লক্ষ্মী
লক্ষ্মী
লক্ষ্মী
সঞ্চয়িতা রায় চৌধুরী
আজকে মজুমদার বাড়িতে বড়ো করে লক্ষ্মী পুজোর আয়োজন করা হয়েছে। পুজোর সমস্ত দায়িত্ব রয়েছে এই বাড়ির কর্ত্রী এবং বউয়ের ওপর। সকাল বেলায় বাড়ির কর্তা মৃণালবাবু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে তার স্ত্রী রঞ্জিনীকে জিজ্ঞাসা করল,"কিগো পুজোর আয়োজন কতদূর?"
তার স্ত্রী রঞ্জিনী বলল,"এই তো হয়েই এসেছে। বউমাকে কখন থেকে বলছি, মা এই অবস্থায় তুমি এতো কাজ কোরো না। কিন্তু কথাটা শুনলে তো।"
রঞ্জিনীর বউমা চারমাস হল অন্তঃসত্ত্বা। এরইমধ্যে এই বাড়ির ছেলে সাহিত্য দশকর্মার কিছু জিনিস নিয়ে এসে বলল,"মা এই নাও দশকর্মার বাদবাকি জিনিসগুলো।"
রঞ্জিনী বলল,"বাহ্! দেখেছো বউমা, আমার ছেলেকে কিছু বলতে হয়না তার আগেই সমস্তকিছু ও করে দেয়। মায়ের কখন কোনটা কি প্রয়োজন ও সব বুঝে যায়।"
এই বাড়ির মেয়ে লক্ষ্মী, ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে সমস্ত কথা শুনছিল। কথাগুলো কানে আসতেই তার মনে পড়ল কিছু বছর আগে তার দিদার বলা কথাগুলো। দিদা তাকে বলেছিল,"জানিস লক্ষ্মী তুই যখন হয়েছিলিস তখন তোর মা-বাবা খুব কেঁদেছিল।"
লক্ষ্মী কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, "আনন্দে দিদা? শুনেছি খুব আনন্দে চোখে জল আসে।"
দিদা বলেছিল,"না রে কষ্টে!" কথাটা শোনার পর ওর কৌতূহলটা যেন বিষণ্ণতায় পরিণত হয়েছিল।
লক্ষ্মী বলল,"কিন্তু কেন দিদা?"
দিদা বলল,"তোর মা-বাবার খুব ইচ্ছা ছিল তাদের কোল আলো করে পুত্রসন্তান আসুক। তারা কখনোই কন্যাসন্তান চায়নি । কিন্তু ভগবানের কি লীলা দেখ! সেই মেয়েকেই পাঠালো তাদের জন্য। জানিস ওরা তোর নামটাও রাখেনি। আমি দিয়েছিলাম তোর নাম লক্ষ্মী। কারণ আমার কাছে তুই লক্ষ্মী। তোর মতোন এমন ভালো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে হয় নাকি। জানিস দিদিভাই প্রতিটা মেয়ের মধ্যে লক্ষ্মী থাকে।"
দিদার বলা কথাগুলো এখনও ওর মনে আছে।
লক্ষ্মীর বারবারই কেবল মনে হয়," দিদা তো বলতো প্রতিটা মেয়ের মধ্যে লক্ষ্মী থাকে, তাহলে আমার মা-বাবা কেন বোঝেনা? নাকি ওদেরর চোখে আমি লক্ষ্মী নই?"
ওর মনে আছে ওর যখন দশ বছর বয়স, তখন ওর ভাই সাহিত্য মায়ের কোল আলো করে এসেছিলো। ওর মা সেদিন খুব খুশি হয়েছিল, লক্ষ্মী দূর থেকে দাঁড়িয়ে ভেবেছিল,"আমি যখন হয়েছিলাম তুমি কি এতোটাই খুশি হয়েছিলে মা? দিদার কাছে শুনেছিলাম তুমি নাকি খুব কষ্ট পেয়েছিলে। "
হঠাৎ তার ভাইয়ের বউ তাকে বলল,"দিদি পুরোহিত এসে গেছে যে, তুমি অঞ্জলি দেবে না?"
লক্ষ্মী বলল,"হ্যাঁ যাচ্ছি ।"
পুজোর অঞ্জলি শেষে রঞ্জিনী ঠাকুরের কাছে হাতজোড় করে প্রণাম করে বলল,"মা দেখো আমার বউমার কোল আলো করে যেন পুত্রসন্তানই আসে।কন্যাসন্তান চাই না মা।"
কথাটা শুনে লক্ষ্মী ভাবলো,"মা আজকের দিনেও তুমি পুত্রসন্তানের প্রার্থনা করছো? তুমি আজ শুধু একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়েকে অপমান করছো তাই-ই নয়; তুমি একজন ভক্ত হয়ে নিজের অজান্তেই তোমার ভগবানকে অপমান করছো।"
পুরোহিত লক্ষ্মীকে দেখে বলল,"আরে লক্ষ্মী কেমন আছিস মা?"
লক্ষ্মী বলল,"ভালো আছি।"
কথাটা বলেই সে পুরোহিতের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।পুরোহিতমশাই আশীর্বাদ করে বললেন, "সত্যিই মৃণাল তুমি ভাগ্য করে মেয়ে পেয়েছো বটে। তোমার ব্যবসার অবস্থা যখন ভেঙে পড়ল, যখন ধার দেনায় ডুবে গিয়েছিলে তখন তো এই মেয়েই তোমাদের সংসারের হাল ফিরিয়ে ছিল নিজের পায়ে রোজগার করে। নিজের ভাইয়ের পড়াশোনার খরচও নিজে চালিয়েছে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভাইয়ের বিয়েও দিয়েছে । আমরা তো পাড়ায় সবাই বলি তোমাদের মেয়ে লক্ষ্মী সত্যিই লক্ষ্মী প্রতিমা। আমার ঘরে যদি এমন মেয়ে থাকতো তবে আমি মাটির মূর্তি নয়, জীবন্ত মূর্তিকেই পুজো করতাম।"
লক্ষ্মী বলল,"ঠাকুরমশাই আপনি আমাকে লক্ষ্মী মানলে কি হবে, আমার কাছের মানুষেরা তো আমাকে লক্ষ্মী মানেনা। তাদের মতে মেয়েরা আর যাইহোক কখনো লক্ষ্মী হতে পারে না, ঘর আলো করতে পারে না বরং ঘরের বোঝা বাড়াতে পারে, ঘর আলো করতে পারে একমাত্র ছেলেরা। সব মেয়েকে সবাই লক্ষ্মী মানে না পুরোহিতমশাই ।"
_____________________
