Piyali Chatterjee

Romance

4.6  

Piyali Chatterjee

Romance

ভালো থেকো

ভালো থেকো

18 mins
1.3K


(১)

প্রায় পনেরো ঘন্টা পর চোখ খুললো রিমি। নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে আছে সে। কোনো একজন কে ভালোবেসে ছিল সে আর তার সৌজন্যেই আজ সে এখানে। দেড় বছরের সম্পর্কের পর হঠাৎই তার আর রিমি কে ভালো লাগলো না। রিমি অনেক অনুরোধ করার পর ও লাভ না হওয়ায় সে নিজের জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিল এবং এইভাবেই সে এসে পৌঁছেছে এই নার্সিংহোমের বেডে। জ্ঞান ফিরতেই ডাক্তার কে ডাকা হলো। ডাক্তার এসে চেকআপ করে রিমির মা কে ভয় মুক্ত করলো। তবে কিছুদিন এখানে রাখতে হবে নিয়মিত চেকআপের জন্য। হাতের স্টিচটাও শুকাতে সময় লাগবে। রিমির মা এবার রিমির কাছে গিয়ে চেয়ারটা টেনে বসলো রিমির চোখ বন্ধ, চোখ বেয়ে জল পড়ছে। এখনো হয়তো সে তার মনের মানুষের কথা ভেবে যাচ্ছে, হয়তো দোষ খুঁজছে নিজের মধ্যে যে কি এমন কারণে রিমিকে ছেড়ে দিলো সে। মায়ের সাথেই বা কি কথা বলবে রিমি? মায়ের সাথে চোখ মেলাতেই পারবে না সে ।

রিমির মা আঁচলে চোখের জল মুছে বললেন- "আচ্ছা রিমি আমরা কি তোর কেউ না? মাত্র কয়েক বছরের সম্পর্ক তোর বাবা মায়ের ভালোবাসার সম্পর্কের চেয়ে বেশি হয়ে গেল?"

রিমি কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। মনে মনে অজস্রবার ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে সে মায়ের কাছে কিন্তু কি বলবে সে? সত্যিই তো অনেক বেশি ভালোবেসে ছিল সে একটি ভুল মানুষ কে। চোখ খুলে মায়ের মুখের দিকে তাকালো রিমি। মনে মনে ভাবলো 'না এই চোখের জল তো চাইনি আমি। নিজের স্বার্থে আমি মা বাবা কে এতটা কষ্ট দিয়ে ফেললাম কি ভাবে।'

রিমির মা বললেন, "তোর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তোর এই অবস্থা দেখে। খালি তোর নাম করছে। দুটি বেলা কিছুটি মুখে তুলছে না।"

রিমি এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না কেঁদে ফেললো। রিমির মা উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো রিমি কে। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলো। রিমির মা চলে যাবার আগে রিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে গেল :- "মা রে ওষুধগুলো ঠিক করে খাস। যে কোনো অসুবিধাই হোক ডাক্তার কে জানাস। কাল সকালে আমি আবার আসবো।"

বন্ধ কেবিনে বসে সামনে রাখা গরম কফি থেকে ওঠা ধোঁয়ার দিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে অর্ণব। পাঁচ বছর আগের চাপা পড়া ক্ষত আবার জগমগিয়ে উঠেছে আজ। তখন অর্ণব একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইনটার্নশীপ করছে। স্কুলের সম্পর্ক বিয়ের দিকে এগোচ্ছে আস্তে আস্তে। অর্ণব আর প্রেরণার বিয়ের তারিখ, কার্ড ছাপানো থেকে শুরু করে বিয়ের মেনু সব ঠিক হয়ে গেছে। অপেক্ষা ছিল শুধু কিছুদিনের কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেল একটি মাসে। প্রেরণা জড়িয়ে পড়লো অন্য একটি সম্পর্কে। প্রথমে অর্ণব না বুঝলেও পরে সবটাই পরিষ্কার হয়ে যায় যখন প্রেরণা অর্ণবের সাথে আলাদা করে দেখা করে সবটা জানায় এবং অর্ণব কে অনুরোধ করে বিয়েটা ভেঙে দিতে। এত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন আর অর্ণব কাউকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনা। অর্ণব তার বাড়িতেও জানায়নি প্রেরণার প্রত্যাখানের কথা। শুধু এটুকুই জানিয়েছিল যে সে বিয়ে তে রাজি নয়। খুব একটা কম কথাও শুনতে হয়নি তাকে দু'বাড়ির থেকেই। এর পর তাদের বিয়ের তারিখ অনুযায়ীই প্রেরণার বিয়ে হয় তবে তার নতুন প্রেমিকের সাথে। হয়তো তারা ভালোই আছে। সবটাই সময় আর ভাগ্যের খেলা। আর এদিকে রিমির মতো মেয়ে ও হয় যে তার ভালোবাসার জন্য মরতেও ভয় পায়না। সত্যিই এই পৃথিবীতে কত ধরনের মানুষ আছে।

