মুটে কার্তিক
মুটে কার্তিক
কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন রাঢ় বাংলায় মুট লক্ষীর পূজো হয় । বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরের কিয়দংশ, বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে বিশেষত ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন অঞ্চলে এই মুট পূজো উৎসবের মত গণ্য ছিল ।
আমাদের গ্রামেও আমি বেশ কয়েকবার ধানক্ষেত থেকে পাকাধানের দু'চার গাছি ধান কাস্তে দিয়ে কেটে , নতুন বস্ত্রে মুড়ে মাথায় করে খামারে এক নিকোনো জায়গায় রাখতাম। তারপর তেল, সিঁদুর, চন্দন, এবং পূজোর অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে লক্ষমী পূজো করতাম । প্রসাদ বিতরণ কিন্তু ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল অর্থাৎ বাইরের কাউকে প্রসাদ দেওয়া হোত না ।
তেমনই এক কার্তিক সংক্রান্তির দিন পাশের গ্রামের এক কৃষক পরিবারের কর্তা মুট এনে খামারে রেখে পূজো করে বাড়ি ফিরল।
সন্ধ্যেবেলায় সাঁঝ বাতি দিতে গিয়ে তার যে অভিজ্ঞতা হল তারই দু'চার কথা লিখছি ।
ওই কৃষক পরিবারের মুখিয়া মানে কার্তিক চন্দ্র মণ্ডল সেদিন সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে দেখল মুট খামারে যেখানে রাখা ছিল তা' নেই । তার জায়গায় পড়ে আছে একটা সদ্য গলাকাটা নরমুণ্ড ।
শির শির করে হেমন্তের শীতল বাতাস বইছে। নরমুণ্ড দেখে তো সে প্রায় অজ্ঞান হবার মত । গোটা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। আর সে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।
দেরী দেখে একটা হ্যারিকেন নিয়ে ওর বউ দেখতে এল । এত দেরী হবার তো কথা নয় । একে হেমন্তকাল । দিন ছোট। সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতে সন্ধ্যে হয়ে যায় । তার স্বামী তো ঠিক সন্ধ্যের মুখেই খামারে গেছে। অথচ সাড়ে সাতটা বাজতে চলল - কার্তিক বাবু বাড়ি আসে না । ওর স্ত্রী মেঘার মনে পড়তেই সে হ্যারিকেন তুলে খামারের দিকে রওনা দিদ ।
এমনিতেই গণ্ডগ্রাম । সেই সময় গ্রামে বিদ্যুতায়ন হয়নি ; যদিও বছর দুই আগে খুঁটি পুঁতে তার টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। একমাত্র ভরসা কেরোসিনের আলো। কারও বাড়িতে হ্যারিকেন ( তখন SUN কোম্পানির হ্যারিকেন বেশ প্রচলিত ছিল ) , অথবা লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনা, রান্না, খাওয়া দাওয়া হোত । তখন গ্রামে সাড়ে সাতটা মানে একেবারে নিঝুম । বেশীর ভাগই কুঁড়েঘর। আর যে দু'একটা পাকা বাড়ি ছিল তাদেরও ভরসা ওই কেরোসিনের আলো । খুঁজলে দু'চার বাড়িতে টর্চ পাওয়া যেত ।
কার্তিক বাবুর বাড়িতে টর্চ ছিল না। সেজন্য হ্যারিকেন নিয়ে মেঘা খামারে ঢুকতেই আলোটা নিভে গেল । অন্ধকারের মধ্যেই ওই নরমুণ্ড হা হা করে হেসে উঠল । মেঘা সেই ভয়ঙ্করদর্শণ মুখ দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠল।
কার্তিক বাবুকে ও ভাবে পড়ে থাকতে দেখে 'খুন খুন ' বলে চিৎকার করে উঠল ।
শীত যদিও তেমন পড়েনি ; গৃহস্থ বাড়ির দরজা জানালা সব বন্ধ ছিল ।
নিকটবর্তী কয়েকজন ছাড়া সেই চিৎকার কেউ শুনতে পেল না ।
যারা পেল লাঠিসোটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল । অস্পষ্ট আলোয় যা দেখল কার্তিকবাবুর ছিন্নমুণ্ড বত্রিশ দাঁত বের করে অট্টহাসি হাসছে । কিন্তু সেই অট্টহাসি কারও কানে এল না ।
ভুত ভুত বলে চেঁচিয়ে যে পারল পালিয়ে গেল;কেউ ঐখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইল । কাত্তিক বাবুর দেহ ঠিক দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না বা পড়েও যায়নি।
গ্রামবাসীদের যারা পালিয়েছিল ; এ পাড়া সে পাড়া তোলপাড় করে টর্চ হ্যারিকেন মশাল জ্বালিয়ে আবার ফিরে এল । ততক্ষণে মেঘা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তার স্বামীকে জড়িয়ে কাঁদছে।
- হা আমার পোড়া কপাল ! এ তোমার কি হল গো ! এবার সসারের কি হাল হবে গো।
কার্তিক বাবু বলল - কাঁদ কেন ? এই তো আমি দাঁড়িয়ে আছি। এই দেখ আমার হাত .
বলে দুটো মাইল খানেক লম্বা হাত বাড়িয়ে দিল ।
-এই দেখ আমার পা ...
বলে তালগাছের মত উঁচু পা জোড়া গুটিয়ে বসলেন ।
মেঘা বলল - এ আমি কি দেখছি গো । তোমার মাথাটা তো মুটের উপর পড়ে রয়েছে !
কার্তিক বাবুর রাগ হল । সে মাথাটা কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়তে যাবে কাটা মাথা বলে উঠল - তুঁই কেঁ রেঁ ? কেঁতো এঁকে চাঁদে পাঁঠিয়ে দেতো !
বলেই কার্তিকের মাথায় গিয়ে বসল ।
কার্তিক বলল - তুই আমার খামারে এসেছিস কেন? কে তুই ? দেখ আমি গরীব চাষী। করে কম্মে খাই। তোর তো কোন দোষ করিনি!
কাটামুণ্ডু নীচে নেমে বলল - আঁজ আঁছিস কাঁল নেই । তুঁই মরবি রেঁ ! আমার হাঁতেই মরবি।
পাড়ার লোকজন চিৎকার করতে করতে এগিয়ে এল। তাই দেখে কার্তিক সাহস সঞ্চয় করে আসন ছেড়ে নেমে পড়ল। অমনি কাটামুণ্ডু সেই আসনে গিয়ে পড়ল ।
- ধানের গাঁছা কাঁটতে গিয়ে আমাকে কাটলি কেন বল?
যদি আমার মুণ্ডু জোড়া লাগিয়ে দিতে পারিস তবেই যাব ; নইলে তোর গুষ্টিশুদ্ধ সবাইকে খাব ।
গ্রামের লোকজন মশাল ও টর্চের আলোয় কিছু দেখতে পেল না । কার্তিক যেমন ছিল তেমনি আছে। অথচ ওর বউটা ঘনঘন জ্ঞান হারাচ্ছে। তখন সবাই মিলে ওর বউয়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করল। বাকিরা কার্তিককে ধরতে যেয়ে দেখে ওরা একটা মস্ত মাথাহীন পাইথনকে ধরেছে । ভয়ে ছেড়ে দিল ।
কার্তিক বলল - ভাইয়েরা তোমরা আমাকে ছেড়ে দিওনা। ওই কাটামুণ্ডুটা দাও তো ! আমি সেলাই করে দি।
- কাটামুণ্ডু ? কই কোথায় ?
