খাজুরাহ সুন্দরী
খাজুরাহ সুন্দরী
একটা বিশ্রী অস্বস্তি হচ্ছিল ঘুমের মধ্যেই। ছটফট করতে করতেই ঘুম টা ভেঙে গেল। উঠে বসল প্রবাল । ঘড়িতে তখন পৌনে তিনটে। মাঝরাত পেরিয়ে ভোরের দিকে এগোচ্ছে সময়। বেডসাইড টেবিল থেকে জলের গ্লাস টা তুলে নিয়ে চুমুক দিল প্রবাল , তখনই কানে এল শব্দটা। নুপুরের রিনঝিন শব্দ। পাশেই শুয়ে রয়েছে প্রবালের স্ত্রী পিয়ালী ।গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । বার কয়েক ঠেলা দিতে সাড়া দিল পিয়ালী, " উঁউ! কি হয়েছে!"
"শুনতে পাচ্ছো? আবার হচ্ছে সেই নুপুরের শব্দ।"
"কিছু শুনছি না। কিছু শোনা যাচ্ছে না প্রবাল। শুয়ে পড় তো তুমি", ঘুম জড়িত স্বরে কথাগুলো বলে পাশ ফিরে শুলো পিয়ালী ।আবার শুয়ে পড়ল প্রবাল। চোখ থেকে ঘুমের রেশ কাটেনি। সহজেই তলিয়ে যেতে লাগল ঘুমের অতলে। কিন্তু ঘুমোনো হলো না। কেউ যেন জোর করে চোখটা খুলতে বাধ্য করল। চাঁদের আলোর মতো মায়াবী স্নিগ্ধ আলোয় ভেসে যাচ্ছে ঘর। পরিস্কার মনে আছে প্রবালের, শুতে আসার আগে আলো নিভিয়ে বিছানায় এসেছিল পিয়ালী ।ঘরে সামান্যতম আলো থাকলেও ঘুম হয় না প্রবালের। পিয়ালী কি পরে কোনোসময়ে উঠে আলোটা জ্বেলেছিল ! কে জানে! নুপুরের শব্দটা যেন আরো বেড়েছে মনে হচ্ছে । যেন ঘরের মধ্যেই কেউ নাচছে। নাঃ। শব্দের উৎসটা খুঁজে পেতেই হবে, ভেবেই খাট থেকে নামতে গেল প্রবাল। পরমূহুর্তেই তীব্র ভয় পেয়ে পাদুটো টেনে নিল খাটের ওপর। একী! টাইলস বসানো দুধসাদা মেঝের ওপর নৃত্যরতা কোনো মেয়ের প্রতিবিম্ব। আপন খেয়ালে নেচে চলেছে মেয়েটা, নৃত্য ছন্দে বেজে উঠছে তার পায়ের নুপুর। ভীষণ ভয় পেয়ে পিয়ালী কে ডাকতে চেষ্টা করল প্রবাল । কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না ওর।
পাশে ডাক্তার ত্রিবেদীকে দেখেই কাল রাতের সব কথা মনে পড়ে গেল প্রবালের । ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল কাল। নার্ভের কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলেন ডাক্তার ত্রিবেদী । কয়েকটা দিন এখন রেস্টে থাকতে হবে। শুয়ে থাকতে থাকতেই আচমকা চোখ পড়ল কাঁচের শোকেসবন্দি সুন্দরীর চোখে। রহস্যময়ী যক্ষিণী মূর্তি। আপন খেয়ালে নৃত্যরতা । ড্রেসিংটেবিলের পাশে একটা কাঠের তেপায়ার ওপর সাজিয়ে রেখেছে পিয়ালী। কাল রাতে শোকেস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল যক্ষিণী, জীবন্ত হয়ে অপরূপ ভঙ্গিতে নেচে উঠেছিল সে । কথাটা মনে পড়তেই আবার কেঁপে উঠল প্রবাল।
খাজুরাহ বেড়াতে গিয়ে একটা আ্যন্টিকের দোকান থেকে কেনা হয়েছিল এই মূর্তি। ১৬/৮ ইঞ্চি একটা কাঁচের বাক্সের মধ্যে বন্দি খাজুরাহ সুন্দরী। এসবে খুব নেশা পিয়ালীর ।অনেক দাম দেখে প্রথমে কিনতে রাজি হয়নি প্রবাল। পিয়ালী তবু জোর করেছিল। মূর্তিটা কেনার সময়ে দোকানদার বলেছিল, "মন্দির গাত্রের অরিজিনাল মূর্তি এটা। যুগলে ছিল , যক্ষিনীর সাথে যক্ষ। যক্ষের মূর্তিটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। কোনোরকমে এই যক্ষিনী কে উদ্ধার করা গেছে।" শুনেই লোকটাকে চেপে ধরেছিল প্রবাল, "এইসব মূর্তি তো মিউজিয়ামে থাকার কথা। আপনার দোকানে এল কি করে" ! আচমকা রেগে গিয়েছিল দোকানদার, "আপনার নেবার ইচ্ছা থাকলে নিন। নাহলে চলে যান। আরও কাস্টমার আসছে আমার "। একজোড়া সাহেব দম্পতি দোকানের কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছিলেন সেইসময়ে। তাঁদেরও নজর ছিল খাজুরাহ সুন্দরীর দিকে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল প্রবালের। বেআইনি হচ্ছে। হোক, তবু আমাদের দেশের প্রাচীন সংস্কৃতি, দেশের বাইরে যেতে দেব না। কঠিন স্বরে বলেছিল , ''মূর্তিটা প্যাক করুন'' । গুনে গুনে দশ হাজার টাকা নিয়ে প্রবালের হাতে মূর্তি টা তুলে দিয়েছিল দোকানদার। চোখে মুখে অসন্তোষ। সাহেব দম্পতির কাছে বেচতে পারলে মূর্তিটার আরও বেশি দাম পাওয়া যেত।
আজ রাতেও নুপুরের আওয়াজে ঘুম টা ভেঙে গেল প্রবালের । সাতদিন ধরে এমনই চলছে। 'আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি! নাকি সত্যিই আমার সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটছে'! মনে মনে ভাবছিল প্রবাল।
খাটের একপ্রান্তে ঘুমিয়ে আছে পিয়ালী। এইমুহূর্তে বড় তেষ্টা পেয়েছে প্রবালের । এঃ। জলটা শেষ হয়ে গেছে। খাট থেকে নামল প্রবাল। খালি হয়ে যাওয়া জলের বোতলটা নিয়ে ঘরের বাইরে এল। এক বোতল জল নিয়ে ঘরে ঢুকতেই চোখ পড়ল মূর্তিটার দিকে। এ কি! কি অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মূর্তি টা । ওর চোখ থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না যে! অদৃশ্য কেউ যেন শোকেসটার দিকে টানছে ওকে । না না, অদৃশ্য নয়। ওই যে খাজুরাহ সুন্দরী টানছে, তার অলৌকিক মায়ার টানে। কি সাংঘাতিক সেই টান! 'কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে' ! শোনা যায়, খাজুরাহ মন্দিরের কিছু মূর্তি নাকি ভীষণ রহস্যময়। রাতের অন্ধকারে তারা নাকি জীবন্ত হয়ে ওঠে।এ মূর্তিটাও কি তবে সেরকমই! আর কিছু ভাবতে পারছে না প্রবাল । 'পিয়ালী! পিয়ালী ওঠো ।আটকাও আমাকে' । চিৎকার করতে চেষ্টা করে প্রবাল। গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না ওর । সহসা নিজেকে একটা সীমিত পরিসরের মধ্যে দেখতে পায় প্রবাল, খাজুরাহ সুন্দরীর খুব কাছে। দুই হাত দিয়ে ওর গলা বেষ্টন করে রেখেছে সে। রহস্যের হাসি তার মুখমন্ডলে। শ্বাস নিতে বড় কষ্ট। ছোট্ট জায়গাটা থেকে চেষ্টা করেও বেরোতে পারে না প্রবাল ।
কি একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল পিয়ালীর। প্রবাল যেন কোথায় চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে বারবার ডাকছে পিয়ালী কে। সাড়া দিচ্ছে না পিয়ালী।
তাড়াতাড়ি উঠে বসল পিয়ালী।ভোর হয়ে গেছে। সাড়ে পাঁচটা বাজে। প্রবাল বিছানায় নেই। তার মানে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে । রোজই এসময়ে হাঁটতে বেরোয় প্রবাল । বিছানা তুলে ঘরের বাইরে এল পিয়ালী। এখন অনেক কাজ ওর।
