ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব পঁয়ত্রিশ-
মিঃ আরণ্যক বসুরায় এখন অনেকটাই সুস্থ। ক্রাচ নিয়ে হাঁটা চলাও করতে পারছেন । কথাও আর তেমন জড়িয়ে যায় না ।
গোপালকৃষ্ণ বাবুর বাড়িতে সুন্দর মানিয়ে নিয়েছেন । কনকলতার মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর অসুস্থতা অস্থিরতার জন্য বেড়ে গিয়েছিল ।কনকলতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধাটুকুও জানাতে পারেননি এই আক্ষেপ তাঁর আমরণ মনে থাকবে।
আর একজনকে তিনি ভুলতে পারবেন না। ললন্তিকা সেন । অপরূপ মোহময়ী নারী যে তার রূপের আগুনে সর্বস্ব নিমেষে ছাই করে দিতে পারে । তাকে উপভোগ করার মত ভাগ্য কয়জনের থাকে ! তা'বলে নিজের পত্নীর প্রতি কোন অবিচার তিনি কখনও করেননি। লোকে হয়ত বলবে অনাচার ।সে তো তাঁর নিজের। এতে কনকলতার কোন দায় নেই।
মনে মনে পত্নীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন মিঃ আরণ্যক বসুরায় । বনলতা দেবীকেও যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছেন । বাড়িতে অনেক নতুন অতিথি এসেছেন। সকলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলেন । খুশির আতিশয্যে পার্টি দেবার আয়োজন করলেন । যাবতীয় খরচপাতি তাঁর।
সকলেই দিনটা দারুন এনজয় করলেন । হঠাৎ ফোন এল তাঁর ফোনে ।
- আরু বলছ ?
প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও বিশ বছর আগেকার সেই কন্ঠস্বর তিনি ভুলতে পারেননি ।
- আরে দেবেনদা ! তুমি ? বাহ্ বাহ্ বাহ্ ! কি আনন্দই না পেলাম । তা' এত বছর পরে আজ হঠাৎ মনে পড়ল ?
মিঃ দেবেন্দ্র ভৌমিক বললেন - এত বছর কোথায় হে ! এই তো কনক চলে যাবার পরও ফোন করেছি । তুমি কথা বলার মত অবস্থায় ছিলে না বলে গোপালদার সঙ্গে কথা বলেছি । তা' ভাই ! এখন কেমন আছো ?
- ফাইন ফাইন । তোমরা সবাই ভালো আছো তো ! আর থাকবে নাই বা কেন - দুই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার; ফরেনে সেটলড । এক মেয়ে - বিয়ে দিয়ে দিয়েছ। খুব খুশি হয়েছি । এখন তো পেনশন পাচ্ছ, তাই না ?
মিঃ ভৌমিক এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন - তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে । অবশ্য তুমি খুশি হবে নাকি দুঃখ পাবে বলতে পারব না । তা' ভাই যাই মনে কর ; শরীর ঠিক রাখবে ।
- কি সারপ্রাইজ দেবেনদা ? বল না শুনি। আমার এখন সব খবরই সমান। কনকই যখন নেই; তখন কোন কিছুই আমাকে টলাতে পারবে না । বল শুনি।
- তোমার আশেপাশে কেউ নেই তো ? এটা খুব গোপন খবর ।
- বল না । এখানে এখন কেউ নেই। সবাই খেয়েদেয়ে গল্পগুজব করছে ।
মিঃ ভৌমিক কোন রাখঢাট না করে সোজাসাপ্টা বলে দিলেন ললন্তিকা সেনকে পাওয়া গেছে।
আরণ্যক বসুরায় চুপ করে গেলেন ।
- এই রে ; সব জানাজানি হয়ে গেছে। তবু সাহস করে বললেন - কোথায় আছে সে ?
- আমার কাছে, আমাদের বাড়িতে।
- মানে ? তাহেরপুরে ? কি ভাবে গেল সে - ওর তো পাসপোর্ট ভিসা কিছুই নেই।
- বাংলাদেশে আসতে সবার পাশপোর্ট লাগে না ভাই। চোরাপথ বলে একটা কথা আছে না ।সেই চোরাপথে এসে চোরাগলিতে পড়েছে।
- ওকে পুলিশে দিও না দাদা । অনেক হিসাবনিকাশ চুকতা করতে হবে । ওকে কি কলকাতায় আনতে পারবে ? তা হলে খুব ভালো হয় ।
- সে আমি জানি ভাই। তাই এখনও পুলিশে দেইনি।
- আমি তো শুনলাম ওর নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে সরকার । এমনকি ইন্টারপোলকেও সব জানানো হয়েছে। দাদা , তুমি আর ছোড়দি দু'জনে মিলে ওকে নিয়ে এস প্লীজ । আমি কৃতজ্ঞ থাকব ।
- দাঁড়াও দাঁড়াও। এত উদ্বেল হয়ে ওঠো না। আগে ইতিবৃত্তান্ত শোন।
আরণ্যক রায় বনলতা দেবী আসছেন দেখে বললেন - দেবেনদা ! বড়দি আসছেন। ওনার সাথে কথা বলে নাও। আমি রাতে ফোন করব ।
বলে বনলতা দেবীকে ফোনটা ধরিয়ে বললেন - তাহেরপুর থেকে দেবেনদা ফোন করেছে ; কথা বলুন।
আরণ্যক বসুরায় গভীর চিন্তায় মগ্ন । ললন্তিকা নিশ্চয় এতদিনে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের কথাটা কবুল করে নিয়েছে ! ধূরন্ধর পুলিশ অফিসার ছিলেন মিঃ দেবেন্দ্র ভৌমিক। এক সময় ঢাকায় ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন। তারপর হয়তো রিটায়ার্ড করেছেন । উকিল ব্যারিস্টাররাও তাঁকে সমীহ করে চলত। আইনের খুঁটিনাটি সব তাঁর নখের ডগায় । এমন জেরা করতেন যেন নির্দোষ লোকও ভাবত উনি যা বলছেন সব সত্যি আর সে নিজে যা বলছে সবই ভুয়ো। তাঁর মত লোকের কাছে ললন্তিকা তো ছারপোকা।
বনলতা দেবী সবার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলেন মি: ভৌমিকের । এতে অন্তত আধঘন্টা সময় তো লেগেছেই। আর ওই আধঘন্টা তিনি কোথায় ছিলেন ভেবে উঠতে পারেননি মিঃ বসুরায় ।
রুদ্র এসে কখন তাঁর ফোন দিয়ে গেছে সে খেয়ালও করেন নি ।
- কি ভাবছেন মেসোমশাই এতক্ষণ ধরে ?
রুদ্র আরণ্যককে আনমনা থাকতে দেখে পুনরায় এসে বলল ।
ধ্যান ভঙ্গ হল আরণ্যকের । বললেন - কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেছলাম বাবা !
প্রকৃতই তাঁর কিছুই হয়নি । হবার কথাও নয় । ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন পুরোপুরি ফিট। এবার অঙ্গ সঞ্চালন ঠিক রেখে চললে আগের মত হয়ে যাবেন ।
রুদ্র চিন্তিত হয়ে বলল - ডাক্তার ডাকব ?
আরণ্যক বললেন - ধূর ক্ষ্যাপা ! এমনি মনে হয়েছিল । আমার কিছু হয়নি । দেবেনদা ফোন করেছিলেন তো । ওদেরকে মনে পড়ে গেল তাই পুরানো স্মৃতিগুলো ঝালাই করছিলাম ।
রুদ্র ' গুডনাইট' বলে চলে গেল ।
মিঃ ভৌমিক ললন্তিকাকে বললেন - এরপরও তুমি কিছু বলবে না ?
ললন্তিকা কথা বলে না । মিঃ ভৌমিক বললেন - তোমার কোন ভয় নেই। আমি তোমাকে পুলিশে দেব না। বরং চেষ্টা করব তোমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। আমি চাই না এখান থেকে পালাতে গিয়ে তুমি কোন দালালের খপ্পরে পড়ে যাও । তাহলে কোন পতিতালয়ে যাওয়া তোমার ভবিতব্য হবে । আমি তা চাই না । এখনও বল আরণ্যক বসুরায়ের সঙ্গে তোমার কতদিনের পরিচয়, আর সম্পর্ক কেমন !
ললন্তিকা সেন সুবোধ বালিকার মত গড়গড় করে সব বলে দিল - মানে- বলতে বাধ্য হল ।
কামালের সঙ্গে তোমার কিভাবে পরিচয় হয়েছে ?
- আমার বিয়ের পার্টিতে ।
- বিয়ে ? তুমি বিবাহিত ? কে তোমার স্বামী ?
- অরবিন্দ সরখেল ।
- তাহলে পদবীতে সেন লাগিয়ে রেখেছ কেন ?
- আসলে অরবিন্দ আমার মামাতো দাদা । বাড়িতে আসা যাওয়া ছিল। দু'জনে দু'জনের প্রতি আকৃষ্ট হই। প্রেম হয় । দু'তিনবার এবরশন করিয়েছি। কারণ তখনও আমাদের বিয়ে হয়নি । শোকে দুঃখে বাবা মা দুজনেই আত্মঘাতী হন । পরে অবশ্য অরবিন্দ এমনি সিঁদুর পরিয়ে দেয় ।
- অরবিন্দকে তো আমার আরও সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওই আসল কালপ্রিট । আরণ্যককে মারতে চাও কেন ?
- লেখা ছাপানোর নামে আমাকে ঠকিয়ে ওর রক্ষিতা করে রেখেছে বলে।
- তার মানে আরণ্যকের সঙ্গে এখনও তোমার এই সম্পর্ক রয়েছে?
ললন্তিকা কথা বলে না । রজনী দেবী বলেন - ছি: ছি: মা , কি ঘেন্না !
মিঃ ভৌমিক বলেন - এই আপা নামের পিছু কি কামালের সাথেও তোমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ?
ললন্তিকা বুঝতে পারে না ইঙ্গিত । চুপ করে থাকলে মিঃ ভৌমিক ধরে নিলেন কামালও এর প্রেমিক।
বললেন - কামাল কি কোন প্রস্তাব দিয়েছে ? এই যেমন ধর এখানে নিয়ে এসে তোমাকে বিয়ে করবে বা ঐ জাতীয় কিছু?
ললন্তিকা বলে - অরবিন্দ পুলিশে ধরা পড়ার পর স্বাভাবিকভাবেই আমার নাম আসে । আমি বিচলিত হয়ে কোন পথের সন্ধান না পেয়ে কামালের শরণাপন্ন হই। কামালের মনে কি ছিল জানি না; তবে ও রাজী হয়ে যায় এবং গোরু পাচারের সঙ্গে আমাকেও এপারে পাচার করে দেয় । তার কথামত এখন তো আমি এখানে।
- শেষ কবে কামালের সাথে তোমার কথা হয়েছে ?
- গতকাল রাতে । ও একটা নতুন নাম্বার থেকে ফোন করেছিল । নতুন নাম্বার দেখে প্রথমে কয়েকবার তুলিনি । একসময় উঠিয়েছি তো দেখি কামাল কথা বলছে।
- কি বলেছে কামাল ?
- ও বিশেষ কিছু বলেনি। আমিই ওকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বায়না করি । ও বলে এখানকার কাজ মিটলেই দু'চারদিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেবে । কিন্তু দশদিন পেরিয়ে গেলেও যখন সে এল না; আমি মুস্তাফাকে বিয়ে প্রলোভন দেখিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি ।
-শেষ প্রশ্ন - আরণ্যককে পেলে কি করবে ?
- বদলা নেব ।
ললন্তিকা ঘৃণার সঙ্গে বলে ।
( ক্রমশ )