দরজায় দুবার টোকা পড়লে অর্ণবের চেতনা ফিরলো।

'হুমম, আসুন।'

নার্স এসে জানালো, 'স্যার, রাউন্ডের সময় হয়ে গেছে।'

অর্ণব কফিটুকু শেষ করে বললো, 'আসছি।'

অর্ণব টেবিলে রাখা চশমাটা তুলে বেরিয়ে পড়লো রাউন্ড এ। বেশ কয়েকটা চেকআপ এর পর রিমির ঘরের দিকে এগোলো অর্ণব। রিমি তখনও একমনে জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। অর্ণব ঘরে ঢুকে রিমির ওষুধ এর লিস্টটা একবার দেখে নিলো। নার্স কে ওষুধ গুলো বুঝিয়ে বেড়াতে যাবে এমন সময় অর্ণব কে রিমি ডেকে বললো, 'ডাক্তারবাবু আমি বাড়ি যেতে চাই। আমাকে প্লিজ ছুটি দিয়ে দিন।'

অর্ণব কোনো কথা বললো না। শুধু রিমির দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থাকলো তারপর চলে গেল। রিমি নার্স এর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বললো- 'আশ্চর্য তো। কোনো কথার উত্তরই দিলেন না। '

নার্স বললো, 'আসলে ডাক্তার অর্ণব একটু কম কথা বলেন। উনি একটু সংরক্ষিত ব্যক্তি। এত বছর আছে আমাদের সাথে কিন্তু ওনার সম্বন্ধে আমরা সেরকম কিছুই জানিনা।'

এই বলে নার্স ও রিমি কে ওষুধ দিয়ে চলে গেল। রিমি কথা না বলে বেশিক্ষন থাকতেই পারে না। এই নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে চুপচাপ তার আর ভালো লাগছে না। কথা বলার ও কেউ নেই। মা ও আসবে পরের দিন সকালে। এতক্ষন চুপ করে শুয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। তার কাছে ফোনটাও নেই যে বন্ধুদের সাথে একটু কথা বলবে তাছাড়া আর বলবেই বা কি তারা হয়তো এতক্ষনে সবটাই জেনে গেছে। সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক এভাবে শেষ হবে তা সে ভাবতেও পারছেনা। রিমি কে পাওয়ার জন্য কত চেষ্টাই না করেছিল সে কিন্তু এখন রিমি কে চিনতেও চায়না। এভাবে কখনো তাকে জীবনে ঠকতে হবে তা রিমি কখনো ভাবেনি।

পরেরদিন রিমির মা এসে দেখে গেল। এখনো অর্ণব আসেনি রিমি ঠিক করেছে আজ আবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলবে। অর্ণব সকালে একটি অপেরাশন সেরে রাউন্ডে গেল। রিমির ঘরে ঢুকতেই আবার সেই এক প্রশ্ন করলো সে,

'কাল আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না যে। আমায় আর কতদিন থাকতে হবে এখানে? এখন তো আমি সুস্থ আছি তাহলে কেন বাড়ি যেতে পারবো না আমি?'

অর্ণব চুপ করে রিমির ব্লাড প্রেসার মাপছে। একটা নতুন ওষুধ ও যোগ করলো হাতের সেলাই তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য। চেকআপ সেড়ে বেড়াতে যাবে এমন সময় রিমি অর্ণব এর হাত টেনে ধরলো উঠে বসে।

'কি ব্যাপার বলুন তো? আপনি কি শুনতে পান না! কেমন ডাক্তার আপনি যে পেশেন্ট এর কথার উত্তর দেন না?'

অর্ণব রিমি কে যতটা সম্ভব এড়িয়ে যেতেই চাইছিল কিন্তু পারলো না। রিমি যেই মুহূর্তে অর্ণব এর হাতটা টেনে ধরলো এক অন্যরকম অনুভূতি হলো। এত বছর যেই অনুভূতিটার থেকে পালিয়ে বেরিয়েছে সে প্রতিটা মুহূর্তে সেই অনুভূতিটাই এটা।

অর্ণব বাধ্য হয়ে রিমির দিকে ফিরলো, 'তোমাকে সাত দিনের আগে ছাড়া যাবে না। একটা নিয়ম আছে সেই অনুযায়ী সব কিছু হয়। তুমি যে হাত কেটেছিলে তখন একবারও বাড়ির লোকের কথা ভেবেছিলে? তুমি জানো এটা একটা আইনি অপরাধ? তুমি হয়তো জীবনটা শুধু নিজের কথা ভেবে বাঁচো কিন্তু অনেকেই সেটা পারে না। পরের বার দয়া করে নিজের ক্ষতি করার আগে বাড়ির লোকেদের কথা ভেবো। আগে সুস্থ হও তারপর নতুন জীবন শুরু করো।'

অর্ণব চলে গেল। রিমির সাথে এই কদিন তার আর কথা হয়নি। অর্ণব দু'বেলা করে নিয়মিত চেকআপ করে গেছে রিমি কে। রিমির ছুটি আজ। রিমির মা, বাবা এসে নিয়ে যাচ্ছে তাদের মেয়ে কে। তবে না রিমির মন ভালো, না অর্ণব এর।

রিমি গাড়িতে বসে কি যেন ভাবছে একমনে হঠাৎ প্রেসক্রিপশন টা খুলে দেখতেই দেখলো নীচে নীল কালি দিয়ে লেখা,

"ভালো থেকো।"

(২)

বাড়ি ফিরে বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে কিন্তু রিমির কোনো কিছুতেই মন বসছে না। রিমি ঠিক করলো যে তার বন্ধুর সাথে দেখা করবে সে। কথা মতো তার প্রিয় বান্ধবী, অনিন্দিতার বাড়ি গেল সে। দুই বান্ধবী মিলে গল্প করছে এমন সময় রিমির চোখ পড়লো দেওয়ালে একটি বাঁধানো ছবির দিকে। ছবিটিতে অনিন্দিতা, তার বাবা ও মা আর ডাক্তার অর্ণব। রিমি কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো অনিন্দিতা কে, 'এই ফটো তে ওই ছেলে টা কে রে অনি?'

অনি উত্তর দেয়, 'আমার দাদা অর্ণব।'

রিমি ফের কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করে, 'তোর দাদা আছে জানতাম না তো! এতবার এসেছি তোর বাড়িতে কখনো তো দেখিনি। আর এই ছবিটাও তো ছিল না।'

'দেখিসনি কারণ ও আমাদের সাথে থাকে না। একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য ও এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।'

'ভুল বোঝাবুঝি মানে?'

'কয়েকবছর আগে ওর বিয়ে ঠিক করা হয় ওরই পছন্দের একটি মেয়ের সাথে কিন্তু বিয়ের কিছুদিন আগেই ও বিয়েটা ভেঙে দেওয়ায় বাবা মা খুব রেগে যায়।'

রিমি বিস্মিতস্বরে বললো, 'বিয়ে ভেঙে দিলো! কিন্তু কেনো?'

অনি বললো, 'মেয়েটি আর একজন কে ভালোবাসতো। আমি জানিস দাদাভাই কে বলেছিলাম একদিন একটা ক্যাফেতে ওই মেয়েটা কে আর একজন এর সাথে বসে থাকতে দেখে কিন্তু ও বিশ্বাস করেনি। এমন কি বিয়ে ভেঙে দেওয়ার সময় ও বলেনি যে দোষটা ওর না ওই মেয়েটার। সব দোষ নিজের উপর নিয়ে বলেছিল যে ও নাকি এই বিয়ে করতে চাইনা। বাবা মা সেই কারণেই ওকে আলাদা থাকতে বলে দেয়। সেই থেকেই ও আলাদা থাকে জানিস।'

রিমি আবার জিজ্ঞেস করলো, 'তুই তাহলে কি করে জানলি সত্যি টা?'

অনি বললো, 'প্রেরণা পরে আমাকে একদিন আমার মোবাইলে ফোন করে সবটা জানায়। দাদাভাই তখন ডাক্তারি নিয়ে ব্যস্ত ওকে একদম সময় দিতে পারতো না আর সেই ফাঁকেই ও জড়িয়ে পড়ে অন্য একটি সম্পর্কে। ওদের বিয়েও হয়ে যায় সেই দিনেই যেদিন দাদাভাই আর ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। জানিস রিমি তোর আর দাদাভাই এর দুঃখটা অনেকটা একই। তোরা ভালোবেসেছিস ঠিকই কিন্তু তার মর্যাদা পাসনি।'

রিমি ঘড়ির সময়টা একবার দেখে নিয়ে বললো, 'আমি এখন আসি বুঝলি। দেরি হয়ে গেল অনেকটা সন্ধ্যা হয়ে গেছে।'

অনি বললো, 'আচ্ছা বাড়ি পৌঁছে ফোন করিস।'

রিমি বাড়ি পৌঁছে অনিন্দিতার সঙ্গে তার নিজের কথাগুলোই ভাবতে লাগলো। বারান্দায় বসে নিচের রাস্তায় চলা গাড়ি, মানুষজন দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো জানে না। ঘুম ভাঙলো সকালে মায়ের ডাকে। তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুললো।

'কিরে এতক্ষন ধরে ডাকছি দরজা খুলছিলি না কেন? আমার তো বড় ভয় করে রে মা। '

'ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই মা। জীবনে যা নেগেটিভ জিনিষ ছিল সব শেষ। এখন না আমি নিজে নেগেটিভ কিছু ভাববো আর না তোমাদের ভাবতে দেবো।'

'আচ্ছা এবারে এই জলখাবার টা খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। আজকে তোর স্টিচ কাটতে যেতে হবে তো ভুলে গিয়েছিস?'

এই বলে রিমি কে বুকে জড়িয়ে আদর করে নীচে চলে গেল। সত্যই রিমির মনেই নেই যে আজ তার স্টিচ কাটার দিন। সে যত দ্রুত সম্ভব একটি সালোয়ার পরে নীচে চলে গেল। জানেনা কেনো এক অদ্ভুত খুশি অনুভব করছে সে মনের মধ্যে। আজ আবার সে অর্ণব কে দেখবে। এত গম্ভীর ভাবে কি করে থাকতে পারে একটা মানুষ ভাবলেই অবাক লাগে তার।

নার্সিংহোমে পৌঁছে প্রায় অনেকটা সময় কেটে গেল। অর্ণব একটা অপারেশন শেষ করে ডাকলো তাদের কে।

রিমি কে দেখেই অর্ণব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কাজের ব্যস্ততায় সম্ভাবতই সেও ভুলে গেছিলো যে আজ তারা আসবে। রিমি কে যে তার এই কয়েকদিনে মনে পড়েনি তা না। তবে কাজের ব্যস্ততার কারণে হোক বা অতীতের কালো স্মৃতির কারণে হোক সে ভুলেই থাকতে চেয়েছিলো রিমি কে। অর্ণবের বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা দেখে রিমি বললো -'আসবো?'

'হুম এসো। অনেকক্ষন অপেক্ষা করতে হলো আসলে একটি অপারেশন ছিল।'

রিমি টেবিলের সামনে রেখে চেয়ারে বসে বললো, 'কোনো ব্যাপার না। আপনি একজন ডাক্তার এইটুকু অপেক্ষা আপনার জন্য করতেই পারি।'

রিমির স্টিচ কাটা হলে। রিমি কে চেয়ারে বসতে বলে কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে দিলো অর্ণব এবং সব বুঝিয়ে দিলো তার মা কে। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো, একজন নার্স এসে খবর দিলো, 'স্যার পরের অপারেশনের জন্য অপেরাশন থিয়েটার তৈরি।'

অর্ণব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, 'আসছি।'

নার্স চলে গেল। রিমির মা ও অর্ণব কে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। অর্ণব খেয়াল করলো রিমি প্রেসক্রিপশনটা উল্টে পাল্টে দেখছে। অর্ণব বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, 'কি হলো? কি দেখছো?'

'এবারে আসল ওষুধের নামটাই তো দিলেন না? যেই ওষুধের জোড়ে এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলাম?'

অর্ণব বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, 'মানে? কোন ওষুধ?'

রিমি স্বল্প হেসে উত্তর দিলো, 'নিচে নীল কালি দিয়ে লেখা ভালো থেকো

যেটার শক্তি যে কোনো ওষুধের থেকে অনেক বেশি।'

(৩)

মাঝে বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। রিমি আর অর্ণব একসাথে ভালোই আছে। রিমি নিজেই হাত বাড়িয়েছিল অর্ণব এর দিকে, অর্ণব সেই হাত কে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। ভালোবাসা থেকে পালিয়ে বেড়ানো খুব একটা সহজ নয়। ফোনের আলাপ কবে যে ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গিয়েছে সেটা অর্ণব বোঝেনি। ওদের ভালোবাসাটা অনেকটা মলমের মতন কাজ করছে পরস্পরের জীবনে। ভাগ্যই হয়তো মিলিয়েছে ওদের কে একে অপরের শক্তি হওয়ার জন্য। ওদের কে দেখলে মনে হয় একটা শুকনো গাছ জল আর রোদের আলো পেয়ে আবার জীবন ফিরে পেয়েছে। রিমির মিষ্টি স্বভাব দেখে অর্ণব আর তার গম্ভীররূপ ধরে রাখতে পারেনা। ওদিকে ছেলেমানুষ রিমি ও কত দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছে অর্ণব এর জন্যে। অর্ণব যখন অপারেশন থিয়েটারে ব্যস্ত তখন সে নিজের হাতে খাবার বানিয়ে নিয়ে তার নার্সিংহোমের ঘরে অপেক্ষা করে। দুজনে একসাথে খাবার খায়। অর্ণব বলে, 'আচ্ছা রিমি, এই যে আমি এত ব্যস্ত থাকি। তোমায় ঠিক করে সময় দিতে পারিনা তোমার খারাপ লাগে না?'

রিমি হেসে উত্তর দেয়, 'না একটুও খারাপ লাগে না। তুমি কত মানুষের জীবন বাঁচাও। তুমি ওদের জন্যে বাঁচো। অপারেশন এর পর তোমার হাসি মুখটা দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়।'

'জানো রিমি তুমি একদম অন্যরকম। কেউ এভাবেও কোনো মানুষ কে ভালবাসতে পারে তা ভাবাই যায়না।'

'আমি তোমার কাছে সারাদিনটা চাইনা অর্নব। এই মুহূর্তগুলোই আমার কাছে অনেক বেশি দামি। আমি তো জীবনে বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি আসলে আমার জীবনে আর অনেক মূল্যবান করে তুললে এই জীবনটাকে।'

