ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
অভয়ঙ্কর সরকার অরবিন্দকে চোখে চোখে রেখেছেন । ওর রুমে গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছেন । তা' সত্বেও অরবিন্দের ফোন তিনি সন্ধ্যে হলেই নিজের কাছে নিয়ে নেন ।
অরবিন্দ বুঝতে পারে না তিনি অযথা তাকে কেন সন্দেহ করেন । আবার জাহিদরা যে এসেছিল সে বিষয়েও নি:সন্দেহ হয়েছে তাদের নাম, চেহারার বিবরণ পেয়ে । এবার তারও সন্দেহ হল হয় ওরা তাকে কিম্বা অভয়ঙ্কর স্যারকে মেরে ফেলতেই এসেছিল ।
এদিকে জাহিদরা চারজন মিলে স্থির করল যে কোন উপায়ে অরবিন্দকে ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করতে হবে। কারণ রেঞ্জার সাহেবের নামটি অভয়ঙ্কর হলেও তিনি যে কত ভয়ঙ্কর তা তাঁর কর্মস্থলে ওরা দেখেছে। পারলে ওকেও মেরে ফেলতে হবে ।
জাহিদ দুপুর বেলা ফোন করল অরবিন্দকে । এই দুপুর বেলায় খাওয়া দাওয়ার পর সকলে যখন যে যার মত বিশ্রাম নিচ্ছে ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল অরবিন্দের ।
জাহিদ বলল - তুই কি রে ? দেখছিস আমরা এসে গেছি তবু কথা বলছিস না ।
অরবিন্দ ফোন তুলেছিল মাত্র : কোনরকম কথাবার্তা বলেনি ।
জাহিদ বলতে লাগল - শোন অরবিন্দ। আরণ্যক স্যার বেপাত্তা হবার পর আমাদের পেটে টান পড়েছে ভাই! অনেক মেহনত করে তোর কাছে এসেছি । এখানে এসে কাজে নেমে পড়েছি । দারুন রোজগার হচ্ছে , বুঝলি ! একটা লরি পাচার করতে পারলেই নগদ পঞ্চাশ হাজার হাতে পাচ্ছি । মাসে যদি দশটা পাচার করি তবে তো লাখপতি হতে সময় লাগবে না । কোথায় আরণ্যক স্যারের দয়ার দান আর কোথায় স্বাধীন ব্যবসা । বিনা পুঁজিতে এমন ব্যবসা করা যায় ; নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবি না । কিন্তু আমাদের তোর মত একজন বুদ্ধিমান মন্ত্রণাদাতা চাই বুঝলি! চলে আয় ওই জেলখানা থেকে। কি রে কিছু তো বল!
অরবিন্দ চুপই থাকল । পাশের ঘরেই স্যার আছেন। কথা বললেই শুনতে পান যদি !
জামির জাহিদেরহাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল - শোন অরবিন্দ! আজ রাতে আমরা আবার ট্রাই করব। তোকে আমিদের খুব দরকার । তুই শুধু আমাদের একটু সাহায্য করিস ।
অরবিন্দের কাছ থেকে কোন রিপ্লাই না পেয়ে জাহিরুল ফোনে বলল - আসবি তো ভালো; নইলে কিন্তু আজ রাতে বাড়িটাই উড়িয়ে দেব। তখন মরলে কিছু মনে করিস না ।
অরবিন্দের এবার শঙ্কা বাড়ল । এদের মত দুর্জন গর্জন করলে যে ক্ষুধার্ত সিংহের তর্জন শুরু হবে - সে তো কথার কথা নয় ।
অরবিন্দ খূব আস্তে করে বলল - ঠিক আছে।
জাহিরুল নেচে উঠল ।
- কথা বলেছে। কথা বলেছে অরবিন্দ।
জাহিদ বলল - কি কথা বলল ?
জাহিরুল বলল - বললে ঠিক আছেৎ। তার মানে আমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল হতে চলেছে।
সারা দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে ওরা আনন্দে মদ খেয়ে নাচানাচি করতে লাগল ।
অরবিন্দ দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। অভয়ঙ্করবাবুর দরজায় আস্তে টোকা দিল । চোখটা লেগে গেছিল রেঞ্জার সাহেবের । দরজা খুলে দেখেন অরবিন্দ দাঁড়িয়ে আছে ।
- কি হল প্রশান্ত ?
- স্যার আমাকে নিয়ে গোপনে একবারটি থানায় চলুন ।
বিস্মিত হলেন অভয়ঙ্করবাবু। বললেন - হঠাৎ এ কথা বলছ কেন ? এখানে তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে নাকি ?
- অসুবিধার কথা নয় স্যার । ভয়ঙ্কর বিপদ আসতে চলেছে আর আজ রাতের মধ্যেই ।
- কি বিপদ বল তো ?
অরবিন্দ সব ঘটনা অভয়ঙ্করবাবুকে বলে দিল ।
- স্যার ওই চারটাকে পুলিশ ছাড়া কেউ জব্দ করতে পারবে না । তাই বলছি, থানায় চলুন স্যার, পুলিশকে গিয়ে সব কথা জানাই ।
অভয়ঙ্করবাবু অরবিন্দের কথামত গাড়ি নিয়ে বের হলেন থানার দিকে । কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল তাঁর। অহেতুক সন্দেহ করছিলেন অরবিন্দকে ।
বাবুলাল ঘনশ্যামদাস ঝুনঝুনওয়ালা থানায় এসে নালিশ জানালেন যে তাঁর কয়লা বোঝাই আঠারো চাকার দশটি ট্রাক পাণ্ডবেশ্বরের কয়লা খনি থেকে কয়লা নিয়ে পাঞ্জাবী মোড় থেকে ধানবাদের দিকে যাবার সময় ট্রাক নাম্বার জি জে ৬২ এল ৬৪৩৭ ট্রাকটি ছিনতাই হয়ে নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে । ট্রাকের খালাসিকে গাড়ি থেকে ফেলে দিলে তার মৃত্যু হয়। আসানশোলের দোমোহানীর কাছে জি টি রোডের ধারে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে বলে খবর পেলাম। একটা ব্যবস্থা করেন স্যার । বহুত রুপাইয়া নুকসান হো গিয়া । শুনা হ্যায় চার আদমী মিলকে ছিন লিয়া গাড়ি।
মিঃ গুপ্ত সেকেণ্ড অফিসারকে ডায়েরী নিতে বললেন।
ঠিক তখনই হাজির হলেন অভয়ঙ্করবাবু এবং অরবিন্দ।
- মিঃ গুপ্ত । আমরা আসতে বাধ্য হলাম , আপনাকে একটু ডিসটার্ব করব বলে ।
- আরে আপনি ! আর ডিসটার্ব কি বলছেন ? ওই দেখুন উনি কত ডিসটার্ব করছেন ।
বলে বাবুলাল ঘনশ্যামদাসের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন ।
রেঞ্জার সাহেব বললেন - ওনাকে দেখে তো ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। তা ওনার আবার কি হল ?
মিঃ গুপ্ত বললেন - ওনার মালবোঝাই ট্রাক ছিনতাই হয়ে গেছে। চার চারটে গুণ্ডার কাজ, বুঝলেন ?
অরবিন্দ বুঝে নিল চারজনের কথা বলছেন যখন তখন জাহিদরাই না হয়ে যায় না । বলছিল তো পঞ্চাশ হাজার ক্যাশ পেয়েছে।
- আমরাও এসেছি চারজন গুণ্ডার নামে এফ আই আর করতে । ওদের পরিকল্পনার কথাগুলো অরবিন্দই বুঝিয়ে বলতে পারবে । নাও , বল সাহেবকে।
অরবিন্দ বলতে শুরু করল ।
স্যার ওদের নাম জাহিদ ( ক্যাপটেন ) , জামির, জাহির, এবং জাহিরুদ । আমারও সন্দেহ হচ্ছে এই ট্রাক লুঠের পিছনে ওরাই আছে। আজ রাতে ওদের স্যারের বাড়িতে অপারেশন চালানোর কথা আছে। আমাকে ফোনে তাই তো বলল ।
- তুমি কি বললে ? মিঃ গুপ্ত প্রশ্ন করলেন ।
- স্যার, আমার উদ্দেশ্য ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। তাই বলেছি ঠিক আছে। তারপরই এই স্যারকে সব কথা বলে এখানে আসতে অনুরোধ করেছি।
- হুম্ । পুরো কথাগুলো বল ।
- স্যার আমি ওদের কথাগুলো রেকর্ড করে রেখেছি । এই নিন আমার ফোন। এতে সব রেকর্ড করে রেখেছি।
মিঃ গুপ্ত ওদের নিয়ে গেলেন একটা অন্য ঘরে। দরজা বন্ধ করে অডিও শুনলেন । নির্দিষ্ট সময় বলতে রাতের কথাই বলেছে। তার মানে সন্ধ্যে থেকেই বাড়িতে পুলিশ রাখতে হবে ।
বললেন - ঠিক আছে এই ফোনটা আমার কাছে রেখে যাও।
অরবিন্দ অভয়ঙ্করবাবুর মুখের দিকে চাইল । তিনি বুঝতে পারলেন ওটা রেখে গেলে অসুবিধে হতে পারে।
তিনি মিঃ গুপ্তকে বললেন - সরি স্যার। ওটা ওর কাছেই থাক না হলে ওরা বুঝে যাবে অরবিন্দ নয় অন্য কেউ কথা বলছে ; সাবধান হয়ে যাবে আর অন্য রাস্তা ধরতে পারে । তাই বলছিলাম আজই যদি ওদের ধরতে চান তবে যার ফোন তার কাছেই থাক ।
মিঃ গুপ্ত বললেন - ঠিকই বলেছেন। চলুন এবার পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলি । এক ঢিলে দু' পাখি মারার সুযোগ নষ্ট করা উচিত হবে না ।
অফিসে বসে সেকেণ্ড অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করলেন । তারপর দশজন বাছাই করা কনস্টেবল এবং সেকেণ্ড অফিসারকে নির্দেশ দিলেন সিভিল ড্রেসে অতিথি সেজে মিঃ সরকারের বাড়ির ভেতরে থাকতে ।
অভয়ঙ্করবাবু এবং অরবিন্দ বাড়ি ফিরে গেলেন । গোপাল বাবু, রুদ্র এবং পটকাকে ডেকে এ বিষয়ে কথা বলে নিলেন। কিন্তু মেয়েদের কাউকেই কিছু বুঝতে দিলেন না ।
ঠিক সন্ধ্যার আগের মুহূর্তে দশজনের পল্টনসহ সেকেণ্ড অফিসার ওদের বাড়ি এলেন। অভয়ঙ্করবাবু ও পটকা ওদের অভ্যর্থনা করে ভেতরের ঘরে বসালেন । এমন ভান করলেন যেন বহুদিনের পরিচিত বন্ধু বান্ধবরা এসেছে দেখা করতে।
পটকা বলল - রাতে আর ছাড়ছি না আপনাদের ! আমি আসছি বাজার নিয়ে। জমিয়ে খাওয়া দাওয়া করে ন ভোরের ট্রেনে যাবেন ।
অভয়ঙ্করবাবু সহমতি জানালেন । শৈল দেবী আঁতকে উঠলেন ।
- এতজনের খাবার দাবার রান্না করার ঝক্কি কে সামলাবে শুনি ?
অভয়ঙ্করবাবু হেসে বললেন - চিন্তা কিসের? আমি আছি তো ! পটকাকে নিয়ে ম্যানেজ করে নেব ।
তারপর পটকাকে বললেন - জোম্যাটোতে সবার খাবার অর্ডার করে দে !
পটকা নাচতে নাচতে জনে জনে জিজ্ঞেস করে খাবারের সূচী তৈরি করে নিল ।
শৈল দেবী আর কিছু বলতে পারলেন না ।
অভয়ঙ্করবাবু বাড়ির সবার সাথে ওনাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন । মেয়েরা খুশি হলেন ।
( ক্রমশ )

