Apurba Kr Chakrabarty

Horror

4.1  

Apurba Kr Chakrabarty

Horror

মামদো ভুতের কবলে।

মামদো ভুতের কবলে।

11 mins
783


         মামদো ভুতের কবলে 

বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা।কুড়মুনে সনাতন চক্রবর্তী নামে এক পন্ডিত ছিলেন। সংস্কৃত ও ব্যাকরন বিদ্যায় পারদর্শী হলেও কোন পেশাদার বৃত্তি নেন নি। বাড়িতে অনেক জমি সম্পত্তি। ব্রাহ্মণ হলেও পুজা চর্চা বলতে নিজের গৃহে প্রতিষ্ঠিত দেবী মা চামুন্ডা কালী ও শিবের পূজা করতেন,এর বাইরে আর নয়।মাছ মাংস আহারে কোন বাচবিচার না থাকলেও মাংস বলতে শুধু বলি দেওয়া ছাগের মাংসই চলত।

হঠাৎই একদিন গ্রামে রব উঠল, তার একমাত্র কাকা সন্ন্যাসী হয়ে যিনি বহুদিন যাবৎ গৃহ ছাড়া, তাকে নাকি দেখা গেছে শ্মশানে ছোট কুড়ে ঘরে বাস করতে!

এদিক ওদিক সমালোচনাও হচ্ছিল, সনাতন পন্ডিত সম্পত্তির লোভে নিজের কাকার সাথে দেখা করছে না। কানে আসতে সনাতন পন্ডিত রেগে গেলেন।

একদিন সন্ধ্যায় শ্মশানের ঐ কুঁড়ে ঘরে গেলেন।ঘরের সমানে দরজার পাস থেকে ডাকলেন, "সন্ন্যাসী ঠাকুর একটু দেখা করার অনুমতি পাবো! "

ভিতর থেকে একজন পুরুষ কন্ঠে ডাকল "এসো বাবা"

সনাতন খরম খুলে ভিতরে ঢুকলেন! সন্ন্যাসী দীর্ঘদেহী একমুখ শুভ্র গোঁফদাড়ি উন্নত কপাল গৌর বর্ন!

সনাতন সন্নাসীকে দেখে চমকে ওঠেন, বাবার মুখে সনাতন, গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী কাকার বর্ণনা  শুনেছেন অনেক । তিনি শ্যামলা বরং কালো বলাই ভালো,বাড়ির গূষ্ঠিশুদ্ধ কালো, কিন্ত ঐ কাকা নাকি লম্বা ধবধবে ফর্সা ছিলেন। 

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী মৃদু হেসে বললেন " সনাতন যা ভাবছ তা নয়, আমি তোমার কাকা নই । "

সনাতন চমকে ওঠেন,"আপনি কি অন্তর্যামী ! "

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী উচ্চ স্বরে হাসলেন,বললেন "যদি হই তোমার কী তাতে কিছু সমস্যা আছে!"

সনাতন নতজানু হয়ে প্রনাম করলেন। বললেন "আমি কেন এসেছি নিশ্চয় জানেন। অনেকেই বলছে আপনি আমার গৃহ ত্যাগী কাকা, সন্ন্যাসী হয়ে গ্রামে ফিরেছেন আমি সম্পত্তি লোভে আপনাকে চিনতে চাইছি না।"

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বললেন "তোমার কী মনে হয়! "

সনাতন বললেন, "আমিও নিশ্চিত আপনিই আমার কাকা। বাবার মুখে কাকার যা বর্ণনা শুনেছি,আমার বিশ্বাসও তাই বলছে। "

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী এবার হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন "তা হলে এখন উপায়! কি ভাবছ? "

সনাতন বললেন "আমার সম্পত্তির অর্ধেক আপনার, আপনি চাইলে ভালো আশ্রম করে দেবো ,আপনার সব খরচ আমি বহন করব। "

এবার বৃদ্ধ আরও জোরে হাসতে লাগলেন। হাসি আর থামে না।

সনাতন নিজেকে এমন বোকা বোকা কোনদিন মনে হয় নি। বললেন "আমি কী কিছু অন্যায় বললাম! "

বৃদ্ধ হেসে বললেন" আগে তুমি তোমার মাথা থেকেই দুর করো, যে আমি তোমার কাকা । ঠিক আছে! আমি তোমার পিতৃতুল্য ভাবতেই পারো। সচ্ছল মানুষ ধর্মে মতি আছে ,সাধু সন্ন্যাসীদের সেবা করতে চাও খুব ভালো।কিন্ত বাছা আমি আমার মা বাবাকে ছেড়ে যৌবনে বাড়ি ঘর সম্পত্তি সব মায়া কাটিয়ে গৃহ ত্যাগ করি। তুমি আমায় আশ্রম করে ধরে রাখবে! "

সনাতন আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিল। বৃদ্ধ বললেন"আমি এখন সন্ন্যাসী না ববং সাধু,আমার সহধর্মীনী আছেন ।ও আমাকে এক স্থানে ধরে রাখতে পারেনি । আমার সাথেই ভবঘুরে ,পাশের কক্ষে ধ্যানে আছেন। আমরা যখন যেখানে ইচ্ছে ঘর বাঁধতে মন চাইলে ঘর বাঁধি। আবার ভালো না লাগলে চলে যাই। ঈশ্বরের কৃপায় চলে যায়। তুমি আমার কাছে নিয়মিত আসবে। তোমার কপাল বলছে ,তোমার অনেক খ্যতি হবে।

সনাতন ঘাড় নাড়ল। গ্রামটিতে বামুন মাত্র বিশ ত্রিশ ঘর।আগুরি গোয়ালা তিলি সদগোপ,বাগ্দি মানুষের অনেক বাস। তারাই পালা করে ঐ বৃদ্ধ সাধু সন্ন্যাসী যাই হোক নিয়মিত সিধে, অর্থাৎ খাবার চাল ডাল তেল নুন ঘি সব্জি আনাজ থেকে জ্বালানী সব কিছুই বিনা পয়সায় দিত। সে সময়ে নাস্তিক ও জাতপাত নিয়ে সংকীর্ণতা এত ছিল না। মানুষ অনেক সুখী ছিল, যদিও মানুষের সম্পদ কমছিল, দেব দ্বিজ সাধু সন্ন্যাসীদের শ্রদ্ধা ভক্তি করে মনে পরিতৃপ্তি পেতো।

সনাতন সাধুর কাছে নিয়মিত যাতায়াতে মানুষের ধারনা পাল্টালো। মাস তিনেক পর হঠাৎই সাধু বাবা অদৃশ্য হয়ে কোথায় যে চলে গেলেন কেউ জানে না।

কিন্ত এই সময়ে সনাতন তাঁর কাছে তন্ত্র সাধনায় ও চামুন্ডার আশীর্বাদে এক সিদ্ধ তান্ত্রিক হয়ে উঠলেন। সনাতনের তাই সন্দেহ ,ইনি তার কাকা, পরিচয় দেন নি,কিন্ত তাকে যে সাধনা তন্ত্র শিক্ষা দিয়েছেন তার ঋণ শোধ করা কোন সম্পদে সম্ভব নয়।

সনাতনের বয়স তখন বড়জোর পঞ্চাশ বাহান্ন। এর মধ্যেই তার দুই ছেলের এক মেয়ের বিয়ে  হয়েছিল, বাকীরা পড়াশোনার মধ্যেই ছিল। সে সময় পুরুষদের কুড়ি একুশে পিতৃত্ব লাভ স্বাভাবিক ঘটনা।

এর পর সনাতনের জীবনে এক বড় পরিবর্তন এলো। কিছুদিনের মধ্যেই তার খ্যাতি সম্মান পাশাপাশি বিশটা পঁচিশটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল, মুলত বাড়ীর অশুভ যোগ দুর করা,আর ভুত প্রেত্নীর দোষ কাটানোর জন্য দুর দুরান্ত গ্রাম থেকে কত মানুষের আবেদন নিবেদন আসত।

কোন বাড়িতে ঢুকেই তিনি বলে দিতে পারতেন, গৃহ অশান্তির জন্য ভুত প্রেত অপদেবতা না গ্রহের দোষ! না কিছুই না,মিথ্যা ভ্রম।

সচ্ছল সনাতনের কোন লোভ ছিল না। যাগ যজ্ঞ শান্তি ক্রিয়াকর্ম করতেই হবে !না দরকার নেই বলে দিতেন।এক পলকে। প্রয়োজনে যাগ যজ্ঞ করলেও নিজের জন্য কোন পারিশ্রমিক চাইতেন না। যা খুসী মনে গৃহী দিতো মেনে নিতেন।

তার বাড়িতে নিয়মিত এমন সব দুরদুরান্তের বিপদগ্রস্ত মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। সংসারে সময় দিতে না পারলেও যে আয় আসত তাতে বাড়িতেও তাঁর কদর বরং বেড়ে ছিল।তিনি নাকী ভুত প্রেত পেত্নীর দেখা না পেলেও অবস্থান অনুভব করতেন। তাদের তন্ত্র বলে চেপে ধরে তাদের রাগ দুঃখ কষ্ট ক্ষোভ যন্ত্রনা ক্রোধ শুনে নিতেন।

লোকে বলত তিনি নাকি চামুন্ডার বর পুত্র।মাঝেমধ্যেই তিনি ভুত প্রেত প্রেত্নির পক্ষের উকিলের মত সওয়াল করতেন, গৃহের ভুতের উৎপিড়িত মানুষদেরই ভৎসনার করতেন। জীবন দশায় ঐ সব ভুত পেত্নিদের প্রতি এই সব মানুষদের নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণের জন্য।

নির্দেশ দিতেন একমাস ঐসব অপদেবতার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা,অনুতাপ,কানমলা দেওয়া ,দুঃখ প্রকাশ করার। এই জন্য কেউ কেউ তাকে ভুত পাগলা বাবা বলত।

সেদিন খেড়ুর গ্রামে থেকে আসা এক প্রৌঢ়া ও তার যুবা ছেলে প্রভাকরকে যা না তাই বলে সনাতন পন্ডিত অপমান করছিলেন।

" বললেন এই পেত্নির জ্বালাতন উৎপীড়ন তারা আরও এক বছর ভোগ করুক ।তার পরে যেন আসে। "

পৌঢ়া ও যুবক নাছাড়বান্দা। সনাতনের পা আঁকড়ে ধরে, কেঁদে বার বার ক্ষমা চেয়ে, তাদের রক্ষা করতে বলে।

সনাতনের স্ত্রী খুব দয়ালু সরল মহিলা। তিনি এই সব নাটকবাজী কান্ড মোটেও পছন্দ করেন না। স্বামীকে সমীহ সম্মান করলেও ভয় করেন না। সোজা তার ঘরে এসে বললেন,"বাড়ির অতিথি এরা,এভাবে এদের কেন কাঁদাচ্ছো! বাড়ির একটা মঙ্গল অমঙ্গল ব্যপার আছে তো নাকি?

সনাতন রেগে বললেন, "দেখো গিন্নি না জেনে না বুঝে কথা বলো না ,এরা পাপীষ্ঠ এদের একবছর অন্তত পাপের ফল ভোগ করুক। "

যুবক কাঁদতে কাঁদতে বলল" মরে যাবো ঠাকুর মশাই, রক্ষা করেন, যা শাস্তি আপনি দিন, মেনে নেবো,আর পারছি না ,দিন রাত এত অসহ্য মরে গেলাম, এবার আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। আমি এত জানতাম না,ও এতো কষ্ট পাচ্ছিল , অপমানিত হচ্ছিল, আমি জানতাম না "বলতে বলতে আবার কাঁদতে লাগল। 

সনাতনের স্ত্রী বললেন" কী হেঁয়ালী হচ্ছে তুমি খুলে বলবে!" বলে এমন তাকালেন। যেন সনাতনই ঐ যুবকের বিপদ দুঃখের মুল কারণ। 

সনাতন বললেন "তবে শোন গতকাল অমবস্যার দিন ওদের বাড়ি যাই।ওদের বাড়ীতে উপদ্রব করছে এক প্রেত্নি। যে ওর প্রথম পক্ষের বৌ।তার চার পাঁচ বছর অবধি বাচ্চা না হলে, এ আবার বিয়ে করে। আগের পক্ষের বৌ মেনে নেয়। দ্বিতীয় বৌ আসার পর পরই গর্ভবতী হল। তখন থেকেই আগের বৌটিকে এই শাশুড়ি বেটা আর নতুন বৌমা প্রতি মুহূর্ত অপমান করতে লাগল।

আগের স্ত্রীর বাপের বাড়ির অবস্থা ভালোছিল না । মেয়েটি শ্বশুর বাড়িতে থাকার চেষ্টা করেছিল।স্বামীকে সে ভালোবাসত।কিন্তু স্বামীর ঘরে যেতেই পারত না, জায়ের গায়ে হাত দিতে নিষেধ ছিল।বলত অপয়ার পর্স্শে পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে। তবু সে সহ্য করে। জায়ের বাচ্চা হবার পরও ছুঁতে দিতো না। একদিন বাচ্চাটা খুব কাঁদছিল,কিন্তু কাছাকাছি কেউ ছিল না, তাই কোলে তুলে আদর করছিল ।এই সেই শাশুড়ি বাচ্চাকে ছো মেরে কেড়ে নিয়ে ,ঐ হতভাগীকে যা না তাই অপমান করে,ডাইনী থেকে রাক্ষসী আরও কত কী! ছেলেকে দিব্যি দেয় ওর সাথে যেন কথা না বলে। আর সুবোধ বালক একটা দিন গোটা ওর সাথে কোন কথা বলেনি। সে বলতে এলে ক্ষমা চাইলে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এর পর হতভাগীর মরা ছাড়া কী পথ ছিল?সেই রাতেই আগুনে পুড়ে শেষে আত্মহত্যা করে।এবার বল গিন্নি এদের উপর একবছর পাল্টাশোধ ঐ অভাগা পেত্নি নেবে না কেন?

সবাই চুপ, শাশুড়ি মাথা নিচু করে কাঁদো স্বরে বলে "সব দোষ আমার, ছেলেটা কেন ---- "বলতে বলতে গলা বুজে গেল।

সনাতন বললেন "ঐ পেত্নি আমায় সব বলেছে ,কাতর ভাবে বলেছে আপনি ঠাকুর,কি বলব আপনাকে!আমি চাই ও মরে আমার কাছে আসুক, আগে বিশ্বাস করে অনেক ত্যাগ আর  ভালোবেসেছিলাম। এবার কাছে পাই, ঝাঁটা পিটে করব যখন তখন।কী ক্ষোভ বুঝলে!"

সনাতনের স্ত্রী বলল,"সে বেচারীও তো খুব কষ্ট পাচ্ছে উদ্ধার হবে,মনকষ্ট আর পাবে না।"

 সনাতন বললেন "সব আমি জানি গিন্নি,কিন্ত ও কষ্ট তো লৌকিক জীবনে পেয়েছে,অলৌকিক জীবনে আর এক বছর পাক না,এখন তো শোধ তুলুক ! এরা বুজুক কি পাপ অন্যায় করেছে! 

সনাতনের স্ত্রী বললেন কী উৎপীড়ন করে! যুবক প্রায় কেঁদে ফেলে বলল "ও মরেছে দুমাস, সেই থেকেই বাড়িতে থাকতে পারি না,বাড়িতে খাওয়া তো অসম্ভব। আমাকে খাবার দিলেই গোছা গোছা পোড়া চূল খাবারে মিশে যায় ,সঙ্গে পোড়া মাংসর গন্ধ সব সময়ই বাড়িতে গেলেই নাকে আসে। আর একা থাকলেই এ দিক ওদিক তাকালে দেখি,সেই বীভৎস পোড়া মুখে কখনও হাসে কখনও ভেংচি কাটে ! আর - -"

সনাতনের স্ত্রী ভয় পেয়ে বলে "থাক থাক ,গা ঘোলাচ্ছে আমার। আমি আর এতে নেই। আপনারা ভালো মানুষ নয়।"

সেদিন অনেক রাত অবধি শাশুড়ি ও তার বেটার চরম দুর্ভোগ হল। সনাতনকে এখনই রাজী না করিয়ে তারা যাবে না। দরকারে এখানেই থাকবে, জলে ভিজবে রোদে পুড়বে, অনাহারে মরবে, কিন্ত সনাতনের বাড়ি থেকে বের হবে না।

ওরা জানে সনাতনের কোন লোভ নেই ,দাবী নেই ,তাই এ ছাড়া কোন পথ নেই। এর আগে এক ভুতের ওঝা এসেছিলেন , কিন্ত প্রেত্নির ভয়ঙ্কর তান্ডব আর হুংকারে ভয়ে পালিয়ে যায়।

সনাতন সেমত নয়,তিনি আগে ভুত পেত্নির সাথে ভাব জমান।তাদের দুঃখ কষ্ট সহানুভূতির সাথে জানতে চান কতটা যুক্তিযুক্ত তাদের ক্রোধ সেটা বলেন।শেষে রফা করার চেষ্টা করেন ,সম্মানের সাথে বিদায় হবে কিনা! নাহলে যাগ যজ্ঞ শান্তি ক্রিয়ায় তন্ত্র বলে তাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।বেশীরভাগ ভুত রফা করে না। নিজেদের অসীম শক্তিধারী ভাবে।এই পেত্নী তো করেই নি বরং একবছর সময় চেয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতে। আর এখনই স্বামীকে সঙ্গে পেলে পালাবে। "

সনাতন খুব দ্বন্দ্বে ছিলেন। জপে মা চামুন্ডার স্মরণ নিলেন, নির্দেশ পেলেন। শাশুড়ির বিনিময়ে স্বামীকে ঐ পেত্নি ছেড়ে দিক। এমন প্রস্তাব সনাতন পেত্নিকে দিক। তাতে রাজি না হলে তন্ত্র বলেই ওকে তাড়িয়ে দে।মূখ্য দোষী ওর শাশুড়ি। নারী হয়ে নারীর মন বুঝতে চায়নি এটা বড় পাপ।সনাতন যেন এসব কথা ওদের না বলে।

আগামী আষাঢ়ের কৃষ্ণ ত্রয়োদশি সাত তারিখ, যজ্ঞের

দিন ঠিক কর।সেই মত সনাতন তাদের দিন জানালেন, তবু সহ্য করা যাবে মাঝে তো মাত্র সতের দিন।

সেদিন দুপুরের পর সনাতন খেড়ুর রওনা দিলেন, মা চামুন্ডাকে স্মরণ করে ।বর্ষা এবার বিলম্বে, কুড়মুনের উত্তরে খড়ি নদী, প্রায় দুই মইল পথ।নদীর জল কোমর বরাবর, গামছা পরে ব্যাগ ছাতা মাথায় তুলে নদী পাড় হলেন। তার পর গামছা ছেড়ে কাপড় বদল করে হাঁটা দিলেন, আরও তিন মাইল পথ। খেড়ুর গ্রাম পৌছাতে পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল।

সনাতনের ফদ্দ মত সব পূজার আয়োজন সামগ্রী মজুত ।আজ বিশেষ বলতে একটা কালো পাঁঠা বলি দিতে হবে। চামুন্ডার পূজা হবে। ঠিক ঠাক সব চলছিল হঠাৎ পূজার আয়োজন স্থলের পাশে পোড়া মাংস, কী ভাবে কখন এল সবার অলক্ষ্যে!

সনাতন তন্ত্র বলে পেত্নির কথা শুনতে চাইলেন।ভয়ঙ্কর ক্রোধে পেত্নি বলে"এটা কী হল ঠাকুর!কথা রাখলে না! দেখব কী করে তাড়াও।"

সনাতন বলল" তোমার বরের পরিবর্তে শাশুড়িকে- -"

কথা শেষ করতে দিল না সে হুঙ্কার দিয়ে বলে"নাকের বদলে নরুন! আরে আমার তাতে কী লাভ! এতে তো বরং আমার জায়ের লাভ,খান্ডার্নী শাশুড়ি আজ না হয় কাল ওকে জ্বালাতন করবেই ।আমি শুধু আমার স্বামী চাই। এবাড়ীতে ও শুধু আমার।"

সনাতন বলে "শাশুড়ি তোমার বেশী দায়ী । "

পেত্নি বলে "তুমি হঠো ঠাকুর ,না হলে তোমার বিপদ হবে।"

সনাতন বুঝল আপোষ করবে না। চারদিক গন্ডি কেটে যজ্ঞের কাজ শুরু হল। শেষে তিন ঘন্টার তন্ত্র যোগে পেত্নি কাহিল হল, রাত এগারোটা নাগাত খুব কাঁদতে কাঁদতে তাকে অভিশাপ দিতে দিতে পেত্নি বলল" এবাড়ি আমি ছাড়ছি ঠাকুর, তোমায় পথে কী হাল করি দেখো।" এক গোঁঙ্গানী কান্নার বিকট শব্দ আর দমকা হাওয়া নিয়ে এবাড়ি থেকে বিদায় নিতে তার প্রিয় নারকেল গাছ টা ভেঙ্গে যখন পালালো ।সনাতন সবাই কে সতর্ক করলেন।

রাত প্রায় বারোটা যজ্ঞ ক্রিয়া কর্ম শেষ। সনাতন এবার ফিরবেন। ও বাড়ির সবাই এক বাক্যে রাত শেষ হলে যেতে বললেও,সনাতনের চ্যালেঞ্জ কী ক্ষতি করে পেত্নি আমি দেখব, মনে মনে ভেবে প্রস্তুত হলেন।

তার দান সামগ্রী ও সঙ্গের বলির পাঁঠার পাঁজরের পর থেকে পিছনের একটি আস্ত ঠ্যাং ভালোমত পরিস্কার করে তালপাতায় প্যাক করে ঝোলানোর ব্যবস্থা করে দিল।সেযুগে পলিথিন কেন ব্যাগ ব্যবহারও এই সব ক্ষেত্রে হত না।

মালপত্র একটু বেশী হওয়ায় দুজন খড়ি নদী অবধি বহন করে নিয়ে এল।কোন সমস্যা হল না।তবে জলে নেমে দক্ষিণ পাড়ে যেতে সনাতন বাকী দুজনকে আর কষ্ট দিলেন না।দুবার করে নিজেই সব মালপত্র মাথায় তুলে পারাপার করলেন।সে দুজন চলে গেল। ভিজে গামছা ছেড়ে সনাতন পোষাক পাল্টালেন ।

সনাতনের একার পক্ষে এত মালপত্র একটু ভারী লাগছিল ,কী করবেন! টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হতে রাস্তা পিচ্ছিল হচ্ছে, এঁটেল মাটির পথ।ছাতা খুলে বাঁ হাতে ধরলেন, ডান হাতে পূজার ফলমুল কাপড়,শাড়ি গামছায় বাঁধা ছিল।নারায়ণ শিলা পুঁথি ডান কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো ওটা হাল্কা ।সমস্যা পাঁঠার পিছনের সমগ্র পা বা ফরা, অন্তত দু আড়াই কেজি, বাঁ কাঁধে ঝুলিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দিলেন একটু ভার কম লাগছে।

নদীর গাবা থেকে উঠে আল পথে পা টিপে টিপে হাঁটছিলেন। আকাশের একপ্রান্ত মেঘমুক্ত, এক ফালি চাঁদের হালকা আলো এসে পরছে ,কোনমত অস্পষ্ট পথ ধরে হাঁটছিলেন।

মাঠ ক্ষেত এখনও জলে ভরে নেই ,আকাশে বিছিন্ন ভাসমান খন্ড হালকা মেঘ থেকেই আচমকা টিপটিপ বৃষ্টি নামাতেই সমস্যা হল।এই ভাবেই এরোর পুকুরের পাড় তিনি এসে গেলেন।

পুকুরের পশ্চিমপাড় বরাবর সুরু চলার মত পথ ,আর তারপর দুটো জমির আল পথ, তারপরই মাঠাল রাস্তা এক মাইলের মত, এরপরই গ্রাম। কিন্ত এ কী!এরোর মস্ত বড় মেঠো পুকুর ,পশ্চিম পাড়ে কিছু তাল গাছ, মস্ত এক অশ্বথ আর পাকুর গাছ।পশ্চিম পাড় বরাবর এই একই সুদীর্ঘ সুরুপথে না হলেও তিনি বার চারেক অতিক্রম করেছেন! হাঁটার সময় মনে হচ্ছিল কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে । পা টিপে টিপে আসার শব্দও হচ্ছিল ! সনাতন প্রথমে পাত্তাই দেয়নি । ফাঁকা নির্জন নিঃশব্দ মাঠে হয়ত তারই চলার প্রতিধ্বনি হবে। কিন্ত তাই বলে একই পথে কেন বার বার এই ভ্রম ! বেশ অনুভব করছেন কোন অশরীরীর অবস্থান।রাত বিরেতে মেঠো রাস্তার পথে এমন তো অনেক অনুভুব করেন, এমন সমস্যা তো মেঠো ভুত কেউ করে না!