রিমি পুরোনো স্মৃতি ভুলে নিজেকে এক নতুন স্বপ্নে সাজাচ্ছে। প্রত্যেকটি রাতের পরেই যেমন সুন্দর একটি ভোর আলোকিত করে গোটা পৃথিবী কে ঠিক তেমনি অনেকটা কষ্ট সহ্য করার পর, জীবনে কঠিন লড়াই করার পর পেয়েছে সে অর্ণব কে। এই সম্পর্কটার মূল্য তার কাছে অনেক বেশি।

রিমি মাঝে মাঝে অর্ণব এর ফ্ল্যাটে যায়। একসাথে কিছুটা সময় কাটায়, পছন্দের সিনেমা দেখে দুজনে মিলে, রিমি অর্ণব এর পছন্দের খাবারগুলো বানায়।

রিমির আর অর্ণব এর সম্পর্কের কথা রিমির মা এবং অনিন্দিতা জানে। তারা দুজনেই খুব খুশি। অনিন্দিতা মাঝে মাঝে রিমি আর অর্ণব এর সাথে ঘুড়তেও যায় ছুটির দিনে। নিজেদের এই খুশির দিনগুলো নিয়ে বেশ ভালোই সময় কাটছিলো তাদের কিন্তু হঠাৎ একদিন একটা কালো মেঘ দেখা দিল আকাশে। রিমি অপেক্ষা করছে অর্ণব এর অপারেশন সেড়ে আসার ঠিক তখনই অর্ণবের ফোনটা বেজে ওঠে। অর্ণব ফোনটা তার ঘরেই রেখেই যায় রিমি থাকলে। প্রথমে রিমি ফোনের দিকে খেয়াল না করলেও পর পর দু বার বেজে কেটে যাওয়ার পর যখন আবার ফোনটি বাজতে শুরু করলো তখন দেখতে বাধ্য হলো। যতই হোক অর্ণব একজন ডাক্তার কোনো ইমার্জেন্সি হতেই পারে। ফোনটা ধরে কানে ধরে হ্যালো বলতে যাবে এমন সময় ওপর দিক থেকে একটি নারীকণ্ঠ ভেসে আসলো

ওপর থেকে ভেসে আসলো কিছু কথা, 'অর্ণব প্লিজ ফোনটা কেটো না আমি প্রেরণা। আমি জানি আমি যা করেছি তার ক্ষমা হয়না তবে একটি বার আমার সাথে দেখা করো। আমি ভালো নেই অর্ণব। তোমার সাথে যে অন্যায়টা আমি করেছি তার ফল আমি প্রতিদিন পাচ্ছি। আমার তোমার সাথে দেখা করা খুব জরুরি। আমি তোমাকে ঠিকানা পাঠাচ্ছি। না করো না প্লিজ।'

ফোনটা কেটে গেল। রিমি কি বলবে বুঝতে পারলো না। ফোনে পর-পর তিনটে মেসেজ ঢুকলো। রিমি মেসেজগুলো খোলার সাহস পেলো না। এত বছর পর আবার এ কোন নতুন ঝড়ের আশঙ্কা এসে পড়লো তাদের দুজনের জীবনে? ফোনটা টেবিলের উপর রেখে রিমি চুপচাপ বেরিয়ে গেল বাইরে। সব কিছুর থেকে অজানা অর্ণব তখন অপারেশন থিয়েটারে একটি প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত।

(৪)

অপারেশন সফল হল। অর্ণব হাত মুখ ধুয়ে রিমির কাছে গিয়ে দেখলো রিমি নেই। খাবারটা টেবিলের উপরে রাখা। অর্ণব ফোনটা তুলে ফোন করতে যাবে হঠাৎ মেসেজগুলোর নোটিফিকেশন চোখে পড়লো। মেসেজে ঢুকেই চোখে পড়লো প্রেরণার মেসেজ। কল লিস্টে অচেনা নম্বরের ফোন দেখে কল রেকর্ডার এ লাস্ট কলটা শুনতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল অর্ণব এর কাছে। অর্ণব বুঝতে পারলো না কি এমন দরকারে এত বছর পর প্রেরণা আবার ফিরে আসলো তার জীবনে। অর্ণব রিমি কে ফোন করলো, দু বার রিং পড়তেই রিমি ফোনটা ধরে নিলো:-

'হুম বলো।'

'কোথায় তুমি রিমি? এভাবে না বলে কোথায় চলে গেছো? আমার কিন্তু খুব ক্ষিদে পেয়েছে তুমি না এলে আমি কিছু খাবো না।'

'প্লিজ অর্ণব জেদ করো না। খাবার রাখা আছে খেয়ে নাও।'

'তুমি না এলে আমি খাবো না রিমি। এবার তুমি ঠিক করো কি করবে আমি ফোন রাখছি।'

