মৃত্যুপুরী
মৃত্যুপুরী
রাকা মাইনস স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতেই গা টা ছমছম করে উঠল আমার। শীতের বেলা,সূর্যের আলো পড়ে আসছে,পশ্চিমাকাশে লাল রঙের খেলা,আর দিগন্তে ধূসর অভ্রভেদী পাহাড়ের হাতছানি। সত্যিই তো,"এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার/কোথায় এমন ধূম্র পাহাড়।" কবির অমর সৃষ্টি মনে পড়ে গেল। যাই হোক, অনেকদিন পরে শহরের দূষণ আর কৃত্রিমতা ছেড়ে মুক্ত প্রকৃতির কোলে,শাল সেগুনের অরণ্যসংকুল এই দেশে মন পেল মুক্তির ছোঁয়া। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকায় অপরাহ্নের এই মায়াবী সৌন্দর্য মনে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলল,আর সেই সাথে কিছুটা হলেও গা ছমছম করে উঠল আমার। আকাশের কোণে সদ্য উদিত প্রায় গোল হয়ে আসা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে মনের কোনো অজ্ঞাত কোণে জন্ম নিল ভয়। নীল মেঘমুক্ত আকাশ,কিন্তু পূর্ণিমা আসতে অধিক বিলম্ব নেই। আর আমি ছাড়া আর কে বেশি জানে,যে পূর্ণিমা আসলেই শাল সেগুনের অরণ্যসঙ্কুল এই উদ্ভিন্নযৌবনা প্রকৃতি পরিণত হয় এক মৃত্যু উপত্যকায়! আর ভাবা সম্ভব হল না। দিগন্তে হালকা কুয়াশার আস্তরণ,চারিদিকে এক অদ্ভুত অপার্থিব শীতলতা -আমার সাথে সঙ্গী বলতে আছে একমাত্র ভাস্কর। আর ভাস্করও বেশ ভালোভাবেই অবহিত রয়েছে আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে। যদিও অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ ও মিস করতে চায় নি বলেই আমার দেখাদেখি ও -ও চলে এসেছে এই পাহাড় জঙ্গল আর আদিবাসীদের দেশে।স্টেশনে আমাদের নিতে দুই মুণ্ডা যুবক সুই আর ঝিন্দারাম এসেছে দেখে ভালো লাগল। আর আরেকটা ব্যাপার দেখলাম,বহুদিন পরে মেঘ কেটে গেলে যেমন সূর্যের সোনালী কিরণকে মায়াবী লাগে,তেমনই আমাদের দেখে বহুদিন বাদে এদের মুখমণ্ডলের ফিরে আসা হাসিকেও যথেষ্ট মায়াবী লাগছিল। তাহলে কি এরাও বুঝতে পেরেছে যে,আমরাই হয়তো ওদের মুক্তি দিতে পারি পূর্ণিমারজনীর হাড় হিম করা আতঙ্ক থেকে।
রাকা মাইনস ঝাড়খণ্ডের অন্যতম বৃহৎ তাম্রখনি। রাকা মাইনস-গালুডি-ঘাটশিলা সুবর্ণরেখা বরাবর বিস্তৃত এই বেল্টটি ভারতকে যে তাম্র আর অভ্রের যোগান দেয়,তার পরিমাণ রাজস্থানের ক্ষেত্রীর পরেই। এছাড়া কিছুদূরেই আছে যদুগোড়ার ইউরেনিয়াম মাইন। কাছেই আছে মোসাবনী, ভাদুয়া,ভুমরু, ডিগরী,বুরুডি, পোখারিয়া,জগন্নাথপুর ,পাহাড়পুর ইত্যাদি। যেন এই আদিবাসী পল্লীগুলি প্রকৃতির ক্যানভাসে অঙ্কিত মনোহর ল্যান্ডস্কেপ-কোনো দক্ষ চিত্রকর স্বহস্তে সেগুলিকে অঙ্কিত করেছে। মাথার ওপর রূপোলী চাঁদ,ইউ কে আর ফ্রান্সে জীবনের একটা বড়ো অংশ কাটিয়েছি,সেই সূত্রেই কান্ট্রিসাইডের পাইন ওকের অরণ্য আর অরণ্যসংকুল পরিবেশের সাথে এই শাল সেগুনের অরণ্যানী ও সংলগ্ন পরিবেশের বেশ মিল খুঁজে পাচ্ছি। ফুরফুর করে বইছে মন মাতাল করা ঠাণ্ডা হাওয়া। কবি ডি লা মেয়ারের কথায়," Slowly, silently, now the moon/