কার্তিক বলল - ওই তো মুটের উপর নামানো ।
কেউ দেখতে পেল না । একজন বুদ্ধি করে কাপড় জড়ানো মুটই তুলে কার্তিককে দিল । কার্তিক বলল
- চট সেলাইয়ের ছুঁচ আর সুতলি দাও।
তাই এনে দেওয়া হল । কার্তিক বলল - এবার তোমরা চারপাশ থেকে মুণ্ডুটা সেলাই করে দাও।
লোকেরা মুটটা কার্তিকের দেহে সেলাই করে দিল । কার্তিক অবাক হল না । কারণ সে জানে সেলাইয়ে তার কোন কষ্ট হবে না ।
কিন্তু মুখে উ: আ: বলে কষ্ট হচ্ছে দেখাতে লাগল ।
একসময় সেলাই শেষ হলে কার্তিক বলল - এবার তোমরা বাড়ি যাও । আমি এর বিহিত করে তবেই ফিরব ।
ওরা যে যার বাড়ি গেল। বাড়ি গিয়ে দেখে কার্তিক তাদের সাথে এসেছে। ওরা অবাক হয়ে গেল ।
সকলের কাছেই এক একটা কার্তিক এসেছে। গাঁয়ে ভুত চেপেছে ভেবে সবাই রাম নাম জপ করতে লাগল । কেউ কেঊ বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল ।
পালাতে গিয়ে পড়ল পাইথনের মুখে। জড়িয়ে ধরল পাইথন; মোচড় দিয়ে মেরে ফেলতে লাগল এক একজনকে। কার্তিকের মনে খুশীর জোয়ার আজ তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হচ্ছে।
সেই নরমুণ্ড এবার রক্তচক্ষু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কার্তিকের উপর ।
গাছের ডালে পেত্নীরা হাসাহাসি করতে লাগল । মুটে কার্তিক ভয় পেয়ে সেই নরমুণ্ডকে বলল - বাবা বেহ্মদত্যি! আমি না জেনে বেলতলায় মুট নামিয়ে ছিলাম। আমার প্রথম বারের দোষ ক্ষমা করে দাও বাবা।
নরমুণ্ড হাসল । মানুষের মত দয়া মায়া স্নেহ ভালবাসা আবেগ অনুভূতি কিছু আমাদের নেই ।
কার্তিক বলল - কিছু নেই ?
- না না । থাকতে পারে না। ওগুলো থাকলে আমার আজ এই দশা হোত না ।
- তবে রাগ হিংসাও তো থাকার কথা নয় ! সেগুলো কেন থাকবে ?
ব্রহ্মদৈত্যপড়ল ফ্যাসাদে । কার্তিক তো ঠিকই বলছে। রাগ দ্বেষও তো থাকার কথা নয় ।
মনে পড়ল পৈতের দিনের কথা । সদ্য উপবীত পরে সায়াহ্নিকে বসেছিল ও । কার্তিকের ঠাকুর্দা ব্রাহ্মণ সেজে কোথা হতে এসেছিল কে জানে ! পৈতে দেবার দায়িত্ব নিয়ে উপবীত ধারণ করিয়েছিল। তারপর সন্ধ্যাবেলায় এসে তাকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছিল । উদ্দেশ্য একমাত্র সন্তানের সম্পত্তি হাতানো। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুতে মা বাবাও গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল । এখন ওরা ভুত পেত্নী হয়ে শ্যাওড়া গাছে আশ্রয় নিয়েছে। পৈতের দিন মরেছিল বলে সে ব্রহ্মদৈত্য হয়ে বেলগাছে আশ্রয় নিয়েছে।
ওদের কুমন্ত্রণায় মনে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগেছে বলে কার্তিককে শাসাতে এই কাজ করেছে।
কার্তিক যখন পূজো করবে বলে কথা দিয়েছে তখন আর অনর্থক বাধানো কেন ?
কার্তিককে সে বলল - রোজ সন্ধ্যেবেলায় একা এসে বেলতলায় পূজো করলে তোকে ছেড়ে দেব ।
কার্তিক রাজী হল । ব্রহ্মদৈত্য বেলগাছে চলে গেল।
তাই দেখে ( ব্রহ্মদৈত্যর ) বাবা মা গালাগাল দিল - আঁটকুড়ির বেটা ।
ব্রহ্মদৈত্য আর রাগল না। বলল - কার্তিকের হাতেই আমাদের সবার মুক্তি হবে ।
( শেষ ,)