হাতের কাজ সেরে সাড়ে সাতটা নাগাদ এককাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসল পিয়ালী। প্রবাল এখনও আসেনি। নটা বেজে যেতে চিন্তায় পড়ল পিয়ালী। এমন তো করেনা ও! এদিকে ফোনটাও তো বাড়িতে ই পড়ে। কাজের মাসি আরতিদিকে একবার সামনের পার্কটায় দেখে আসতে বলল পিয়ালী। নাঃ। নেই।
বেলা দুটো বেজে গেল। পাত্তা নেই প্রবালের। আত্মীয়,স্বজন, প্রতিবেশীরা খোঁজ খবর করছে। কোথায় গেল ছেলেটা! সন্ধ্যা নাগাদ প্রবালের বন্ধুর সাথে স্থানীয় থানায় এল পিয়ালী মিসিং ডায়েরি করতে। আরতিদি আজ পিয়ালী র সাথেই রয়েছে। এ অবস্থায় মেয়েটাকে একলা ফেলে যেতে চায়নি মানুষ টা।
আজ সারাটা দিন কিছু মুখে তোলেনি পিয়ালী। রাত এগারোটা নাগাদ জোর করে কিছু খাইয়ে পিয়ালীকে শোবার ঘরে নিয়ে এল আরতি। আজ সারাটাদিন এই ঘরটায় আর পা রাখেনি পিয়ালী। ওকে খাটে শুইয়ে নিজে মেঝের ওপর বিছানা করে শুয়ে পড়ল আরতি ।
রাত তিনটে নাগাদ অদ্ভুত এক অস্বস্তি বোধ হওয়ায় ঘুমটা ভেঙে গেল আরতির। ঝুম ঝুম শব্দ ভেসে আসে কোথা থেকে! কেউ নুপুর পরে নাচছে! ওমা! ঘরে আলো জ্বলছে। যেন পূর্ণ চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে ঘর। "এত আলোয় ঘুম হয় নাকি! ও বৌদিমণি, তুমি কি আলোটা জ্বেলে দিলে?" পরক্ষণেই পিয়ালীর দিকে নজর পড়ে আরতির। ঘুম ভেঙে বিছানার ওপর উঠে বসেছে পিয়ালী । "কি দেখছো অমন করে"?
"ওইদিকে দ্যাখো আরতিদি, ড্রেসিংটেবিলের পাশে", আঙুল দিয়ে দিক নির্দেশ করে পিয়ালী। পিয়ালীর আঙুল নির্দেশিত স্থানে চোখ পড়তে বাকরুদ্ধ আরতি। একী! এ কী দেখতে পাচ্ছে! ওই কাঁচের বাক্সের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে আলোর ছটা। সেই আলোয় ভেসে যাচ্ছে ঘর। আর বাক্সের মধ্যে নাচের নেশায় মাতাল হয়ে উঠেছে যক্ষিণী। কিন্তু যক্ষিণী যে একলা ছিল। তাহলে তার দোসর এল কোথা থেকে!
ফিসফিস করে বলে উঠল পিয়ালী, "প্রবাল! দেখতে পাচ্ছো আরতিদি! ওই যে প্রবাল!"
বাকরুদ্ধ আরতি। শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত নামছে নিচের দিকে। যক্ষিণীর পাশে সত্যিই একফুট উচ্চতা বিশিষ্ট প্রবাল । দুই অসমবয়সী নারীর মুক দৃষ্টির সামনে প্রবালের বক্ষলগ্না হয়ে নেচে চলেছে যক্ষিণী। সহসা পিয়ালীর গলা চিরে বেরিয়ে এল আর্তনাদ, না. আ. আ.! সঙ্গে সঙ্গেই ওর হাতের এক ধাক্কায় ছিটকে পড়ল কাঁচের শোকেস। নিভে গেল আলো। নিরন্ধ্র অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নির্বাক দুই নারী। হঠাৎ কেমন একটা গোঙানির শব্দ। ছুটে গিয়ে আলো জ্বালল আরতি। "একী! দাদাবাবু! ঘরের মেঝেতে চারিদিকে ভাঙা কাঁচ ছড়িয়ে পড়েছে। তারই মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে প্রবাল।
আকাশে আলো ফুটছে একটু একটু করে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল প্রবাল। পিয়ালী ওর মাথার কাছে বসে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আরতির নজর পড়ল যক্ষিণীর দিকে। মাটিতে পড়ে রয়েছে কেমন অসহায় ভঙ্গিতে। পরপর দুবার, প্রিয় হারানোর বেদনায় বিদীর্ণ হয়ে গেছে ওর বুক।