অর্ণব ফোনটা রেখে দিল। কিছুক্ষন পর রিমি ফিরে আসলো। অর্ণব ঠিক করলো রিমি কে সাথে নিয়েই সে প্রেরণার সাথে দেখা করবে। অর্ণব প্রথমে যেতে না চাইলেও রিমি নিজেই অর্ণব কে যেতে বলে। খাওয়া দাওয়া করে অর্ণব সেই দিনের মতো সব রুগী দেখা শেষ করে সন্ধ্যে হতে রিমি কে নিয়ে বেরিয়ে পরলো প্রেরণার সাথে দেখা করার পথে। গাড়ি গিয়ে থামলো একটি রেস্টুরেন্টের সামনে। ভিতরে ঢুকে রিমি আর অর্ণব সামনেই একটি চেয়ার টেনে বসলো। কিছুক্ষন পর প্রেরণা একটি বাচ্চা ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো। অর্ণব এর সাথে রিমি কে দেখে প্রেরণা প্রথমে একটু চমকে উঠলেও এগিয়ে গিয়ে নিজেই আলাপ করে নিলো রিমির সাথে। সঙ্গে আসা বাচ্চাটি প্রেরণার নিজের সন্তান।

প্রেরণা জিজ্ঞেস করলো, 'কেমন আছো অর্ণব?'

অর্নব উত্তর দিলো, 'ভালো আছি। হঠাৎ এত বছর পর এভাবে ডেকে পাঠালে?'

প্রেরণা দ্বিধান্বিত হয়ে রিমির দিকে তাকাতেই অর্ণব বলে উঠলো,

'ভয় নেই ওর সামনে বলতে পারো। ও আমার হবু স্ত্রী রিমি।'

হবু স্ত্রী কথাটা শুনে রিমি মনে মনে খুবই আনন্দিত হলো। এত মাস হলো তারা একসাথে কিন্তু কখনো অর্ণব বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথা তোলেনি। সে নিজেও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি তবে আজ অর্ণব এর মুখে হবু স্ত্রী শুনে প্রেরণার খুব ভালো লাগলো।

প্রেরণা একটু হেসে উত্তর দিলো, 'ও বাহ বেশ। খুব ভালো খবর।'

'কি বলবে বলছিলে বলো।' অর্ণব জিজ্ঞেস করলো।

'আসলে কি ভাবে যে বলবো কিছু বুঝতে পারছিনা। বিয়ের পর থেকেই ঋক এর সাথে সম্পর্কটা বাজে দিকেই এগোচ্ছিল। কখনো গায়ে হাত তোলা আবার কখনো নেশা করে সারারাত বাড়ি না ফেরা। এর মাঝেই একদিন সুখবর পাই যে আমি মা হতে চলেছি। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। প্রতীক এর জন্মের পর ঋক আরো বাজে ব্যবহার করতে লাগলো আমার সাথে। আমি এতদিন নিরুপায় হয়ে ওর সাথে ছিলাম কিন্তু আজ আমি মুক্তি পেয়েছি ওর থেকে। এতদিন পর আমি ডিভোর্স পেয়েছি ওই নারকীয় জীবন থেকে।'

'হুম সব টাই বুঝলাম কিন্তু এর মধ্যে আমি কি....'

কথা টা মাঝখানেই থামিয়ে দিলো প্রেরণা। বললো :-

'না অর্ণব। আমি নিজেকে তোমার জীবনে আবার ফিরিয়ে নিতে বলার জন্য আসিনি। একবার শুধু তোমার সাথে দেখা করে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আজ থেকে আমার এক নতুন জীবন শুরু হচ্ছে। যেখানে শুধু আমি আর আমার ছেলে থাকবে। আমি চাইনা কোন খারাপ স্মৃতি কারুর মনে থাকুক আমাকে ঘিরে। তাহলে আমি আর আমার ছেলে ভালো থাকবো না।'

'তোমাকে আমি অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি প্রেরণা। এবার আমাদের উঠতে হবে কাল সকালে একটা অপারেশন আছে। তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা করি।'

অর্ণব রিমির হাত ধরে বেড়াতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে প্রেরণা বললো, 'অর্ণব আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। বিদেশে মাসির কাছেই থাকবো এখন থেকে প্রতীক কে নিয়ে। তাই শেষ বারের মত দেখা করে গেলাম। আর হয়তো এই জীবনে আমাদের দেখা হবে না। অনেক স্মৃতি আছে তোমার সঙ্গে। অনেক মুহূর্ত এবং অনেক স্বপ্ন। আমি যা করেছি তার জন্য পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাদের দুজনের জন্য আমার অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো। তোমরা চিরকাল ভালো থেকো।'

(৫)

অর্ণব রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়েই রিমিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল সেদিন। রিমি ও না বলতে পারেনি। দুই পক্ষের বাড়ির মত নিয়ে বিয়ে ও ঠিক হয়ে যায়। অর্নব এর ইচ্ছা ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিমি কে সে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। দিনক্ষণ ও ঠিক হয়েছিল সেই মত। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে এলো এবং একদিন সানাইরের সুরে বাঁধা পড়লো অর্ণব এবং রিমি। পরেরদিন রিমি তার বাবা, মা কে ছেড়ে চলে গেল একটি নতুন পরিবারে। অর্ণব এর বাড়িতে লোকজনের ভিড় নতুন বউয়ের অপেক্ষায়। নিয়ম অনুযায়ী বাবা, মায়ের ঋণ শোধ করার সময় রিমি মুখ ফুটে

'মা তোমার সব ঋণ শোধ করে দিলাম।' কথাটা কিছুতেই বলতে পারলো না। শুধু চোখের জল দিয়ে বিদায় নিয়েছিলো সে। অর্ণব ও যাওয়ার সময় রিমির বাবা মা কে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলো,

"চিন্তা করবেন না রিমি কে যতটা সম্ভব আগলে রাখার চেষ্টা করবো।"

অর্ণবের বাড়িতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। নতুন বউ এর সাথে গল্প বসে গিয়েছিল সবার। নানা রকম খেলা হয়েছিলো তাদের নিয়ে। সেদিন রিমি আর অর্ণবের কাল রাত্রি তাই মেসেজেই কথা হলো সবার চোখ এড়িয়ে। বৌভাতের দিন সকালে রিমি সবার জন্য বিভিন্ন রকম এর মিষ্টি, এবং পায়েশ বানালো। বৌভাতের অনুষ্ঠান ও ভালো মতোই কাটলো কিন্তু বৌভাতের রাত্রে হঠাৎই অর্ণব এর একটি ইমার্জেন্সি ফোন আসলো নার্সিংহোম থেকে। অর্ণব এর বাবা, মা বারণ করলো ঠিকই তবে রিমি অর্ণব কে আটকালো না। একটা জীবনের দাম নিজেদের সুখের চেয়ে অনেক বেশি তাই রিমি অর্নব কে নার্সিংহোমে যেতে বললো। অর্ণব ও নার্সিংহোমে চলে গেল। রিমির সারারাত ঘুম হলো না। সকালে উঠে রিমি অর্ণব কে ফোন করলো কিন্তু অর্ণব এর ফোনে ফোন ঢুকলো না। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ব্যস্ত আছে ভেবে রিমি এতক্ষন কিছু না বললেও এইবার বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লো সে। ঠিক করলো নার্সিংহোমে গিয়েই খোঁজ নিয়ে আসবে। নার্সিংহোমে খোঁজ নিতে গিয়ে যা শুনলো তাতে তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল রিমির।

ভোর রাতেই অর্ণব অপারেশন শেষ করে বাড়ির দিকে ফিরছিল কিন্তু হাইওয়ে এর দিকে একটি মাল বোঝাই ট্রাক গিয়ে ধাক্কা মারে অর্ণব এর গাড়িতে। অর্ণবের মাথার পিছন দিকে লাগার কারণে সে তখনই জ্ঞান হারায়। আসে পাশের লোকজনই নিয়ে আসে তাকে নার্সিংহোমে। সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে তাদের তাই বাড়িতে ফোন করে খবর দেওয়ার সাহস হয়নি কারুর। ডাক্তার জানায় অর্ণব এর গত কয়েক বছরের কোনো স্মৃতি মনে নেই। এমন কি রিমির সঙ্গে আলাপ ও মনে নেই তার। অর্নব সুস্থ হলে তাকে কিছুদিন পর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।

সেই ঘটনার পর সাত মাস কেটে গেছে। রিমি কে অর্ণব তার বোনের বান্ধবী হিসেবেই চেনে। সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ তবে তার জীবনের সবচেয়ে কাছের তার ভালোবাসার মানুষটিকেই তার মনে নেই। অর্ণব আগের মতোই নার্সিংহোমে ব্যস্ত থাকে। একদিন নার্সিংহোমে একটি মেয়ে ভর্তি হলো ঠিক যেই অবস্থায় রিমি ভর্তি হয়েছিল। অর্ণব বুঝতে পারলো না কি কারণে তবে মেয়েটি কে দেখে তার মায়ের কান্না দেখে অস্পষ্ট কিছু দৃশ্য অর্ণবের চোখের সামনে আসতে লাগলো। সারাদিন ধরে অর্নব এর মনে সেই অস্পষ্ট দৃশ্যগুলো ভাসতে থাকলো। পরেরদিন ও আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। যেই মেয়েটির চেকআপ করতে গেল অর্ণব অমনি মেয়েটি কেঁদে বলে উঠলো:-

"ডাক্তারবাবু আমি বাড়ি যাবো। আমার ভুল হয়ে গেছে আমাকে প্লিজ বাড়ি যেতে দিন।"

কথাগুলো শুনে অর্ণব নিজের চোখের সামনে অন্য একজন কে অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পেল-- কিন্তু সে কে তা অর্ণব জানেনা। সেদিনের মতো অর্ণব তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেল। পরের দু'দিন সে আর নার্সিংহোমে গেল না। অসুস্থতার কারণে বাড়িতেই থাকলো সে। প্রচন্ড মাথার যন্ত্রনা হতে লাগলো তার। বাড়িতে থেকে সে একটু সুস্থ হলো। পরেরদিন মেয়েটির ছুটি তাই অর্নব কে সেদিন যেতেই হলো। যতই হোক মেয়েটির দায়িত্ব অর্ণব এর কাঁধেই ছিল। ওষুধগুলো ও বুঝিয়ে দিতে হবে মেয়েটির পরিবারের সদস্য কে।

রিমির মন সকাল থেকে বিচলিত। অর্ণব কে চোখের সামনে এমন কষ্ট পেতে দেখেও কোনো উপায় নেই তার কাছে গিয়ে তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেওয়ার। ডাক্তার ও বলে দিয়েছেন মাথায় চাপ পড়লে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাই রিমি অর্নব এর সামনেও যায়না তবে মাঝে মাঝে লুকিয়ে দেখে অর্নব কে। মাঝে মাঝে নিজের হাতে রান্না করে খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখে অর্নব এর জন্যে। অর্ণব এর কাছে সে শুধুই তার বোনের বান্ধবী যে পরিবারের একটি সমস্যার কারণে তাদের বাড়িতে থাকছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে রিমি চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা। প্রতিদিন ঠাকুরের সামনে বসে কতই না প্রার্থনা করে অর্ণব কে ভালো করে দেওয়ার। ঘরে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছলো রিমি হঠাৎ ফোন বেজে উঠতে দৌড়ে গিয়ে ঘরে বিছানার উপর রাখা ফোন টা ধরতে গিয়েই চমকে ওঠে। একি দেখছে রিমি! অর্ণব এর ফোন। কিন্তু তা কি করে সম্ভব.... সেই দুর্ঘটনার পর থেকে অর্ণব তো তার সাথে ঠিক মতো কোথাও বলে না। অর্ণব এর ফোন থেকে তাদের ফটো, নম্বর, মেসেজ সব সে নিজের হাতে ডিলিট করেছিল ডাক্তারের কথায় তাহলে অর্ণব কি ভাবে ফোন করছে তাকে?

নাকি আবার কোনো বিপদ ঘটলো! অন্য কেউ ওর ফোন থেকে ফোন করছে না তো?

রিমি ফোন টা তুলে কাঁপা গলায় বললো :- "হ্যালো।"

"রিমি...."

কিছুক্ষন এই মুহূর্তটা স্তব্ধ হয়ে গেল। দুজনের কেউই কথা বললো না। অর্ণব স্তব্ধতা ভাঙলো :-

"রিমি আমার সব মনে পড়ে গেছে। আমি কি করে যে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো বুঝতে পারছিনা। তুমি আজ আবার আগের মতো আমার জন্য নিজের হাতে খাবার বানিয়ে আনবে রিমি? আবার আগের মতো একসাথে বসে খাবো।"

রিমি নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারলো না। এতগুলো দিনের প্রার্থনা, এতগুলো দিনের স্বপ্ন যেন সত্যি হয়েছে আজ। সে বাড়িতে সবাই কে এই সুখবর টা জানালো এবং অর্ণবের প্রিয় খাবারগুলো বানিয়ে অর্ণব এর কাছে গেল। রিমি কে দেখে অর্নব নিজের বুকের মাঝে টেনে নিলো রিমি কে। রিমির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো, 'এই শেষ আর কখনো আমার জন্য তোমাকে কাঁদতে হবে না রিমি।' রিমি নিজের হাতে খাইয়ে দিলো অর্নব কে। বাড়িতে সবাই রিমি আর অর্ণব এর বাকি থেকে যাওয়া ফুলশয্যার রাত এর প্রস্তুতি শুরু করলো। অর্ণব এর মা ঠাকুর ঘরে গিয়ে ধুপ আর প্রদীপ জ্বালিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করে বললো :-

"এতদিন পর যখন সব ঠিক হয়েছে তখন যেই সময় থেকে থেমে গিয়েছিল রিমি আর অর্ণব এর একসাথে পথ চলা সেই জায়গা থেকেই না হয় শুরু হোক তাদের চিরকাল একসাথে থাকার যাত্রা। তাদের জীবনে আর কখনো যেন কালরাত্রি না আসে ঠাকুর। তাদের কে ভালো রেখো।"

তিন বছর কেটে যায় চোখের নিমেষেই, রিমি আর অর্ণব সেদিন যেভাবে সব বাধা কাটিয়ে একসাথে ছিল। আজ ও তেমন আছে। এখন রিমি একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান এর মা। তার এখন অনেক দায়িত্ব কিন্তু সংসারের নানা চিন্তার ভিড়েও অর্ণব আর রিমির ভালোবাসা একটুও কমেনি। এখনো রিমি প্রত্যেকদিন নিজের হাতে খাবার বানিয়ে পাঠায় অর্ণব এর জন্য। শুধু দুপুরবেলাটা একসাথে বসে গল্প করে খেতে পারে না আগের মতো এই যা....


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance