মকর সংক্রান্তি
মকর সংক্রান্তি
তখন আমি অনেকটাই ছোট ছিলাম তবুও আজ মনে পড়ছে সব । যেন সে দিনের কথা । আমাদের গ্রামের বাড়িতে ঢেকি ছিল । ধান ভানা হতো ।হটাৎ ঢেকিটা খারাপ হয়ে গেলো। ঢেকির মাথায় যে মুগুর থাকতো , মনে হয় সেটা অকেজো হয়ে যাওয়ায় ঢেকি অচল হয়ে যায় । বেশ মুস্কিল । তবে আমাদের পাড়াতেই একটা বাড়ি ছিল খুব গরিব ।ওদের বাড়িতেও ঢেকি ছিল । তখন সবাই ওদের বাড়িতে ধান ভানতে যেতো । ধান ভেনে দিত ঐ বাড়ির ছেলে সনাতন আর ওর মা । দু জনে মিলে ঢেকিতে পা দিত । ঢেকির তাল টা ওরা ভালো দিত।
আর যার ধান সে থাকতো ঢেকির গোড়ায় । ওরা মা ও ছেলে দু জনেই ছিল অন্ধ । ঐ ঢেকিতে পা দিয়েই ওরা জীবিকা অর্জন করতো ।20 সের মানে এক সলি । এক সলি ধান ভেনে দিলে বারো - তেরো সের চাল পাওয়া যেতো । তার মধ্যে ওদের পারিশ্রমিক দেড় সের চাল । এই ছিল হিসাব মোটামুটি। ঐ বানির চালেই ওদের সংসার চলত । পোষ্য ছিল সাকুল্যে চার পাঁচ জন ।লোকে ওদের বাড়ি ধান ভানতে আসত কারণ , হাস্কিং মেশিন গ্রামে ছিল না সেই সময় । অবশ্যn পরে এসেছিল । কিন্তু সেটা অনেক দূরে । যারা অল্প
ধান ভানতে চায় তারা যেতো না । কারণ তারা ঢেকি
ছাঁটা চালে অভ্যস্ত । আর একটা কারণ নগদ লাগতো বানি । ফলে আমাদের পাড়ায় সনাতনদের
বাড়িতেই ভিড় হতো খুব । ওরাও বেশ খুশি হতো ।
পৌষ সংক্রান্তির এক সপ্তাহ আগে থেকে ওরা ধান
ভানা বন্ধ করে দিত । কারণ তখন চাল কুটোর জন্য
টাইম বুক করতে হতো । কেউ এক সের , কেউ দু সের , কেউ তিন সের চাল গুড়ো করতো
পিঠে তৈরর জন্য । ওরা এক পোয়া , কোথাও দু
পোয়া চালের গুড়ি বানি নিত ।
প্রত্যেক বাড়িতে পিঠে তৈরির ধুম পড়ে যেত ।
কতো রকমের যে পিঠে তার ইয়ত্তা নেই । গ্যাড়া পিঠে , আস্কে পিঠে , সরু চাকলি ,পুরের পিঠে ।
পুর হতো অনেক রকমের । ডালের পুর , ফুল কপির পুর , সন্দেশের পুর আর নারকেল পুর ।
আরও থাকতো--চিড়ের পিঠে । সব শেষে হতো
দুধ পুলি । পুরো দুধে সেদ্ধ পিঠে । আর হতো খেজুর গুড়ের পায়েস এবং ভাজা পিঠে ।
সবই মা বসে বসে করতো । টাটকার থেকে বাসি
পিঠে খেতে ভালো লাগতো । মকর সংক্রান্তির আগে দুটো দিন আর পরের একটা দিন । মোট
চার টে দিনের উৎসব । চাউড়ি , বাউড়ি , মকর
এখান । চার দিনই মা লক্ষ্মীর আরাধনা । বাউড়ির
দিন পিঠে পায়েস 'মা'কে দিতেই হবে । মকরের
দিন খিচুড়ি । তার সাথে পাঁচ রকমের ভাজা , পিঠে
পায়েস মাস্ট । সারা গ্রাম উৎসব মুখর হয়ে থাকতো । মকরের দিন সকালে বড় পুকুরে ডুব
দেওয়ার ধুম পড়ে যেতো । কে আগে ডুব দিতে পারে । ডুব দিয়েই নতুন জামা প্যান্ট পরে আগুন
পোয়ানো । এক সপ্তাহ ধরে জঙ্গল থেকে আনা শুকনো ডাল পালা এনে পুকুরের পাড়ে থরে থরে
রাখা হতো । মকর স্নান হয়ে গেলেই ঐ শুকনো
কাঠে আগুন ধরানো হতো । সবাই আগুন পোয়াত।
আগুন যতো ওপরে উঠতো তত হতো আনন্দ আর চীৎকার । ঠিক তার পরেই টুসু নিয়ে শোভা-
যাত্রা । দলের পর দ্ল বড় বড় চৌদালে টুসুকে বসিয়ে হাত ধরাধরি করে নাচ আর গান । তার সাথে চের চেড়ে পেটে লাকড়া । বাঁশি ড্রাম ।
তখন তো আর ডি জে ছিল না। বেশ লাগতো ।
মকরের পরের দিন এখান পরব । ঐ দিন আবার
মা লক্ষ্মীর পুজো হতো উঠোনে ওটাই নিয়ম ছিল ।
পুজো হয়ে যাবার পরও মা উঠোনে থাকতেন বেশ
কিছুক্ষণ । শেয়াল না ডাকা পর্যন্ত ওনাকে তোলা
যেতো না । কথিত ছিল যে শেয়াল প্রথম ডাকবে
সেই না কি মারা যাবে, ওরাও ব্যাপার টা জান তো।
তাই শেয়াল গুলো ডাকতেই চাইত না । ফলে অনেক ক্ষণ মা লক্ষ্মী কে উঠোনে ঠান্ডায় থাকতে হতো। সকাল থেকেই কিন্তু শুরু হতো তোড়জোড় ।
উঠোনে আলপনা দেওয়া । ফুল তোলা....।
ঐ দিনটা আরো আনন্দের । ঐ দিন বাড়ি বাড়ি
মাংস ভাত খেতেই হবে। মাংস-মানে খাসির মাংস ।
এখান দিন সকালে গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত
পাড়ায় পাড়ায় ছাগল কাটার পালা । আমরা গুনতে
শুরু করতাম --- আজ কতগুলো ছাগল পড়ল ।
ঐ দিন আবার শিকারেরও রেওয়াজ আছে । নিকটবর্তী জঙ্গলে সব দল বেঁধে যেতো লাঠি আর
বল্লম নিয়ে ।অন্তত একটা খরগোশ পেতেই হবে । তারপর সেটা কে নিয়ে বাজনা বাজাতে বাজাতে
গ্রামে ফেরা । তারপরের দিন ফিস্ট । অবশ্য ঐ
একটা খরগোশের মাংসে হতনা । কারণ দলে অনেক লোক থাকতো । মকরের দিন যে আধ পোড়া কাঠগুলো থাকতো ও গুলো বিক্রি হতো ।
সেই টাকাটাও ফিস্টে লেগে যেতো ।
গ্রামের সেই দিন গুলোর কথা মনে পড়লে যেন হারিয়ে যাই ।গল্পটা পঞ্চাশ -ষাট ব্ছর আগেকার ।
দিন গুলো জলের মতো পার হয়ে গেলো । গতকাল
ছিলো বাউড়ি । শ্রীমতীর শরীর ভালো নেই । উনি
আয়োজন করলে আমি অনেক সময় হাত লাগিয়ে
দিই ।কিন্তু আয়োজন টাই হয় নি । সন্ধ্যা বেলায়
পিঠে কিনতে গঙ্গা সাগর
হে কপিল মুনি !
সত্তর লক্ষ যন্ত্রনা ক্লিষ্ট তাপ দগ্ধ
আজ তোমার পদতলে -
তুমি মহামুনি - ত্রীকালদর্শী রয়েছ নীরবে
বসে নি:সীম সমুদ্র তলে !
হে মুনিশিরোমনি !
ঘন কুয়াশা বৃষ্টি , অসহ্য শৈত্য প্রবাহ
উপেক্ষা করে ওরা আকাশ তলে !
হে সত্য দ্রষ্টা !
মানুষের দুঃখ নিবারণ কর ওরা আজ দিগ্ভ্রান্ত
মুক্তির উপায় বলো উপদেশ ছলে !
হে মহাঋষি !
ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ওরা আগত
সমুদ্রের উচ্ছ্বাস সহি করতলে
মধ্যরাত্রি থেকে পরের মধ্য রাত্রি ,চব্বিশটি ঘন্টা
ওরা আপন পলক না ফেলে
আত্মমগ্ন তোমার উজ্জ্বল সিন্দুরে পট তলে
কেউ সমুদ্রে অবগাহন রত, কেউ আবিষ্ট বেলাতলে
কেউ করজোড়ে সিক্তদেহে কেউ আবক্ষ জলতলে
বলে দাও প্রার্থনার উপায় কি ভাবে তোমায় মেলে
কি ভাবে মিলতে হয় তোমা সাথে অপার নীলতলে !
কতো কুটির , কতো হোগলা পাতার ছায়া তলে
নিয়েছে আশ্রয় নির্বিঘ্ন শ্রী চরণ তলে -ওরা
হে কপিল মুনি , আমরা রয়ে গেলাম ঘরে যারা
দিও আশীর্বাদের ছিটা অকপটে যেও না ভুলে !
আসমুদ্রহিমাচল তোমার নেত্র তলে
এই বিশ্বাসে কাটাই দিন ' জয় কপিল মুনি বলে!!'
ব্ছর বছর ভরুক গঙ্গা সাগর এমনি করে
ভারতের আধ্যাত্মিক মহিমাকে উজ্জ্বল করে
আরো -আরো -আরো উজ্জ্বল , হে মুনি !!
...............................................................
। পেলাম না। এধার ওধার ঘোরাঘুরি করে যখন ঘরে ফিরবো ভাবছি তখন
শেষকালে একটা মিষ্টির দোকানে দুধপুলি কিনে
আনলাম গোটা দশেক । অবশ্য ছানার । যাই হোক ওটা খেয়েই পিঠে খাওয়ার শখ মেটাতে হলো ।
আগামী কাল এখান । মাংস খেতেই হবে । আর 'মা'
এর পুজোটাও করতে হবে । তবে উঠোনে হবে না
ঘরেই হবে ।
................................................,,.................