Walks the night in her silver shoon;
/This way, and that, she peers, and sees/
Silver fruit upon silver trees;"। সত্যিই আজ বড়োই মায়াবী লাগছে এই রূপোলী চন্দ্রিমাকে,কেমন যেন এক অদৃশ্য মায়াবলে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে। যখন আদিবাসী গ্রাম শিরীষবাণীতে পৌঁছলাম রাত সাড়ে আটটা বাজে,বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে এদিকে।
ভারতভূমের আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ গোষ্ঠী এই মুণ্ডারা,এদের ভাষা মুণ্ডারী, অত্যন্ত সরল ও পরিশ্রমী এই জনগোষ্ঠী শিংবোঙাকে নিজেদের উপাস্য দেবতা বলে মনে করে। এমনকি বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি যা নিজেদের সরল যুক্তি দ্বারা তারা বুঝতে পারে না,তাদেরকেও ঈশ্বর বলে মানে। সেজন্যই গত দু-তিন মাস ধরে পাহাড়তলিতে প্রতি পূর্ণিমারাতে যে মৃত্যুর ঘনঘটা ঘটে চলেছে,এই সরল আদিবাসীরা মনে করে যে,তাতেও কোনো অপদেবতার হাত রয়েছে।
যাই হোক,বনমোরগের মাংস আর কুকরি খেতে বেশ ভালোই লাগল। আর তারপরেই পাহাড়তলির শীতলতার মধ্যে নিদ্রাদেবীর আরাধনা।কিন্তু সেই ঘুম ভেঙে গেল মধ্যরাত্রেই। উত্তর পাহাড়তলির কোণে কোনো অজানা জীব অপার্থিব স্বরে হিংস্র গর্জন করছে। সেই রক্ত জল করা গর্জন শুনে আমার দেখাদেখি ভাস্করেরও নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। ভালোই উপলব্ধি করতে পারছিলাম আমরা,শয়তান জেগে উঠেছে।এখানে আসার আগে ঘাটশিলায় আদিবাসীদের মুখে যা শুনেছিলাম,তাতে ভেসে এল দূর দূরান্তের মার্কিন মুলুকের ফিলাডেলফিয়ার সেই রহস্যে ভরা আতঙ্কের কথা,যা ভাবলে রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেয়। প্রত্যক্ষদর্শী সুই আর ঝিন্দারামের মুখে পূর্ণিমারাতের ডিমরি লেক সংলগ্ন শাল অরণ্যে আবির্ভূত হওয়া সেই জীবের বর্ণনা থেকে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছিলাম ফিলাডেলফিয়া অঞ্চলের উপকথার এক ভয়াল ভয়ঙ্কর প্রাণীর সঙ্গে। সাক্ষাৎ শয়তানের সন্তান সে,তার নাম জার্সি ডেভিল। ঘোড়ার মতো লম্বাটে মুখ,কিন্তু তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি।চারপেয়ে ,আবার কখনো দু পেয়ে হয়েও চলতে পারে।খুরের পরিবর্তে হাত পায়ে ধারালো নখর। কাঁটাযুক্ত লেজ। অলৌকিক সম্মোহনী ক্ষমতা সম্পন্ন রক্তাভ দুই ভয়াল চোখে পৃথিবীর সমস্ত বিভীষিকা প্রতিভাত। নরখাদক এই প্রাণী আবার উড়তেও পারে, উড্ডয়নের সুবিধার্তে একজোড়া ডানাও বর্তমান।
তেরো সংখ্যাটাই অশুভ,আর সে মাদার লীডের তেরো তম সন্তান। ফিলাডেলফিয়ার পাইন ব্যারেনের জনমনিষ্যিহীন এক পরিত্যক্ত প্রাসাদে একাকী এক নারী বাস করতেন,যার নাম মাদার লীড। কালাজাদু ও তন্ত্রমন্ত্রে পারদর্শিনী এই নারী শয়তানের সাথে সঙ্গম করার পর তেরোবারের জন্য গর্ভবতী হয়ে পড়লে তিনি গর্ভজাত ভ্রূণকে এই বলে অভিশাপ দেন,সে নিজেও শয়তান রূপে পৃথিবীর কোলে জন্ম নেবে। যথাসময়ে জন্ম নেয় সেই সন্তান,ফুটফুটে মানবসন্তান থেকে নিমেষে সে পরিণত হয় এক কিম্ভুতকিমাকার দানবসন্তানে। মাদার লীডকে পরিবৃতা করে যেসকল পরিচারিকারা তখন ছিল,সবাইকে দংশন করার পরে জানলা ভেঙে সে পাইন অরণ্যের দিকে চলে যায়।
তার প্রচণ্ড বিভীষিকাময় গর্জনে বারবার কেঁপে ওঠে ফিলাডেলফিয়ার পাইন ব্যারেন। কিন্তু একটাই কথা ভেবে বারবার কেঁপে উঠছিলাম,ফিলাডেলফিয়ার সেই বিভীষিকা পূর্ব সিংভূমের শাল মহুয়ার অরণ্যে পা রাখল কি করে!ভাস্কর শুধু একটাই কথা বলল,"বুঝলি তো কৃষাণু,মনে হয় আমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছি!" ক্রিপটোজুলজিস্ট হিসাবে পশ্চিমী মুলুকে আমারও নাম হয়েছে। কৌতুহলমিশ্রিত আতঙ্কে আমারও গা ছমছম করে উঠল। বরাবরই হিমালয়ের রহস্য ইয়েতি, কুমায়ুনের আতঙ্ক মিগোই, স্কটল্যান্ডের লক নেস মনস্টার,অস্ট্রেলিয়ার হিংস্র বুনীপ,ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের ব্রিটিশ ক্যাট,আটলান্টিকের সর্পদানব,গ্রীসের উপকথার ভয়ঙ্করী মেডুসা । সাধারণ মানুষ আর প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে, এদের অস্তিত্ব শুধুই রূপকথা আর কল্পকথায়। কিন্তু আমরা ক্রিপটোজোলজিস্টরা ভালো মতোই জানি,যা রটে কিছু তো তার ঘটে। আর এটাই তো আমাদের সাবজেক্ট। তাই তো আমরা চরম আত্মবিশ্বাসের সাথে বলি যে,তারা আছে।
পরের দিন এক সোনালী রৌদ্রভরা সকালে ভাস্করকে নিয়ে শিঙবোঙার থানে গেলাম। আদিবাসীদের কি একটা যেন পরব ছিল,পাহাড়ের কোলে মেলা বসেছে।ভাস্কর আমায় বলল জানিস তো ভাই,এসব অঞ্চলের আলাদা একটা ethnicity আছে। গ্রাম গ্রামান্তর থেকে সকল মুণ্ডা আদিবাসীরা এসেছে।সেখানেই দেখা হয়ে গেল প্যাটের সাথে। প্যাট এখানকার স্থানীয় খ্রিস্টান আদিবাসী যুবক। প্যাটের মুখ থেকেই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পেলাম এই আতঙ্ক সম্পর্কে।
পাহাড়ের ওপর আদিবাসীদের মেলা। কাছাকাছি গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আদিবাসীরা এসেছে। আর সেখানেই প্যাট আওড়াচ্ছিল,"Man that is born of a woman hath but a short time to live,and is full of Misery. He cometh up and is cut down like a flower,he fleeth as it were a shadow, and never continueth in one stay.
In the midst of life we are in death..... "
মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম বাইবেলের দ্য অর্ডার ফর দা বেরিয়্যাল অব দ্য ডেড -এর অংশ।প্যাটের মুখমণ্ডলে এক চাপা আতঙ্ক,উস্কোখুস্কো চুল,দিনরাত যেন ওর জীবনীশক্তিকে কোনো অজানা আতঙ্ক অবিরত শুষে চলেছে।কিন্তু চারদিকে আনন্দমুখর এই উৎসবের পরিবেশ,শীতের সকালের সোনালী রৌদ্র,ভেসে আসা মহুয়ার মিষ্টি গন্ধ,মনের প্রেমিকসত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলা বনমুরগী ,বটের,ঘুঘু,পাহাড়ি ময়না আর তিতিরের কুহুতানের এই অপূর্ব সমন্বয়ের মধ্যে এরকম আতঙ্কের কারণ কি!তাহলে কি প্যাট কিছু জানে পাহাড়তলির এই বিভীষিকা সম্পর্কে!হঠাৎই চতুর্দিকের আলোকোজ্জ্বল উষ্ণ পরিবেশকে আলোহীন শীতার্ত প্রতিভাত হতে লাগল।টিলার ওদিকে একটা ছোট্ট পাহাড়ি নদী তিরতির করে উচ্ছ্বলা তরুণীর ন্যায় বয়ে চলছে,তার ওদিকে ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন শালবন। সেখানে কোথাও লুকিয়ে থাকলেও তো থাকতে পারে পাহাড়ের বিভীষিকা। প্যাটের মুখে কাঁপা কাঁপা স্বরে শুনলাম এক কাহিনী,শীতের সকালের এই উষ্ণতার পরিবেশে এক অপরূপ রূপকথা বলে মনে হতে লাগল।
তিনমাস আগের কথা। পাহাড়তলিতে এক বিদেশী প্রেমিকযুগলের আবির্ভাব হয়,এই অঞ্চলের আদিবাসীদের সাথে আলাপ করতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। প্রেমিকযুগল মূলতঃ পাহাড় আর জঙ্গলে ফটোগ্রাফি আর ট্রেকিং এর টানে এলেও তাদের আচরণ দেখে ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হয় নি। সোনালী চুলওয়ালা ছেলেটার কাঁধে ছিল এক অদ্ভুত উলকি। কিন্তু সেটা কোন্ জীবের তা প্যাট বা আদিবাসীরা কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু একটা কথা সম্পর্কে প্যাট নিশ্চিত,ঐ ভয়াল ভয়ঙ্কর জীবটিই হল ঐ প্রেমিকযুগলের পরম আরাধ্য। প্রেমিকযুগলের বেশিরভাগ সময়টাই কাটত ডিমরি লেকের আশেপাশে ও পশ্চিমের পাহাড়ে। কিন্তু এখানে তাদের কি উদ্দেশ্যে আসা! কেনই বা আসা! সে সম্পর্কে স্থানীয় মুণ্ডা আদিবাসীরা অনবহিতই ছিল। হঠাৎই একদিন জঙ্গলের গভীরে শোনা যায়, এক হিংস্র অজানা জানোয়ারের বিভীষিকাময় গর্জন। একদিন পূর্ণিমারাতে কঙ্কা বস্তির দিকে দু তিনবার পরপর শোনা যায় সেই রক্ত জল করা হিংস্র গর্জন। পরের দিন সকালে যা আবিষ্কার হয়,তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে ওঠে মুণ্ডা সমাজ। গভীর শালবনে যখন কুম্ভাটুয়ার ডাকে কুয়াশামাখা সকাল নামে,তখন আবিষ্কৃত হয় দুই ওঁরাও যুবকের রক্তহীন প্রাণহীন মৃতদেহ। অনন্ত আতঙ্কে পলকহীন চোখের দুই তারা বিস্ফারিত হয়ে আছে।মৃত্যুর আগেই যেন আকারহীন অনন্ত ইভিল মূর্তিমান বিভীষিকার রূপ ধারণ করে নেমে এসেছিল তাদের সামনে। বাবলা গাছের ছায়ায় বসে,প্যাটের মুখে এই কথা শুনতে শুনতে আমার,কৃষাণু সাহার মতো প্রখ্যাত ক্রিপটোজুলজিস্টেরও গা শিরশির করে উঠছিল এই কথা শুনে।
বিকেলের মরা হলুদ আলো। পথটা চলে গেছে জঙ্গলের মধ্যে উঁচু নিচু। বিকেলের ম্লান সোনা রোদ এসে তার সোনার আঙুল ছুঁইয়েছে বনের নরম কোমল সবুজ গায়ে। চারদিকে টিটিফুলের সৌন্দর্য,এছাড়াও এইদিকে সানফ্লাওয়ারের মতো এক অদ্ভুত সুন্দর ফুল ফোটে।যেখানে যেখানে জঙ্গল ফাঁকা, সেখানে চোখ পৌঁছয় দিগন্তরেখার ধূম্র পাহাড়ে। এক মনোরম কিন্তু অপার্থিব পরিবেশ।পশ্চিমাকাশে রক্তরাগের ছোঁয়া। মহুয়াতলায় সাসানডিরির পাশে দাঁড়িয়ে ভাস্করের সাথে ভাবছিলাম আমি। সাসানডিরির একদিকে ঘন বাঁশের জঙ্গল। সেদিক থেকে ভেসে আসছিল হেঁড়োলের ডাক।শীতের সাঁঝের এই হাওয়াকে আজ অতিমাত্রায় শীতল বলে মনে হচ্ছিল।
সাসানডিরি অর্থাৎ মুণ্ডাদের কবর। মৃতের অন্তিম শয্যা। প্যাটের মুখে শুনেছিলাম যে মুণ্ডারা যেমন শিং বোঙার পূজা করে,তেমনই বিদেশী প্রেমিকযুগলও এক মহাশক্তির আরাধনা করত প্রতি শনিবার। তবে সেই শক্তি নাকি শুভ নয়। মানুষের পক্ষে পরম অশুভ সেই শক্তি।
আমি বুঝতে পারছিলাম না,ওরা কি! ওরা কি স্যাটানিস্ট না ওরা ইল্যুমিনেটি। নাকি তন্ত্রের কোনো গুহ্য জগৎ ওদের নখদর্পণে আছে। যাই হোক,তারপর প্যাট আমাকে যা বলেছিল তার সারমর্ম এই যে,তরুণীর মৃত্যুর পর সেই বিদেশী তরুণকেও আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। যেন সে শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছিল।
এখন এই পড়ন্ত বিকালে যে সাসানডিরির সামনে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি,সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছে সেই বিদেশী অজানা তরুণীকে। আদিবাসীরাই করেছে তাদের নিজস্ব রীতিনীতি মেনে। কিন্তু সিংভূমের এইসব অঞ্চলে আগেও এসেছি। অনেক সাসানডিরিতেও গেছি। কিন্তু বাবলাতলার টাঁড়সংলগ্ন এই সাসানডিরির ব্যাপারটাই আলাদা। এখানে এসে দাঁড়াতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি আমার মনকে গ্রাস করল-তা হল এক সর্বগ্রাসী ভয়। ভাস্করও বুঝতে পারলাম,কিছু একটা ফিল করছে। সবথেকে বড়ো কথা স্থানটা অত্যধিক শীতল। মৃত্যুপুরীর শীতলতা গোটা স্থানকে গ্রাস করছে। আর আরোও বড়ো কথা,কোথা থেকে ভেসে আসছিল নাকে অদ্ভুত ধরণের এক পচা গন্ধ।হঠাৎই দেখলাম ভাস্করের চোখ স্থির হয়ে গেছে একদিকে। আমিও তাকালাম সেইদিকে আর দেখতে পেলাম সেই অভীষ্ট বস্তুকে। না,আমরা আমাদের লক্ষ্যে সফল হয়েছে,যা খুঁজতে এসেছিলাম ,তা পেয়েছি। আর কোনো প্রমাণ প্রয়োজন হবে না। ফেরা দরকার। এইসময় পশ্চিম দিকের কালাপাহাড়ির দিক থেকে ধেয়ে এল একদল হুড়ালের হিংস্র গর্জন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তিতিরের বুক ফাটা কান্না শোনা যাচ্ছে। না,আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা উচিত হবে না। ভাস্করকে বললাম,"চলো দাদা,এখন ফিরে চলি,কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই অন্তিম লড়াই লড়তে হবে।"
রাতের মোমের নিভু নিভু আলোয় কঙ্কা বস্তিতে মোড়লের মুখমণ্ডলকে যথেষ্ট চিন্তান্বিত বলে প্রতীত হচ্ছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম টম ও রোজি ছিল শয়তানের উপাসক। তারা নিজের শরীর ও আত্মাকে উৎসর্গ করেছিল শয়তানের কাছে। তাই তো মার্কিন মুলুকের ফিলাডেলফিয়া থেকে আসা এই প্রেমিকযুগলের সাধনা ও উৎসর্গে সন্তুষ্ট হয়ে সিংভূমের পাহাড়ী উপত্যকায় শয়তান নেমে এসেছে আতঙ্কের মূর্তিমান প্রতীক ভয়ঙ্কর ক্রিপটিড জার্সি ডেভিলের রূপ ধরে। পূর্ণিমারাতে একের পর এক হয়ে যাচ্ছে হিংস্র মৃত্যুকাণ্ড। আজই আমি আর ভাস্কর সাসানডিরিতে প্রত্যক্ষ করেছি সেই অমূর্ত ইভিলকে। যার জন্য ছোটনাগপুরের এই স্বর্গপুরী পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। কিন্তু অন্বেষণ করাই তো ক্রিপটোজুলজিস্টের কাজ। এখন আমার লক্ষ্য প্রথমে বহির্জগতের কাছে এই ক্রিপটিডের অস্তিত্বের কথা প্রমাণ করার জন্য তার একটা ক্লিয়ার ফটোগ্রাফি তোলা। যেটা মনে হয় না চাঁদনি রাতে করতে খুব একটা অসুবিধা হবে। আর দ্বিতীয় হল,তার ধ্বংসের ব্যবস্থা করা। হ্যাঁ,শয়তানের সন্তানকে নিজের থেকে দূরে রাখতে হলে একটু রসুনের কোয়া যথেষ্ট। কয়েক বছর আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম হিমাচলের কাঙড়া ভ্যালিতে। সেখানে আলাপ হয়েছিল পরম শিবভক্ত সমর সিং রাণার সাথে। রাণাজীর কাছ থেকে পেয়েছিলাম দেবাদিবের দিব্য ত্রিশূল,আকারে ছোট হলে কি হবে-মন্ত্রপূত। অশুভ শক্তিকে ধারেকাছে ঘেঁসতে দেয় না।
যাই হোক,আকাশে চাঁদ উঠেছে। রূপোলী চন্দ্রালোকে ভেসে যাচ্ছে সমগ্র বিশ্বচরাচর। হু হু করে বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া।শালবনের মধ্যে ওঠা মর্মর ধ্বনিকে কেমন যেন অপার্থিব বলে মনে হচ্ছে। রাতজাগা কোনো অজানা পাখি একটানা ডেকেই চলেছে। রাতেরও যে এক অজানা অপার্থিব সঙ্গীত রয়েছে,এইসব স্থানে এলে উপলব্ধি করা যায়।আমরা জঙ্গলের পথ ধরে তিনজন চলেছি। উদ্দেশ্য ডিমরি লেক। যেখানের কাছাকাছি শয়তানটা নিজের আস্তানা গড়ে রেখেছে।পূর্ণিমারাতের মায়াবী জ্যোৎস্নায় যখন উদ্ভাসিত হয়ে যায় বিশ্বচরাচর,তখন সেই চন্দ্রালোকের মধ্যে জানোয়ারটা খুঁজে বেড়ায় নিজের চন্দ্রাহত শিকারকে। অদ্ভুত এক সম্মোহনী ক্ষমতা আছে হিংস্রতা মাখা রক্তাভ দুই চোখের।প্রাণীটার রূপ এতই ভয়ঙ্কর যে ওর উপস্থিতিই সাধারণ মানুষকে হার্ট ফেল করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
যাই হোক,রজনীর সঙ্গীত শুনতে শুনতে এসে পৌঁছলাম ডিমরি লেকের ধারে। স্বচ্ছ জলে গোল পূর্ণচন্দ্রের প্রতিবিম্বকে অনুপম সুন্দর লাগছে। দিগন্তরেখায় ধূসর পাহাড়শ্রেণীকে কৃষ্ণকায় বলে প্রতীত হচ্ছে।লেকের জলে ওঠা উর্মিমালার ধ্বনি যেকোনো প্রেমিকহৃদয়কে উদ্বেল করতে পারে। আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি,তাদের মধ্যে অধিপতিরূপে বিরাজমান পূর্ণচন্দ্র। ভাস্কর ফিসফিস স্বরে বলে উঠল,"কি রে কৃষাণু,তোর প্রতীক্ষিত ব্যক্তির তো কোনো দেখাই নেই। আদৌ কি আসবে সে!" আমারও বিরক্ত লাগছিল। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ,কে জানে! এক একটি মুহূর্তকে এক এক ঘন্টা বলে মনে হচ্ছে।
বুধাইয়ের প্রশংসা করতে হবে। এই শীতের পূর্ণিমারাতেও সে তার যুবতী প্রেমিকা লালির উষ্ণ সান্নিধ্য ছেড়ে এসেছে কেবলমাত্র আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী হবার জন্য আর পাহাড়তলির বিভীষিকাকে নিজের হাতে বধ করার জন্য। সত্যিই,এই মুণ্ডা যুবকের নিঃস্বার্থ চরিত্র ও সাহস প্রশংসনীয়। আজ স্বয়ং মোড়ল তার হাতে শয়তানকে বধ করার জন্য শিংবোঙার আশীর্বাদপ্রাপ্ত শূল তুলে দিয়েছে,সেই শূলের ইস্পাতের শাণিত ফলা রূপালী চন্দ্রালোকে জ্বলজ্বল করছে।মুখচোখে কঠিন প্রতিজ্ঞার ছাপ।
ঘড়ির কাঁটায় বারোটা বাজে।উত্তর দিক থেকে ভেসে এল একপাল যামঘোষক শিয়ালের ডাক। বাতাস থেমে গেছে,ঝিলটাতে আর ঢেউও উঠছে না। প্রকৃতির এই আশ্চর্য নীরবতা কি ভয়ঙ্কর কোনো কিছুর পূর্বাভাস!
ঝিলটাতে কিন্তু হঠাৎই মুহুর্মুহু অতিকায় ঢেউ উঠতে লাগল,যেন জলের নীচে ভূমিকম্প হচ্ছে,অথবা অতিকায় অপার্থিব কোনো কিছু জলের তলায় বিচরণ করছে। বেশ বুঝতে পারছি যে,প্রতীক্ষিত মুহূর্ত চলে এসেছে।
আচম্বিতেই শূন্য থেকে আবির্ভূত হল সেই অতিকায় মূর্তিমান বিভীষিকা। যিনি আবির্ভূত হলেন সিংভূমের এই ছোটনাগপুরের পটভূমিকায় তিনি মোটেও পরিচিত কেউ নন। বরং সাউদার্ন নিউ জার্সির পাইন ব্যারেনের মূর্তিমান আতঙ্ক। অতিকায় চেহারা,ছাগলের মতো মুখ,বাঁকানো দুই সাদা ধারালো শিং,কিন্তু তিনি তৃণভোজী নন। চোয়ালের আগায় ঝিলিক মারছে ধারালো দাঁতের সারি,ওড়বার জন্য বাদুড়ের মতো পাখনা, পিছনে কাঁটাযুক্ত লেজ,রোমশ চেহারা ,হাতে পায়ে ক্ষুরের বদলে ধারালো নখযুক্ত থাবা,রক্তাভ প্রাণহীন দুই চোখে এই বিশ্বজগতের সমস্ত বিভীষিকা প্রতিভাত। প্রাণীটা চারপেয়ে নয়,দুপেয়ে। শয়তানের উপযুক্ত সন্তানই বটে। আমাদের তিন জনের দিকে অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে চেয়ে রয়েছে জন্তুটা।যেন শিকারকে শেষ মুহূর্তের জন্য নিরীক্ষণ করছে।
হঠাৎই জন্তুটা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিভীষিকাময় গর্জন করে উঠল। সেই গর্জনে কেঁপে উঠল চন্দ্রালোকিত বিশ্বচরাচর। পাহাড়ী অঞ্চলে সেই ধ্বনি বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। কঙ্কা বস্তির লোকেরাও হয়তো শুনতে পেয়েছে এই গর্জন। চোখের সামনেই দেখলাম ডাকাবুকো ভাস্কর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মূর্ছিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।বুধাইকে দেখলাম হাতের শূল ফেলে সম্মোহিত হয়ে ধীরলয়ে সেই মূর্তিমান বিভীষিকার দিকে এগিয়ে চলেছে। ঘটনার ঘনঘটায় কিছু সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বুঝলাম,কিছু একটা করা অতি আবশ্যক।
ইচ্ছা করলে এখনই ছবি তুলতে পারি। কারণ জানি গলায় পঞ্চাক্ষী রুদ্রাক্ষ আমার ক্ষতি করার সাধ্য এই শয়তানের নেই। আর চন্দ্রালোকিত পরিবেশে অত্যাধুনিক ক্যামেরায় রূপকথার এই জীবের ছবি তুলতে পারলে আমি,কৃষাণু সাহা,প্রমাণ করতে পারব জার্সি ডেভিলের অস্তিত্ব বাস্তবেই রয়েছে। খ্যাতির বন্যা বয়ে যাবে,চতুর্দিকে আমার নামে জয়ধ্বনি পড়ে যাবে। কিন্তু আমি খ্যাতির পিছনে ছুটি না। শিবে ভক্তি যার, শুধু খ্যাতির পিছনে ছোটা তার জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। এখন সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভাস্কর আর বুধাইকে বাঁচানো আর সর্বোপরি পাহাড়তলির নিষ্পাপ মানুষদের এই বিভীষিকার হাত থেকে রক্ষা করা। ঝোলা থেকে বার করলাম রাণাজীর দেওয়া মন্ত্রপুত ত্রিশূল। তিন শূল সৃষ্টি ,স্থিতি আর লয়ের প্রতীক। এই ত্রিশূলের ফলাতেই বিদ্ধ হয়েছিল মহাভয়ঙ্কর ত্রিপুরাসুর,তাহলে এই শয়তান কোন ছাড়। ত্রিশূল হাতে এগিয়ে গেলাম হুঙ্কার করতে থাকা মূর্তিমান সেই বিভীষিকার দিকে। আজ অশুভের নিধন হবেই। জয় মহাকাল!