Dola Bhattacharyya

Tragedy Crime Others

3  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Crime Others

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু

5 mins
1.1K



এমন একটা দিন যে আসতে পারে, তা অনেক আগেই আন্দাজ করেছিল অধীরা । বারবার বলেছে রাঘব কে, "এমন সর্বনাশা খেলায় মেতো না গো"। অধীরার কথা কানেই নেয় নি রাঘব। দাঁত বার করে বলেছে, "এ খেলায় জিতলে কত টাকা পাব জানিস! খালি ফরফর করছে। ঘটে বুদ্ধি থাকলে তবে তো বুঝবি"। 


ঘটনার সুত্রপাত বেশ কয়েকবছর আগে। ধলা গাইটা সেবার এঁড়ে বাছুর বিয়োলো। তখন বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছিল অধীরা , " এ আবার কোন কাজে লাগবে"! রাঘব বলেছিল, "আরে, লাগবে রে, লাগবে। কাজে লাগবে। একটু বড় হোক। ভালো করে যত্নআত্তি কর। তারপর দেখবি কত কাজে লাগে। আরে, এখানে কারো এরকম ষাঁড় আছে নাকি। গরুগুলোর ডাক উঠলে পাল খাওয়ানোর জন্য কত দূরে দূরে নিয়ে যায় সব দেখিসনি! এরপর সব আমার কাছে আসবে। আমি বাবা বিনা পয়সায় কিছু করতে পারব না। আমার কাছে ফেলো কড়ি মাখো তেল, ব্যস।"

দেখতে দেখতে বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে ভবেশ । প্রচুর খেতে পারে। অনেক সময় গরুগুলোর খাবারেও ভাগ বাসায়। ভবেশকে চাষের কাজে লাগায় না রাঘব। গরুদুটোর বেশ বয়স হয়েছে। মাঠে হাল দিতে বেশ কষ্ট হয় ওদের। রাঘবকে বললে বলে," আর কটা দিন দ্যাখ না। এবার ট্রাক্টর কিনব আমি "। কিন্তু কি করে কিনবে সেটা আর বলে না। চিন্তা করে অধীরা । ভবেশ কে নিজে হাতে খেতে দেয়, যত্ন করে রাঘব। শিংদুটো ঘসে মেজে ধারালো ঝকঝকে করে তোলে। শেষপর্যন্ত একদিন বলেই ফেলল, "ভবেশ কে আমি ষাঁড়ের লড়াই তে নামাবো। প্রতিযোগিতায় ওর নাম এন্ট্রি করানো হয়ে গিয়েছে।" চমকে ওঠে অধীরা , "না, না গো, এ বড় সর্বনেশে খেলা। প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে। নাম তুলে নাও"। 


"মেয়েছেলের বুদ্ধি তো। খালি নাকিকান্না। আরে দ্যাখ না কি হয়। আমার ভবেশ  জিতলে কত টাকা পাবে জানিস! বোকা কোথাকার "। 


খেলার আগের দিন, ভবেশের সারা গায়ে লাল রং করে দিল রাঘব। আর সিং দুটোতে কুচকুচে কালো রং। ব্যাপার দেখে শিউরে উঠল অধীরা।" যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না।" অধীরার কথায় প্রচন্ড রেগে যায় রাঘব।চোখ লাল করে বলে " এভাবে কু ডাক ডাকলে ঘাড় ধরে বাড়ির বাইরে বার করে দেব "। মনে মনে মাতা অম্বা কে স্মরণ করে অধীরা, "আমার সিঁথির সিঁদুর রক্ষা কোরো মাগো। আর ওই অবলা প্রাণীটাকেও রক্ষা কোরো। দুপুরে সেদিন রাঘব নিজে হাতে খাওয়ায় ভবেশ কে, ও যা যা খেতে ভালবাসে সব। 


পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে ভবেশের পিঠে চড়ে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হয় রাঘব। ভবেশ আজ বড়ই অশান্ত। কাল রাত থেকে ওকে আর খেতে দেওয়া হয়নি। তার ওপর নিজের গায়ের ওই লাল রং তীব্র অস্বস্তিতে ফেলেছে ওকে। 


    শুরু হয়ে গিয়েছে ষাঁড়ের লড়াই। লড়াই এর ময়দানের খুব কাছেই রাঘবের বাড়ি। ঘর থেকেই শোনা যাচ্ছে উল্লসিত জনতার পাশবিক চিৎকার। সাথে ষাঁড় গুলোর ভয়ংকর ডাক। মনে মনে ভাবে অধীরা, এ খেলা কি বন্ধ হতে পারে না! কতগুলো নিরীহ পশু মারা পড়ছে এতে। মানুষ ও মারা যায়। কি লাভ এই মৃত্যুর খেলা খেলে! এই মুহুর্তে অধীরার কাজ নেই কোনো। সকালেই রান্না হয়ে গিয়েছে, রাঘব খেয়ে বেরোবে বলে। অধীরার আজ আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। রাঘব আগে ফিরুক, তারপর দেখা যাবে। 


  এবার ভবেশের পালা। নাম ডাকা হতে ভবেশের পিঠে চড়ে রাঘব এগিয়ে যায় যুদ্ধের জায়গায়।ভবেশের প্রতিপক্ষ সাদা রঙের ষাঁড় টা খুবই শক্তিশালী। খুব সহজেই তাকে হারিয়ে ভবেশ এখন প্রচন্ড উত্তেজিত। সাদা ষাঁড়ের ঘাড় ভেঙে দিয়েছে ভবেশ। মহা উল্লাশে দ্বিতীয় প্রতিপক্ষের দিকে এগিয়ে যায় এবার। 


পরপর চারটে প্রবল প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করে ভবেশ এখন ক্লান্ত। তবুও আর একজন এগিয়ে আসে ওর দিকে। রাঘবও বাধা দেয় না। লোভে পড়ে গেছে সে। আবার শুরু হল লড়াই। এবারে হেরে যাচ্ছে ভবেশ। হেরে যাচ্ছে এবার ও। সহ্য হয় না রাঘবের। সমানে উত্তেজিত করতে থাকে ওকে। তুমুল উত্তেজনায় ঘুরে দাঁড়ায় ভবেশ। নতুন করে আঘাত হানে প্রতিপক্ষের ওপর। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে দেয় তাকে। হেরে যাচ্ছে এবার ছাই রঙের ষাঁড় টা। ওর মালিক এবার সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ওকে।রাঘবও চেষ্টা করছে ভবেশ কে শান্ত করতে। কিন্তু ভবেশের মাথায় যেন খুন চেপেছে আজ । এক ঝটকায় পিঠ থেকে ফেলে দেয় রাঘব কে। আঘাতের পর আঘাত নেমে আসে রাঘবের ওপর। একসময়ে রাঘব কে ছেড়ে ছুটতে শুরু করে ভবেশ।রক্তের গন্ধ পাগল করে তুলেছে ওকে। আতংকিত জনতা ভয়ে দিশাহারা। 


    ও অধীরা, দ্যাখ দ্যাখ, ভবেশ জিতে ফিরেছে। ওকে বরণ করে তোল দেখি। 


অবাক হয়ে দেখছে অধীরা। রাঘব হাসছে। ভবেশের সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে। তবু দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ও। ঘুমটা ভেঙে যেতে বিছানার ওপর উঠে বসে অধীরা। এটা তাহলে স্বপ্ন ছিল! বুকটা কেঁপে ওঠে অধীরার। ছুটে বাইরে আসে ও। কিসের যেন হইচই শোনা যাচ্ছে! কারা যেন ছুটতে ছুটতে আসছে। ওর সামনে দিয়ে কিছু মানুষ দৌড়ে চলে গেল । আরো কিছু আসছে। কিছু যেন বলছে ওরা, "রাঘবকে মেরে ফেলেছে খুনে ষাঁড় টা"। চমকে ওঠে অধীরা। কি বলছে ওরা! ছুটে যায় মাঠেরমাঠের দিকে।


 তখনও এলোমেলো দৌড়ে বেড়াচ্ছে প্রাণীটা, দেখে ডাক দিল অধীরা, "ভ-বে-এ-এ-শ" ।ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায় প্রাণীটা। কি ভেবে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে অধীরার দিকে। শিং থেকে তখনও হতভাগ্য রাঘবের দেহাবশেষ ঝুলছে। কান্নায় ভেঙে পড়ে অধীরা, "মেরে ফেললি মানুষটাকে! কত ভালোবাসতো তোকে ও। আর তুই তাকে মেরে ফেললি! বেইমান!" বিলাপ করতে থাকে অধীরা। দেখতে পায় না, ভবেশের চোখ দিয়েও তখন টপ টপ করে জল ঝরে পড়ছে। কি বুঝেছে অবোধ প্রাণীটা কে জানে। অতিরিক্ত রক্তপাতে শরীর অবসণ্ণ ওর। একসময়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে ও অধীরার সামনে। চমকে ওঠে অধীরা, "ভবেশ "! শেষবারের মতো জলেভরা চোখদুটো তুলে অধীরার মুখের দিকে তাকায় ভবেশ। থরথর করে কেঁপে ওঠে সারা শরীর টা ওর। তারপর স্থির হয়ে যায় একেবারে। তখন মাইকে ঘোষণা হচ্ছে প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর নাম। ষাঁড় শান্ত হয়েছে দেখে লোকজন ফিরে আসছে এবার। অধীরা দেখছে, কারোও মনে কোনো রেখাপাত ঘটেনি।কারো তো কিছু নতুন করে হারায় নি। এরকম তো প্রতিবারই হয়। 

  বিজয়ীর পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠেছে অধীরা। ওর হাতে বিজয়ীর ট্রফি তুলে দেওয়া হল। তার সঙ্গে অনেকগুলো টাকা। ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, "তুমি কি কিছু বলতে চাও?" 

"হ্যাঁ সাহেব। কিছু বলতে চাই আমি। অনুমতি দিন আমাকে"। 

ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, "বেশ। বলো"। 

আর্ত কন্ঠে বলে ওঠে অধীরা, "আমি এই টাকা নিতে চাই না সাহেব। তার বদলে একটা আর্জি আছে আমার। বন্ধ হয়ে যাক এই খেলা। যে খেলায় রয়েছে রক্ত দর্শনের আনন্দ আর হারানোর বেদনা, বন্ধ হয়ে যাক সেই খেলা। আমি শুধু এই ট্রফিটাই নেব। আমার ভবেশের স্মৃতি টুকু থাক আমার কাছে। কান্নায় ভেঙে পড়ে অধীরা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy