ম্যাগ্নিয়াম
ম্যাগ্নিয়াম
১
দুগ্ধবৎ হিমবাহের ওপর দিয়ে ভাসমান গ্রেগরির মনে হল, ওর মতন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আগন্তুকের জন্যও পৃথিবী তার অসীম অধিস্থান প্রসারিত করে অপেক্ষা করছে নীরবে।
গ্রেগরী স্কাই-ডাইভিং করতে এসেছে নিউজিল্যান্ডের ফক্স গ্লাসিয়ারে। এই মুহূর্তে ও প্রবলবেগে ধেয়ে নামছে অফুরান আকাশের কোল থেকে পার্থিব বাহুবন্ধনের আলিঙ্গনে।
ছোটবেলা থেকেই স্কাই-ডাইভিং, প্যারাগ্লাইডিং, স্কিয়িংয়ের খুব শখ গ্রেগরির। বহুবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়ত ভ্রমণ সফরে। এবারের যাত্রায় সে একাই বেড়াতে চলে এসেছে অফিসের বার্ষিক ছুটি নিয়ে। বিস্তীর্ণ হিমনদের ওপর দিয়ে উড়ে চলা হেলিকপ্টারের থেকে লাফ দিয়ে শুরু হয় ওর এই ভাসমান ডুবুরি অভিযান। এই ক্রীড়ায় পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার ফলস্বরূপ, ও বেশ কুশলপ্রাপ্ত। নির্মেঘ নীল আকাশ আর বরফতুল্য বায়ুপ্রবাহ ভেদ করে ওর গতি এখন শুভ্রনীল তুষারাবৃত পৃথিবীর দিকে, মাধ্যাকর্ষণের দ্বারা পরিচালিত। এই এক মিনিটের নিয়ন্ত্রনহীনতা ও ছেড়ে দিয়েছে সেই অমোঘ টানের ওপর, যার থেকে পার্থিব কোন বস্তুরই নিস্তার নেই।
হঠাৎ একরাশ মেঘের দল উড়ে এল ওর গতিপথে। পলকের জন্য গ্রেগরির মনে হল, ওর গতি মন্থর হয়ে আসছে। মাধ্যকর্ষণশুন্য স্থানকালে ভাসছে ও, হারিয়ে গেছে অনস্তিত্বের শূন্যগর্ভে। অভিজ্ঞ গ্রেগরির মনে হল, নিশ্চয়ই কোন ভ্রম হচ্ছে, এমনটা তো কখনও হয়নি। হাওয়ার মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত তরঙ্গ, এক অভূতপূর্ব শক্তি, হয়ত কোন চৌম্বকীয় আকর্ষণ, যেটা গ্রেগরীকে নিম্নগামী পতন থেকে আটকে রাখছে।
আকস্মিকভাবে মেঘের ওপর দেখা দিল একটা অদ্ভুতাকার উড়োজাহাজ, যেরকমটা কষ্মিনকালেও গ্রেগরী দেখেনি, শোনেনি বা পড়েনি। উপর দিকটা পিরামিডের মতন সম্পূর্ণ ত্রিভুজাকার আর নীচের দিকটায় রোটর ঘুরে চলেছে অবিরত। সম্পূর্ণ ধাতব আকাশযানটা মুহূর্তে এমনভাবে নব্বই-ডিগ্রী ঘুরে গেল যে মাথার দিকের ত্রিভুজাকারের কোনটা তাক করল গ্রেগরির দিকে সরাসরি আর তখনই ওর চোখে পড়ল যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ও নিজেই… না না, তা কি করে সম্ভব! অবিকল ওর মতন দেখতে, ওর বেশভূষাতেই একজন বসে আছে সেই উড়োজাহাজের ভেতরে আর চালনা করছে সেটাকে ওরই দিকে। ক্রমেই কমে আসছে ওদের মধ্যে ব্যাবধান। সুস্পষ্টভাবে গ্রেগরী দেখতে পাচ্ছে নিজের ক্লোনকে… আকাশ জুড়ে তখন মেঘের ঘনঘটা আর বজ্রধ্বনি। কান পাতা দায়, চোখ ঝলসে যাচ্ছে বিদ্যুতালোকে, আর এই কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে গেল সেই উড়োজাহাজ। স্তম্ভিত গ্রেগরির মাথায় খেলে গেল, ও কি ভবিষ্যতের কোন সময়কে চাক্ষুষ দেখল? নিজের স্থানকাল ভেদ করে জাদুবলে হানা দিল কয়েকশত বছর পরের ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে?
আকাশ জুড়ে তখন বাজপাখির আকারে সহস্র ধাতব উড়োজাহাজ, পাক খেয়ে খুঁজে চলেছে কোন অজ্ঞাত প্রতিদ্বন্দীকে। অকস্মাৎ গ্রেগরির চোখে পড়ল একটা প্যারাশুট। অদ্ভুত ব্যাপার তো! ভবিষ্যতের আকাশে আজকের প্যারাশুট? ভাবতে না ভাবতেই তীব্রবেগে পড়তে লাগল ও নীচের দিকে, নিম্নদেশে বহুপরিচিত আজকের ভাসমান পৃথিবী আর ঊর্ধে নির্ণিমেঘ নিষ্কলঙ্ক শুন্য আকাশ!
২
টানা রিক্সায় একটুও ওঠার ইচ্ছে ছিল না রিয়ার। আহারে, কি কষ্ট হয় রিক্সাচালকদের! একেবারে হাড়-জিরজিরে চেহারা, কি সাংঘাতিক পরিশ্রমের কাজ! কিন্তু ওর কথা শুনে সোহম, মানে রিয়ার বরের হাসি আর থামে না।
'এটাই এদের পেশা আর নেশা রিয়া রানী, হাজার চেষ্টা আর অন্যত্র কাজের প্রলোভনেও এরা এই কাজ ছাড়বে না। এদের কষ্ট ভাবছ? একবার শুধু চড়ে দেখ... শহর চিড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে তোমাকে'
সোহমের পীড়াপীড়িতে টানা রিক্সায় উঠতে বাধ্য হল রিয়া। তবে ওঠার পর এ কি! এ যে এক সম্পূর্ণ অন্য অনুভূতি!
হাসছে রিক্সাচালক, সে যেন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা এক বিস্মৃত সারথি, অনবলোকিত কোন আকস্মিক ঘুর্নিপ্রবাহে টেনে নিয়ে চলেছে তার সওয়ারীদের এক অবিস্মরণীয় অশ্বারহনে।
টুংটাং শব্দে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে এই শশব্যস্ত তবু স্বপ্নিল শহরের রাস্তা দিয়ে। শীতের মায়াবী কুয়াশাঘন সন্ধ্যা ভেদ করে এগিয়ে আসছে ট্রাম, হিমেল বাতাসে মিশেছে হকারদের ডাকাডাকি। রাস্তার হলদে আলো, ধোঁয়া ওঠা গরম চা, রজনীগন্ধার ঘ্রাণ আর ব্যাস্ত মানুষের কথোপকথন জানান দিচ্ছে কলকাতার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি। কিন্তু এ কি, ক্রমশই ওরা যে আলো-শব্দের জগৎ পিছনে ফেলে ছুটে চলেছে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ দিয়ে, যেটা শেষ হতেই শুরু হল মেঠো পথ। ধুলো উড়িয়ে বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যস্থল দিয়ে দৌড়ে চলেছে ওদের রিক্সা – না তো, ঘোড়ার গাড়ি! রিক্সা ঘোড়ার গাড়িতে পরিণত হল কিভাবে?
‘ও ভাই, এ কোথায় নিয়ে এলে আমাদের?’ দুঃস্বপ্ন দেখছে ভেবে নিজের গায়ে জোর চিমটি কাটল রিয়া। নাহ, এ যে জাগরণে ঘটছে এসব ঘটনা… এই মুহূর্তেই ঘটছে। ঘোড়ার গাড়ি প্রবল উদ্দ্যমে ছুটে চলেছে সামনে, কোত্থাও কিছু নেই। পাশে সোহম নেই, এতক্ষনে খেয়াল হতে রিয়া একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল। ওর চোখ প্রবল আশংকায় খুঁজে চলেছে কোন জনবসতি, কোন স্থাপত্য, কিছু একটা, কিন্তু পথের দুই ধারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা বহুপুরাতন জরাজীর্ণ ছোট শ্বেতপাথরের মন্দির।
এই মন্দির তো একটু আগেই কলকাতার রাস্তায় দেখল না? সেটা এখানে… রিয়ার মনে হল ও দৈব্যক্রমে অতীতের কলকাতায় চলে এসেছে… ভাবতে না ভাবতেই আকস্মিকভাবে এক প্রবল হ্যাঁচকা টানে নিমেষের জন্য চোখ বন্ধ করতেই, কানে এল ঢং ঢং করে কাল ভেদ করে বাজতে থাকা মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর প্রচুর মানুষের সমবেত কথোপকথনের কোলাহল।
‘এসে গেছি, নেমে পড়ুন’ রিক্সাচালকের কণ্ঠস্বরে চমকে চোখ খুলে তাকাতেই রিয়া দেখলো ব্যস্তসমস্ত জনবহুল আজকের কলকাতা শহর।
এই সমস্তই কি ওর মনের ভ্রম? না কি ওই শীর্ণকায় রিক্সাচালক মানুষটা কোন জাদুগর?
'নাহ দিদিমনি, আমি তো শুধুমাত্র আজকের কলকাতাবাসী' বিনম্র রিক্সাচালকের কথার আড়ালেও, তার চোখের অন্তরালে উঁকি দিল এক প্রছন্ন সৌরজগৎ।
৩
শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে সন্তর্পনে এগিয়ে চলেছে আফ্রাহদের গুপ্তচরের দল। সীমান্তের এই দিকটায় গভীর দুর্ভেদ্য অরণ্য। অনধিগম্যপ্রায় এই সীমান্তে, মহাকায় তরূপ্রাচীর সহস্র শতাব্দীব্যাপী বিনিদ্র প্রহরীর মতন মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। শোনা যায়, এখানে বিবিধ সরীসৃপের সাথে সাথে ভয়াল অ্যানাকোন্ডার বাস। কোন মানুষ সচরাচর এই জঙ্গলের ধারেকাছে আসে না।
কিন্তু আফ্রাহদের অতীব নিষিদ্ধ গুপ্তকর্মের প্রয়াস তাদেরকে এই পথ ধরতে বাধ্য করেছে। দুর্গম্য জঙ্গল ভেদ করে মিলবে গুপ্ত সুড়ঙ্গপথ, ভূগর্ভের ভেতর দিয়ে সেটা পৌঁছে দেবে ওদেরকে ওপর দেশের জঙ্গলে। কিন্তু সেখানে জঙ্গল এত নিবিড় নয়, অন্ততপক্ষে দিনের সূর্যরশ্মি গাছের পাতা ভেদ করে মাটি স্পর্শ করার অবকাশ পায়। ধন্য ধরিত্রীতে অগাধ জীব জন্তুর বিচরণ থাকলেও, সেখানে সেই ভীষণ অ্যানাকোন্ডার আনাগোনা নেই বলেই শোনা যায়।
তিন দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে এখন আফ্রাহরা সেখানে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। এখন সামনের পথ অপেক্ষাকৃতভাবে চলনযোগ্য আর কম বিপজ্জনক। একটা বহুবর্ষজীবী অজ্ঞাতনামা গাছের সামনে আফ্রাহ দুদন্ড দাড়াল পিপাসা মেটানোর অভিপ্রায়ে। ইঙ্গিতে তার সহযাত্রীদের ইশারা করল এগিয়ে যেতে। জল খেয়ে মুখ মুছতে গিয়ে ভারী খচমচ আওয়াজ পেতেই সে তাকিয়ে দেখল, কোথাও কেউ নেই, সহযাত্রীদের আর দেখা যায় না। এই দুমুহূর্তেই চোখের আড়াল হয়েছে সবাই। কিন্তু সামনের দিক থেকে পদধ্বনি আসছে। সন্তর্পনে গাছটায় আড়াল হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বলা কি যায়, বিপদ কোন দিক থেকে আসে? কম বিপদে তো পড়তে হয়নি এতটা রাস্তা অতিক্রম করে আসার সময়। কিন্তু এই মুহূর্তে যা দেখল, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না একেবারেই।
বিশালাকারের এক অ্যানাকোন্ডা, গাছের ডালে ডালে পেঁচিয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে, এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের মতন। এদিকের পাতলা জঙ্গলে যে অ্যানাকোন্ডা থাকে না বলেই শুনেছিল? আফারাহের সমস্ত চোখ জুড়ে নেমে আসছে সশব্দ আঁধার, তবে কি এর বাহুবেষ্টনেই হারিয়ে যেতে হবে এতদূর এসে? নিজের ধুকপুকুনির সাথে তাল মিলিয়ে আবছা হচ্ছে দৃষ্টি, লুকোতে গিয়েও সজোরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় গাছের গুঁড়ি বেঁধে।
মুখ তুলে তাকাতেই একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়ে। এ কি? কোথায় সে মহাকায় অজগর? বহুদূরের ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে এগিয়ে আসছে ও নিজে, সাথে ওর স্ত্রী আর ওদের দুই ছেলেমেয়ে। ওরা এগিয়ে আসছে সামনে, পরিবর্তিত হচ্ছে পটভূমি, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে চারিপাশের জঙ্গল, ক্ষীণ সূর্যালোকস্নাত সকাল ক্রমে পরিবর্তিত হচ্ছে রৌদ্রতপ্ত অপরাহ্নে।
কিন্তু আফারাহের স্ত্রী-সন্তানাদি যে গত হয়েছে প্রায় বছর পাঁচেক আগে। ছেলে মেয়েরা এত বড় ছিল না তখন… কিন্তু হ্যাঁ, এতদিনে এরকমই বড় হত নিশ্চই। চোখ ভরে সমসাময়িক অন্য কোন মাত্রার নিজেকে দেখতে লাগল আফ্রাহ। ওর ষষ্ঠইন্দ্রিয় জানান দিল যে সামনের এগিয়ে আসা আফ্রাহ কোন সমান্তরাল মহাবিশ্বে বিদ্যমান ওর নিজস্ব প্রতিলিপি।
আজ ওর পরিবার থাকলে এমনই মুহূর্ত আসতে পারত ওর জীবনে। কিন্তু হায়, তারা যে কবেই বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছে। জমি-জায়গা-পরিবার কিছুই আর নেই। শুধু বুভুক্ষু চিলের ন্যায় আজও আফ্রাহ ঘুরে বেড়াচ্ছে শত্রুপক্ষদের টুকরো গোপন-তথ্য উদ্ঘাটন করার অভিপ্রায়ে। নিজের জীবন বাজি রেখে এই ঝুঁকিপূর্ণ কর্মজীবনের পিছনে তাড়া করে, সে হারিয়ে ফেলল নিজের অন্তরাত্মাকেই, নিজের কাছের মানুষদেরকেই। একবার কি ফিরে পাওয়া যায় না সেই মুহূর্তগুলো, সেই হারানো জীবন? চলে যেতে পারে না সেই অন্য মহাবিশ্বের নিজের মধ্যে, যেখানে ওর বর্তমান আজও উজ্জ্বল,আনন্দদায়ক, শান্তিপূর্ণ?
আয়ান্না, ওর স্ত্রী, বিয়ের পরপরই নিজের গলা থেকে খুলে একটা লকেট ওকে পড়াতে পড়াতে বলেছিল সেটা সবসময় রেখে দিতে নিজের কাছে। সন্তান হওয়ার পর আকুতি করেছিল বেরিয়ে আসতে এই সাংঘাতিক কর্মজীবন ছেড়ে। চলে যেতে একসাথে এক শান্তিপূর্ণ জায়গায়। কিন্তু নাহ, পারেনি করতে সেটা আফ্রাহ। নিজের কর্মজীবন, দায়িত্ব ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি সে। বড় আফসোস হয় প্রতিনিয়ত। আয়ান্নার কথা শুনলে কি এখনও পেত ওকে নিজের কাছে? ওই বিস্ফোরণের থেকে রক্ষা করতে পারত হয়ত ওদেরকে, সে মুহূর্তে নিজের কর্মক্ষেত্রে না থাকলে। নিজের অজান্তেই সেই লকেটটা স্পর্শ করতে, ক্ষণিকের মধ্যে দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়ে ফিরে এল সে নিজের স্ব-স্থানে, সেই ভয়াল জঙ্গলে।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, কোন অ্যানাকন্ডা চোখে পড়ল না। তবে কি সেই একমুহূর্তের স্থানকালান্তরণ সত্য ছিল? রক্ষা করল ওকে অজ্ঞাতভাবে?
৪
ফেনিল সমুদ্রতরঙ্গের সাথে তাল মিলিয়ে ভেসে চলেছে হোরেসের স্পিডবোট। লক্ষ্য ওর একটাই, বন্ধুদেরকে টেক্কা দিয়ে সর্বাগ্রে পৌঁছতে হবে সুদূরের অচেনা দ্বীপটায়। বহুবার স্বপ্নে হাতছানি দিয়েছে ওকে এরকমই একটা দ্বীপ। বারংবার আসা স্বপ্নে, কারা যেন ইশারা করে ডাকে ওকে ওখানে। বন্ধুদের সাথে সমুদ্রসফরে এসে, আচমকাই হুবহু সেই স্বপ্নে দেখা দ্বীপ চোখে পড়ে যায় ওর। আর তখনই শুরু হয় সেদিকে দ্রুতবেগে এগিয়ে যাওয়া। কারুর দিকে ফিরে তাকিয়ে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করতে চায়না, ভয় হয় যদি স্বপ্নের মতনই ফের অন্তর্হিত হয়ে যায় এই দৃশ্য।
কিনারের কাছাকাছি এসে দিকবিদিক চিন্তাভাবনা না করেই ঝপাং করে জলে ঝাঁপ দেয় হোরেস। সাঁতরে পৌঁছতে হবে বাকিটা। খুব ভালো সাঁতারু সে বরাবরই। কিন্তু জল যে এখানে এত হিমশীতল, আর সমুদ্রস্রোত এতটাই প্রবল, সেটা কল্পনা করতে পারেনি। হাত পা যেন অবশ হয়ে আসছে। ওই তো সামনেই বিস্তীর্ণ বালুকাময় তটভূমি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সাঁতরে এগোলেও, একই জায়গায় রয়ে যায় হোরেস। সামনে, পেছনে, পাশে কোথাও নড়তে পারে না। হোরেসের মনে হয় কোন অদৃশ্য শক্তি যেন ওকে স্থিরীকৃত করে রেখে দিয়েছে সেই একই স্থানকালে, যেই বর্তমান ক্ষণিকের মধ্যে ও এক অবরুদ্ধ কারাবাসী, পরিত্রাণ নেই সময়ের এপারে বা ওপারে। কোনক্রমে মাথা ঘুরিয়ে দেখল পেছনের দিকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, কোথাও কোন বন্ধুকে দেখতে পেল না। এই তো কয়েক মিনিট আগেও ওর পেছনেই ছিল ওরা, এই এত বড় সমুদ্রে কোথায় বিলুপ্ত হয়ে গেল নিমেষে!
মরিয়া হয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হোরেস ডুব দেওয়ার চেষ্টা করল জলের তলায়, যদি সাঁতরে স্থানান্তরণ করা যায়, বা এই মুহূর্ত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। ডুব দিতেই দেখল ওর স্পীডবোটটা ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রে। আতংকিত হয়ে ভাবল, এ কি করল ও! এক মুহূর্তের আবেগে নিজের কি সর্বনাশ ডেকে আনল? এবার কিভাবে ফিরবে? তড়িঘড়ি ভেসে উঠতেই এবার এক্কেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল। কোথায় সে দ্বীপ, কোথায় সে স্বপ্নের দেশ, কোথায় বন্ধুবান্ধব? ও তো একলাই সমুদ্রের জলতরঙ্গের সাথে লড়াই করে আরও গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে দূর্বার গতিতে!
৫
আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে ইউনিভার্সিটি পৌঁছতে, মনে মনে ভাবলো থাও। অঙ্কের ক্লাসটা বোধহয় শুরু হয়ে গেছে এতক্ষনে। ভাগ্য ভাল থাকলে, স্যার ঢুকতে দেবেন ক্লাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে, তিন তলা অবধি সিঁড়ি ভেঙে, একেবারে পশ্চিম কোন থেকে লম্বা দালান পেরিয়ে অপরপ্রান্তের পুবদিকের ক্লাসরুমটায় পৌঁছতে হবে।
থাও লক্ষ্য করে দেখেছে, ধীরেসুস্থে এগোলে কমপক্ষে সাতমিনিট লাগে ওর। কিন্তু আজ আর এত দেরি করলে চলবে না। দৌড় লাগায় ও। তিনতলাতেই লাইব্রেরি ঘর, ছুটতে ছুটতে সেটা পেরোনোর সময় সেখানে লাইব্রেরির জায়গায় সিম্বোলজি ক্লাসের সাদা লেবেলটা দেখে অবাক হয়ে যায়। একপলকের জন্য সেটার দিকে পেছন ফিরে তাকাতে, প্রবল ধাক্কা লাগে দেওয়ালের সাথে। চোখে অন্ধকার নেমে আসে, বসে পরে মেঝেতে।
যাহ্, এখানে দেওয়াল এল কিভাবে? আর লাইব্রেরি ঘরের জায়গায় সিম্বোলজি ক্লাসরুমই বা কেন? এই বিভাগের সমস্ত ক্লাস তো পাঁচতলার উত্তরপশ্চিম দিকের শেষ শ্রেণিকক্ষে হয়ে থাকে। থতমত হয়ে উঠে বসতে গিয়ে, একেবারে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়ে থাও। আরে, এ তো জলের ওপর বসে আছে ও! চারদিকে থইথই করছে জল, ওপরে বরফের স্টেলেকটাইট জমে নীচের দিকে নেমে এসেছে, টপটপ করে ঝরে পড়ছে জলবিন্দু, আর ও বসে আছে একটা গুহার অভ্যন্তরে। ভালভাবে উঠে দাঁড়ানোর মতন অনুকূল অবস্থাও নেই। কোথা থেকে একক রশ্মি এসে পড়েছে একটা বরফের চাঁইয়ের ওপর। সেটা প্রতিসৃত হয়ে বিচ্ছুরিত হয়েছে বন্ধ গুহার দিকে দিকে। কিভাবে ও এখানে পৌঁছল, ভেবে কুল পায়না। পরক্ষনেই মনে হয়, এটা কি তবে মৃত্যুর পরবর্তীকাল?
দিশেহারা হয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে থাকে দুই চোখ। খেয়াল করে, দূরে, বহুদূরে, কোথাও একটা বড়সড় আলো। হয়ত সেটা এই গুহার একটা প্রবেশপথ। এই ভেবে সামনের দিকে এগোতে থাকে কোনরকমে। থাও অনুভব করতে চায় যে এই বিভ্রান্তিকর পরিবেশ আসলে অস্তিত্বহীন, সবটাই হচ্ছে ওর মাথার মধ্যে, কিন্তু সবটাই যে ভীষণভাবে সত্যি ঘটে চলেছে। একটা অজ্ঞাত চৌম্বকীয় শক্তির উপস্থিতি বুঝতে পারছে ও, যেটা কোন মানবিক ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুধাবনযোগ্য হওয়া উচিত নয়, তবুও ধরা দিচ্ছে ওকে ইঙ্গিতে।
যতই এগোতে থাকে আলোর উৎসের দিকে, ততই থাও বুঝতে পারে যে এই আলো গুহার প্রবেশ বা প্রস্থান পথ নয়, ও যা দেখছে তা নিছকই রৌদ্র নয়, এ হয়ত কোনো জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড, যার উত্তাপে বরফ জল হয়ে ভেসে যাচ্ছে প্রবাহে। কিন্তু সেই উৎসের কাছে এসে যা দেখল, তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না ও। বিশালাকার ফটকের ওপারে, বহুদূরে জ্বলন্ত গনগনে সূর্য, আর তার চারপাশে অবিরাম আবর্তনে এক আকাশ ভরা গ্রহ নক্ষত্র। এ কোথায় পৌঁছে গেল থাও? নিজের সৌরজগৎকে কোথা থেকে দেখছে ও? ফটকের বাইরে হাত বাড়াতে যেতেই সেটা অবস্থান্তরিত হল আরশিতে।
স্তম্ভিত থাও সেই আয়নায় নিজেকে দেখে অপলক। মৃত্যুর পর কি নিজের প্রতিবিম্ব এভাবে দেখা যায় আয়নায়? রহস্যময়ভাবে, কাঁচে প্রতিফলন হয় একটা সাদা লেবেলের, যেটা নিলম্বিত থাকে গুহার মধ্যবায়ুতে। সেই সিম্বোলজি ক্লাসের লেবেল! ঝটিকায় পিছন ফিরে তাকাতেই, মুখ থুবড়ে পড়ল ফের নীচে। উহ, মাথাটা বেশ টনটন করছে, যেন এইমাত্র অভিঘাত হয়েছে বড়সড়। মুখ তুলে তাকাতেই, লাইব্রেরির বাইরে নিজেকে বোকার মতন বসে থাকতে দেখে একেবারে বিহ্বল হয়ে যায় থাও।
৬
‘স্যার, আমাদের পূর্বনির্ধারিত ধারণা আমূল বদলে দিয়েছে এই কয়েকদিনের অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা’ উত্তেজিত এভার কণ্ঠস্বর, ‘ম্যাগ্নিয়ামের প্রভাব অকিঞ্চিৎকর ভেবে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা’
‘আমাদের গবেষণার টীম কিন্তু বহু জায়গা থেকে জানান দিচ্ছেন যে অনেক মানুষের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হচ্ছে’ বলল চিন্তান্বিত ব্যানার্জি। ‘সেটা ক্ষনিকের ভ্রম ভেবে উড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকে, অনেকে আবার আতংকিত হয়ে পড়ছেন।’
সত্তরোর্ধ বৈজ্ঞানিক ডাঃ রুসেলের বাংলোবাড়িতে আজ বিশিষ্ট কয়েকজন বৈজ্ঞানিক উপস্থিত হয়েছেন। গত কয়েকমাস ধরে বিশ্বজুড়ে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দেখা দিয়েছে, সেটা এবার মানুষজনের ইন্দ্রিয়ের মধ্যেও ধরা পড়ছে। যে শক্তির জেরে এসব পরাবাস্তবিক ঘটনা, বৈজ্ঞানিকমহলে সেটার নামকরণ হয়েছে ‘দ্য ম্যাগ্নিয়াম ইফেক্ট’।
এই ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষন করা আর মানুষের ওপর তার সরাসরি কি প্রভাব পড়ছে, সেটা খতিয়ে দেখার কাজে নিযুক্ত হয়েছেন সারা বিশ্বের বহু খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক। অবশ্যই এটা এখন অতি গোপনীয় পর্যায়ে রয়েছে। সাধারণ মানুষ যদি এসব ঘটনার পেছনে মহাজাগতিক প্রভাবের কথা জানতে পারে, তাহলে পৃথিবী জুড়ে বিশৃঙ্খলা-বিভ্রান্তি দেখা দেবে।
সারা বিশ্বে, সকলের পর্যবেক্ষনের ভিত্তিতে নিয়মিত আলোচনাসভার আয়োজন হয়। আজ তেমনই একটা সভা চলছে ডাঃ রুসেলের বাড়িতে। এবার বৈজ্ঞানিকমহলে ওনার অনুমান প্রকাশ করার সময় এসে গেছে, মনে মনে ভাবলেন ডাঃ রুসেল।
তাই বললেন
‘এখনও পর্যন্ত ম্যাগ্নিয়ামের ফলে কিরকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আমরা একবার সেটা সংক্ষিপ্তসারে দেখি’
‘স্যার, স্থান-কাল-মাত্রা পরিবর্তনের অনুভূতি হচ্ছে অনেকের’ বলল এভা।
‘কিছু মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন। এমন এক সময়কার কথা যখন তাঁদের এই পৃথিবীতেই আর থাকার কথা নয়!‘
‘আবার কেউ কেউ দেখেছেন বহু বছর পিছিয়ে যাওয়া অতীত’ বলল মার্টিন, ‘এমন অনেকেই আছেন যারা বর্তমান সময়টা চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু ভিন্ন স্থান-কাল-মাত্রার। নিজেদের অবিকল প্রতিরুপ, এক অন্য গমনপথে এক অন্য পৃথক জীবনে, সমান্তরাল মাত্রার নিজেকে‘
‘বর্তমান মুহূর্তটা স্থির হয়ে যাওয়ার অনুভূতিও হচ্ছে অনেকের‘ পুনরায় বলল এভা। ‘তবে সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ আছেন এখনও পর্যন্ত, যারা নিজেদের পরকাল প্রত্যক্ষ করতে পারছেন। লক্ষ্য করে দেখা গেছে, এই অনুভূতিগুলো সর্বাধিক কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থায়ী থাকে। তারপরই বর্তমানের কোন বস্তু সেই মানুষটার ইন্দ্রিয়ের মধ্যে এসে পড়লে, সেই প্রতিচ্ছবিটা ভেঙে যাচ্ছে’
‘যেমন?’ প্রশ্ন লরেলের।
‘যেমন ধরুন আপনি ওই গির্জাটা দেখতে পাচ্ছেন। স্থানকালান্তরিত হবার পর যদি কোনভাবে সেটার দৃশ্য, সেখান থেকে উৎপন্ন হওয়া কোন শব্দতরঙ্গ বা কোনরকম স্পর্শনের মধ্যে আসেন, তাহলে তক্ষুনি এই বর্তমানে ফিরে আসবেন’ স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে বলল ব্যানার্জি।
‘দ্রষ্টব্য ব্যাপার হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট সময়ে, একজন মানুষের সাথেই, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য এই ঘটনাগুলো ঘটছে’ বলল এভা।
‘আমাদের পর্যবেক্ষন কি বলছে? কাদের সাথে এইরকম অভিজ্ঞতার প্রবণতা বেশি?’ মার্টিনের প্রশ্ন।
‘দ্রুত চলনবেগে থাকা মানুষের সাথেই এরকম অনুভূতির সম্ভব্যতা বেশি। স্থিতিশীল অবস্থায় এরকম অভিজ্ঞতা এখনও পর্যন্ত বিরল’ চটপট উত্তর দিল ব্যানার্জি।
‘চল এই পরিসংখ্যানটা তাহলে বিশ্লেষণ করা যাক। আমাদের পর্যবেক্ষণ বহাল থাকবে’ এবার শুরু করলেন ডাঃ রুসেল।
‘সব রাষ্ট্রের তুখোড় বৈজ্ঞানিকরা এই প্রপঞ্চের পিছনে কালঘাম ছুটিয়ে চলেছে। ম্যাগ্নিয়ামের ক্ষমতার সম্পূর্ণ পরিধি বোঝা বড়ই দুষ্কর।
এখনও বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি। পৃথিবী, অবশ্য শুধু পৃথিবী কেন, আমাদের সমগ্র আকাশগঙ্গা এখন যেই নক্ষত্রমণ্ডলগত স্থান দিয়ে ধেয়ে চলেছে, সেখানে এমন কোনরূপ আকাশজাত বস্তুর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মধ্যে এসে পড়েছে, যেটা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষন ক্ষেত্র আর সময় প্রবাহের সাথে সঙ্ঘর্ষ ঘটাচ্ছে। কি সেই বস্তু, আদৌ সেটা কোন বস্তু না প্রতিবস্তু, অথবা কোনো শক্তি, সেটা এখনও ঠাহর করা যায়নি।
আমাদের গবেষণার ভিত্তিতে, এরকম কোনও বহিরাগত তরঙ্গের প্রভাব পড়ার কথা ছিল না এই সময়ে, আমাদের সৌরজগতের ওপর। কিন্তু সেটা ঘটছে। খুব বিস্তৃত স্তরে বিশ্লেষণ করতে গেলে, ম্যাগ্নিয়ামের অয়স্কর্ষণী ক্ষেত্র বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বা বলতে পার বিকৃত করছে আমাদের পৃথিবীর অয়স্কর্ষণী ক্ষেত্রকে।
এখনও পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করে যা দেখা গেছে, এই প্রভাব সবসময় হয় না, পৃথিবীর সব জায়গাতে সমান ভাবেও হয় না। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ বিশেষে এটা সময়কে আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অপভ্রষ্ট করছে। ডুবে যাচ্ছে জাহাজ, প্লেন পথভ্রষ্ট হচ্ছে, অজানা মানুষজন উপস্থিত হচ্ছে মনশ্চক্ষে। কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও, মানুষ তার বর্তমান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ম্যাগ্নিয়ামের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বড় বিপর্যয়কর হতে পারে। তবে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব যে কি হবে, আর কতদিনই বা পৃথিবী এই অতিজাগতিক তরঙ্গপ্রবাহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, কিই বা এর নিস্তারের পথ, তার সবটাই এখনও অন্ধকারে।
তবে এই পর্যন্ত সকল মানুষের যা যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে সবই এই দুই ক্ষেত্র বিকর্ষণের ফলস্বরূপ।’
‘তার মানে কি স্যার, এটা আমাদের মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলে এরকম স্থানান্তরের বিভ্রম ঘটাচ্ছে? না কি এগুলো সত্যিই ঘটছে?’ উৎসুক ব্যানার্জি।
‘সংশয়ে আছি’ গম্ভীর ডাঃ রুসেল, ‘তবে আমার ধারণা, ক্ষেত্র-সংঘর্ষের কারণে মুহূর্তের জন্য ভারসাম্য হারিয়ে এসব প্রতিচ্ছবির সৃষ্টি হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত, তথ্য অনুযায়ী বেশ কিছু মানুষ একটা প্রবল চৌম্বকীয় আকর্ষণ অনুভব করতে পেরেছে’
‘তার মানে,’ বলল এভা ‘এখন করণীয় হচ্ছে, এক – ম্যাগ্নিয়ামের অন্তরালে এই বহিরাগত জ্যোতিষ্ক বস্তু অথবা পরাবস্তুকে বোঝা আর তার পরিসর মাপা। দুই – কতদিন আমরা এর প্রভাবে থাকব, সেটা ঠাহর করা’
‘আর তিন –পৃথিবীবাসীদের ওপর কতদুর প্রভাব, ম্যাগ্নিয়াম প্রভাব হ্রাস করা যায় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা’ শেষ করল লরেল।
‘সর্বাগ্রে করণীয় হচ্ছে জনসাধারণকে অবিচলিত রাখা। শত-সহস্র বছর ধরে আমাদের পৃথিবী অনেক বিপজ্জনক সংঘর্ষণের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু ধ্বংস তো হয়ে যায়নি। আজও নীল পৃথিবী শস্যা, শ্যামলা, উজ্জল রয়েছে। আগামীদিনেও থাকবে। সৃষ্টি, প্রলয়, সৃষ্টি কালের নিয়মের ঘূর্ণাবর্তনে আসবেই। তবে একসাথে তার সম্মুখীন হয়ে তার মোকাবিলা করাটাই বুদ্ধির কাজ আর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির বিশেষত্বের পরিচয়’ আশ্বস্ত করলেন নির্মলচিত্তের, তুখোড়, জ্ঞানসম্পন্ন, খ্যাতনামা ডাঃ রুসেল।
এতদূর বলে এবার থামলেন উনি। তারপর সাদর আমন্ত্রণ জানালেন
‘চল আমরা এবার মধ্যাহ্নভোজ করে নিই। ঘড়িতে দুপুর ১টা বেজে গেল।‘
ডেভিস ওনার বহুপুরাতন সহকারী। সে সকলকে স্টাডি রুম থেকে পার্শ্ববর্তী বিশাল হলঘরে নিয়ে গেল।
‘তোমরা এগোও, আমি আজকের আলোচনার নথিপত্রে সই করে আসছি’ আরামকেদারায় গিয়ে বসে বললেন ডাঃ রুসেল।
শ্বেতপাথরের হলঘর এখন বৈজ্ঞানিকদের গুঞ্জনে মুখর হয়ে উঠেছে।
‘টুং টাং’ বেল বাজার আওয়াজে, ডেভিস বিশালায়তন কাঠের সদর দরজা খুলতে এগিয়ে গেল। দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ ঘরে ঢুকে উপস্থিত সকল অতিথিদের দেখে দুঃখপ্রকাশ করে বললেন
‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী মহোদয়গণ! ডাঃ ম্যান্টিস বিশেষ দরকারে আমাকে স্বত্বর ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কাউকে অবগত না করিয়েই আমাকে বেরিয়ে যেতে হয়। তবে আর পাঁচ মিনিটেই বেলা বারোটা বাজবে, আমরা নির্ধারিত সময়ানুযায়ী আমাদের আলোচনাসভা শুরু করতে পারব। ম্যাগ্নিয়াম ইফেক্টের বিশেষ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য আমরা প্রতিপাদন করতে সক্ষম হয়েছি।‘
‘কিন্তু কিন্তু...’ কাঁপছে ডেভিসের গলা, বিস্ফারিত ওর চাহনি।
‘কিন্তু কি?’ নবাগন্তুক লোকটার চোখে কৌতূহল। এতক্ষনে উনি খেয়াল করলেন, সকলেই যেন স্তম্ভিত হয়ে অবিশ্বাস্যভাবে তাকিয়ে আছে ওনার দিকে।
‘কিন্তু ডাঃ রুসেল’ ব্যানার্জি বলল নবাগন্তুক লোকটাকে, ‘আপনি তো এতক্ষন আমাদের মধ্যে থেকে আমাদের সাথেই আলোচনা করছিলেন!’
ইভা হঠাৎ দৌড়ে গেল ভেতরের স্টাডি রুমে।
কোথায় ডাঃ রুসেল? তবে ওই তো, নথিপত্রে ওনার নীল কালির হস্তাক্ষর তো জ্বলজ্বল করছে! কালির সই এখনও ঈষৎ ভিজে, আরামকেদারাটা কি হালকা দুলছে?
হলঘরের ঘড়িটায় ডং ডং জানান দিয়ে বার বেলা নামল এই পৃথিবীতে।
সমাপ্ত।