মৎস্যকন্যা
মৎস্যকন্যা


বোল্ডারের উপর থেকে যে লোকটা মাঝেমধ্যেই নজরে এসে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলো , খানিক সময় ধরেই তাকে নিয়ে বেশ সন্দেহ হচ্ছিলো । বালু চরাচর জুড়ে লোকের হুলস্থুল কাণ্ড । উপরে একদম বাঁধানো জায়গায় বসেছিলাম আমি ও আমার মা বাবা । অত দূর থেকে কোনো নির্দিষ্ট লোকের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করা যায় না । প্রশ্ন হলো আমার গেলো কী করে ? গল্পটা শুরু থেকে ... এই দাঁড়ান দাঁড়ান পিছনে কীসের হৈচৈ !
উঠে কোলাহলের উৎসস্থল লক্ষ্য করে যেতেই চোখে পড়লো ঘটনাটা । একটা অদ্ভুত প্রাণী উঠেছে সমুদ্র থেকে । বলেই ছিলাম লোকে গিজগিজ করছে সমুদ্রের কাছ থেকে উপর অবধি । অতএব সমুদ্রের নিকটবর্তী কোনো কোলাহলের শব্দ এলেও তার কারণ অনুধাবন না করাটাই স্বাভাবিক । তাই প্রাণীটাকে যখন এক্কেবারে উপরে তুলে আনা হলো তখনকার কোলাহলের শব্দটা আলাদাভাবে জোরে কানে এলো ।
একটা প্রাণী যার মাথা পুরো মানুষের মতো শরীরের উদরের কাছ থেকে পুরোটাই মাছের মতো । মুখটি একটি সুশ্রী কোমলশ্রী নারীর । আমি বুঝলুম প্রাণীটি বেঁচে । নুলিয়া গোছের লোকেরা লোকেদের সরিয়ে এগোতে যাচ্ছে কিন্তু লোকেদের উৎসাহের চোটে তা আর সম্ভব হচ্ছে না ।
এমন সময় হঠাৎ করেই সেই লোকটা এসে লোকেদের " সরুন সরুন " বলে রাস্তা খালি করে দিলো । ভদ্রলোক বুঝেছিলেন আমি পিছনে আছি তাই নুলিয়াদের যাওয়ার জায়গা করে আমার দিকে ফিরলেন ।
" আপনি , ঠিক আমার পিছনে পিছনে ঘুরছেন কেন বলুন তো ! " ভদ্রলোক বললেন ।
" পিছনে পিছনে ঘুরে কাউকে অনুসরণ করার কোনো উদ্দেশ্য নেই । আপনি এমনই অদ্ভুত চালচলন দেখাচ্ছেন যে ১৫ই আগষ্টের দীঘার জনসমুদ্রেও আপনার দিক থেকে নজর সরছে না । " বললাম আমি ।
এবার সুর পাল্টে ভদ্রলোক বললেন , " বাসেতে আমার অদ্ভুত ব্যবহার আর তারপরে যা যা হচ্ছে তা সকলেরই ভাবনার কারণ । "
আমি বললাম , " তা তো বটেই । "
উনি বললেন , " আপনি কথাটা পাঁচকান না করলে আমি আপনাকে বলতে পারি । "
আমি বললাম , " গোপনীয়তা সম্পর্কে আমাদের পুরোপুরি সহযোগিতা আপনি পাবেন । "
উনি বললেন , " চলুন তবে । কাকু , কাকিমা আসুন ওই চায়ের দোকানটায় বসা যাক । হাতে সময় আছে তো ? "
আমি বললাম , " সময় অবশ্য বেশ অল্প । আজ সন্ধ্যের ট্রেনেই ফিরছি । তবে ১ ঘন্টার মতো সময় হবে । "
উনি বললেন , " ১ ঘন্টা লাগবে না । আধা ঘন্টা হলেই হবে ।
আমি সামুদ্রিক প্রাণী নিয়ে রিসার্চ করছি । বাসে আমি অত গরমেও চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আড়ালে একটি বিশেষ বিষয়ে কিছু আর্টিকল পড়ছিলাম । আর তার সাথে কিছু জরুরী স্কেচ করছিলাম । বালিসাহির কাছে হঠাৎ বাসে বিরাট একটা ঝাঁকুনি অনুভব হয়েছিলো সেটা বোধ করি আপনার মনে আছে । ওই সময় একটা ভীষণ জরুরী স্কেচ করছিলাম । থিওরির বর্ণনা অনুসারে আঁকছিলাম , ঝাঁকুনি ছবি খারাপ না করে যাতে তাই হুঠ করে আমায় দেখবেন বাসের দেওয়ালে কিছু করতে । ওই মুহূর্তের জন্য আমি দেওয়ালে ছবির যে পার্টে ছিলাম সেটার একটা পয়েন্ট লিখছিলাম । হুম এতে পাগলামি ছিলো খানিক কিন্তু প্রাণীবিদদের বোধহয় খানিক এরকমই হতে হয় । যা হোক , এবার আসল কথা বলি । ওই যাদের দেখলেন এক প্রাণীকে নিয়ে যেতে ওরা আসলে আমার লোক । এক দুইজন নুলিয়ার ছেলেরা । বেশ কয়েকদিন ধরেই আমার কাছে একটা খবর আসছিলো দীঘার সমুদ্রে মৎস্যকন্যা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে । ওই মৎস্যকন্যা নাকি পরপর দুই সপ্তাহে দুই নৌকা ধরে ডুবিয়ে দিয়েছে । যদিও আরও অনেক নৌকাই দেখেছে ওই মৎস্যকন্যাকে তাদের আশেপাশে কিন্তু শোনা যাচ্ছে ওই নৌকার যাত্রীদের মৎস্যকন্যা কোনো ক্ষতি করেনি । এই বিষয়েই কিছু জার্নাল আর স্কেচ নিয়ে ঘাঁটছিলাম । আর এখানে এসে অবধি আমার লোকেদের আর নুলিয়াদের সাহায্যে ওই প্রাণীটিকে তোলার কাণ্ড তদারক করছিলাম তাই হয়তো আমায় বারেবারে এদিক ওদিক ঘুরতে দেখবেন । আচ্ছা একটু ওদিকে যেতে হবে আমায় । দাদা চায়ের দামটা নেবেন । "
লোকটিকে কোনো অতিরিক্ত প্রশ্ন করার অবকাশ পেলাম না । কিন্তু ওইদিকে যেতে তো কোনো বাধা নেই । অন্ততঃ কিছুক্ষণ কর্মকাণ্ড দেখা যেতেই পারে ।
রূপকথায় যে মৎস্যকন্যার কথা শুনেছি তা যে আদৌ বাস্তবে বিরাজ করে তা আজকে এই ঘটনা ঘটলে আমি কেন আরও অনেকেই জানতে পারতো না । একবার ওই মৎস্যকন্যাকে যেদিকে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিকে গেলাম । ওখানেও প্রচুর ভীড় । সামনে সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কিছু বলছেন ।
এসব দেখে আমরা হোটেলের দিকে এগোচ্ছি ওই ভদ্রলোক পিছন থেকে আবার ডাকলেন , নাম ধরে নয় তবে এতটাই কানের পাশ থেকে যে বোঝা যায় আমাকেই বলছেন , " আমার কার্ডটা রাখুন । "
নিলাম আর ফিরে এলাম হোটেলে । স্নান সেরে খাবার খেতে নীচে এলাম । হোটেলেরই এক লোকের সাথে কথা বললাম বিষয়টা নিয়ে । দেখলাম বিষয়টা নিয়ে সেও উৎসাহী ।
তবে এত সবের মধ্যে তার মুখে কিছু টুকরো কথা শুনলাম । আমি বললাম , " এখানে আগামী কিছুদিন বোধহয় আমলোকও ওই নিয়েই মেতে থাকবে । "
লোকটি বললো , " হবে না কেন ? ওই প্রাণীটা অর্থাৎ মৎস্যকন্যার মুখটা দেখেছেন ? "
আমি বললাম , " হ্যাঁ , খুব সুন্দর মুখশ্রীর নারীমুখ । "
লোকটি বললো , " হুমম আর লোকজন ওকে চিনতে পেরেছে । গতবছর নভেম্বরের পর থেকে ওকে আর পাওয়া যায় না । এখানকারই মেয়ে । "
আমি বললাম , " মানে ? এসব কী কথা বলছো ? "
লোকটা বললো , " হুম ঠিকই বলছি । শুনেছি সমুদ্রের পাড়ে কোনো একরাতে ও ঘুরতে যায় । মাছ ধরতে বেরোনোর আগে কয়েকজনের কুনজরে ও পড়ে যায় । শারীরিক অত্যাচার করে শুনেছি ওকে নৌকো থেকে মাঝসমুদ্রে ফেলে দেয় । কিন্তু কারোর প্রতি প্রমাণ নেই বলে গ্রেফতার কেউ হয়নি । "
আমি বললাম , " আচ্ছা গত দুই সপ্তাহে দুটো বড় নৌকা ডুবে গেছে শুনলাম ? "
লোকটা বললো , " হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন । কিন্তু আশ্চর্য কথা কি জানেন ওই নৌকাগুলো থেকে তিনজন ছাড়া বাকিরা কিন্তু অন্ততঃ ১০ জন হবে তারা কীভাবে অন্য আরেক নৌকার খোঁজ পেয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে নিয়েছিলো আর বাকিদের লাশ হাজার খুঁজেও মেলেনি । "
এর মধ্যে খাবার চলে এলো । তাই যথারীতি কথায় ছেদ পড়লো । খাওয়া শেষ করে হোটেলের মালিকের সাথে কিছুক্ষণ একই বিষয়ে কথা হলো । কথায় কথায় দীঘা মেরিন পার্ক , রাজ্য সরকার চালিত , সেখানকার প্রধানের মিসিং হবার খবর শুনলাম । উনিও নাকি নভেম্বরের সেই রাত্রি থেকেই নিখোঁজ । অবাক হলাম এই শুনে যে ভদ্রলোকের নাম হলো নিকুঞ্জ গুপ্ত ।
আমি উপরের ঘরে এসে কার্ডটা দেখে রীতিমতো চমকে উঠলাম । নিকুঞ্জ গুপ্তের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো ! ও ভগবান ! ভদ্রলোককে ফোন করে আরেকবার দেখা করার সুযোগ ছিলো না , কারণ সময় ছিলো নিতান্তই কম ।
আধঘন্টা মতো রেস্ট নিয়ে হোটেলের ফর্ম্যালিটি মিটিয়ে দীঘার ঝটিকা সফর শেষ করে স্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম । বাইরে থেকে কাজু দর করলাম কিন্তু দেখে মনে হলো না সেরকম । কাজুর নাড়ু আর কাজুর চাক কিনে স্টেশনে ঢুকলাম । স্টেশন ঝকঝক করছে । স্টেশনটাকে আলাদা করে বোঝার উপায় নেই যে ওটা স্টেশন । যেন কোনো ফাইভস্টার হোটেল প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগে মনে হলো । প্ল্যাটফর্মটাও কি অপূর্ব করে সাজানো ... আচ্ছা ওইটা কী ?
১ নং প্ল্যাটফর্মে একটা লোক পড়ে আর তার চারপাশে আরও লোক জমায়েত হয়েছে । আমি ভীড় ঠেলে সামনে এসে দেখি সেই ভদ্রলোক মানে নিকুঞ্জ গুপ্ত । পাশের লোকজন দেখলাম বেশ উত্তেজিত ।
ওদিকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে লোকটির দেহ । বুকের কাছে একটা কাচের টুকরো গাঁথা , লোকটা দম নেওয়ার জন্য হাঁ করে আছেন । হাত পাঁচেক দূরে যে জিনিসটা দেখলাম সেটা আমি দেখেইছি আগেই কিন্তু সেই মৎস্যকন্যা যাকে আমি আগেই দেখেছি সেই প্রাণী প্ল্যাটফর্মের পাশ দিয়ে সরে সরে স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছে । আমার মুখ দিয়ে আপসেই বেরিয়ে এলো , " ও কী ? "
পাশের উত্তেজিত জনতার একজন বলে , " ও আমাদের চামেলী । এই শয়তান ব্যাটা প্রকাশ সাধুই ছিলো ওর শেষ টার্গেট । "
আমি থামিয়ে বললাম , " কী বলছেন ইনি তো নিকুঞ্জ গুপ্ত , আমায় ওনার কার্ড দিয়েছেন ! এই দেখুন । "
আমায় ওই পাশের লোকটি কিছু বলতে যাবে তো মৃত্যুপথযাত্রী সেই লোকটি আমায় হাত নেড়ে কাছে ডেকে বললো , " ওনা ... রা আঃ ঠিক ... আমি প্রকাশ সা ...ধু , নিকুঞ্জবাবুকে আমি খুন করি । আ... আমি টাকা... ওই নুলিয়াদের ... চামেলীকে অত্যাচা ... র । "
খাপছাড়া কথা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি । লোকটির নিঃশ্বাস ত্যাগের পর বাকিদের থেকে পুরোটা শুনি । প্রকাশ নাকি সামুদ্রিক প্রাণী কালোবাজারি করে । তাকে বাধা দেন নিকুঞ্জ বাবু । তাই সুযোগ বুঝে নিকুঞ্জবাবুকে খুন করে তাঁরই মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় প্রকাশের লোক ।
ট্রেন আসতে তখনও কিছু দেরী থাকায় খানিক বাইরে এলাম , দেখলাম এলাকার লোকেরা মৎস্যকন্যাকে যত্নসহকারে গাড়ীতে তুলে সমুদ্রে নিজ জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে । ইতিমধ্যে পুলিশ লাশ নিতে এসে গেছে । এখন চোখ পড়লো মৃতদেহের মাথার কাছে রাখা বড় ভাঙ্গা কাঁচের জায়গাটা ।
ট্রেনের নাম ততক্ষণে অ্যানাউন্স হয়ে গেছে ।ট্রেন আসতে কামড়া বেছে বসলাম । এসি কামড়ায় গিয়ার টেনে সিটটা পিছনে নিয়ে একবার কার্ডটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে নীচে এক কোণায় চোখে পড়লো ১৬১৯ নম্বর । কিছুক্ষণ পর তার তাৎপর্য বুঝলাম , পি এর স্থান ১৬ নম্বরে ও এসের স্থান ১৯ এ । অর্থাৎ ... বড়ো মাপের ক্রিমিনালরা এইভাবেই বোধহয় হিন্ট দেয় ।