খাদ্য -খাদক -আত্মীকতা
খাদ্য -খাদক -আত্মীকতা
আমার বড় বৌদি সুরাসিকা এবং সুপাচিকা। রস গুণ পিতৃদত্ত ,বৌদির বাবা প্রসিদ্ধ লেখক ,হাসির ফোয়ারা আর শ্লোকের ঝর্ণা তাঁর ছিল স্বভাবজ। রন্ধন কুশলতা বৌদির অর্জিত গুণ। আমি তার অতি প্রিয়। হস্টেল থেকে বাড়ীতে আসার আকর্ষণ বেড়ে যেতো বৌদির হাতের মোচা ঘন্টর গন্ধে। সেই বৌদি আমার ওপর রেগে বললো ,' ঠাকুরপো ,বলতে পারো তোমার কোন খাবারটা অপছন্দ ?'
রাগের দোষ বৌদিকে দেওয়া যায় না। ঘটনাটা খুবই সাধারণ। বৌদি যত্ন করে রান্না করেছে বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ। আমি খাচ্ছি আর আমার যা অভ্যেস তাই বলেছি ',ফার্স্ট ক্লাস। ' একটু বাদে বৌদি বসলো খেতে ,বেগুন-ইলিশ মুখে দিয়েই থু থু করে চিৎকার।
দুবার নুন আমিও যে বুঝিনি তা নয়। কিনতু ছোটবেলার habit ,মায়ের কাছে পাওয়া ,খাবার লক্ষী ,কখনো খারাপ বলতে নেই। আমার জননী একটু অত্যাচারী স্বভাবের ছিল; আমার বৌয়ের শাশুড়ি হবার সব গুণ উঁকি দিতো। মায়ের কড়া আদেশ ,কোনো খাবার ফেলা চলবেনা ,শুধু খেতে যতটুকু মুখ খুলতে হয় ততটুকু খুলবে ,কথা বলতে হবে না খেতে খেতে। ভদ্রমহিলাকে দোষ দেওয়া অবিচার হবে। ছ ছেলে ,তিন গরু,এক টিয়া ,বারো হাঁস ,দু ডজন মুরগি ,চার খারগোশ ,এক কর্তা ,তার ওপর আত্মীয় বন্ধু -সব মিলে মোটামুটি ভালোই সংখ্যা ; ঘুঁটে কয়লার উনুন জ্বালানো থেকে শুরু ,স্বামীকে খাইয়ে শেষ -সব একহাতে। সেই জন্যে control parameter বানাতেই হয়েছে।
যাই হোক ,বৌদির তিরস্কারে মনের জানলা খুলে গেল ,গভীর আত্মসমীক্ষায় বসলাম। আমি একজন খাদক ; খাদ্যকে আমি কি ভাবে দেখি ? আমার চোখে খাদ্য তিন শ্রেণীতে বিভক্ত : কম ভালো ,ভালো এবং বেশী ভালো ;গীতাতেও এইরকম লিখেছে : তম ,রজ এবং সত্ত্ব। কাউকে ছোট করেনি কাউকে পরিত্যাগ করেনি। আমিও কোনো খাবারকে ছোট করিনি ,পরিত্যাগ করিনি।
আমার সর্বখাদ্যে সমভাব আমার শক্তির আধার ,কেউ মানেনা আমার কথা। কিনতু আমার স্থির বিশ্বাস এক দিন আসবেই যেদিন আমাকে মরণোত্তর খাদ্যশ্রী দেয়া হবে
যেদিন মাছটা পড়বে না গো আমার পাতে
&nb
sp; তখন তুমি বুঝবে ঠ্যালা হাতে নাতে।
খাবার গুলোয় করছো যত অবহেলা
ভুগবে তুমি ডায়াবেটিস পেটের জ্বালা।
যাকগে ভবিষ্যতের কথা ,তাকাই চলো অতীতে। এই তো বছর দশেক আগের কথা। একটা আদিবাসী গ্রাম ,আমরা কজন গ্রাম হিতৈষী গেছি ওষুধ দিতে। গ্রামের মানুষ ছাড়লো না। রাত কাটালাম সেখানেই। সে কি আপ্পায়ন ;মুরগী কাটা হলো চোখের সামনে ,fresh chicken ; রান্নাঘরে ঢিবরির আলোতে বৌমা রেড়ির তেলে চাটুতে ভাজল এক এক করে ,সঙ্গে মোটা চালের ভাত ,নুন -কাঁচা লঙ্কা -পেঁয়াজ। গৃহ কর্তা পরিবেশন করলেন অপিপেটিসের ,শুদ্ধ হাঁড়িয়া। আমার বন্ধুরা বিনীত ভাবে হাতের জেলা পায়ে ফেললো আর ডিনারটাও খেতে পারলো না। আর আমি ? প্রথম গেলাসটাতে একটু অসুবিধে ,দ্বিতীয়ে আরাম,তৃতীয়ে পরমানন্দ। ডিনার তো নয় -পঁচিশ তারা হোটেলে খাচ্ছি।
আশি বছর পেড়িয়ে গেলো ,আমি এখনও খাচ্ছি ,খেয়ে তৃপি পাচ্ছি। এখনও সুগার ,ডায়বেটিস মুক্ত ;প্রেসার ঠিক আছে। ভাবলাম আমার সুখাদ্যময় জীবনের সূত্রটা মানব কল্যাণে লিপিব্দ্ধি করে যাই ,তাই এ রচনা।
খাদকগণ ,ভুলিওনা যে তোমার এবং তোমার খাবারের অন্তরালে অনেক মমতা ,স্নেহ ,ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। চোখটাকে বন্ধ করে দেখোনা সেই ভালোবাসার ধূপের গন্ধ পাও কি না। খাবারটাকে সেই অজানা সুরভীতে মেখে দেখতো এবার খাবারটা কেমন ? জিভ আর মন মিলেই তো মানুষের মতো খাওয়া তাই না ?