সনাতন মনেমনে ভাবলেন,আলো আধাঁরে এ বেশ তো গোলকধাঁধায় পরেছি! হালকা বাদুলে ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। অশ্বথ গাছের পাতায় পত পত করে নির্জনতা ভেঙ্গে বেশ জোরে শব্দ হচ্ছিল। একটা রাত পাখী মনে হয় হুতোম পেঁচা দুর থেকে আলো আধাঁরে উড়ে এসে ঝটপট শব্দে পাকুর গাছে ঘন ঝোপে ভরা কোন ডালে বসল।যেন এক ভুতুরে অলৌকিক পরিবেশ।সনাতন খুব সাহসী মানুষ, এখনও গায়ে যুবকের বল।আজ কিন্তু কেমন মনে হচ্ছিল।একটু ভয় ভয়ও করছে,গায়ে ঘাম ঝরছে।বৃষ্টিটা যেন থমকে আছে। আবার জোরে নামবে না তো !এই ভাবেই বা কতবার একই পথে চক্র দেবো!

ক্লান্ত আর হতাশায় পাকুর গাছ তলায় বসে ভাবলেন অনেক তো সময় গেল, আর একটু বসে বাকী রাতটা এখানেই কাটিয়ে দি ,সকাল হলে না হয় হাঁটা দেবো ।

হঠাৎই খণা গলায়, খূব কাছ থেকেই কে যেন বলল "যতই মন্ত্র পড় , এটা আমার এলাকা ,তোমাকে ভোড় পর্যন্ত ঘুড়িয়ে মারব! "

সনাতন বলে "তুই কে? "

উত্তর এল "আমি মাম্দো!"

সনাতন হেসে বলে "মেঠো ভুত! কিন্ত আগের কী নাম ছিল!কোথাকার মানুষ ছিলি হতভাগা! "

এবার উত্তর এল "তোমার গ্রামের আমি তিনু ঘোষ! এই পাকুর গাছে গত মাঘে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছি।

সনাতনের মনে পরে গেল। "বেশ তো, তা আমার পিছনে কেন! তোর কি সর্বনাশ করেছি শুনি?"

উত্তর এল "না ঠাকুর মশাই সর্বনাশ কেন করবে! তুমি তো মানুষ ভালো, কিন্ত কতদিন মাংস খেতে পাইনি।তোমার সঙ্গে অনেক মাংস ,কচি পাঁঠার, আহা লোভ হবে না!একটু দাও না, আমি ছেড়ে দেবো। "

সনাতন বলল" আরে বোকা সেটা বলবি তো!" বাঁ কাঁধের ভার কমিয়ে পাঁঠার পিছনের সমগ্র পা পাকুর গাছ তলায় ছুড়ে দিলেন।

একটা আনন্দ হৈহুল্লোর শুনতে পেলেন, সাঙ্গপাঙ্গরা হয়ত জুটেছে। তিনু খুশী হয়ে বলল" ঠাকুর মশাই চলে যাও ।"

সনাতনের গিন্নি উৎকন্ঠায় ঘুম আসছিল না,এত রাত তো হবার কথা নয়।রাত প্রায় সাড়ে তিনটে বা চারটে সনাতন বাড়ি ফিরলেন।

গিন্নি জিজ্ঞেস করলেন "এত দেরী হল যে? "

সনাতন বললেন "আর বলো না মামদো ভুতের পাল্লায় পড়েছিলাম।"গিন্নি বললেন "সে কী গো! কী ভয়ঙ্কর কান্ড!"

সনাতন বললেন "পরে সব বলব, আগে পুকুরে ডুব দিয়ে শুদ্ধ হয়ে আসি।"

ইতিমধ্যেই আষাঢ়ে পুবের আকাশে হালকা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছিল।

(গল্পটি চারের দশকের একটা আংশিক সত্য কাহিনী আমার বাবার মুখে শোনা।)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror