লেখা হলো শুরু
লেখা হলো শুরু


ঠিক মনে করতে পারছি না। অনেকটাই শোনা কথা। তবে কে লেখার পথে হাত ধরে নিয়ে গেছিল তাকে খুবই মনে আছে।
আমার মেজদা। এখন থাকে বিলেতে। এক্কেবারে সাহেবদের মত রং ,সাদা ধবধবে কিন্তু একটা লালচে রং ঠিকে বেরোচ্ছে। মেমসাহেব বৌ ,সাহেব ছেলে ,সাহেব -মেম নাতি -নাতনী। প্রাসাদের মতো বাড়ী ,নামটা কাব্যিক : সবুজ ছাউনি। বড়ো লিভিং রুম -বই আর গান -সিনেমার ভান্ডার। একটা বিশেষত্ব ভারতবর্ষের ওপর লেখা ছাড়া কোনো বই নেই ; উত্তম -সুচিত্রার পরের কোনো সিনেমা নেই ,কানা কেষ্ট থেকে হেমন্ত অনেকের গান পাবে -আধুনিক গায়কদের স্থান মেজদার বাড়ীতে নেই।
সেই মেজদা।
আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়। জন্ম থেকে আমি আর মেজদা অভিন্ন আত্মা। যতক্ষণ বাড়ীতে থাকতো ,আমি গায়ে লেপ্টে থাকতাম। আদর করে ডাকতো গজানন বলে -আমার চেহারাটা ছিল মানানসই ,-মোটাসোটা ভুঁড়িওয়ালা।
মেজদার বয়েস তখন দশ। ইস্কুলে ইংরিজি শিখছে। থেকে থেকে ইংরিজি বলে ,সি এ টি ক্যাট ,বি এ টি ব্যাট ,আরও কত কি। অবাক হয়ে চেয়ে দেখতাম আর কি ভাবতাম মনে নেই। সেই মেজদিই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ;সেখানেই থামে নি। হাত ধরে লেখার রাস্তায় নামিয়েছিল।
মেজদা ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো তেঁতুল মাখতো ,সর্ষের তেল ,নুন -কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। সবগুলোকে চটকে চটকে মাখছে তো মাখছেই ;তারপর ছোট ছোট গোল্লা -আহারে ,অমৃত সমান !
একটু একটু মনে পড়ছে। গ্রীষ্মের ছুটি। মা ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাইগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে। আমি আর মেজদা পেয়ারা গাছের নীচে। পি সি সরকারের মতো মেজদা এ পকেট সে পকেটথেকে বার করছে তেঁতুল ,তেল আর নুন ;আমি জানি ১আমার দায়িত্ব। গাছ থেকে কালো কালো দুটো কাঁচা লঙ্কা মেজদাকে দিলাম। মেজদা একমনে মাখছে। পদার্থ বিজ্ঞান বলে ,একই স্থানে দুটি বস্তু থাকিতে পারে না। ওরা আমার মেজদাকে দেখেনি তাই এমন কথা লিখেছে। তেল -তেঁতুল- নুন এক দেহে হলো লীন। পাথরে থ্যাৎলানো লঙ্কা গুলো তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করে আছে। নুন -তেল -তেঁতুল সাম্রাজ্যে ছোট ছোট করদ রাজ্যের মতো -আকবরের সাম্রাজ্যে বারো -ভূঁইয়া।
এবার বিরতি, বিশ্রাম, হাফ টাইম। আকাশের দিকে তাকিয়ে মেজদা -বাণী: 'বুঝলি গজা, মুখ্যু হয়ে থাকলে চলবে ?'
মুখ্যু কি জানিনা। আমার শ্রীমুখ দেখেই মেজদা বুঝলো মুখ্যু নামক ল্যাটিন শব্দ আমার মগজে ঢোকেনি।
মেজদা প্রাঞ্জল করে বোঝালো, 'বুঝলি তোকে লিখতে হবে।'
সেই প্রথম কেউ বললো লিখতে হবে আমাকে।
মেজদা কর্মবীর, শুধু কথায় নয়, সঙ্গে সঙ্গে কাজে পরিণত করতে করতে হবে কথাকে।
গম্ভীর আদেশ এলো,'তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, তোকে লিখতে হবে।'
একটু পরেই হাত ইজেরে মুছে আমরা দুজনেই তৈরী।
লেখার বেদী তৈরী হলো, গাছতলায় একটা জায়গা পরিষ্কার করে, তার ওপর সমান সামনে ভাবে ধুলো মাটি ছড়ানো হলো।
একটা গাছের ডান্ডা আমার হাতে ধরা, মেজদা আমার হাতটাকে চেপে ধরে তৈরী বেদিতে বোরো বড়ো করে আঁকলো এক ছবি
A
একটু আঁকা ব্যাঁকা, কিন্তু আমার প্রথম লেখা।
সেই থেকে লেখার মহাপ্ৰস্থান শুরু। সত্তর বছরেও সারমেয় রূপে স্বর্গের কোনো দেবদেবী আমাকে লেখার দেবলোকের পথ দেখতে আসেননি। আমি চলেছি নিজের আনন্দে, নিজের খেয়ালে; শিখিনি লেখার আইন কানুন; শুধু মেজদার হাত ধরে যে ছবি এঁকেছিলাম, সেই রকম জীবনের ছবিগুলো এঁকেই চলেছি।