Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Drama Tragedy

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Drama Tragedy

মায়ের স্বীকারোক্তি

মায়ের স্বীকারোক্তি

4 mins
300



মা চলে গেলেন। শেষ কটা দিন খুব কষ্ট পেয়েছেন।

মণি হাসপাতাল আর বাড়ী করেছে ক'দিন কেবল।

আজ বাড়ীটা একেবারে খাঁখাঁ করছে। মায়ের কাজকর্ম মিটে গেছে গতকাল। মণি মানে মণিমালার দুই ভাই আর দুই বোন তাদের নিজের নিজের পরিবার নিয়ে যে যার নিজের সংসারে ফিরে গেলো আজ সকালেই। মণিমালা... বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান মণি। বাবার অকালমৃত্যুর পর বাস্তবিকই বাড়ীর প্রথম সন্তানের দায়িত্বই পালন করে আসছে এতোকাল ধরে। বাবা চলে যাওয়ার পর মণি বুক দিয়ে আগলে ছিলো এতোদিন মা আর ছোট ভাই বোনেদের। মণি কোনো আঁচ আসতে দেয়নি কারোর ওপর। 


মণি ভাইবোনেদের লেখাপড়া শিখিয়ে উপযুক্ত করেছে, যথাসময়ে তাদের বিয়ে দিয়ে তাদের সংসারী করেছে। এদিকে সময়ের গতিতে নিজের কাছ থেকে কখন যেন নিজের সংসারধর্ম করার বয়সটি পেরিয়ে চলে গেছে। দায়িত্ব কর্তব্যের চাপে তা আর তার নিজেরই খেয়াল করা হয়ে ওঠেনি। তারপর তো ভাইবোনেরা যত বড় হয়েছে তত বেশি করে মাকে ঘিরেই মণির জগৎসংসার আবর্তিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভাইবোনেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। আর মায়ের সব দায়দায়িত্ব মণি একাই সামলেছে। ইচ্ছে হলে ক্কচিত কদাচিৎ ফোনেই ভাইবোনেরা মায়ের প্রতি কর্তব্য সমাধা করেছে। মা বিরক্ত হয়েছেন প্রায়শই ওদের নির্লিপ্ততায়, কিন্তু মণি কখনো কোনো অভিযোগ অনুযোগের ধার ধারেনি। মা'কে বুঝিয়েছে ভাইবোনেদের ব্যস্ততার কথা।



গত পুজোর পরে একদিন অফিস থেকে ফিরে মণি মা'কে বড্ড বিমর্ষ অন্যমনস্ক দেখেছিলো। বিষণ্ণ

মা তেমনভাবে কিছু ভাঙতে চাননি মণির কাছে, মণিও অবশ্য জোর করেনি। তবে মণি লক্ষ্য করেছিলো মা হাসি হারিয়ে ফেলেছেন। বেশি কৌতূহল দেখানো মণির স্বভাববিরুদ্ধ, তাই মাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করলেও বা মা নিজেও মুখ ফুটে কিছু না বললেও মায়ের পরিবর্তনটা মণির চোখ এড়ায়নি। মণি মা'কে চিরকাল দেখেছে রাতে শুতে যাবার আগে একটা লাল বাঁধানো মলাটের মোটা খাতায় অনেক কিছু লিখে রাখতেন, বাবা এ নিয়ে 'খেরোর খাতা' বলে অনেক রসিকতাও করতেন মায়ের সাথে। তবে মণির মনে কখনো মায়ের ঐ 'খেরোর খাতা' সম্পর্কে কোনো কৌতূহলই জাগেনি।



আজ এই ফাঁকা বাড়ীতে মা'কে খুব মনে পড়ছে মণির। একাএকা বসেছিলো অন্ধকার বারান্দায়। হঠাৎ কী মনে হলো মণির, "খুলে দেখিতো একবার, কি লিখতেন মা ঐ লাল 'খেরোর খাতা'য়?" মায়ের ঘরে গিয়ে মায়ের দেরাজ হাতড়ে বার করলো মণি মায়ের ঐ খাতাটা, একের পর এক পাতা ওল্টাচ্ছে আর বিস্মিত হচ্ছে মণি মায়ের লেখা এগুলো? কী সাধারণ অথচ গতিময় ভাষায় কী অসাধারণ দিনলিপি লেখা! মণি ছাপাবে মায়ের সব লেখা। স্থির করে ফেলেছে মনে মনে। 



শেষ পাতার লেখায় পৌঁছেছে মণি। তারপর আর কিছু লেখা নেই। কিন্তু একী লিখেছেন মা, কেনই বা লিখেছেন? বারবার পড়ছে মণি আর মানে খুঁজছে মায়ের শেষ লেখার। কিচ্ছু বুঝতে পারছে না মণি। মা গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছেন... "শুধুমাত্র পেটে ধরলেই কী মা হওয়া যায়? নাকি নাড়ি ছিঁড়ে জন্ম দিলেই কেউ সন্তান হয়? মণির আমার সুস্থ সবল দীর্ঘায়ু হোক। আশীর্বাদ করি ভালো থাকুক। আজ আমার মনটা সুস্থির হয়েছে। এই ভদ্রাসন, এই সম্পত্তি সবই তো কেবল মণিরই প্রাপ্য। আমিই তো উড়ে এসে জুড়ে বসলুম। বড়ো গ্লানি আসে নিজের জীবনের প্রতি। আমি যদি তখন না আসতুম এ বাড়ীতে, যদি জামাইবাবুর সাথে ঘনিষ্ঠ না হতুম, তবে তো আমার দিদিটা বেঁচে থাকতো। মণির নিজের মা বেঁচে থাকতো। মণিকে চোখের সামনে দেখি আর অন্তর্দহনে জ্বলে পুড়ে মরি। মণির বাবাও তো আঁতুরেই মণির মায়ের আত্মহত্যার শোকটা বুকে বইতে পারলেন না। আত্মীয়-স্বজন বিবর্জিত হয়েই চলে গেলেন অকালে। তারপর মণি... আমার ঐটুকু মেয়ে মণি বুকে করে আগলে রাখলো এতোগুলো বছর ধরে। মণি যদি জানতে পারে আমিই ওর মায়ের মৃত্যুর কারণ, তাহলে কী মণি আমাকে মা বলে আর মেনে নিতে পারবে? নাকি এই অপদার্থ নিজের দিদির ঘরভাঙানে মাসির দিক থেকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে? মণির নামেই এই সব সম্পত্তি উইল করে রেখে গিয়েছিলেন ওর বাবা। আজ আমি সেই উইলের সাথেই আমার ইচ্ছাপত্রও জুড়ে দিলুম। সব যাতে কেবলমাত্র মণিরই থাকে সেই ব্যবস্থাই করে উকিলবাবুর কাছে দিয়ে এলুম। ঈশ্বর আমার মণিকে ভালো রাখুন। মণির বারোদিন বয়স থেকে মণিকে বুকে জড়িয়েই যে আমি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি। দিদি, আজ সাহস করে তোর কাছে ক্ষমা চাইছি। করবি ক্ষমা দিদি? মণির কাছে সবচেয়ে বড়ো অপরাধী আমি, ওকে মাতৃহারা করেছি... তাই হয়তো আমার নিজের পেটের ছেলেমেয়েরা আমাকে দেখে না। আর আমাকে বুক দিয়ে আগলে রাখে আমার মণি। আমার মণি সত্যিই মণি... আমার মণিমালা। কোটিতে এক। সত্যিই রে দিদি তুই রত্নগর্ভা... আমার মনে শুধু পাঁক ছিলো, তাই কাদামন নিয়েই জন্মেছে ছেলেমেয়েগুলোও। আর তোর পেটের মণিমালা জগৎসেরা... নিজের জীবন পার করে ফেললো সৎমা আর তার পেটের ছেলেপুলেদের জন্য। আর আমিও কত স্বার্থপর ভাব... তোর আর তোর মেয়ের জীবনটা ছারখার করে দিলুম শুধু নিজে ভালো থাকতে চেয়ে। দিদি রে, মহাপাতকী আমি! আমার নরকেও ঠাঁই হবে না। পারলে আমায় ক্ষমা করিস দিদি।" পড়া শেষ করে মণি থরথর করে কাঁপতে থাকলো 'খেরোর খাতা'টা দু'হাতে ধরে। কিন্তু কী আশ্চর্য! মণির তো মা'কে মানে মাসিকে একটুও ঘৃণা হচ্ছে না! বরং উল্টে মণির বুক ফেটে অবরুদ্ধ চিৎকার বেরিয়ে এলো, "মাআআআআআ..."। আহা, একেই বুঝি বলে সম্পর্কের জটিল সমীকরণ!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract