কুয়াশায় ঘেরা আরশির কাহিনী
কুয়াশায় ঘেরা আরশির কাহিনী
কোলকাতা থেকে মোটামুটি চারশো কিলোমিটার দূরে ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা সীমান্তে ছবির মতো সুন্দর শহর মনোহরপুর। শাল-পিয়ালের অরণ্যে ঘেরা ধূম্র পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই শহর যেন কোনো সুদক্ষ চিত্রকর দ্বারা অঙ্কিত ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা ছবি। ভ্রমণপিপাসু মানুষদের পক্ষে বেড়িয়ে আসবার জন্য এক আদর্শ জায়গা। পাশ দিয়ে এক প্রাণোচ্ছ্বল উদ্ভিন্নযৌবনা যুবতীর মতো তিরতির করে বয়ে চলেছে কল্লোলিনী কোয়না নদী। শীতকালে কুয়াশা ঘেরা সকালে শাল সেগুনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মর্মরধ্বনি তুলে বয়ে চলে উত্তুরে হাওয়া। ছবির মতো এই সুন্দর শহরে একরাশ পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করছে হনুমান মন্দির। এছাড়া আছে রাধাস্বামী সৎসঙ্গ বিয়াস এবং কিছু দূরেই মা তারিণী মন্দির। এছাড়া কাছাকাছি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাহাদা,বালিবা,অভয়পুর,বারপোস ইত্যাদি আদিবাসী গ্রাম। এখান থেকে চক্রধরপুর আর টাটানগরও খুব একটা দূরত্বে নয়। কোয়েল নদী তো খুব কাছেই! এক কথায় প্রকৃতিরাণী সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে সাজিয়েছে নিজেকে। মনোহরপুর সত্যিই মনোহর! এই জায়গাটির আরেকটি বিশেষত্ব হল এখান দিয়ে সারান্দা ফরেস্টে প্রবেশ করা যায়। তাই ঝাড়খণ্ডের এই ছোট্ট শহর মনোহরপুর সারান্দা অরণ্যের প্রবেশদ্বারও বটে!
কিন্তু,সবচেয়ে বড়ো বিড়ম্বনার ব্যাপার হল পৃথিবীর এইসব সুন্দর সুন্দর স্থানেই বিভিন্ন রহস্যময় অতিলৌকিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মনোহরপুর শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে অনন্ত রহস্যে ঘেরা পাথরের দেশে ধূসর পাহাড়ের কোলে মন খারাপ করা একরাশ নিঃসঙ্গতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বোসভিলা। সুদৃশ্য পরিবেশে এক সুদৃশ্য বাড়ি! এই বাড়ির ইতিহাস কি,তা কেউ জানে না। একমাত্র আদিবাসী গ্রাম বালিবা খুব কাছে।সেখানকার কিছু অতিবৃদ্ধ লোক জানে এই বাড়ির ইতিহাসের কথা। রহস্যে মোড়া অতিলৌকিক এক অধ্যায়!
সময়টা ষাটের দশক। স্বাধীন ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে কিছুটা উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। তবুও বাঙালীদের কাছে জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে হাওয়া বদল করার জন্য পশ্চিমের বিকল্প নেই। ছুটি কাটাতে যাওয়া মানেই পাহাড়ে ঘেরা ভাগলপুর,মুঙ্গের,দেওঘর,জসিডি,মধুপুর,গিরিডি,টাটানগর,চক্রধরপুর,পালামৌ ইত্যাদি। এখানকার জল হাওয়া ভালো,শাল সেগুন পলাশের অরণ্য ছবির মতো সুদৃশ্য ইত্যাদি। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কুহেলীকে নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম খ্যাত কিন্তু বেশী সুন্দর ও নির্জন স্থান মনোহরপুরে বেড়াতে এসেছিলেন মধ্য তিরিশের বাঙালী যুবক আদিত্য বোস। এসেছিলেন একমাস ছুটি কাটাতে,কিন্তু এসে তিনি যে এখানে প্রকৃতিরাণীর অপার্থিব সৌন্দর্য ও নির্জনতার প্রেমে পড়ে গেলেন, প্রকৃতির সন্তান এই আদিবাসীদের ভালোবেসে ফেললেন, পাহাড়ের ঠিক কোলে গভীর জঙ্গলের মধ্যে বানালেন সুদৃশ্য লাল রঙের দোতলা বোসভিলা। ষাটের দশকের বাঙালী হলেও আদিত্যবাবু তথাকথিত 'ভেতো বাঙালী' ছিলেন না। রীতিমতো তিনি জঙ্গলে পাখি ও ছোট ছোট জীবজন্তু শিকারে বেরোতেন। ব্রিটিশ আমলে আদিত্যের দাদু জয়ন্ত বোস তার কাজকর্মের জন্য সরকার থেকে রাইফেল পেয়েছিলেন। সেই রাইফেল তখনো আদিত্যের কাছে ছিল।সেই রাইফেল নিয়ে আদিত্য চষে বেড়াতেন পশ্চিম সিংভূমের পাহাড় জঙ্গল। স্থানীয় গ্রামের আদিবাসীদের সাথে আলাপ হয় আদিত্যের। আদিবাসীরা মারাঙ্গ বুরু বা বোঙ্গাবাবার পূজারী। আদিবাসীদের অক্লান্ত পরিশ্রম করার ক্ষমতা,তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা,নিষ্পাপ সারল্য যেমন রেখাপাত করে আদিত্যের মনে,তেমনই আদিত্যের যৌবনের চাঞ্চল্য,অক্লান্ত পরিশ্রম করার ক্ষমতা,বুকভরা সাহস ,জেদ ও প্রকৃতিপ্রেমী সত্ত্বাকে ভালোবেসে ফেলে আদিবাসীরা। স্থানীয় মুণ্ডা সুদক্ষ যুবক ঝিন্দারাম হয়ে ওঠে আদিত্যের সহচর!
অপরদিকে আদিত্যের পরম সুন্দরী পঁচিশ বছর বয়সী স্ত্রী কুহেলী ছিলেন সত্যিই কুহেলিকায় ঘেরা একজন নারী।তিনি বাড়ি থেকে বেরোতেও কম,সত্যিই তাঁর চালচলন ছিল রহস্যময়। মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে বোসভিলা থেকে বেরিয়ে পশ্চিমের পাহাড়ের দিকে তিনি কোথায় যেতেন,কেউ বলতে পারত না। গভীর রাতে তিনি বাড়ি ফিরতেন। আদিত্যও মনে হয় কিছুটা স্ত্রীর রূপ ও যৌবনে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন যে,তাকে প্রশ্ন করার কথা তার মাথাতেই আসেনি।সদ্যযৌবনা স্ত্রীর সৌন্দর্য এতোই তাকে মুগ্ধ ও বশীভূত করেছিল যে,এই পাহাড় জঙ্গলের দেশে এসে তাঁর স্ত্রী কুহেলীর আচার আচরণের এতো পরিবর্তন তিনি খেয়ালই করেন নি। আদিবাসীদের কাছে এক সকালে তিনি শুনেছিলেন অদ্ভুত এক কথা,এই বোসভিলা থেকে দুমাইল দূরত্বে পাহাড়ের কোলে একটি গ্রাম আছে,সেখানে অপদেবতা বা শয়তানের পূজারীরা বাস করেন। এই পাহাড় জঙ্গলের দেশে এইসব কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস বহুল প্রচলিত ছিল,তাই তিনি পাত্তা দেন নি।যাই হোক,আদিত্যের কোনো এক পূর্বপুরুষ রাজস্থানের কোনো এক রাণার কাছ থেকে উপহারস্বরূপ পেয়েছিলেন একটি কেতাদুস্তর আরশি বা আয়না।আদিত্য সেই আয়নাটি তাদের নিজের বাড়ি থেকে আনিয়ে বোসভিলায় রেখেছিলেন। একদিন ঘটল এক অবাক করা কাণ্ড! আদিত্য দেখতে পেলেন আরশির কাচের মাঝ বরাবর একটি ফাটল। দেখে অবাক হয়ে গেলেন,আয়নাটি কোথাও পড়ে গেছিল নাকি! কুহেলীর তো উচিত ছিল যে,ঘটনাটা তাঁকে জানানো। তাঁর এতো শখের আরশি।
এদিকে আদিবাসী গ্রামের ওপর নেমে এল ভয়ের কালো ছায়া। পূর্ণিমা আর অমাবস্যা রাতে নিখোঁজ হতে লাগল সদ্যজন্মানো শিশুরা। ভয়ের এক কালো মেঘ ছেয়ে এল আকাশে!
এরপর এল সেই ভয়ঙ্কর রাত। পূর্ণিমার রূপোলী জ্যোৎস্নায় যখন ছেয়ে গেছিল বিশ্বচরাচর বোসভিলায় শুনতে পাওয়া গেল গুলির আওয়াজ আর সেই সাথে কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ।কিছুক্ষণ পরে শোনা গেল এক নারীর আর্তনাদ। তারপর সব কিছু নিস্তব্ধ।
পরের দিন সকালেই বোসভিলা থেকে বেরিয়ে গেলেন আদিত্য। আদিত্য বোসকে আর দেখেনি মনোহরপুর বা আশেপাশের অঞ্চলের লোকেরা। আরোও আশ্চর্যের ব্যাপার হল,আদিত্য যখন বেরোচ্ছিলেন তখন ঝিন্দারাম বা স্থানীয় কেউই তাঁর স্ত্রীকে তাঁর সঙ্গে দেখে নি। যে মানুষটা এই পাহাড়ে ঘেরা অরণ্যের শ্যামলিমা ভরা জায়গাটিকে এতো ভালোবাসতেন ,যারা তখন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তাদের দেখে মনে হচ্ছিল এই পাহাড়ের দেশ থেকে তিনি যেন ফিরতে পারলেই বাঁচেন। কিসের এতো তাড়া,এতো ভয় -কেউ বুঝল না। আশ্চর্যের ব্যাপার,বাবু তো আরশিটা সঙ্গে নিতে ভুলে গেলেন। এই তো দোতলার ঘরে রাখা রাজস্থানের রাণার উপহার দেওয়া আরশিটা ঝকঝক করছে। যেন মনে হয় একদম নতুন! কি আশ্চর্য,বাবু তো বলছিল আরশিটায় চিড় ধরেছে। কোথায় চিড়,চিড়ের তো চিহ্নমাত্র নেই।একদম নতুন আরশি। কতো দামী,আর বাবু বাড়িটায় তালা না লাগিয়ে এই দামী জিনিসপত্র ফেলে এভাবেই বেরিয়ে গেলেন। আর মালকিনই বা গেল কোথায়!তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া গেল না কুহেলীকে। গুলি চলার আওয়াজ সবাই শুনেছে,অথচ রক্তের দাগ বা চিহ্ন তো কোথাও নেই। বাবু যদি মালকিনকে খুন করে থাকেন,তাহলে সেই দাগ গেল কোথায়!আশ্চর্য,এই ঘরটায় এসে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়।কেমন যেন অদ্ভূত এক মন খারাপ করা পরিবেশ।
না,ফিরে আসেন নি আদিত্য। বছরের পর বছর কেটে যায়।একরাশ মন খারাপ করা নিঃসঙ্গতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বোসভিলা। পূর্ণিমার মায়াবী জ্যোৎস্নায় যখন ছেয়ে যায় বিশ্বচরাচর,তখন বাড়ি থেকে শোনা যায় গুলির আওয়াজে কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ,তারপর এক নারীর রক্ত জল করা অপার্থিব আর্তনাদ ,তারপর এক পিশাচের হাড় হিম করা গগনভেদী হুঙ্কার। কেঁপে ওঠে বিশ্বচরাচর।
রটে যায় ভূতুড়ে বাড়ি দুর্নাম। সবাই জানে,এক নারীর অভিশপ্ত প্রেতাত্মা এই বাড়ির আনাচে কানাচে কোথাও বন্দি হয়ে আছে।অথচ,কেউ জানে না আসল সত্যটা। সেই কলঙ্কিত অধ্যায়টা!
2017 সালের ডিসেম্বর মাস। হাওড়া থেকে আসা সকালের ইস্পাত এক্সপ্রেস করে দুপুরে সুদৃশ্য মনোহরপুর স্টেশনে নামল রাজর্ষি ব্যানার্জী যার ডাকনাম রাজ,আর তার প্রেমিকা সদ্যযুবতী স্ত্রী স্বাতী গাঙ্গুলি। একদম স্বাতীর মনের মতো জায়গা। এখানে নাকি গভীর শালবনের মধ্যে বোসভিলা বলে একটা জায়গা আছে। সেটাই রাজ আর স্বাতীর হানিমুন ডেস্টিনেশন। রাজের কোনো এক বন্ধু ঠিক করে দিয়েছে। এমনিই ভূগোলের ছাত্রী স্বাতীর খুব প্রিয় জায়গা হল ছোটনাগপুর,তাও মনোহরপুর বিখ্যাত তার নির্জনতার জন্য। এমনিই মনোহরপুর প্রথমবারের জন্য এসেছে স্বাতী,ট্রেন থেকে নামতেই মনে হয় এই জায়গাটা যেন তার পূর্বপরিচিত। এখানে সবকিছুই তার চেনা। শুধু সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়েছে,জনসংখ্যা বেড়েছে,উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। স্বাতীর চোখের তারায় ভেসে ওঠে অতীতের এক অস্পষ্ট ছবি।
ট্রেন মোটামুটি ঠিক টাইমেই ছিল। দুপুর সোয়া একটায় প্রকৃতির অমল শোভা দেখতে দেখতে মনোহরপুর পৌঁছাল রাজ আর স্বাতী। স্টেশনের চারপাশে প্রকৃতির অপরূপ লীলা। শীতের দুপুরের মায়া মাখানো রোদ। শহরেরই হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে ট্রেকার ভাড়া করে তারা গিয়ে ওঠে বোসভিলাতে । ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজে। বেলা পড়ে আসছে। স্বাতী অবাক হয় পাহাড়ের কোলে জঙ্গল অধ্যুষিত সভ্য সমাজ থেকে দূরে এরকম একটা নির্জন স্থানে এরকম সাজানো গোছানো বাড়ি থাকতে। নামটা 'বোসভিলা',নিশ্চয়ই যিনি বানিয়েছিলেন তার পদবী ছিল বোস। যাই হোক, চারদিকে শাল গাছ। এছাড়া আছে মহুয়া, কুসুম,টিলাই,গুলার ইত্যাদি। কাছেই সারান্দা ফরেস্ট। সম্বর,চিতল আর বাইসন ঘুরে বেড়ায় ,এছাড়া জঙ্গলের গভীরে চিতাবাঘের দেখা পাওয়াও বিচিত্র নয়। এছাড়া আছে শীতের মরশুমে আসা বিভিন্ন রঙ বেরঙের পরিযায়ী পাখি। ভিলার চারদিকে ফুটেছে মরশুমী ফুল। ঠিক পিছন দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি কোয়না নদী। রাজ আসবার আগে নাকি ওর বন্ধু বিক্রম বোসকে বলে রেখেছিল এখানে আসছে। বিক্রমের কোন্ দূর সম্পর্কের জ্যাঠা আদিত্য বোস এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। মনে মনে ভাবে স্বাতী,একে এই পাহাড় জঙ্গলের মন মাতাল করা পরিবেশ। তারপরেই কিছুদিন পরেই পূর্ণিমা। রাত হলেই শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নায় ছেয়ে যাবে বিশ্বচরাচর। আর এই নির্জনতা আর অরণ্যের দিনরাত্রির মাঝে সে তার রাজের সাথে এই ভিলা থেকে শুনবে অরণ্যের সেই স্বর্গীয় সঙ্গীত। রাজের চয়েসটা তো দারুণ,এই বোসভিলা একদম পারফেক্ট হানিমুন ডেস্টিনেশন হতে চলেছে।উফ,পাশেই কোয়না নদীতে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সেই নানা রঙের খেলা জাস্ট অপূর্ব। কিন্তু,এই বাড়িটাকে এতো চেনা চেনা লাগছে কেন!রাজর্ষির সাথে বোসভিলার ভিতরে ঢোকে স্বাতী।আগেও যেন দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে। নিজের মনোভাবকে পাত্তা দিতে চায় না সে। আঁকড়ে ধরে তার প্রেমিক স্বামীকে।
বাড়িটা দোতলা। ওপরে ছাদ। ছাদ থেকে দূরে পাহাড়ের গায়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখলে নবকুমারের ঐ উক্তিটিই মনে পড়ে,"আহা কি দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তরে ভুলিব না। "পাহাড়ের গায়ে লাল গোল বলের মতো সূর্য অস্ত যাচ্ছে এবং সেই আলো গোলাপী প্রতিপ্রভা রূপে সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে। সামনেই নদী,এইদিকটায় কি পাখি রা খুব একটা আসে না! চিতল বা সম্বরও তো চোখে পড়ল না। অবাক লাগে স্বাতীর।
সুদর্শন যুবক রাজের সাথে স্বাতীর পরিচয় শপিং মলে। একদম ফার্স্ট সাইট লাভ যাকে বলে। রাজ নিজেই একটা ট্র্যাভেলিং এজেন্সির ডিরেক্টর।স্বাতী ভূগোলে মাস্টার্স করছে,ভ্রমণপিপাসু। প্রেমটা অসম্ভব তো ছিলই না,আর নিয়তিও ভূমিকা পালন করেছিল এক্ষেত্রে। না হলে,বারবার শপিং মলেই হোক, গড়ের মাঠেই হোক বা গঙ্গার ধারেই হোক স্বাতীর সাথে রাজকে এভাবে দেখা করিয়ে দিত না।সত্যিই ভাগ্যের লিখন খণ্ডাবার কার সাধ্যি!
এখান থেকে সারান্দা ফরেস্ট মোটামুটি চার মাইল। আশেপাশে আদিবাসীদের গ্রাম আছে। আর শুধু মাইলের পর মাইল দিগন্তবিস্তীর্ণ সবুজ বনানী। তবুও ঘরটায় কেমন যেন মন খারাপের ছোঁয়া আছে। ঢুকলেই মন খারাপ করে। সেদিক থেকে ছাদটা অনেক ভালো। একঝলক মুক্তির হাওয়া। কয়েকদিন পরে পূর্ণিমা! উফ,কতো রোম্যান্টিক লাগবে সবকিছু। মনে মনে ভেবে পুলকিত হয় রাজর্ষি। বিক্রম একটা কাজের লোক ঠিক করে দিয়েছে, বুদ্ধ মুণ্ডা। স্থানীয় সিংভূম অঞ্চলের মুণ্ডা উপজাতির লোক। সরল,বিশ্বাসযোগ্য আর প্রচণ্ড পরিশ্রমী। তবে কানে মনে হয় একটু খাটো! কেমন যেন অদ্ভুত রকম। সব কথায় সাড়া দেয় না। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে থাকে সারাদিন। কি যেন ভেবে চলে! আর কেমন এক অজানা ভয়ে যেন গুটিয়ে থাকে!মাঝে মাঝে এতোটাই সিঁটিয়ে থাকে যেন ওকে দেখেই ভয় লাগে রাজ আর স্বাতীর। দুদিন কেটে গেল। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হল না। এরমধ্যেই ওপর তলার ঘরে রাখা সুন্দর কারুকার্য করা অপরূপ আর্শিটা চোখে পড়ল স্বাতীর। ইশ,রাজ তো এর কথা আগে বলে নি। কতো সুন্দর! সম্প্রতি পরিষ্কার করা হয়েছে। জানলা থেকে এসে পড়া রৌদ্রকিরণে আরশিটা ঝলসে উঠছে। ঔজ্জ্বল্য বিকিরণ করছে!এখন কয়েকদিন এই আয়না ওরাই ব্যবহার করবে। আয়নাটা বহু দিনের পরিচিত বলে মনে হল স্বাতীর। কোথায় যেন দেখেছে দেখেছে,কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না।
প্রকৃতির অনন্ত নিঝুমতা আর প্রেমের অফুরন্ত উষ্ণতার মধ্যে আরোও দু তিন দিন কাটাল রাজ আর স্বাতী। এছাড়াও,ফটোগ্রাফি,নদীতে বোটিং করা ,জঙ্গলে বেড়িয়ে আসা এসব তো আছেই। এরপরেই সেই প্রেমের জীবনে নেমে এল ভয়ের কালো মেঘ।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। বিকেলে যখন কোয়না নদীতে এক অপরূপ সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ সৃষ্টি করে রক্তিম সূর্য অস্ত যাচ্ছিল,তখনই বিশ্বচরাচরে প্রকৃতির নানা ছন্দে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল অতিপ্রাকৃত কিছু ঘটার কথা। যেন খুবই চরম অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। পূর্বদিকে উঠেছে পূর্ণিমার গোল রূপোলী চাঁদ। স্বাতীর মনে পড়ে গেল ডি লা মেয়ারের লেখা 'Silver' কবিতাটি। " Slowly ,silently,now the moon/ Walks the night in her silver shoon/ This way,and that,she peers and sees/ Silver fruit upon silver trees." গোল রূপালী থালার মতো চাঁদ যেন জানান দিচ্ছিল বোসভিলাতে অপার্থিব ভয়ানক কোনো কিছু ঘটতে চলেছে। পুনরাভিনীত হতে চলেছে ইতিহাসের এক ঘটে যাওয়া কলঙ্কিত অধ্যায়। এই প্রথমবার সন্ধ্যাবেলা গভীর জঙ্গল থেকে চিতাবাঘের ডাক শুনতে পেল স্বাতী।
গণ্ডগোলটা ঘটল সন্ধ্যাবেলাতেই।রাজ আসার আগেই এই বাড়িতে ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা করে রেখেছিল। কিন্তু এই বাড়িটার ওপর ঘরে,অর্থাৎ যে ঘরে আয়না রাখা আছে, আগের দিনই বাল্বটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। মোমবাতি নিয়ে কি মনে হতে আরশিটার সামনে এসে দাঁড়াল স্বাতী। জানলা থেকে ভেসে আসছে মায়াময় রূপোলী চন্দ্রকিরণ আর এক অদ্ভূত মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। আর তখনই আয়নায় নিজের মুখের পরিবর্তে স্বাতী দেখতে পেল ক্ষতবিক্ষত এক নারীর মুখ। কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। স্বাতীকে দেখামাত্রই খিলখিল করে হেসে উঠল সেই নারী। হাতছানি দিয়ে ডাকছে স্বাতীকে। এই দৃশ্যের আকস্মিকতা ও ভয়াবহতা দুটোই অসহ্য হয়ে উঠল স্বাতীর কাছে। ওখানেই দড়াম করে অজ্ঞান হয়ে পড়ল স্বাতী।রাজ বাইরের বারান্দাতেই প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছিল।দড়াম করে পড়ার শব্দ পেয়ে ঘরে ছুটে গেল রাজ। দেখল তার স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে এই আয়নার সামনে পড়ে আছে।
স্বাতীকে নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে চোখমুখে জল ছেটানো আর মাথায় হাত বোলাতেই কিছুক্ষণের মধ্যে হুঁশ ফিরে এল স্বাতীর। পাশেই বসে ছিল কাজের লোক বুদ্ধ মুণ্ডা। তার চোখমুখে এক অপার্থিব ভয়ের ছবি। যেন সে আগে থেকেই জানত অশুভ কিছু ঘটবে আর নিকট ভবিষ্যতেও অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে।
ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মনে করতেই নিজের মনে হাসি পেল স্বাতীর। এই ঘটনা যদি সে রাজকে বলে তাহলে রাজ তাকে পাগল ছাড়া আর অন্য কিছু ভাববে না। স্বাতী নিজেও যথেষ্ট যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মেয়ে। বিকেলে সে যথেষ্ট টায়ার্ড ছিল। অন্ধকার ঘরে যখন তার হাতে টিমটিম করে জ্বলছিল মোমবাতি ,আর জানলা থেকে ঘরে এসে পড়ছিল রূপোলী চন্দ্রকিরণ,তখন হয়তো সেই মায়াবী পরিবেশে তার মানসিক বিভ্রম ঘটেছে। সে যা দেখেছে সেটা Delusion ছাড়া আর কিছুই নয়। এটাই হয়ে থাকবে। নইলে আগে তো কখনো হয়নি,এখনই বা কেন হল!
বারান্দায় এসে দাঁড়াল স্বাতী। ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে,এতেই বাইরে এতো নির্জন,এতো নীরব যে মনে হয় রাত অনেক হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের শুরু। বাইরে চাপ চাপ কুয়াশা। গোল চাঁদের আলো সেই কুয়াশার আস্তরণের ওপর পড়ে রূপোলী প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করেছে। আকাশে অল্প অল্প মেঘ রয়েছে। আকাশের চাঁদ যেন সেই মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। দূরে কোথাও হাতি ডাকছে। হিমেল হাওয়া অরণ্যের মধ্য দিয়ে পাতার মর্মরধ্বনি জাগিয়ে বয়ে চলেছে। এটাই কি অরণ্যের সঙ্গীত! পিছন থেকে এসে স্বাতীর কোমর জড়িয়ে ধরল রাজর্ষি। আজ প্রেম জেগেছে রাজের মনেও। মন মাতাল করা অরণ্যের রোম্যান্টিক পরিবেশে প্রেমের খেলায় মেতে উঠল স্বামী স্ত্রী। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল মিলনের তীব্রতা। এই প্রেমের মিলনের সাক্ষী থাকল বনানীর মধ্যে মর্মরধ্বনি তুলে বয়ে চলা হিমেল হাওয়া আর আকাশের একলা চাঁদ। আজকের রাত পূর্ণিমার রাত। আজকের রাত প্রেমের রাত। আজকের রাত অলৌকিকতার রাত। রাজ শুনেছে যে, আদিবাসীরা বলে থাকে যে এই পূর্ণিমার রাতে বিভিন্ন অতৃপ্ত আত্মারা পৃথিবীর বুকে নেমে আসে।এসে তাদের কামনা বাসনা পূরণ করতে চায়।
রাতে বিশেষ কিছু ঘটল না। পরোটা আর চিকেন কষা খেয়ে অরণ্যের নিঝুম সঙ্গীত শুনতে শুনতে নিদ্রার জগতে চলে গেল দুজনায়। কিন্তু তাদের এই ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হল না। রাত মোটামুটি দুটো হবে। বন্দুকের গুলির তীব্র আওয়াজ আর সেই সাথে কাঁচের ঝন ঝন করে ভেঙে পড়া আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল রাজ আর স্বাতীর। আর তখনই হল এক নারীর বুকভাঙা আর্তনাদ। কাঁপতে থাকল বোসভিলা!
কুয়াশা ভরা ডিসেম্বরের এক হিমেল সকাল। বইছে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। বারান্দার ব্যালকনিতে একা দাঁড়িয়ে আছে স্বাতী। দূরে জঙ্গলের ওপর কুয়াশার আস্তরণ। এখন সে ঘটনাগুলির কিছুটা মর্মোদ্ধার করতে পারছে। না,গত রাতে আয়নায় দেখা ঐ ক্ষতবিক্ষত মুখটা তার বিভ্রম বা delusion ছিল না। প্যারাসাইকোলজির মতে, যেখানে কোনো নৃশংস বা মর্মান্তিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে কালচক্রের সাথে সাথে সেই নৃশংস বা মর্মান্তিক ঘটনাটি অলৌকিক ভাবে পুনরাভিনীত হওয়ার ঘটনাটি অসম্ভব কিছু না। আর ঐ আয়না! অনেক সময় যাদের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় বা মর্মান্তিক ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয় তাদের আত্মা অতৃপ্ত কামনা বাসনার জন্য পরলোকে যেতে পারে না। আটক হয়ে যায় মধ্যলোকে! তাহলে ঐ ক্ষতবিক্ষত মুখ কি কোনো নারীর প্রেতাত্মার ,যে শিকার হয়েছিল কোনো এক ছলনার,তাই সে বন্দি হয়ে গেছে মধ্যলোকে। সে কি তাকে কিছু বলতে চায়! দিতে চায় কি সে তাকে কোনো আসন্ন ঘটনার পূর্বাভাস। সেদিনের সে ঘটনার পর বেশ কয়েকদিন সন্ধ্যাবেলা ঐ আয়নায় ঐ নারীর ক্ষতবিক্ষত ছায়ামূর্তি টাকে দেখেছে স্বাতী। প্রথমে মনে হয়েছে বিভ্রম,তারপর যখন সে দেখল বিভ্রম নয় তখন সে চরম ভয় পেয়েছে, আর এখন সত্যিই মনে হচ্ছে ছায়ামূর্তিটা যেন তাকে কিছু বলতে চায়। যেন কিছু আসন্ন বিপদ থেকে সাবধান করতে চায়। কিন্তু কেন! আর আরশিটারই বা ইতিহাস কি! কেন সেই আরশিটা ওকে এইভাবে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। মনে হয়,যেন ঐ আরশি আর ঐ নারীমূর্তি যেন ওর অনেক দিনের চেনা। জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক রয়েছে ওদের সাথে।না,ওকে জানতেই হবে কি রহস্য লুকিয়ে আছে ঐ আরশির মধ্যে। ওকে আজ সন্ধ্যাবেলাতেই জানতেই হবে, রহস্যের কুয়াশায় ঘেরা এই আরশির কাহিনী।
পশ্চিম দিগন্তকে নানা রঙে রাঙিয়ে অস্তাচলে গেলেন দিবাকর। পৃথিবীর বুকে নেমে এল সন্ধ্যার অন্ধকার। জঙ্গলের গভীরে কোথাও ডেকে উঠল একজোড়া বাইসন। রাজ নিচে জঙ্গল আর কোয়না নদীর ফটোগ্রাফ দেখতে ব্যস্ত। মোমবাতি হাতে দোতলার ঘরে ঢুকল স্বাতী। আরশির সামনে এসে দাঁড়ালো। আর আরশিতে ভেসে উঠল এক ক্ষতবিক্ষত নারীর মুখ। কপাল বেয়ে রুধিরধারা নামছে।
স্বাতী আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠল-"কে তুমি! কি চাও! কেন এইভাবে বারবার আমাকে দেখা দিচ্ছ। এইভাবে কেন ডাক বারবার! আজকে বলতেই হবে ,তুমি কে!আর আমার সাথে তোমার সম্পর্কই কি!"
হিসহিস করে হেসে উঠল আয়নার নারীটি,"মনে হয় না আমাদের মধ্যে জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। আমি যে তোমারই অতীত,কুহেলী।তোমার পূর্বজন্ম বলতে পার। ভাবতে পারো,আমারও ভালো লেগেছিল এই সুন্দর বোসভিলা। এখানকার মনোহর প্রকৃতি। তারপরে এক অভিশপ্ত রাতে এই বোসভিলাতে মরতে হয়েছিল আমাকে।সেই প্রতিশোধ নেবার সময় এখন এসে গেছে।"
চমকে উঠল স্বাতী,"মানে!তুমি কি বলতে চাও!"
খিলখিল করে হেসে উঠল আয়নার নারীটি,"বলছিই তো তুমি আমার ভবিষ্যৎ,আমার পুনর্জন্ম। আমাদের সত্ত্বা শুধু পৃথক,কিন্তু আমাদের আত্মা এক ও অভিন্ন। তুমিই আমি আর আমিই তুমি। এই আয়নায় আমার সত্ত্বা জীবনের ব্যর্থতা আর বুকে অনন্ত প্রতিশোধের জ্বালা নিয়ে বন্দি হয়ে আছে। এবার এসেছে আমার প্রতিশোধের পূরণের সময়। হ্যাঁ,তোমার মাধ্যমেই পূর্ণ হবে আমার প্রতিশোধকামনা।আমার জন্যই তোমাকে প্রতিশোধ নিতে হবে ওর বিরুদ্ধে,ওদের জন্য।হ্যাঁ করতেই হবে আমার অসমাপ্ত কাজ।"
দৃঢ়স্বরে উত্তর দিল স্বাতী,"না ,প্রতিশোধ কোনো সমস্যার যোগ্য সমাধান কোনোকালেই হতে পারে না। বিশ্বাস করি না আমি প্রতিশোধের মন্ত্রে। না,আমি প্রতিশোধ নেব না।"
এবার আয়নার ওপার থেকে বলে উঠল কুহেলী,"এই আয়না কোনো সাধারণ আয়না নয়। এটা অতীত আর বর্তমান কালের বিভাজনরেখা। এর ওপারে আমি আছি ,আর এপারে তুমি। আমি অতীত আর তুমি বর্তমান। তাই তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ।কিন্তু ,পরিস্থিতি একই রকম। সেদিন পূর্ণিমার দিনে আমাকে বলি হতে হয়েছিল স্যাটানিজম এ বিশ্বাসী এক শয়তানের পূজারীর হাতে,যিনি ছিলেন স্বয়ং লুসিফারের উপাসক মি. আদিত্য বোস।স্যাটানিকদের অন্যতম। তিনি এখানে এই পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে সুন্দর বোসভিলা স্থাপন করে এখানকার সরল পরিশ্রমী প্রকৃতির সন্তান আদিবাস
ীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে সেখানকার আদিবাসী শিশুদের নরবলি দিয়ে এই বোসভিলারই দোতলার উত্তর পশ্চিম দিকের একটি ঘরে জাগিয়ে তুলেছিল লুসিফারকে।আর নিজেও লাভ করেছিল অতিলৌকিক ক্ষমতা,যার মধ্যে একটি হল বছরের পর বছর ধরে চিরযুবক থেকে যাওয়া। নিজের শয়তানী সাহায্য পাওয়ার জন্য সে মাঝে মাঝে ছুটে যেত উত্তর-পশ্চিম পাহাড়তলির সেই অভিশপ্ত ভয়ঙ্কর গ্রামে যেখানে এখনোও শয়তানের উপাসকরা বাস করে। সাধারণ মানুষ সেই গ্রামে প্রবেশ করতে পারে না। পুরো গ্রামটাই নাকি মায়া। একমাত্র যে শয়তানের প্রকৃত উপাসক,শয়তান তাকে ঐ গ্রামে নিজের কাছে ডেকে নেয়।"স্তম্ভিত হয়ে এই অতিলৌকিক অভূতপূর্ব কাহিনী মন দিয়ে শুনছিল স্বাতী। কিছুক্ষণ থেমে বলে উঠল কুহেলী আরশির ওপার থেকে।"আমি জেনে গেছিলাম ওর এই স্যাটানিজমের কথা। ও শয়তানকে নিজের পূর্বপুরুষ বলে মানে। শয়তানই ওর প্রভু,আর ও তো তারই। তাই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে ফলো করতাম। বারবার ছুটে যেতাম উত্তর পশ্চিমের সেই পাহাড়তলির দিকে যেখানে শয়তানের উপাসকদের গ্রাম রয়েছে বলে শোনা যায়। কিন্তু,সেই অভিশপ্ত গ্রাম খুঁজে পাই নি। ঐ গ্রাম যে মায়ার বন্ধনে বাঁধা। হায়!আর ওও জেনে গেছিল আমি ওর রহস্য জেনে গেছি। তাই তো সেদিন পূর্ণিমারাতে এই বোসভিলায় খুন করেছিল আমাকে।বন্দি করে দিয়েছিল আমার সত্ত্বাকে আয়নার মধ্যে মধ্যলোকে। নিজের শ্বদন্ত দিয়ে সমস্ত রক্ত পান করেছে আমার শরীর থেকে তারপর এই শরীরকেই ও ওর দৈব মন্ত্রবলে মমি বানিয়ে লুকিয়ে রেখেছে এই বাড়িরই কোনো এক গুপ্তঘরে।আর তারপর বন্দুকের গুলিতে ভেঙে দিয়েছে সেই আয়না।
কিন্তু ও জানত না,বিধাতার ইচ্ছা অন্যরকম ছিল। তাই তো আবার দৈববলে জোড়া লেগেছে ঐ আয়না। আমার পুনর্জন্ম হয়েছে। বোসভিলাতে কোনো এক অদৃশ্য যাদুবলে সেই পূর্ণিমারাতে ঐ অভিশপ্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে।"
"না না,আমি প্রতিশোধ নিতে পারব না।" মায়াবী চন্দ্রালোকে কুহেলী তার অলৌকিক অপার্থিব সত্ত্বা মিশিয়ে দিল স্বাতীর মধ্যে। আয়নার কাঁচে ফুটে উঠল একটা চিড়।
সেই রাতে যখন চন্দ্রিমার মায়াবী চন্দ্রালোকে ভেসে যাচ্ছিল বিশ্বচরাচর,তখন বোসভিলাতে ঘটে যাওয়া সেই মর্মান্তিক ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভেসে উঠল স্বাতীর চোখে।ঘটনার আকস্মিকতায় আর বীভৎসতায় বারবার শিউরে উঠল স্বাতী।আর আয়নার কাঁচে দেখল সেই ষাটের দশকের যুবক আদিত্য বোসকে। দেখেই চিনতে পারল। সে আর কেউ নয়-রাজর্ষি,তারই রাজ।
শয়তান। স্বর্গীয় উদ্যানের সেই সর্পরূপী দানব যে চেয়েছিল ঈশ্বরের বদলে সৃষ্টিকে পরিচালিত করতে। যে সবসময় তার অনুগামীদের ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পরিচালিত করে। কেউ বলে লুসিফার,আবার কেউ বা বলে ইবলিশ। যাকে বলা হয়েছিল ঈশ্বরসৃষ্ট মানব আদমের সামনে নত হতে,কিন্তু সে সেটা না মানায় তাকে স্বয়ং ঈশ্বর স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করলেন। সেই থেকে শয়তানের মনে পরম করুণাময় ঈশ্বরের প্রতি দ্বেষ বহ্নিশিখার মতো বিরাজমান।আর বহ্নিশিখার মাধ্যমে সে মানুষদের মননে পাপের আগুন জ্বালিয়ে তোলে। যদিও অনেকে বলেন শয়তানের মুখ ছাগলের মতো,মাথায় শিং থাকে,হাতে পায়ে ক্ষুর থাকে,বাইবেলে বলা হয়েছে শয়তানের তেমন কোনো নির্দিষ্ট বাহ্যিক গঠন নেই। শয়তান নিরাকার।খারাপ শক্তির এক সত্ত্বা। এই শয়তান প্রায়ই মানুষকে ছলনা বা প্রবঞ্চনার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে চালিত করতে আসে তার সুদর্শন সুন্দর এক আলোকময় রূপ বা Angel of Light এর রূপ ধরে।
যারা স্যাটানিজমে বিশ্বাসী তারা এই শয়তানকে নিজের পিতৃপুরুষ ও আরাধ্য দেবতা বলে মনে করে। তাদের মতে এই সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন শয়তান। শয়তানই তাদের প্রভু। আর এর বদলে শয়তান হয়তো তাদের কিছু অতিলৌকিক শক্তিও প্রদান করে। এমনই একজন লোক হলেন আদিত্য বোস যিনি নানাভাবে তন্ত্রমন্ত্রের মাধ্যমে শয়তানের উপাসনা করার মাধ্যমে পেয়েছেন অনন্ত যৌবনের আশীর্বাদ। এই বোসভিলারই একটি ঘরে নরমুণ্ডের আসনে বসে তিনি উপাসনা করেন তাঁর আরাধ্য প্রভুর।তাঁর বাস্তব কুহেলী জেনে ফেলেছিল,তাই মরতে হয়েছিল কুহেলীকে এই বোসভিলাতে। কিন্তু তাতে কি হয়েছে!শারীরিক চাহিদা,ভালোবাসার সঙ্গ দেওয়া-ও তো তাঁর মতো সুদর্শন পুরুষকে দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে কতো মেয়ে আছে। কুহেলী গেছে তো কি হয়েছে,স্বাতী তো এসেছে। এরকম কতো মেয়ে তার জীবনে আসবে যাবে। স্বাতী গেলে আরেকজন না হয় আসবে! আর মৃত্যু!মানুষের জীবনে চরম সত্য। না মৃত্যুকে তিনি ভয় করেন না। এই বোসভিলাতেই একটা ঘরে রাখা আছে সেই জিনিস যেটা তাঁর প্রাণভোমরা। তাঁর প্রাণ তো তাঁর নিজের শরীরে নেই,সেই জিনিসটার মধ্যেই রাখা আছে প্রাণ,যে জিনিসটা সর্বক্ষণ তাঁর প্রাণে স্পন্দিত হয়ে চলেছে,কি সেই জিনিস একমাত্র তিনিই জানেন। ইচ্ছা ছিল কুহেলীর শরীর তিনি অমাবস্যার রাতের দিন তাঁর প্রভুর উদ্দেশ্যে বলিপ্রদত্ত করবেন,কিন্তু মাঝখান থেকে কুহেলী সবকিছু জেনে যাওয়ায় তাঁর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। না,এবার তাঁর সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হবেই। হ্যাঁ,পূর্ণ হবে স্বাতীর মাধ্যমে। অমাবস্যার নিকষ অন্ধকারে যখন ছেয়ে যাবে পাহাড় জঙ্গল সবকিছু,আকাশে উজ্জ্বলতা বিকিরণ করবে কালপুরুষ,তখন উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী স্বাতীর দেহ তিনি উৎসর্গ করবেন তাঁর প্রভুকে। হ্যাঁ,তাঁর প্রভু সেই উন্মুক্তকেশা সুস্তনী নারীর দেহ ভোগ করে পরিতৃপ্ত হবে,আর এর বিনিময়ে তিনি আদিত্যকে প্রদান করবেন অমরত্বের মহামন্ত্র। অমরত্ব,কি সুন্দর জিনিস! সামনের ঘরে বসে কথাটা ভাবতেই দুচোখ জ্বলজ্বল করে উঠল রাজর্ষি ব্যানার্জী রূপী আদিত্য বোসের।
আরে ঐ তো স্বাতী। মনে হয় সবে স্নান সেরে উঠেছে। নীল শাড়ি আর পিঠ ও কাঁধের ওপর এসে পড়া উন্মুক্ত সিক্ত কেশরাশিতে স্বাতীকে অনবদ্য লাগছে। সত্যিই মোহময়ী কোনো অপ্সরা বলে মনে হচ্ছে। রাজ দেখতেন থাকে স্বাতীকে। আকাশে কৃষ্ণা দ্বাদশীর চাঁদ। সত্যিই প্রেম করতে ইচ্ছা করছে।
স্বাতীর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল রাজ। কপালে টকটকে লাল সিঁদুর। স্বাতীকে টকটকে লাল সিঁদুর তো কি,রাজ এর আগে খুব একটা সিঁদুর পরতেই দেখেননি। স্বাতী নিজেও একজন বিজ্ঞানমনস্ক তরুণী। সে নিজেও সিঁদুর পরা পছন্দ করে না। সহসাই বিনা মেঘে বজ্রপাত হলে যা হয় চমকে উঠল রাজ। অতীতের ঘটে যাওয়া এক অধ্যায় ভেসে উঠল তার চোখের তারায়। এমনই নীল শাড়ি,এমনই কপালে সিঁদুর,ভিজে খোলা চুল- এসব তো কুহেলীর বেশ। কিন্তু কুহেলী! তাহলে কি কুহেলীর প্রেতাত্মা ফিরে এসেছে। অবাক হল রাজ।না,কুহেলীর আত্মাকে তো সে আয়নার মধ্যে বন্দি করে আয়নার কাঁচ ভেঙে দিয়ে কুহেলীর ইহলোকে ফেরত আসার রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। হুস,যত্তোসব উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা। এতো ভয় পেলে তার মতো স্যাটানিকের চলে কিভাবে! তার আত্মা একমাত্র তার প্রভুর দাস। আর কারোর নয়।
"চলো না ডার্লিং,এই বাড়িতে বসে বোর হওয়ার চেয়ে বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।" স্বাতীর প্রেমাতুর প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে পারল না রাজ। আর গাড়িতে বসে যা আগে কখনো ঘটে নি তাই ঘটল। স্বাতীর মতো নাস্তিক মেয়ে বায়না ধরল মা তারিণীর মন্দিরে যাবার।
ওরা যখন মন্দির চত্বরে পৌঁছাল তখন ঘড়িতে মোটামুটি সাড়ে আট টা বাজে। পুরোহিত ছাড়া চাতালে কেউ নেই। ঠাণ্ডার সময়,চারদিকে হিম পড়ছে। কাঁসর ঘন্টার শব্দ শুনে অস্বস্তি ফিল করল রাজ। মন্দিরে পা রাখতেই বিদ্যুত খেলে গেল তার শরীরে। পায়ে ফোস্কা পড়ে গেল। মন্দিরে ঢুকতে পারল না রাজ। ভেতরে ঢুকে দেবীকে প্রণাম করল স্বাতী। তারপর ফিরে তাকাল রাজের দিকে। অবাক হয়ে গেল রাজ-এই ভঙ্গি,এই চাহনি যে তার অতিপরিচিত কুহেলীর।
আজ ডিসেম্বরের আকাশ হালকা মেঘাচ্ছন্ন। দূরে দিগচক্রবালে ধূসর অভ্রভেদী গিরিরাজ যেন একরাশ রহস্যকে নিজের বুকে বন্দি করে দাঁড়িয়ে আছে। বইছে হাড় কাঁপানো হিমেল হাওয়া। আকাশের সূর্য যেন মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। তবে এই শ্যামলিমা বঙ্গের পরিচিত শ্যামলিমা থেকে অনেকটাই আলাদা। এই অঞ্চলে ছোটনাগপুরের চিরাচরিত রুক্ষতা বিরাজমান। তবে ঋতুটা শীতকাল হওয়ায় প্রকৃতির সেই রুদ্ররূপ চোখে পড়ছে না,তার পরিবর্তে প্রকৃতি যেন পুষ্পে সজ্জিত হয়ে প্রেমের গান করছে। এখন পাতাঝরার মরশুম। তাও শহরের কোলাহল আর কৃত্রিমতা থেকে এখানকার শ্যামলিমা অনবদ্য।
দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবে রাজ ,দিন দিন স্বাতীর কাজকর্ম কেমন যেন সন্দেহজনক হয়ে যাচ্ছে। কোনোদিন তো স্বাতী মন্দিরে যাবার জন্য জেদ করে নি,হঠাৎ এমনই বা কি হল যে স্বাতীর মাথায় মন্দিরে যাবার ভূত ছাপল। আচ্ছা,কুহেলীর প্রেতাত্মা কোনোভাবে স্বাতীকে প্রভাবিত করে নি তো! না না,এ হতে পারে না,এ যে একেবারেই অসম্ভব। তার স্বাতী,তার স্বাতীই থাকবে। অনেককষ্টে অনেক খুঁজে সে এমন মেয়ে খুঁজে পেয়েছে যার মধ্যে লুসিফারকে তুষ্ট করার সব গুণই বিদ্যমান। না না,এই মেয়েকে সে হাতছাড়া কোনো মতেই করতে চায় না। এই যুবতীই তাকে এনে দেবে তার অভীষ্ট সেই অমরত্বের মহামন্ত্র। কিন্তু,একদিকে সে যেমন অমরত্ব চায়,এটা ঠিক ,তেমন কি এটাও ঠিক নয় এতোদিনে সে স্বাতীকে কোথাও না কোথাও ভালোবেসে ফেলেছে। কোথাও না কোথাও মনের মধ্যে স্থান দিয়েছে সে তার স্বাতীকে। রেসপেক্ট করতে শুরু করেছে স্বাতীকে,গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে স্বাতীর ফিলিংস আর চাহিদাগুলিকে। নইলে আগের দিন গাড়িতে যখন স্বাতী মন্দিরে যাবার জন্য বায়না ধরল,তখন সে তো স্বচ্ছন্দে না করতেই পারত। কিন্তু ,সে তো না করল না। স্বাতীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল,যেন রাজি না হয়ে তার উপায়ও ছিল না। স্বাতীর চোখের তারায় সে দেখে সূর্যকিরণে,সারা দিনে স্বাতীর একটু সান্নিধ্য,একটু স্পর্শ পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে সে। স্বাতীর অপ্সরানিন্দিত স্বরে শিহরিত হয়ে ওঠে তার শরীর ও মন। এটা প্রেম নয় তো আর কি! আর একটা কথা তো আছেই,মানুষই হোক আর দানব,প্রকৃতির সান্নিধ্যে হৃদয়ে আবেগের গভীরতা আর অনুভূতির তীব্রতা বৃদ্ধি পাবেই। এটা যেমন স্বাতীর ক্ষেত্রে সত্য,তেমনই এই মনোহরপুরের ধূম্র পাহাড়ের কোলে এই ছবির মতো জায়গায় প্রকৃতি এতো মায়াময় যে,তার ক্ষেত্রেও স্বাতীর প্রতি আবেগের তীব্রতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন সে আর তার হরিণীচক্ষু প্রেমিকা স্বাতীকে হারাতে চায় না,কোনোভাবেই না।
কিন্তু অমরত্ব! পরম অভীষ্ট তো তাকে লাভ করতেই হবে। এইসব ভালোবাসা আর প্রেম মোহমায়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এই মোহমায়ার জাল থেকে বেরোতে পারলেই পূর্ণ হবে তার মনস্কামনা,সে অমরত্ব লাভ করবে। এখন স্বাতীর প্রেমে হাবুডুবু খেলে তার পরম অভীষ্ট কোনোদিনই পূর্ণ হবে না। এই প্রেমের জাল ছিন্ন করে তাকে বেরোতেই হবে,হ্যাঁ বেরোতেই হবে। কিন্তু দিন দিন স্বাতী কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে। যেন ও অতীতের সেই যৌন আবেদনময়ী কুহেলী হয়ে উঠছে। অবাক লাগে রাজের।
দূরে ঐ ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে মাটি খোঁড়ে কে! বুদ্ধ মুণ্ডা না! হ্যাঁ বুদ্ধ মুণ্ডাই তো। ওই লোকটাও রহস্যময়। সবসময় রহস্যের কুয়াশা দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখে। ধুর। কোথায় না তাকে সবাই ভয় পাবে,এদের দেখে তার মনেই ভয় লাগছে। কিন্তু বুদ্ধ মুণ্ডা মাটি খুঁড়ছে কেন! মাটি থেকে ওটা কি বার করছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল শিশুর কঙ্কাল। এবার রাজের দিকে ফিরে তাকাল বুদ্ধ মুণ্ডা! কোটরে ঢোকা দুই জ্বলন্ত গোলার মতো চোখ দেখে এই প্রথমবার ভয় পেল রাজ। এই মুখ সে কোথায় যেন দেখেছে। এই প্রথম বিদ্যুতের মতো রাজের মনে ভেসে এল সেই উত্তর যা এতদিন তার মনেই আসে নি। হ্যাঁ,পঞ্চান্ন বছর আগের সেই আদিবাসী বন্ধু,যে তাকে বিশ্বাস করে নিজেকে তার কাছে উৎসর্গ করেছিল,সেই ঝিন্দারাম!
স্বাতী আর কুহেলী এক হয়ে গিয়েছে। দুই প্রজন্মের এক অদ্ভুত সমাপতন। কিন্তু,তাও স্বাতীর মনে কাজ করছে এক অজানা ভয়। সে কি পারবে নিষ্পাপ আদিবাসী শিশুরা আর কুহেলীর হয়ে প্রতিশোধ নিতে। সে কি পারবে আদিবাসীদের ন্যায় ফিরিয়ে দিতে। কাছেই জঙ্গলের গভীরে রয়েছে এক অজানা শ্মশানকালীর মন্দির। খড়্গহস্তে কৃষ্ণবর্ণা মুণ্ডমালিনী মা লোলজিহ্বা বিস্তার করেছেন। 'শক্তি দাও মা,অশুভ কে বিনাশ করার শক্তি দাও। ' মনে মনে বলে ওঠে স্বাতী তথা কুহেলী। কিন্তু কিভাবে! মায়ের খড়্গে সে ছিন্ন করবে রাজের মুণ্ড অথবা শয়তানের পূজারীকে বিদ্ধ করবে মহাদেবের ত্রিশূল দিয়ে। কিন্তু তাতে কি হবে সমস্যার সমাধান। আবছা আবছা মনে পড়ছে স্বাতীর যে,এই বাড়িরই এক গুপ্তঘরে শয়তান তাঁর পাথরে কোঁদানো মূর্তির মধ্যে বিরাজ করছেন। বড়ো ভয়াল এক হিংস্র চতুষ্পদ শ্বাপদের মূর্তি রূপে। কোনো পূর্ণযৌবনা নারীকে রমণ করতে পারলেই তিনি তাঁর পূর্ণশক্তি নিয়ে জেগে উঠবেন। কিন্তু,না তা সে হতে দেবে না। তার আগেই ধ্বংস করবে সেই শয়তানী মূর্তিকে। হ্যাঁ ,মায়ের কাছ থেকে সে নিয়েছে সেই রক্তমাখা খড়্গ ,যা নিয়ে মা দানব দলন করেন। সেই আদিশক্তিই তো বধ করেছিলেন মহা ভয়ঙ্কর শুম্ভ নিশুম্ভ,ভয়াল দানব চণ্ড মুণ্ডকে। তাহলেই বা এই শয়তানই কেন বধ হবে না! শয়তানকে পর্যুদস্ত আজ হতেই হবে।আচ্ছা,এই বুদ্ধ মুণ্ডা বলে আদিবাসী লোকটা কেমন! এ কি তাকে কোনো সাহায্য করবে! মনে তো হয়,খুব ভক্তি করে। মালকিন মালকিন বলে ডাকে। আচ্ছা,বুদ্ধ মুণ্ডা তো আজকের এক যুবক। তাহলে লোকটাকে এতো চেনা বলে মনে হয় কেন,যেন মনে হয় জন্ম জন্মান্তরের পরিচিত।
না,প্রথমে যেটা করতে হবে ঐ গুপ্তঘরটা খুঁজে শয়তানের মূর্তিটা ধ্বংস করতে হবে যেভাবেই হোক। তারপর একতলার ঐ পেন্ডুলাম ঘড়িটাই বা বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছে কেন! ওটার কি কোনো যোগসূত্র আছে এই ঘটনার সাথে,কোনো সম্পর্ক রয়েছে আদিত্য আর লুসিফারের সাথে। হঠাৎই শরীরে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল স্বাতীর। আচ্ছা ,ঘড়িটা এরকম মাঝে মাঝে দুলে ওঠে কেন। ভালো করে খেয়াল করে ও দেখে কখনো সঙ্কুচিত হয়,কখনো বা প্রসারিত হয়। মাঝে মাঝে অদ্ভুত ঘড়ঘড় শব্দও বেরোচ্ছে। কেঁপে উঠল স্বাতীর প্রাণমন। ও শুনেছে যে শয়তান তথা শয়তানের উপাসকদের প্রাণভোমরা অন্য কোথাও লুকানো থাকে।
এই ঘড়িটা কি জ্যান্ত! এখানেই কি লুকানো রয়েছে শয়তানের তথা শয়তানের উপাসকের প্রাণভোমরা। না ,কুহেলী এতো খুঁজে যা পারে নি,তা সে পেরেছে। সে খুঁজে বার করতে পেরেছে তার জীবনে ঘনিয়ে আসা সমস্যা থেকে বেরনোর চাবিকাঠি। এবার সে খতম করবেই শয়তানকে।
হঠাৎই পিছন থেকে বুদ্ধ মুণ্ডা কুহেলীর অতি পরিচিত গলায় বলে উঠল,"বাবুকে এবার সব হিসাব চুকাতে হবেই ।" অবাক হল কুহেলী,"ঝিন্দারাম না!"
আজ অমাবস্যা। সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ আর ঝোড়ো হাওয়া অতিলৌকিক,চরম অশুভ কিছু ঘটার পূর্বাভাস দিচ্ছে। শীতের অন্যান্য সকালের মতো আজ সেই সোনালী রোদ উধাও। পরিবর্তে আকাশের মুখ ভার। ঘন কুয়াশায় দূরের পাহাড়শ্রেণীকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। বেলার দিকে হালকা রোদ উঠলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হল না। সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই পশ্চিম দিকের পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়ল সূর্য। জঙ্গলের মধ্যে বাইসনের ডাকের সাথে পৃথিবীর বুকে নেমে এল সন্ধ্যা।
বোসভিলায় একসাথে রাজ আর স্বাতী । রাজের দৃষ্টি স্বাতীর শরীরে নিবদ্ধ,স্বাতীর চোখেও কামনা। জিন্স আর ফুল স্লিভ ব্ল্যাক শার্টে রাজকে অনবদ্য লাগছে। নীল শাড়িতে খোলা চুলে স্বাতীকেও মদির লাগছে। কেন জানি না আজ মন চাইছে স্বাতীকে খুব ভালোবাসতে। কিন্তু,রাজ জানে,নারীসৌন্দর্যের এই ফাঁদে পা দিলে চলবে না। স্বাতী যে প্রভুর জন্য বলিপ্রদত্ত!আজ রাতে স্বাতীর এই মদির সৌন্দর্যই জাগিয়ে তুলবে তার প্রভুকে।আর সে পাবে অমরত্ব!
পানীয়ের সাথে হয়তো কিছু মেশানো ছিল,পানীয়টা খেতে খেতে ঝিম ধরে গিয়েছিল স্বাতীর। হয়তো কিছুক্ষণের জন্য সে বেহুঁশ হয়েও পড়েছিল। যখন সে হুঁশে ফিরল তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করল এক গুপ্ত কুঠুরিতে বাঁধা অবস্থায়। ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে তার পোষাক। তার কিছু দূরেই অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে একহাতে নরমুণ্ড ও এক হাতে মানুষের অস্থি নিয়ে তন্ত্রে লিপ্ত এক কুদর্শন অতিবৃদ্ধ লোলচর্ম অস্থিসার ব্যক্তি। এই কি তাহলে রাজ তথা আদিত্যের আসল রূপ। আর সেই অগ্নিকুণ্ডের অপর দিকে যে বসে আছে তাকে দেখে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলে স্বাতীর শরীরে।
কোনো ব্যক্তি নয়। পাথর কুঁদে তৈরি করা এক মূর্তি। দেখলেই হাড় হিম করা ভয়ে আচ্ছন্ন হয় শরীর আর মন। এক চতুষ্পদ শ্বাপদের মূর্তি। সামনের দু পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তীক্ষ্ণ নখর,দুকষ থেকে নির্গত বড়ো ধারালো শ্বদন্ত,আর পাথর কুঁদে তৈরি করা চোখদুটি বড়োই জীবন্ত। সেই চোখ থেকে এই জগতের সমস্ত হিংস্রতা প্রতিফলিত।যেন সমস্ত ক্ষুধা আর যৌনলালসা নিয়ে বসে আছে সেই জীব। এই কি শয়তান লুসিফার!
বৃদ্ধ মগ্ন ছিল যজ্ঞের কাজে। আজ অমাবস্যার রাত। আকাশে চাঁদ ওঠে নি। মেঘ সরে গিয়েছে।মেঘহীন আকাশে কালপুরুষ ঔজ্জ্বল্য বিকিরণ করে মহাকালের অমোঘ বার্তা শোনাচ্ছে।
দুর্বোধ্য মন্ত্র পাঠ করছে বৃদ্ধ। চতুষ্পদ শ্বাপদের দেহে যেন ধীরে ধীরে প্রাণসঞ্চার হচ্ছে। চোখের মণি উন্মীলিত হয়েছে। হাত পা নড়ছে। শ্বদন্ত বিস্ফারিত হচ্ছে। চোয়াল থেকেই সত্যিই লালা গড়িয়ে পড়ছে। বৃদ্ধ যজ্ঞে আহুতি দেবার সাথে সাথেই হাড় হিম করা হুংকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে উঠে দাঁড়ালো শ্বাপদ। কেঁপে উঠল বোসভিলা। শয়তান জেগে উঠেছে।
এদিকে তখনই ঘরে অকস্মাৎ ঝড়ের মতো প্রবেশ করল স্বাতী আর বুদ্ধ মুণ্ডা তথা ঝিন্দারাম। স্বাতীর এক হাতে শ্মশানকালীর খড়্গ ,আরেকহাতে পেণ্ডুলাম ঘড়ি যেখানে লুকিয়ে আছে অশুভ শক্তির উপাসক আদিত্যের প্রাণভোমরা। না,অনেক প্রচেষ্টায় অবশেষে এই অমাবস্যার রাতেই অভীষ্ট পূর্ণ হয়েছে স্বাতীর । সে খুঁজে পেয়েছে সেই ঘর ,বোসভিলার যে ঘরে যুগ যুগান্তর ধরে অধিষ্ঠান রয়েছে শয়তানের। আরাধনা করা হয় ঈশ্বরের নয়,শয়তানের।
চমকে উঠলেন আদিত্য বোস।এ যদি স্বাতী হয়,তাহলে এতক্ষণ যজ্ঞকুণ্ডের সামনে যাকে বন্দি করে রেখেছেন তিনি ,সেই নারী আসলে কে! সে কি কোনো মানবী না অন্য কেউ! আদিত্য জানেন না,তাঁর প্রভুকে নিধন করতে মহাকাল আজ স্বয়ং শক্তিকে আবাহন করেছেন। আজ ফের বিনাশ ঘটবে অশুভের!
খিল খিল করে অপার্থিব হাসিতে হেসে উঠল সেই উদ্ভিন্নযৌবনা নগ্নিকা। এই প্রথমবার ভয় পেলেন আদিত্য। হয়তো ভয় পেয়েছেন তাঁর প্রভুও। হঠাৎই এক দিব্য আলোয় ছেয়ে গেল চারদিক। মুক্তকেশী নগ্নিকা তাঁর পরিচিতা ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণা চতুর্ভুজ মূর্তি ধারণ করলেন। হাতের দিব্য খড়্গ দিয়ে কেটে ফেললেন তাকে রমণ করতে আসা হিংস্র শ্বাপদের মুণ্ড। এরপর সেই মুণ্ড নিয়ে তার রক্ত পান করতে করতে ছন্দে ছন্দে তালে তালে প্রলয়ঙ্কর নৃত্য করতে থাকলেন। কেঁপে উঠল বোসভিলা।
এদিকে স্বাতীর মধ্যেও কুহেলীর অপার্থিব সত্ত্বা জেগে উঠেছে। তার চোখ থেকে বেরিয়ে তীব্র তেজে জ্বলে উঠল পেণ্ডুলাম ঘড়িটি। সেই সাথে আগুন ধরে গেল রাজ তথা আদিত্যের শরীরে। দাউদাউ বহ্নিশিখায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেলেন আদিত্য বোস। তাঁর প্রভুর মতোই বিনাশ ঘটল তাঁর ।এদিকে প্রবল অট্টহাস্যে হেসে উঠল কুহেলী। বাইরের একটা ঘর থেকে এল আরশিটার ঝনঝন করে ভেঙে পড়ার শব্দ । মায়াবী আরশিটার কাজ এবার শেষ হয়েছে। শয়তানের বিনাশ ঘটেছে ।এতদিন মায়াবলে ওটা অটুট ছিল,এখন সেই মায়াবলের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে।
বাতাসে মিলিয়ে গেল বুদ্ধ মুণ্ডা তথা ঝিন্দারাম। মালকিনকে দেওয়া কথা ও রাখতে পেরেছে ।খুনী ধ্বংস হয়েছে। এখন ঝিন্দারামের আত্মার মুক্তি ঘটতে চলেছে।
স্বাতীর শরীর থেকে বেরিয়ে যায় কুহেলীর অপার্থিব সত্ত্বা। অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে স্বাতী।
নিজের নশ্বর শরীরটাকে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে আদিত্যের। এতোদিনে তার অভীষ্ট পূরণ হয়েছে। তিনি ভুল লোককে নিজের প্রভু বলে মেনেছিলেন,ভুল শক্তির কাছে নিজের সত্ত্বা সঁপে দিয়েছিলেন,সে তাকে সবসময় ভুল পথে পরিচালিত করেছে,ভুলভাল নির্মমতাপূর্ণ কাজকর্ম করিয়ে নিয়েছে। তিনি যে নিজেকে কামনা বাসনা রহিত করার কথা ভাবতেন,সেই বাসনার জালেই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন। অমরত্ব লাভ করার বাসনা। এইভাবেই বাসনার জালে বন্দি হয়ে গেছিলেন তিনি।
কিন্তু,এতদিন পর তাঁর জ্ঞানচক্ষু খুলে গেছে। সে আর তিনি নন,সে এখন সে। অহং সরে গেছে তাঁর জীবন থেকে। আকাশ থেকে যেমন মেঘ সরে গেলে,সোনালী সূর্যকিরণ এসে পড়ে,তেমনই আদিত্যের আত্মা থেকে অজ্ঞানতার মেঘ সরে গিয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন,মানুষের প্রভু শয়তান নন, এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর। তিনিই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা,তিনিই জগৎপালক শ্রীহরি আবার তিনিই প্রলয়কারী মহাকাল।তিনি যেমন পরম করুণাময়,তেমন তিনি শক্তিমানও বটেন। তাঁর রুদ্ররূপের সামনে শয়তান দাঁড়াতেই পারবে না। আর রইল কথা অমরত্বের,মুক্তির কাছে সে তো তুচ্ছ। অমরত্ব মানেই দীর্ঘ জীবনের যন্ত্রণা,আর মুক্তি মানেই প্রশান্তি। সত্যিই প্রাণ ভরে হাসতে পারছেন তিনি। দীর্ঘ জীবনযন্ত্রণার পর তাঁর অভিশপ্ত আত্মা মুক্তি পেতে চলেছে। "কুহেলী তোমাকে ধন্যবাদ ।" বলে দিব্যজ্যোতি হয়ে পৃথিবীর সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে অনন্ত আকাশে মিলিয়ে গেলেন তিনি। এটাই মুক্তি,এটাই নির্বাণ।
কিছুক্ষণ পর উঠে বসল স্বাতী। কুহেলীর প্রতিশোধ পূরণ হয়েছে। শিশুদের আত্মার মুক্তি ঘটেছে। স্বাতীর মনে এখন প্রতিশোধের জিঘাংসা নয়,শ্রান্তি আর শান্তি। দুঃস্বপ্নের রাত শেষ হয়েছে।
বোসভিলা থেকে যখন ক্লান্ত শরীর ও মনে স্বাতী বেরিয়ে এল,তখন দূরে পাহাড়ের বুক চিরে পুবাকাশকে নানা রঙে রাঙিয়ে দিবাকর উদিত হচ্ছেন। পাখির কূজনে মুখর হয়ে উঠেছে চারদিক। না,আর কোনোদিন অশুভ কিছু ঘটবে না বোসভিলায়। এক নতুন দিন শুরু হতে চলেছে।