ল্যান্ডফোনের ইতিকথা
ল্যান্ডফোনের ইতিকথা
বাড়িতে তখন ফোনের একটাই রিসিভার। বাইরের দিকের ঘরে টেবিলের উপরে রাখা থাকতো। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাম্বার ডায়াল করতে হতো। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধব সবার সঙ্গে যোগাযোগের ওই ছিল একমাত্র অনুঘটক। বেশ লাল টুকটুকে রঙ, দোহারা ভারি চেহারা, মাথায় জড়ানো থাকতো অনেকটা লম্বা তারের বেণী। ওর নাম ছিল ল্যান্ডফোন।
মাঝে মাঝে ওর মাথা বিগড়ে যেত। অফিস থেকে লোক এসে বাগিয়ে দিয়ে যেত। সময় লাগতো বটে তবে সকলেই সেই সময়টুকু অপেক্ষা করার ধৈর্য রাখতো। জরুরি প্রয়োজনে পাশের বাড়িতে ফোন করতে যেতে হতো এবং পাশাপাশি বাড়ির কেউ এতে বিরক্ত হত না। কেননা তারা জানত কোনদিন হয়তো তাকেও যেতে হবে অন্যের বাড়িতে ফোন করতে।
ঝড় জল হলে ও সবার সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে দিত। শরীর গন্ডগোল হলে কর্কশ গলায় কথা বলতো। পোস্ট অফিসে ওর মাস মাইনে দিয়ে এলেও বিএসএনএল কর্তারা মাঝে মাঝে এই বিল দেখাতে ডেকে পাঠাতেন। নিজের অফিসে ছুটি নিয়ে সেই কাজে ছুটে যেতে হতো। তাই ওকে নিয়ে ঝামেলার অন্ত ছিল না। কিন্তু তারপরেও ওর প্রতি বাড়ির সকলের অদ্ভূত ভালোবাসা ছিল। সবচেয়ে বড় কথা ওর ওপর বাড়ির সকলের সমান অধিকার ছিল। ও কারো নিজস্ব ছিল না।
মাঝে কয়েকবার ওর রূপের পরিবর্তন ঘটলো। ওর শরীর হলো হালকা,রঙ হলো সাদা। প্রতিটি নম্বর ডায়াল করার জন্য একটি করে বোতাম ওর গায়ে বসানো হল। রিডায়ালের একটা বোতাম ছিল ওখানে। তার কিছুদিনের মধ্যেই ঘরে এল ওর সহযোগী যাতে একইসঙ্গে বেশ দুজন কথা বলতে ও শুনতে পারে। ওর কাছে না গিয়েও অন্য ঘর থেকে ওর মাধ্যমে কথা বলা ও শোনা যেতে পারে।
অধিকাংশ লোকের ঘরেই তখন এই ল্যান্ডফোন ছিল না। তারা প্রয়োজনে রাস্তার মোড়ে টেলিফোন বুথে টাকা দিয়ে ফোন করে আসতো। সেই যুগে ফোনের বুথের ব্যবসা একটা লাভজনক ব্যবসা ছিল। কত মানুষের রুজি রোজগার ছিল এই ফোন বুথ।
ধীরে ধীরে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কান্ড ফুলেফেঁপে উঠতে থাকলো। এসে গেল যোগাযোগের নতুন মাধ্যম মুঠোফোন। বাড়িতে সকল সদস্যের নিজস্ব একটা করে মুঠোফোন হল। পুরনো সেই রিসিভারগুলো ধুলোর আস্তরণে ঢাকা হেমন্তের ঝরাপাতার মতো বড়ির এক কোণে অযত্নে পড়ে থাকলো। এ যেন কর্ম ক্ষমতাহীন বৃদ্ধ পিতা-মাতার বৃদ্ধাশ্রমে পুনর্বাসন। এখনো যখন ওদের দেখি এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় ভরে ওঠে মন।