Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!
Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!

Piyali Chatterjee

Horror Thriller

4.5  

Piyali Chatterjee

Horror Thriller

মোহিমপুরের জমিদারবাড়ি

মোহিমপুরের জমিদারবাড়ি

13 mins
745


ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই ফোন তুলে কানে ধরলাম আমি। রণজিৎ এর ফোন।

- হ্যাঁ রণ বল। আজ এত সকালে উঠলি? ব্যাপার কি ভাই?

- ধুর আর বলিস না ভোর চারটের সময় এত জোরে কানের সামনে মিউজিক প্লেয়ারে মহালয়া চালিয়ে দিলে স্বয়ং কুম্ভকর্ণের ও ঘুম ভাঙতে বাধ্য।

- আমার ও এক হাল ভাই। সূর্য উদয় হবার আগেই বাবা এসে তুলে বসিয়ে দিলো মহালয়া শুনতে। তবে যাই বলিস ভাই এই ফিলটাই আলাদা। কেমন আজ থেকেই পূজো পূজো আমেজ। তা তুই ফোনটা কেন করলি সেটাই তো বললি না?

- বলছি, শুনে যা। এই বছর পূজোতে বাবা, মা, ঠাকুমা বেনারস যাচ্ছে বাবার পূর্বপুরুষের জন্য পূজো দিতে। আমি যাবো না বলে দিয়েছি।

- সে কি কেন?

- আমার একটা প্ল্যান আছে।

- আহ গুরু এবার আসল কথায় আসো। প্ল্যান টা কি শুনি?

- আমার বড় দাদু অর্থাৎ আমার বাবার দাদু মোহিমপুর গ্রামের জমিদার ছিলেন। বাবার মুখে শোনা এক কালে সেখানে খুব ঘটা করে দূর্গা পূজো হতো। গোটা গ্রামের মানুষ এক সাথে আয়োজন করতো সেই পূজো। ওই বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত দূর্গা মন্দির ও রয়েছে। যদিও সে অনেক আগের কথা। বহু বছর ধরে সে বাড়িতে কোনো লোক থাকে না। বড় দাদু মারা যাবার পর দাদু বাবা কে নিয়ে এই কলকাতা শহরে চলে এলেন। বলা যেতে পারে বড় দাদুই শেষবার দূর্গা পূজো করেছিলেন। বাবা তখন খুব ছোট। তখন থেকেই সে গ্রামে আর যাওয়া হয়নি কারুর তবে শুনেছি সেই বাড়িটা এখনো তেমনি পরে আছে। একটি পরিবার আছে যারা বহু বছর ধরে দেখাশোনা করে যাচ্ছে বাড়িটা, সম্ভবত মন্দিরের পূজারীর পরিবার। মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকেই একটি পাকা বাড়িতে থাকেন সেই পরিবার। পূজারী যাতে সর্বদা মন্দিরের দেখভাল করতে পারে তাই নাকি বড় দাদু তাদের জন্য একটি পাকা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে। মন্দিরটা বাড়ির ঠিক পাশেই। আমি ভাবছিলাম এইবার পূজোটা সেই বাড়িতে কাটালে কেমন হয়?

- আরে বন্ধু জব্বর প্ল্যান। তবে তুই তো কখনো সেখানে যাস নি? আর সেখানে কি অবস্থা সেটাও আমাদের অজানা। যদি কোনো গোলমাল হয়?

- ওসব কিস্যু হবে না। সব ঠিক করে নেব, ওখানে যাওয়ার আগে। পূজারীর পরিবার তো আছেই। বাবা মাসে মাসে টাকাও পাঠায় বলেই জানি। দাদুভাই ও পাঠাতো। দাদুভাই মারা গেছে দু'বছর হবে দশমীর দিন সেই কারণেই বাবা বেনারস এ যাচ্ছে দাদুভাই এবং নিজের পিতৃপুরুষের নামে পূজো দিতে। কাউকে বলিনি তোকে বলছি, জানিস দাদুভাই এর ইচ্ছে ছিল শেষ জীবনটা মোহিমপুরের ওই বাড়িটায় কাটানোর। দাদুভাই একদিন আমাকে ডেকে জানিয়েছিল, তার বাবার প্রতিষ্ঠিত দূর্গা মন্দিরটি শেষ একবার দেখে যেতে চায়। দাদুভাই চেয়েছিল একটিবার সেই দূর্গা মন্দির এ পূজো করা হোক।

- কবে যাবি বলে ঠিক করেছিস?

- আমি ওদের ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠাবো কালকের মধ্যে। কাজটা খুব গোপনে করতে হবে বাবা যাতে না জানতে পারে। বাবাকে বলেছি পূজোর কদিন আমি তোর বাড়িতে থাকবো। সব ঠিকঠাক হলে আমরা ষষ্টিতেই বেড়াবো। বাবাও সেদিনই বেনারস এর জন্য রওনা হবে।

এই ফোন আলাপের কয়েকদিন পর রণজিৎ এর ফোন পেলাম আবার। সে জানালো সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে। অনলাইনে মোহিমপুরের টিকিট ও কাটা হয়ে গেছে। ষষ্ঠীর দিন সকালে যথা সময়ে গিয়ে দাঁড়ালাম প্ল্যাটফর্মে। শিয়ালদহ স্টেশন এর প্লাটফর্মে লোকজন এর ব্যস্ততা, ফেরিওয়ালাদের ডাক, কোন প্লাটফর্মে কোন ট্রেন আসবে তার এনাউন্সমেন্ট সঙ্গে আগমনী সুর, সব কিছু জানান দিচ্ছে পূজো এসে উপস্থিত। আমি যাওয়ার আট মিনিটের মাথায় রণজিৎ এসে পৌঁছালো। আমাকে দেখে এক গাল হেসে এগিয়ে এলো আমার দিকে। হেসে জিজ্ঞেস করলো,

- কিরে কতক্ষন?

- বেশিক্ষণ নয় এই নয় মিনিট মত। টিকিটগুলো কই?

রণ জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুটো টিকিট বের করলো। দুজনে গিয়ে বসলাম ট্রেনে। মোহিমপুর পৌঁছতে লাগলো পাঁচ ঘণ্টা। যাওয়ার পুরো সময়টাই রণ এবং আমি ঘুমিয়েই কাটালাম। যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। প্লাটফর্মে নেমে রণ কিছুক্ষন দাঁড়াতে বললো।

- এখানে দাঁড়া, সম্ভবত কেউ আসবে আমাদের নিয়ে যেতে। চিঠিতে তেমনটাই লেখা ছিল।

- চিঠি? কোন চিঠি?

- তোকে বলেছিলাম না ওদের ঠিকানায় চিঠি পাঠাবো?

কথাটা শেষ হওয়া মাত্র খেয়াল করলাম রণজিৎ এর চোখ প্ল্যাটফর্মে লোকেদের ভিড় ঠেলে একদিকে থেমেছে। আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করতেই দেখলাম একটি আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ে কাকে যেন খুঁজছে এই ভিড়ের মাঝে। ভারী মিষ্টি দেখতে মেয়েটি, মেয়েটির পরনে লাল রঙের চুড়িদার, হাতে লাল চুড়ি। তার হাঁটু পর্যন্ত চুল একটি ক্লিপের সাহায্যে বাঁধা রয়েছে। চেহারার উজ্জ্বলতা যেন স্টেশন আলোকিত করে তুলছে। আমরা দুজনেই বেশ অনেকক্ষন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম এমন সময় রণ আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো, 'ওই দ্যাখ আমাদের নিতে এসেছে।'

কথাটা বলে রণজিৎ নিজের ব্যাগটা পিঠে নিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। আমিও ওর পিছনে গেলাম।

- তুমি উমা?

মেয়েটি লাজুক এবং ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে উত্তর দিলো, 'হ্যাঁ আপনি?'

- আমি রণজিৎ। ও আমার বন্ধু রাজা। চিঠিতে জানিয়েছিলাম। চলো যাওয়া যাক।

- হ্যাঁ চলুন। বাইরে থেকে রিকশা পেয়ে যাবো।

রণজিৎ বললো,

- রিকশা? কিন্তু তিন জন রিকশা তে কি ভাবে যাবো?

মেয়েটি এবার একটু হাসলো, কোনো উত্তর না দিয়ে স্টেশনের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। একটি রিকশা ডেকে আমাকে এবং রণ কে বসিয়ে রিকশা চালক কে ঠিকানা বুঝিয়ে দিলো। রিকশা কিছু দূর যেতেই দেখলাম রণ রিকশার পিছনের প্লাস্টিকের পর্দা সরিয়ে মেয়েটিকে দেখবার চেষ্টা করছে। এই দেখে আমি বললাম,

- কি ব্যাপার গুরু? এক দেখাতেই প্রেমে পড়লে নাকি?

রণ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, 'ধুর ব্যাটা তোর সব কিছুতেই প্রেম লাগে। তবে মেয়েটি বেশ ইন্টারেস্টিং।'

আমি মুচকি হাসলাম। এই একুশ বছর বয়সে এসে অন্তত একটি মেয়েকে তো রণ-র ইন্টারেস্টিং লাগলো। রিকশা চালক আমাদের কথোপকথন শুনে গলা ঝেড়ে বললো, 'আইগে বাবু আপনারা কি হরগোবিন্দ বাবুর বাড়িতে এসেছেন?'

রণ উত্তর দিলো, 'না। আমার বাবার দাদু এই মোহিমপুরের জমিদার ছিলেন। বড় দাদু মারা যাওয়ার পর বাড়িটায় আর কারুর আসা হয়নি। এই পুজোতে আমরা পুরোনো পরম্পরা অনুযায়ী দূর্গা পূজোর আয়োজন করবো বলে ঠিক করেছি।'

রিকশা চালক রণ এর কথা শুনে এতটা অবাক হয়ে গেল সে এক হেঁচকা আওয়াজে রিকশা থামিয়ে মাঝ পথে দাঁড় করিয়ে দিল রিকশা। পিছন ফিরে আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়ে বললো, 'এসব কি বলছেন কি? আপনাদের কি মাথা খারাপ হলো নাকি? ও বাড়িতে পূজো করবেন মানে? আপনারা জানেন না ও বাড়িতে ভূত প্রেত আছে?'

এই ভূত প্রেত এর কথাটা শুনে আমি যতটা অবাক হলাম খেয়াল করলাম রণ ততটা গুরুত্ব দিলো না ব্যাপারটাকে। উল্টে রিকশা চালক কে ধমকের সুরে বললো, 'পূজো যখন করবো বলেছি তখন করবোই। নাও চলো।'

রিকশা আবার চলতে শুরু করলো এবং দশ মিনিটের মধ্যেই এসে থামলো বিশাল এক বাড়ির বাইরে। জমিদার বাড়ি না রাজপ্রাসাদ বোঝার জো নেই। কি বিশাল বাড়ি। এত বছরের পুরনো বাড়িটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই বাড়িতে কেউ থাকেনা। যদিও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে গেছে এবং লাল ইঁট উকি দিচ্ছে বহু জায়গা দিয়ে। লোহায় ঝং ধরেছে। গাছ পালা বেরিয়েছে ফাঁক দিয়ে। বাড়িটির বেশিরভাগ স্থাপনাই আটচালা দেউল রীতিতে তৈরি। ঘন গাছ-গাছালির মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে জমিদার বাড়িটি। বাড়িটার পাশেই দূর্গা মন্দিরটি লক্ষ্য করলাম। মন্দিরটি যে পুরোনো সেটা বোঝা যাচ্ছে তবে এখনো তার যত্ন রাখা হয় সেটাও দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। মন্দিরের ঠিক উল্টো দিকে অর্থাৎ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানেই আরো একটি এক তোলা পাকা বাড়ি। বাড়িটা এমন ধাঁচে বানানো যাতে সবসময় বাড়ির ভিতর থেকে জমিদার বাড়িটায় এবং মন্দিরে নজর রাখা যায়। বাড়ির সব দরজা জানালা মন্দিরের দিকে। রণ রিকশার ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গিয়ে সেই এক তলা বাড়িটায় ঢুকলো। আমাদের দেখে একজন মহিলা এগিয়ে এলো।

- 'নমস্কার। এত দেরি হলো?'

- 'ট্রেনটা অনেকটা দেরি করলো। এক একটি প্ল্যাটফর্মে অনেকক্ষণ করে দাঁড়িয়েছিল।'

- মহিলাটি এবার হাঁক পারলো, 'উমা জল মিষ্টিটা নিয়ে আয়।'

আমি এবং রণ দুজনেই অবাক হলাম। উমা? সে এত তাড়াতাড়ি কি করে এল?

উমা ভিতর থেকে প্লেটগুলো সামনে এনে রাখলো। শুধু জল মিষ্টি? লুচি, আলুরদম, পায়েস, দুই ধরনের মিষ্টি আরো কত কি। রণ-র দিকে তাকিয়ে দেখলাম খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আমিও হাত লাগালাম। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে এসে বসলাম ঘরে। এতক্ষনে মহিলাটির আসল পরিচয় পাওয়া গেছে। নিমাইচন্দ্র হলো উমার বাবা এবং এই মুহূর্তে মন্দিরটির পূজারী। এর আগে নিমাইচন্দ্রের-র বাবা হরগোবিন্দ ছিলেন মন্দিরের দায়িত্বে। হরগোবিন্দের বয়স এখন ছিয়ানব্বই। বয়সের কারণে এবং রোগের কারণে এখন আর বাড়ির চৌকাঠ পার করেন না তিনি। নিমাইচন্দ্রের স্ত্রী সুচন্দ্রা হলেন এই মহিলাটি এবং ওনাদের একমাত্র মেয়ে হচ্ছে উমা। আমাদের থাকার ব্যবস্থা এই বাড়িতেই করেছে। উমা গিয়ে ঘরটা দেখিয়ে দিল। ঘরে গিয়ে আমি এবং রণ দুজনেই গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। সারাদিনের ট্রেনের ধকল এবং ক্লান্তির শেষে এ যেন এক অন্য স্বর্গসুখ।

রাতে একটি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল আমার। আমি দেখলাম একটি বয়স্ক মহিলা, দাঁত ফাঁক করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার এলো চুল উড়ছে আকাশে। আমি মাটিতে পড়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইছি। আমার সমস্ত শরীরে শিহরণ খেলে গিয়েছিল সেই স্বপ্ন দেখে। আমি উঠে বসে কাঁপা কাঁপা হাতটা এগিয়ে দিয়ে রণ কে ডাকলাম।

- এই রণ? রণ?

রণ উত্তর দিলো ঘুমের ঘোরে, ' কি হলো?'

- একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলাম রে।

- ও ঠিক আছে। নতুন জায়গা, ওরম হয়। এখন ঘুমিয়ে পর কাল অনেক কাজ আছে।

অগত্যা আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুম কিছুতেই আসলো না। প্রায় পঁচিশ মিনিট মতো ওভাবেই এপাশ ওপাশ করতে করতে যেই একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছি অমনি একজন এর বিকট চিৎকার এবং তারই সঙ্গে উঁচু থেকে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজ কানে এলো। রণ ধরপরিয়ে উঠে বসলো। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে লাইটের সুইচ টিপলাম। দেখলাম রণ আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আওয়াজটা কোথায় হলো জানার জন্য আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির লোকজনদের দেখতে গিয়ে দেখলাম সবাই ঘুমোচ্ছে। আশ্চর্য এত জোরে আওয়াজটা হলো অথচ কেউ উঠলো না? আমি রণ কে বললাম,

- মনে হয় গভীর ঘুমে ঘুমোচ্ছে। চল তো একটু বেরিয়ে দেখি। আওয়াজটা কিন্তু খুব বেশি দূর থেকে আসেনি।

রণ আমার কথায় সায় দিলো। আমরা আস্তে করে বাড়ির সদর দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম। বাইরে প্রধান রাস্তার আবছা আলো এ পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না। এদিকটা অন্ধকার। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে জমিদার বাড়ির দিকে খানিকটা যেতেই আমার পায়ে কিসের সাথে একটা ধাক্কা লাগলো। মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালাতেই আমার হাত থেকে মোবাইলটা পরে গেল। একটি বয়স্ক লোকের পচা গলা দেহ। মাথার নীচে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। আমি আর এগোতে পারলাম না। রণ কে ডাকতে গিয়ে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না।মাটিতে পড়ে গেলাম। কেউ যেন আমাকে ধাক্কা দিয়েই মাটিতে শুইয়ে দিল। এবার আমার চোখ গেল জমিদার বাড়ির ছাদের দিকে। অন্ধকারের মধ্যেও স্পষ্ট একটু আগে স্বপ্নে দেখা সেই বয়স্ক মহিলাটিকে দেখতে পেলাম আবার। তার সেই ফাঁকা দাঁতের হাসি, তার এলো চুল উড়ে চলেছে হাওয়ায়। ভয়ে, আতঙ্কে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এল।

আমার জ্ঞান ফিরলো যখন, তখন মাঝের দুটো দিন কেটে গেছে। সপ্তমী এবং অষ্টমী কাটিয়ে আমি নবমীর দিন স্বজ্ঞানে ফিরলাম। রণ আমাকে জানালো সেদিন রাতে যখন ও আমার দিকে ফিরে আমাকে মাটিতে অজ্ঞান অবস্থায় খুঁজে পায় তখন আমাকে উমা-র বাবা, নিমাইচন্দ্রের সাহায্যে ঘরে নিয়ে যায়। গত দুদিন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল আমার। কোনো অবস্থা না দেখে রণ আমার বাড়িতে খবর দেবে ভেবেছিল তবে ফোন নম্বর না থাকায় পারেনা এদিকে আমার ফোনটাও হাত দিয়ে পরে ভেঙে গিয়েছিল সেদিন রাতে। নবমীর দিন আমার জ্ঞান ফেরাতে রণ একটু স্বাভাবিক হলো। আমাকে গত দুদিনের সমস্ত কথা জানালো। রণ আমাকে জানায় যে সেদিন যেই চিৎকারের আওয়াজটা শুনে বাইরে বেরিয়েছিলাম সেটা কোনো মানুষের চিৎকারের শব্দ ছিল না। আওয়াজটা ছিল একজন অতৃপ্ত অশরীরির। হরগোবিন্দ কে রণ-র প্রপিতামহ ঋষিকেশ চক্রবর্তী, এক তীর্থস্থান থেকে তার দূর্গা মন্দিরের জন্য এখানে নিয়ে আসে। হরগোবিন্দের আগে পিছে কেউ ছিল না। এই গ্রামেরই একজন মেয়ের সঙ্গে হরগোবিন্দের বিয়ে দেন ঋষিকেশ চক্রবর্তী। একটি পাকা বাড়িও বানিয়ে দেন তাদের। এক বছর পর নিমাইচন্দ্রের জন্ম হয়। হরগোবিন্দ এবং রণ-র দাদু সমবয়সী ছিল তাই তাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় সহজেই। হরগোবিন্দ সংসার এবং মন্দিরের দায়িত্ব পালন করছিল সমানতালে। মাঝের কয়েক বছর কেটে গেল এভাবেই। এর মাঝে হঠাৎ একদিন রণ-র প্রমাতামহ অহল্যা, অর্থাৎ রণ-র দাদুভাই এর মা অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তার দেখে জানালো মাথার ব্যামো। সারাদিন তাকে একটি ঘরের ভিতরেই রাখা হতো। সময় সময় রণ- এর ঠাকুমা নিজের শাশুড়ির ঘরে জল, খাবার পৌঁছে দিতো। রণ এর বাবা তখন নিমাইচন্দ্রের চেয়ে কয়েক বছর বড়। তাকে সর্বদা চোখে চোখে রাখা হতো তখন। ব্যামোটা এমনই ছিল যে অহল্যা দেবী সকলকে নিজের শত্রু ভাবতে শুরু করেছিল এমন কি নিজের স্বামী কেও। ঋষিকেশ সেবার পঁচিসতম দূর্গা পূজোটা বেশ বড় করে করতে চেয়েছিল। সেই নিয়ে আলোচনা ও শেষ করে ফেলেছিল হরগোবিন্দের সাথে। সব কিছু হিসেবমতই এগোচ্ছিল তবে হঠাৎ একদিন রাত দুটোর কাছাকাছি একটি আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় সকলের। জমিদার বাড়িতে তখন ভর্তি দাস-দাসী। সকলে সেই আওয়াজে উঠে পড়ে। বাইরে বেড়িয়ে দেখে ঋষিকেশ এর নিথর দেহ পড়ে রয়েছে জমিদারবাড়ির ঠিক সামনে। সকলে উপরে তাকাতেই অহল্যা দেবী কে দেখতে পান। সকলের অমন করে তাকানো দেখে অহল্যা দেবী নিজেও ঝাঁপ দেন ছাদ থেকে এবং তার দেহ মাটি ছোঁয়ার সাথে সাথে তার নিঃশ্বাস স্তব্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনার পর থেকেই রোজ রাতে ওই বেদনাদায়ক চিৎকার সবাই শুনতে পায়। সেদিন থেকেই ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে আসছে প্রতি রাতে। অনেকে ঋষিকেশ বাবু এবং অহল্যা দেবী কে দেখতেও পায়। যেমনটা আমি দুদিন আগে দেখেছিলাম। এর পরের ঘটনা আমাদের জানা, রণ-র দাদুভাই এই ঘটনা সহ্য করতে না পেরে পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে ছেলে এবং স্ত্রী কে নিয়ে কলকাতা চলে যায়। রণ আমাকে এও জানায় যে ঋষিকেশ বাবুর অন্তিম ইচ্ছা ছিল বাকি থেকে যাওয়া দূর্গা পূজো যার জন্য আজ পর্যন্ত তার অতৃপ্ত আত্মা মুক্তি পায়নি। ঋষিকেশ বাবু চেয়েছিলেন গ্রামের প্রতিটি মানুষ সেই দূর্গা পুজোয় উপস্থিত থাকুক তবে হরগোবিন্দের অর্থবল সামান্য। গোটা গ্রাম কে ভোজ খাওয়ানোর মত অর্থ তার ছিল না। এদিকে জমিদারবাড়ি ও ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল রণ-র দাদুভাই এর চলে যাওয়ায়। রণ-র দাদুভাই যা টাকা পাঠাতো তাতে হরগোবিন্দের সংসার চালাতে অসুবিধে হতো না তবে প্রতিবছরের সেই জাঁকজমক দূর্গা পূজো স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। রণ এই দুদিনে গোটা গ্রামের মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছে এই বছরের দূর্গা পূজোর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে। রণ তার বাবার থেকে কয়েক হাজার টাকা পূজো উপলক্ষে নিয়ে এসেছিল তা দিয়ে মোটামুটি একদিনের ভোজ দেওয়া যাবে গ্রামের মানুষজন কে। বাকি রইলো পূজো রণ কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজের একটি আংটি সম্ভবত তার দাদুভাই এর, সেটা বিক্রি করেছে এই গ্রামেরই কোনো এক সোনার দোকানে।

তাকিয়ে দেখলাম বাইরেটা অন্ধকার হয়ে আসছে। উমা এসে দুটো বাটিতে চপ মুড়ি দিয়ে গেল। হরগোবিন্দ বাবু দেওয়ালে ভর দিয়ে আমাদের পাশে এসে বসলো। রণ এবং আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

- রণ, আমি ভাবিনি তোমার সাথে কোনোদিন দেখা হবে। তোমার দাদুভাই আমার আগেই চলে গেল। তোমার বাবার চিঠি পেয়েছিলাম তবে শরীরের এমন অবস্থা... সে যাই হোক তুমি এসেছো খুব ভালোই হয়েছে। ঋষিকেশ বাবুর অন্তিম ইচ্ছের কথা শুধু আমিই জানতাম। কতটা উতলা ছিল সেই বারের পূজোর জন্যে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই পূজোর পর তার আত্মা নিশ্চই মুক্তি পাবে। তবে কি জানো সে কখনো আমাদের কারুর কোনো ক্ষতি করেনি। বরং এত বছরে যা কিছু শুভ শুধু তার দয়াতেই।

কথাগুলো বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হরগোবিন্দ বাবু। উমা এতক্ষন দাদুর পাশেই দাঁড়িয়েছিল এবার সে দাদুকে ধরে তার ঘরে পৌঁছিয়ে দিলো। রণ আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 'কাল দশমী। পূজোর শেষ দিন। বাবা ও তার পিতৃপুরুষের নামে পূজো দেবে বেনারস এ। এদিকে বড়দাদুর ইচ্ছেমত গ্রামের সবাই এখানে আসবে মা দূর্গার পুজোতে। আমার বিশ্বাস মা দূর্গার ইচ্ছেতেই আমি এই গ্রামে এসেছি। নাহলে তুই বল এত বছর পর কেন আমাকে এই গ্রাম এত টানলো?'

আমি বললাম, 'জানিস রণ, মাঝে মাঝে এমন অনেক জিনিষেরই ব্যাখ্যা মেলে না। যদি কাল রাতে ওই আওয়াজটা না পাওয়া যায় তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে সবটা।'

সেদিন রাতেও ওই ভয়ঙ্কর আওয়াজটা কানে এলো। তবে সেদিন আর অতটা ভয় পেলাম না কেউই। পরেরদিন সূর্যের আলোর অপেক্ষায় ছিলাম আমরা সকলে। সকাল থেকে ঢাকের বাজনা, অঞ্জলি নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকলাম। বাড়ির দালানে বড় করে প্যান্ডেল করা হয়েছে, দুপুরের দিকে ভোজ আরম্ভ হলো। গ্রামের সবাই এসে দেবী দর্শন সেরে, অন্নগ্রহণ করে নিজ বাড়ি ফিরলো। সেদিনের মত সূর্য ডুবে গেল। রণ এর ফাঁকে একবার তার বাবা কে ফোন করে নিলো,

- হ্যালো বাবা?

- হ্যাঁ রণ বল। তোর পূজো কেমন কাটছে?

- ভালো বাবা। তোমাদের পূজো দেওয়া হয়ে গেছে?

- হ্যাঁ, এই মাত্র পূজো দিয়ে হোটেলে ফিরলাম।

- মা, ঠাম্মি, তুমি তোমরা ভালো আছো তো?

- হ্যাঁ বাবা আমরা ভালো আছি। তোর মা আর ঠাম্মি সবার জন্য কি সব কিনছে হোটেলের বাইরের দোকানগুলো থেকে।

- ঠিক আছে বাবা রেস্ট নাও।

ফোন রেখে দিলো রণ। ক্লান্ত দেহ নিয়ে আমরাও সকলে যে যার ঘরে চলে গেলাম শুতে। রণ আর আমি ঠিক করেই রেখেছিলাম যে আমরা সেদিন ঘুমাবো না তাই সেই মত জেগে বসে রইলাম। ঘড়ির কাঁটা একটা, দুটো, তিনটে, চারটে ঘুরতে ঘুরতে পাঁচটায় গিয়ে পৌঁছিয়েছে তখন রণ আমার দিকে ফিরে বললো, 'দেখলি আজ আর আওয়াজটা আসেনি। মা দূর্গার আশীর্বাদে আমার বড় দাদু এবং বড় ঠাম্মি মুক্তি পেল।'

রণ-র মুখে খুশির হাসি। পরেরদিন সকাল সাতটায় আমাদের ট্রেন তাই ঘুমানোর মত সময় নেই। উঠে তৈরি হয়ে সবাই কে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। নিমাইচন্দ্র নিজে এসে আমাদের ছেড়ে গেল মোহিমপুর স্টেশনে। আমি এবং রণ দুজনেই ট্রেন এর জন্য অপেক্ষা করছি এমন সময় ভিড় ঠেলে একটি কন্ঠ কানে আসতেই সে দিকে তাকিয়ে দেখলাম উমা। রণ-র খোঁজে এসেছে।

- রণজিৎ বাবু? রণজিৎ বাবু?

রণ সেদিকে ফিরতেই উমা তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।

-রণজিৎ বাবু আপনি আপনার এই আংটিটা ফেলে এসেছিলেন। আমি ঘরে ঢুকতেই বালিশের নীচে আংটিটা পেলাম। বোধহয় ঘুমের ঘোরে আঙুল থেকে খুলে গিয়েছিল। নিন।

উমা আংটিটা বাড়িয়ে দিল রণ-র দিকে তবে সে অবাক হয়ে উমার দিকেই তাকিয়ে থাকলো। আমি বললাম,

- কিরে ভাই? আংটিটা নে। ট্রেন যে ছেড়ে দেবে।

রণ উমার হাত থেকে আংটিটা নিয়ে নিল। উমা চলে যাওয়ার আগে রণ-র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'আর কি কখনো আসবেন না এখানে?'

রণ উত্তর দিলো, 'আসবো। খুব তাড়াতাড়ি। তোমার বালিশের নিচে একটি কাগজে আমার ফোন নম্বরটা লিখে রেখে এসেছিলাম। পেয়েছো?'

উমা উত্তর না দিয়ে লাজুক মুখে হেসে ছুটতে ছুটতে চোখের আড়ালে হারিয়ে গেল ভিড়ের মাঝে। আমি এবং রণ ট্রেনে উঠে পড়লাম।

ট্রেনে ফেরার সময় আমি রণ কে চিন্তিত মুখে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,

- কিরে তোর আবার কি হলো? উমার জন্য মন খারাপ করছে বুঝি?

রণ বললো, 'জানিস এই আংটিটা সেটাই যেটা আমি একটি সোনার দোকানে বিক্রি করে এসেছিলাম। উমা বা তার বাড়ির লোক সেকথা জানতো না। জানলেও এত তাড়াতাড়ি গিয়ে আংটিটা ফিরিয়ে আমাকে দিয়ে যাবে সেটাও সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি যখন ফোন নম্বরটা লিখে কাগজের টুকরোটা বালিশের তলায় রাখছিলাম তখনও আংটিটা দেখিনি। হঠাৎ করে কোথা থেকে আসলো এটা?'

আমি কোনো উত্তর দিলাম না বা বলা ভালো আমার কাছে কোনো উত্তর ছিল না। কিছু কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর হয়না। কিছু কিছু ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না।


Rate this content
Log in

More bengali story from Piyali Chatterjee

Similar bengali story from Horror