কড়চা#৯|ভয় পায়নি ভিয়েতনাম
কড়চা#৯|ভয় পায়নি ভিয়েতনাম


০২ এপ্রিল ২০২০
দিন বদলাচ্ছে, ঘটছে পালাবদল। আমি যাতে এই দেশে জাঁকিয়ে না বসতে পারি তার জন্যে সবদিকে সবরকম চেষ্টাও চলছে। দেখতে দেখতে লকডাউন অবস্থায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। ছবিটাও বদলাচ্ছে। যার সঙ্গে আমার লড়াই সেই মানুষের গতিপ্রকৃতির মধ্যেও তো সেই বদলের ছাপ পড়ে!
কালকের ঘটনাটাই ধরুন না! আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থেকে সবই আমি লক্ষ করি, কিছুই আমার নজর এড়ায় না। গতকাল সকালে একটা রেশন দোকানের সামনে যা হুজ্জুতি হলো, তাতে আমিই শিউরে উঠলাম। হাতাহাতি, চুলোচুলি কোনটাই বাদ গেল না।সবই হলো সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এর নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে। দোকানের সামনে বড়োবড়ো করে লেখা ছিল - 'পরস্পরের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন'। কে শোনে কার কথা! চিরকালের স্বভাব, লাইনে গা ঘেঁষাঘেসি করে দাঁড়ানো, ঠেলাঠেলি, কে কতো তাড়াতাড়ি আগেভাগে নিয়ে কেটে পড়তে পারে। এই সব নিয়েই গোলমালের সূত্রপাত। এত প্রচার, এত লেখালেখির পরও এদের চোখ খোলে নি। আমার ছোঁয়া থেকে বাঁচতে গেলে এই দূরত্ব বজায় রাখাটাই তো সবার আগে জরুরী। লাইনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে দেখে আমি মনে মনে বললাম, 'তোদের প্রাণে যা ইচ্ছে হয়, তাই তোরা কর্। তোদের ভুলেই তো আমার সুবিধে। দেখবো হাসবো, ধরবো রে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবো রে!
আর মাত্র দুটো দেশ দখল করলেই আমার ডবল সেঞ্চুরি হবে। এখনো অবধি আমার থাবা পড়েনি মাত্র সতেরোটা দেশে। তারাও কদিন আর আমায় ঠেকিয়ে রাখতে পারবে সেটাই দেখার। যে মহাদেশ - এশিয়া থেকে আমি উঠে এসেছি, সেখানে মাত্র চারটে দেশ - ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া, তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকিস্তান অক্ষত আছে এখনো। কি কেমন পারফরম্যান্স আমার? ব্যাটিং ক্রিজে একদম অনড় হয়ে চালিয়ে যাচ্ছি।
আপনার নিজেকে এখন কেমন অসহায় লাগছে না; ছোট্ট লিলিপুটদের দেশে দড়িদড়া বাঁধা গালিভারের মতন? আমি যখন প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিলাম তখন আপনারা তোয়াক্কাই করেন নি। বর্মে মোড়া, বিভিন্ন অস্ত্রবলে বলীয়ান গোলিয়াথের মতন অপরাজেয় ভেবেছিলেন নিজেদের। ভাবতেই পারেননি আমার একটা গুলতির আঘাত আপনার শরীরের সবচেয়ে আসল জায়গা শ্বাসনালীতে গিয়ে আপনার দফারফা, মানে আপনার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারে! মনে তাচ্ছিল্যের ভাব এনে ছড়া আউড়েছেন -- হাতিঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল! এই সহজ সরল সত্যটা জানেন না, অপোনেন্টকে কখনো আণ্ডারএস্টিমেট করতে নেই! তাই বলছি মশাই, এখনো দেরি হয়নি, সময় থাকতে থাকতে জানুন, শিখুন অন্যদের কাছ থেকে - যারা আমাকে কাছে ঘেঁসতে দেয়নি ঠেকিয়ে রেখেছে, বা আমার আক্রমণের হড়পা বানকে কিছুটা হলেও রুখতে পেরেছে।
আপনারা যা খুশি ভাবুন, যা খুশি চিন্তা করুন, যেভাবে খুশি ছক সাজান। আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আমি সব লক্ষ করছি। দেখছি বুদ্ধি খাটিয়ে মোটামুটি তিনটে উপায়ে আপনারা আমাকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন - লকডাউন করে মানুষকে ঘরবন্দি করে রাখা, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং অর্থাৎ নিতান্ত প্রয়োজনে বাইরে বেরোলেও একজনকে অপরের থেকে দূরে রাখা মানে অল্প কিছু নিয়ম-বাধা রেখে স্বাভাবিক জীবন, আর সবশেষেরটা আমার ছোঁয়া লেগেছে কিনা তা পরীক্ষা করা। তৃতীয়টা বেশ কঠিন। কারণ বেশিরভাগ দেশেই, এমনকি প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও এই পরীক্ষার ব্যবস্থাপত্তর প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। হবে না কেন, কেউ তো আগে আমার কথা জানতোই না। ভাবতেই পারে নি আমি আসবো, দেখবো, জয় করবো। তাই ছকটা সাজানোই হয়নি। ইজরায়েল এখন চেষ্টা করছে আপনার গলার আওয়াজ ফোনের অ্যাপে শুনে বোঝার যে আপনি আক্রান্ত কিনা! হাতে একটা ধাতব পট্টি পরানোর কথাও ভাবছে যেটা পরে থাকলে প্রতি মুহূর্তে আপনার শরীরের সব কিছু -- তাপ, রক্তচাপ, নাড়ীর গতি, চিনির পরিমাণ -- বোঝা যাবে।
আমাকে আর পাঁচটা ভাইরাসের মতো ভেবেছিল ইউরোপ ও আমেরিকা। আমি যে কতোটা ভয়ংকর এবং কতো তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে মানুষজনকে কাবু করতে পারি তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। সংক্রমণের শুরুতে তাই গা-ছাড়া ভাব দেখিয়ে সামান্য দুচারটে বাধা রেখে দিব্যি স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছিল। আর এখন? অগুণতি লোককে যমের দুয়ারে পাঠিয়ে আমি তাদের মাজা ভেঙে দিয়েছি। ওরা জানতো না যে হার্ড ইমিউনিটি ব্যাপারটা বলতে সোজা কিন্তু সেই সামগ্রিক প্রতিরোধ ক্ষমতা চটজলদি গড়ে ওঠে না। তৈরি হতে অনেক অনেক বছর লেগে যায়। ভ্যাকসিন তৈরির জন্যে গবেষণা চলছে বটে। ওটাও তো রাতারাতি সম্ভব না। তাই যতদিন না বেরোচ্ছে, ততদিন বাঁচতে চান তো সাবধানে থাকুন, অন্যদের থেকে ছোঁয়াচ বাঁচাতে নিজেরা দূরে দূরে থাকুন।
এতদিনে তো জেনেই গেছেন আমার স্বভাব চরিত্রের কথা। উঁকিঝুঁকি মারি, আড়ি পেতে অন্যদের কথা শুনি। ফোনে কথা বলছিল দু'জন। আমিও কান পাতলাম। দু'জনের একজন একাধারে নামকরা ডাক্তার ও বিখ্যাত ফটোগ্রাফার! লোকে বলে ডাক্তারবাবুর পায়ের তলায় সর্ষে! লেখার হাতও খুব ভালো। এহেন ডাক্তারবাবু এই বছর ফেব্রুয়ারির মাঝ থেকে মার্চের গোড়া পর্যন্ত বেড়াতে গেছিলেন ভিয়েতনামে। সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই তিনি জানাচ্ছিলেন এক ছোকরা সাংবাদিককে।
- ভিয়েতনাম নাকি প্রথমে চীন ও পরে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা সব বিমানের উড়ান বন্ধ করে দেয়?
- ঠিকই শুনেছ। ওরা গোড়া থেকেই সতর্ক ছিল। যেমনি খবর পেয়েছে এই দেশে, অমুক দেশে করোনা ভাইরাসের ছোঁয়া লেগেছে অমনি সেই সব দেশ থেকে আসা যাত্রীসহ বিমানকে নামতে দেয় নি নিজেদের এয়ারপোর্টে। এমনকি ভিসা অন অ্যারাইভালও বন্ধ করে দেয়। বেশ কিছু বিমানকে ফিরে যেতেও বলা হয়। স্বদেশে ফেরত আসা যাত্রীলের বাধ্য করা হয় কোয়ার্যান্টিনে ১৪ দিন থাকতে।
- বলেন কি! ওইটুকু একটা দেশ, সে গোড়াতেই এই ব্যবস্থা করলো ..
- হ্যাঁ, শুরুতেই লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়েছিল। তার সাথেে ছিল থার্মাল স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা, স্যানিটাইজার, আর করোনার বিষয়ে সচেতন করানোর জন্যে ছোট্ট এক বই - ভিয়েতনামি ও ইংরেজি ভাষায়। সেখানে লেখা ছিল বা অন্যান্য মিডিয়াতেও প্রচার চলছিল কোন পরিস্থিতিতে কি করবেন, কোথায় যাবেন। স্কুল, কলেজ, বড় জমায়েতের জায়গা, যেগুলো বন্ধ রাখলে মোটামুটি জীবন চলার অসুবিধে হবে না, সেগুলোতে প্রশাসন তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল প্রথম থেকেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, নিয়ম নির্দেশ মেনে চলা ওদের মজ্জায়।
- আপনি তো বেড়াতে গেছিলেন। ট্যুরিস্ট হিসাবে কোনো রেস্ট্রিকশনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল?
- না, সেরকম কিছুই তো দেখিনি। সায়গনে বা হো চি মিনে বাধ্য না করা হলেও আমাদের মাস্ক পরানো হয় প্রত্যন্ত এলাকায় নামার ঠিক আগে, আমাদের নিজস্ব মাস্ক না থাকলে ওরাই দিচ্ছিল। আর আমরা সবজায়গায় খুব ওপেন ট্রিটমেন্ট পেয়েছি, খুব ভাল আতিথেয়তা...
- বাঃ! আচ্ছা, ২২শে জানুয়ারি থেকে আজ অবধি মাত্র ২৩৯ জন ওখানে করোনা-আক্রান্ত, এখনও কেউ মারা যায়নি! এতগুলো প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে কোন জিনিসটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয়েছে?
- সুন্দর প্রশ্ন করেছো। জানো তো দেশটার নাম ভিয়েতনাম। ১৯৫৫ সাল, তুমি তখন জন্মাও নি। দ্বিতীয় ইন্দো-চীন যুদ্ধের সেই শুরু। সেটাই ভিয়েতনাম যুদ্ধ। টানা কুড়ি বছর ওরা যুদ্ধ করেছিল। যার তার সঙ্গে নয়, খোদ আমেরিকার সঙ্গে। ওরা বীরের জাত, ভয় পেতে শেখেনি। এবারেও ভয় পায়নি!
ধন্যবাদ - ডঃ অশোক কুমার ঘোষ, শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়