৃত্যদল আর নাকে ধাক্কা দিচ্ছে বিশেষ তরলের বোঁটকা গন্ধ। এমনভাবে ঘেরা পড়েছি যে বের হতে পারছি না। একি হ্যাপা! মনে মনে ভাবলাম, ‘কি গেরোয় আজ আটকে গেলাম।’ অল্পক্ষণ পরেই বুঝলাম, যে ছেলেটি আমার হাতে টান দিয়েছিল, সে ভেবেছিল আমি হয়তো ওদের সাথে নাচতে চাই। তার অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করে আমার তাই মনে হলো। সে পাশেই ছিল। আমাকে দেখিয়ে বেশি বেশি ধেই ধেই করে নাচতে লাগলো। যেন বলতে চাইল, ‘এইভাবে আমার মতো করে নাচো।’ 


       আমার পরিত্রাণ নেই বুঝতে পেরে মাথায় হঠাত্ই একটা বুদ্ধি খেলে গেল। অজ্ঞান হওয়ার ভান করে পড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। একা একা যদি রাস্তায় পড়ি তবে আর রক্ষে নেই। নৃত্যদলের যা দুলুনি তাতে করে পদপিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা সমূহ। সুতরাং আমার সামনেই যে ছিল তাকে জড়িয়ে আলতো করে পড়ে গেলাম তার গায়ের ওপর। চোট কারো লাগেনি। বাদ্য বাজনা থেমে গেল। আমি চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে রইলাম। ওদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। চ্যাংদোলা করে আমাকে রাস্তার পাশে নিয়ে শুইয়ে দিল। তারপর রাস্তার পাশের খাত থেকে গামছা ভিজিয়ে জল এনে আমার চোখে মুখে মাথার ওপর ছাড়তে লাগল। প্লাষ্টিক-পচা খাতের জল। উৎকট গন্ধে আমার বমি হওয়ার জোগাড়। নিজের দোষে আমি ফ্যাসাদে পড়েছি। শুধু মনে হচ্ছে নিজের গালে সপাটে কয়েকখানা চড় কষিয়ে দিই। খানিক পরে একটা চোখ ছোট করে খুলে বাইরের পরিস্থিতি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তৎক্ষণাৎ একজন বলে উঠল, 

— ওই তো রে, মরেনি বেঁচে আছে। 

তার কথায় আছে জড়ানো ভাব। নিশ্চয় সে একটু বেশি খেয়েছে। নাঃ, এবার চোখ খুলে ফেলি। দু'চোখ খুললাম। দেখি মুখের ওপর একজন ঝুঁকে এসেছে। তাকে ভনিতা করে জিগ্যেস করলাম, 

— আমি কোথায় ভাই? 

সে বলল, 

— বন্ধুসংঘ ক্লাবে। তুই আমাদের ক্লাবের মধ্যে আছিস। 

আমি বললাম, 

— এটা তো ভাই রাস্তা, ক্লাব কোথায়? 

সে বলল, 

— এটাই আমাদের ক্লাব। 

এবার পাল্টা জিগ্যেস করল, 

— তুই এখানে কি করছিস? 

আমি উঠে বসলাম। পিঠের ধুলো ঝেড়ে বললাম, 

— আমার মা অসুস্থ। রাস্তা জ্যাম হয়েছে দেখে বাস থেকে নেমেছি। আপনাদের ঐ বক্সের আওয়াজে আমার মা আরো অসুবিধা বোধ করছেন। 

এবার অন্য আর একজন যে ততটা মাতাল হয়নি, বলল, 

— কই তোমার মা? 

আঙুল বাড়িয়ে বললাম, 

— ঐ বাসটার মধ্যে বসে আছেন। 

সে বলল, 

— চলো তার কাছে। 

আমরা বাসটার কাছে গেলাম। 


       শোভাযাত্রা থেমে যাওয়ায় রাস্তা খানিক খালি হয়েছে। সামনের গাড়িগুলো ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করেছে। বাসে উঠে দেখি মা বুকের কাছটা হাত দিয়ে চেপে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বললাম, 

— মা, দেখো আমাদের বাস চলতে শুরু করেছে। তুমি কি ভালো বোধ করছ না? 

মা, চোখ বন্ধ করে নিলেন। মাথা একদিকে কাত করে ইশারায় জানালেন...ভালো আছি। বুঝলাম, আসলেই তিনি ভালো নেই।

         © গল্পটি এখানেই সমাপ্ত।

★ আগামী সপ্তাহে পড়বেন, ‘হাসি পেলে হাসুন...পর্ব ১২’

   


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy