Piyali Chatterjee

Tragedy Inspirational

4.2  

Piyali Chatterjee

Tragedy Inspirational

কলঙ্কিনী আভা

কলঙ্কিনী আভা

7 mins
454


রাত তখন তিনটে বেজে দশ মিনিট আভা গাঙ্গুলী নড়বড়ে পা ফেলে ফেলে বাড়ির মেইন গেট খুলে ভিতরে ঢুকলো। রাত তিনটে বেজে চার মিনিটে গাড়িটা এসে থেমেছিল তার বাড়ির ঠিক সামনে। আভা গাড়ির পিছনের সিটে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গাড়ির চালক কয়েকবার ডাকলো আভা কে, 'এই যে ম্যাডাম শুনছেন? আপনার বাড়ি এসে গেছে। ও ম্যাডাম! কি যে জ্বালায় পড়লাম এই রাত বিরেতে, আরে ও ম্যাডাম!'

কোনো লাভ হলো না, এত ডাকার পরেও আভার শরীরে বিন্দুমাত্র হেলদোল নজরে পড়লো না গাড়ি চালকের তাই বিরক্তিতে, রাগে সে জোরে গাড়ির হর্ন বাজাতে শুরু করলো। এইবার কাজ হলো, আভার ঘুম এক মুহূর্তে ভেঙে গেল, সে হকচকিয়ে তাকালো গাড়ি চালকের দিকে। গাড়ি চালক বললো, 'কি যে করেন ম্যাডাম কখন থেকে ডাকছি। আপনার বাড়ি এসে গেছে নামুন। আমাকে কতটা পথ ফিরতে হবে সময় কত হলো দেখেছেন?'

আভা সেসব কথায় কান দিলো না পাশে রাখা ব্যাগটা খুলে ভাড়া মিটিয়ে সেটিকে কাঁধে কোনো মতে ঝুলিয়ে দুই পায়ে জুতো আছে কিনা দেখে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে গিয়ে কোনোমতে গাড়ির দরজাটা ঠেলে দিলো কিন্তু তার গায়ে জোর নেই তাই গাড়ির দরজা বন্ধ হলো না। গাড়ি চালক রাগে কি যেন বিড়বিড় করতে করতে সামনের দরজাটা খুলে নেমে পিছনের দরজাটা রাগে ঠেলে দিয়ে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।

এতক্ষনে পাড়ার দু-চারটে বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে। একটি দম্পতি ঘুম ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে দোতলার জানালায়। আভার ঠিক পাশের বাড়িতে একজন মাঝবয়স্ক ভদ্রমহিলা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সেই দম্পতির দিকে তাকিয়ে বললো, 'কি অবস্থা দেখেছো? বেচারা সুরেশটা মারা গেল এখনো একটি বছরও পেরোলো না আর তার স্ত্রী মাঝরাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরছে। শুনলাম নাকি সবাই মিলে ঠিক করেছে এ বছর তোমাকে ক্লাবের সভাপতি করবে। একটু দেখো তো বাবা নীল। ওকে যাতে এ পাড়া থেকে বিদায় করা যায়। রোজ রোজ এসব সহ্য করা যাচ্ছে না।' উপরে দাঁড়িয়ে থাকা নীল বউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে সবিনয়ে ঘাড় নেড়ে বললো, 'ঠিক বলেছো কাকিমা। এসব চলতে দেওয়া যায়না। এদের দেখে আমাদের বাড়ির মেয়েগুলো খারাপ হতে পারে। আমি কালই দেখছি কি করা যায়।'

যে যার ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিলো।

পরেরদিন ক্লাবের কাছে লিখিত পত্র জমা দেওয়া হলো যার সারমর্ম হলো এই যে আভার কারণে বৈদ্যপাড়ার সমানভাবে শান্তি এবং সম্মান নষ্ট হচ্ছে তাই যেন একটি উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়। সঙ্গে চিঠির নীচে পাড়ার প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ির একটি করে সদস্যের সই। আভা সকালেই ঘুম থেকে উঠেছে। ছয় বছর বয়সী ছেলে কে তৈরি করে স্কুলে পাঠিয়েছে। কাজের মেয়েটা আজ আবার ডুব দিলো মনে হয়। সাড়ে নটা বাজতে চললো এখনো তার দেখা নেই। এত দেরি তো সীমা কখনো করেনা। আজ সকালেই মোবাইলে মেসেজ এসেছে, ব্যাংকে মাইনের টাকা ঢুকেছে কয়েক মাস ভালো ভাবেই কেটে যাবে। সুরেশ মারা যাবার পর মাথার ওপর কতগুলো দায়িত্ব এসে পড়েছে আভার। কাল রাতের কথাগুলো আভার কানে ঠিকই এসে পৌঁছেছে। পাশের বাড়ির যেই কাকিমার কান কাল আভার কারণে লজ্জায় কাটা পড়ছিলো সেই কাকিমার হাত পা ধরতেও বাকি রাখেনি আভা সুরেশ মারা যাওয়ার পরে ছেলের মুখে ভাত জোগানোর জন্যে কিছু টাকার আশায় তবে তিনি সোজা নাকোচ করে দিয়েছিলেন এই বলে, 'কি বলছো তোমাকে টাকা দিলে তুমি শোধ দেবে কি করে বৌমা? ছেলেটা তো চলে গেল তাছাড়া তোমার কাকুর আর কতই বা আয়। ছেলেগুলো ও তো বউ পেয়ে আমাদের ভুলতে বসেছে। এই সময় টাকা চেয়ো না অন্য কোনো উপকার লাগলে বলো সর্বদা আমাকে পাশে পাবে।'

তার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই নিজেদের পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান কি ঘটা করেই না করলেন। মাছ, মাংস, পোলাও, চার রকমের মিষ্টি, শুধু কি তাই? অরুণ কাকু তৃপ্তি কাকিমা কে নতুন একটি সোনার চেইন ও উপহার দিলেন। তবে সেদিন ছেলেটা দুটো ভালমন্দ খেয়েছিল এই যা। আভা কে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করেননি তারা। বলেছিল, 'বৌমা কাল আমাদের পঁয়ত্রিশতম বিবাহবার্ষিকী তোমার ছেলেটাকে পাঠিও। তুমি তো বিধবা তাই এইসব অনুষ্ঠানে তোমাকে যেতে নেই বোঝই তো সমাজের পাঁচজন কে নিয়ে চলতে হয়।' আভা হেসে বলেছিল, 'না না কাকিমা আমি যাবোনা। আমি বাবান কে পাঠিয়ে দেব।'

কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পেল আভা। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো সীমা। ঘরে ঢুকে হাওয়াই চটিটা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। আভা কিছু একটা সন্দেহ করে গিয়ে দাঁড়ালো সীমার পিছনে। 'কি হয়েছে রে সীমা? মুখটা এমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছিস কেন?' আভা মজার ছলে জিজ্ঞাসা করলো।

'তোমাকে নাকি এ চত্বরে আর থাকতে দিবেনা বৌদিমনি। আমাকে ডেকে ওই সামনের বাড়ির নীলদাদাবাবু কইলেন।'

'কি বললো?'

'কইলো যে তোর বৌদিরে গিয়ে কইবি যে আর মাত্র কয়টা দিন তারপর আর এ পাড়ায় তার আর থাকা হচ্ছেনি। সবাই মিলে ঠিক করেছি ওকে তাইরে ছাড়বো। নতুন কাজ খোঁজা শুরু করে দে।'

আভা মুচকি হাসলো। সীমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, 'তুমি হাসছো? তোমার চিন্তা হচ্ছেনি?'

'চিন্তা? কিসের চিন্তা?'

'তোমাকে যদি সত্যি সত্যি তাইরে দেয়?'

'ধুর! অতই সোজা বুঝি। আমার স্বামীর বাড়িতে আমি আছি। আমিও দেখবো কে আমাকে তাড়ায়।'

সীমা এবার শান্ত হয়ে বললো, 'বৌদিমনি একটা কথা ছিল।'

'কি কথা বল না।'

'বলছিলাম যে আমার টাকাটা? ঘরে চাল বাড়ন্ত স্বপ্নার বাবা কাল খুব মেরেছে।'

'কি? তোর গায়ে আবার হাত তুলেছে? তুই চুপচাপ সহ্য কেন করিস বলতো?'

'কি করবো বৌদিমনি এই বয়সে কার হাঁড়িতে গিয়ে উঠবো? বাপ মা তো কবেই স্বর্গে গেছেন।'

আভা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, 'দাঁড়া তুই একটু আদা দিয়ে চা বসা আমি মোড়ের এটিএম টা থেকে টাকা তুলে আনছি। আজ সকালেই টাকা ঢুকেছে তাই একটু দেরি হলো।'

আভা শোবার ঘরে গিয়ে এটিএম কার্ডটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় ফাঁকা রাস্তাই পেল তবে টাকা তুলে ফেরার পথে নীল এর মুখোমুখি পড়তে হলো। নীল নিজেই কথা বললো, 'বৌদি, কাল অত রাতে কোথায় গিয়েছিলে? পাড়ার সবাই তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে জানো?'

আভা ঘাড় নাড়লো। নীল আবার বলে উঠলো, 'একি জানো না? পাড়ার সবাই তো জানে। সবাই সই ও দিয়েছে।'

আভা মুখে দুঃখের ভাব এনে বললো, 'তাহলে আর কি চলে যাবো না হয় এই পাড়া ছেড়ে।'

নীল চকিতে আভার হাতটা নিজের হাতে ধরে নিয়ে বললো, 'এমা না না বৌদি তা হয় নাকি। আমি দেখছি কি করা যায়। দরকার পড়লে আমি সবার সাথে লড়বো।'

আভা হাতটা সরিয়ে নিলো।

'আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি এখন আসি। বাড়িতে সীমা কাজ করছে।'

বাড়ি ফিরে আভা সীমার হাতে তুলে দিলো মাস মাইনের টাকা সঙ্গে আরও হাজার টাকা দিয়ে বললো, 'এই টাকাটা লুকিয়ে রাখবি তোর বর যেন না দেখে। নিজের জন্য একটা ব্যথার মলম কিনে নিস আর মেয়েটার জন্য ভালমন্দ কিছু রান্না করে দিস।' সীমার চোখে খুশির জল চলে এল। সে আদা দেওয়া গরম এক কাপ চা এনে দিল আভা কে। চায়ের ধোঁয়ায় আভা সুরেশ এর মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল। সুরেশ এবং আভা একই অফিসে চাকরি করতো। সেদিন আভা অফিসে যায়নি বাবান এর স্কুলে একটি মিটিং থাকায় আভা সেদিন ছুটি নিয়েছিল কিন্তু কে জানতো সেই দিনটা তার জীবনে এমন ঝড় বয়ে আনবে। বাড়ি ফেরার পথে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে সুরেশের বাইকে। স্পট ডেড! আভা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সবটুকু কষ্ট গিলে ফেলেছিল। অফিসের ওইটুকু মাইনেতে সংসার ডুবতে বসেছিল। স্কুলের মাইনে, ছেলের টিউশন এর টাকা, সীমা কে তাড়িয়ে দিতে পারেনি বড় ভালো মেয়ে সুরেশ মারা যাওয়ার পর সে নিজে থেকেই বলেছিল, 'বৌদিমনি কয়েকমাস না হয় কম পয়সাই দিও। কাজটা খুব দরকার। সব ঠিক হলে না হয় মিটিয়ে দিও।'

চাকরিটাও চলে যেতে বসেছিল। বস বলেছিলেন, 'দেখো তোমার কাজে কোম্পানি খুশি নন। তারা আমাকে জানিয়েছেন। এখন তুমি একা একজন মহিলা একটি বাচ্চাও আছে তোমার। তোমার মুখের দিকে চেয়ে আমি কোম্পানি কে বোঝাতে পারি তবে তাতে আমার কি লাভ হবে বলো তো?'

আভা সেদিন তার বস এর কতটা লাভ করাতে সফল হয়েছিল তা সে জানেনা তবে ছেলের কথা ভেবে নিজেকে সপে দিয়েছিল তার হাতে। এই বাজারে একবার চাকরি গেলে যে চাকরি পাওয়া কতটা কঠিন তা আভা ভালো করেই জানতো। অফিস থেকে আভা কে তার বস নিয়ে গিয়েছিলেন একটি পাঁচতারা হোটেল এবং একটি ক্ষুধার্ত প্রাণীর মত আভার গোটা শরীরটাকে ভোগ করেছিলেন তিনি। সেটি মাত্র সূত্রপাত ছিল। এরপরে বহুবার আভা কে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন। অদ্ভুতভাবে হ্যাশট্যাগ মিটু কেবল বড়লোক তারকাদের মুখেই ভালো লাগে শুনতে আম জনতার মুখে নয়। কাল রাতেও একই ভাবে তার বস এর ক্ষিদা মেটাতে হয়েছে আভা কে একটি হোটেল রুমে। ধীরে ধীরে পৈশাচিক অত্যাচার বেড়েই গেছে তার। কখনো উরুতে সিগারেটের ছেঁকা দিয়েছে, কখনো বুকের মাঝে ব্লেড দিয়ে চিরে দিয়েছে, আবার কখনো গ্লাসের পর গ্লাস মদ জোর করে ঢেলে দিয়েছে আভার গলায়। আভা এই নারকীয় যন্ত্রনা সহ্য করে গেছে কেবল চাকরিটা বাঁচাতে কারণ এই সভ্য পাড়ার প্রায় সকলের কাছেই ধার চেয়ে সে অসফল মুখে এবং খালি হাতে বাড়ি ফিরেছে প্রতিবার। সামনের বাড়ির নীল যার দরদ আজ এত উতলে পড়লো আভার জন্য সেও যে কতবার কু নজরে তাকিয়েছে আভার দিকে তার ঠিক নেই। কয়েকবার তো খোঁজ খবর নেবার নাম করে বাড়িতে এসে কু প্রস্তাব ও দিয়ে গিয়েছে মজার ছলে। এই যেমন, 'কখনো একা লাগলে আমাকে ডেকো দাদা নেই তো কি আমি তো আছি।' বা কখনো বউ বাপের বাড়ি গেলে আভার বাড়ি গিয়ে বলেছে, 'জানো তো ও বাপের বাড়ি গেছে। বড় একা লাগছে। তুমিও তো একাই থাকো ভাবছি এখানে এসেই থাকি একসাথে থাকলে একাও লাগবে না। কি বলো?' বলেই এক অট্টহাসি হেসেছে প্রতিবার। পাছে কিছু বললে মজা করছিলাম বলেই যাতে খালাসী মেলে। আভা সব বোঝে। যেই নীল কাল রাতে তার পরিবারের মেয়েদের নিয়ে এতটা চিন্তিত ছিল সে কেন আজ মাঝরাস্তায় তার হাত ধরলো, কেন সে পাড়ার সকলের সাথে লড়তেও তৈয়ার সেটাও আভা জানে। তবে আভা বোঝেনা একটি কথা, সম্মান কি শুধু মেয়েদেরই যায়? যারা নিজের শরীরের ক্ষিদা মেটাতে অন্য একটি মেয়ে কে নিজের বিছানায় আনতে চায়, বা যারা কোনো মেয়ের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাদের গায়ে এই সমাজের প্রচলিত কয়েকটি নামের তকমা লাগায় সেই ছেলেদের সম্মান যায়না কেন!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy